অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা পর্ব -০৮

গল্প: #অপ্রত্যাশিত_ভালোবাসা
লেখক: #কাব্য মেহেরাব

পর্ব: ০৮

চার পাঁচ মিনিট এভাবে আঘাত করার পর তিনি শান্ত হলেন। যখন দেখলেন আমি আর চিৎকার করছি না। গর্ভ অবস্থায় কোন নারী এভাবে আঘাত সহ্য করতে পারে না।প্রবীশ বাবু বেলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ মুছে নিলেন।

সামনের টেবিলের উপর পানি জগ সহ গ্লাস ফ্লোরে পড়ে ভেঙে গেছে। একটু পানি খেয়ে গলা ভিজাতে চান হয়তো তিনি। রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে পড়ল। নিচে এসে ডাইনিং এর সামনে পানির জগ দেখলো। কিন্তু তাতে পানির বিন্দু ফোটাও অবশিষ্ট নেই। রেগে গিয়ে ডাক দিল

প্রবীশ:রামু জেঠু…..? রামু জেঠু……?(জোরে চিল্লিয়ে)

বয়স্ক লোক (রামু জেঠু):…….( আস্তে আস্তে তিনি চোখ মুছতে মুছতে ডাইনিং এর সামনে এসে দাঁড়ালেন।)

প্রবীশ: জল কোথায়? রামু জেঠু….?(ধমক দিয়ে)

রামু জেঠু: আমি এখনই এনে দিচ্ছি..(এত রাগ দেখে তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন).

বলেই তিনি জল আনতে কিচিনে গেছেন। জগ ভরে পানি এনে প্রবীশ বাবুর সামনে দিলেন। প্রবীশ বাবুর হাতের দিকে তাকাতেই তিনি থমকে গেলেন। হাত কেটে রক্ত চুয়ে চুয়ে পরছে।

রামু জেঠু: বাবা সাহেব…? আপনার হাতে কি হয়েছে…? আপনি কি আবার….

প্রবীশ: হ্যাঁ আমি আবার ভাঙচুর করেছি….. শেষ করে দিবো আমি মেঘাকে… মেরে ফেলবো ওকে আমি….

রামু জেঠু: পাগল হয়েছেন আপনি….? কাকে মারার কথা বলছেন….

প্রবীশ: কাকে বুঝতে পারছ না।…..? ঐ মেঘা কে…(জোরে চিল্লিয়ে)

রামু জেঠু: কিন্তু বৌরানী তো…… আপনি কি মামনি কে……

প্রবীশ: হ্যাঁ…..হ্যাঁ হ্যাঁ

রামু জেঠু:বাবা সাহেব…?উনি মেঘা বৌরানী নন…..

প্রবীশ: কিন্তু ওও ওতো মেঘা..

রামু জেঠু: ভুল করছেন আপনি… একজনের সাজা অন্যজনকে দিয়ে আপনি বড় ভুল করছেন..

প্রবীশ: সব মেয়েরা এক ।আমি ঘেন্না করি এইসব মেয়েদের।

বাবা সাহেবের হাতে রক্ত দেখে, বুঝতে পারে কোনো অঘটন ঘটিয়েছে। আমার সাথে কি করেছে না করেছে ভেবে রামু জেঠু ওখানের সময় ব্যয় না করে দ্রুত উপরে চলে আসলেন।

প্রবীশ বাবু র রুমে এসে দেখলেন, আমি রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছি। পাশেই তার মাজার বেল্ট। বুঝতে বাকি থাকে না,প্রবীশ বাবু আমার সাথে কি করেছেন।তৎক্ষণাৎ তিনি অমিত বাবু কে ফোন করেন।

কিছু সময়ের ব্যবধানে অমিতা বাবু ও হাজির হয় প্রবীশ বাবুর রুমে। তিনি এসে আমার এই অবস্থা দেখে রেগে যান। ডক্টর কে ফোন দেন। ডক্টর এসে আমাকে মেডিসিন দেন। কিছু কিছু জায়গায় ব্যান্ডেজ টেপ করে দেন। মলম দিতে বলে ক্ষতস্থানে।প্রেগনেন্সিতে এইভাবে শারীরিক অত্যাচার এর ফলে দুর্বল হয়ে যায় আমি। পালস খুব স্লো চলছিল তাই স্যালাইন ও দিতে হয় আমার শরীরে।

প্রবীশ বাবু তার নিজস্ব রুমে বসে ড্রিঙ্ক করছেন। অমিত বাবু ডক্টর কে বিদায় দিয়ে প্রবীশ বাবুর রুমে র সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় নক করলে, ভিতর থেকে আওয়াজ আসে….

প্রবীশ:” come “(বলে আসতে বলেন তাকে প্রবীশ বাবু।)

ভিতরে যেয়ে অমিত বাবু দেখেন প্রবীশ বাবু বসে বসে ড্রিঙ্ক করছেন। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে তাকে বললেন।

অমিত: এমনটা কেন করলেন আপনি……?

প্রবীশ বাবু গ্লাসের ড্রিঙ্ক ঢালছে আর গিলছে। অমিত বাবুর করা প্রশ্নে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

অমিত: আপনার রাগটা মেঘার ওপর! কিন্তু এই মেঘা সেই মেঘা নয়। এটা কেন ভুলে যাচ্ছেন আপনি…?

প্রবীশ: ঘেন্না করি আমি মেয়েদের…. সবাই ধোকাবাজ এক এক টা কাল নাগিনী….

অমিত: তাহলে মেয়েটাকে কেন এখানে এনে এইভাবে টর্চার করছেন……..?

প্রবীশ বাবু ড্রিংস এর বোতল টা ছুড়ে মারল অমিত বাবুর পায়ের কাছে। অমিত আচমকাই পিছিয়ে যায় এক পা।প্রবীশ বাবু উঠে এসে অমিতবাবুর কলার চেপে ধরে বললেন

প্রবীশ: আমার কাছে কৈফত চাওয়ার তুমি কে…?

অমিত: দীর্ঘ আট বছর আপনার সাথে রয়েছি আমি, আপনার কষ্টটা আমি বুঝি। নিজের চোখে দেখেছি। তাই বলে আপনি ভুল করলে সেটা বলা আমার কর্তব্য বলে আমি মনে করি। আপনি ভুল করছেন রাগের বশে…….

প্রবীশ: চলে যাও তুমি আমার সামনে থেকে…..

অমিত: একটা গর্ভবতী মেয়ের ওপর এত অত্যাচার করবেন না ভগবান সহ্য করবে না…

প্রবীশ: I say get out…….!

আমিত বাবু তার রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অমিত বাবু যেতেই প্রবীশ বাবু একটা বোতলের মুখ খুলে তাতে নিজের ঠোট দিয়ে ড্রিংস করতে থাকে।

কেটে গেল দুই দিন। প্রবীশ বাবু এই দুইদিন আমার সামনে আসেনি। রামু চাচা আমার সম্পূর্ণ খেয়াল রেখেছেন এই দুদিন। অমিত বাবু এসে আমাকে দেখে যান দিনে দুইবার। এই দুইদিন আমি রুম থেকে বাহিরে বের হয়নি। আমার খাবার উপরে পাঠিয়ে দেয় রামু চাচা।

চোখ বন্ধ করে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছি আমি। এখানে আসার পর থেকেই, কাব্যকে আগের থেকে আরো অনেক বেশি মিস করছি। নিজের ভাই ভাবির কথা খুব মনে পড়ছে। কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছে নিজের মায়ের পেটের ভাই। নিজের স্বার্থে ভাবির অভিনয় কে প্রশ্রয় দিয়ে অবিশ্বাস করেছে আমাকে। আর ভাবছি…..

পাষাণ পৃথিবীর পাষাণ মানুষ ,
স্বার্থের বিনিময়ে সবাই বেহুশ,
দূরে গেলে অভিমান, কাছে এলে অভিনয়,
মানুষ যে নিষ্টুর এটাই তার পরিচয়।।

হঠাৎ দরজা খুলে প্রবীশ বাবু হাতে একটা ট্রে তে করে কিছু একটা আনলো। পাশের টেবিলে ট্রে টা রেখে দিল। তারপর আমার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল….

প্রবীশ: এখন শরীর কেমন লাগছে…..(মাথা নিচু করে, নিজের হাঁটুর দিকে তাকিয়ে )

মেঘা: (এইভাবে পশুর মতন মেরে এখন জানতে এসেছে কেমন আছে আমার শরীর! এরা সবাইকি অভিনেত্রী? সহ্য হলো না আমি কেমন আছি সেটা ওনার জানতে চাওয়া। তাই বললাম) অভিনয় টা খুব ভালোই করতে পারেন……

প্রবীশ:(ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালো) কি বলতে চাচ্ছ তুমি ডালিয়া…..?

মেঘা: মেঘা! আমি মেঘা, ডালিয়া নই…..

প্রবীশ:(মেঘা নামটা শুনে মাথায় রক্ত ওঠে গেছে। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করল। তারপর বলল ) গরম গরম কফি এনেছি খেয়ে নাও ।

মেঘা: গরম কফি না এনে এতে বিষ মিশিয়ে আনুন আমি হাসিমুখে তা পান করব।

প্রবীশ নিজের জন্য বুলেট টি আর মেঘার জন্য কফি এনে ছিল। দেখতে এসেছিল মেঘা এখন কেমন আছে। দুইদিন মেঘার সামনে আসেনি। একটু খারাপ লাগছিলো নিজের। সেজন্যই এসেছিল মেঘার খবর নিতে। কিন্তু মেঘা তাকে আবার রাগাতে চাই। এইজন্যই মেয়ে মানুষকে একদম সহ্য করতে পারে না প্রবীশ বাবু। এক লাইন বললে এরা 10 লাইন বুঝে নেই।

প্রবীশের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার দিকে তাকাতেই আমি মুখটা ঝাঁমটি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকালাম। ব্যাস এই ইগনোর করাটা তার সহ্য হলো না।

আমার মুখটা তার হাত দিয়ে এমন ভাবে ঠেসে ধরলো ,যে আমার ঠোট টা আপনা আপনি খুলে গেল। পুরা এক মগ বুলেট টি আমাকে ঢকঢক করে খাইয়ে দিল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।

আমার গলা বুক জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। বুলেট টি খাওয়ার অভ্যেস আমার কোনদিনও ছিল না। বরাবরই ঝাল যুক্ত খাবার আমি এড়িয়ে চলি। নাক মুখ ঠোঁটে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গরম ভাপে চোখ যেন কোঠা থেকে বেরিয়ে আসছে।

আমি চিৎকার করে বারবার পানি চাচ্ছি। কিন্তু এই নির্দয় লোকটা আমার চিৎকার উপভোগ করছে। যেন তিনি এটাই চেয়েছিলেন।হাতিয়ে পাশের টেবিল থেকে পানি ঢেলে খেতে গেলে তিনি পানি গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দেন।

মেঘা: কি করলেন আপনি এটা…? আমার গলা বুক জ্বলে যাচ্ছে।। আমি সহ্য করতে পারছিনা। (গলা ধরে চিৎকার করে বলছি)

প্রবীশ: বিষ খেতে চেয়েছিলে না, আমার হাতে! সামান্য বুলেট টি সহ্য করতে পারছো না?

মেঘা: প্লিজ এমন করবেন না আমার সাথে! আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি বলুন…? আমার সাথে তো আমার সন্তান আছে।আপনি আমার সাথে ওই নিষ্পাপ বাচ্চাকে কেন এমন শাস্তি দিচ্ছেন…..?( প্রবীশ বাবুর পায়ের কাছে বসে হাত ধরে অনুরোধ করছি)

প্রবীশ:(হাত দিয়ে আমার মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে দাড় করালেন,আর বললেন) কষ্ট হচ্ছে…? নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করো তোমরা মেয়েরা…? নিজের গর্ভে একটু একটু করে বড় হওয়া সন্তানকে এক নিমিষেই হত্যা করতে পারো তোমরা। তোমাদের তো কোন মায়া থাকার কথা না.. ।সেদিনও আমি আমার সন্তানকে বাচাঁনোর জন্য মেঘার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিলাম । কিন্তু মেঘা আমার সন্তানকে এবরশন করিয়েয় নিল। বাচ্চা টাকে মেরে ফেলে ও শান্তি হয়নি মেঘার। এবরশন করা বাচ্চাটির কয়েক টুকরো করা দেহ টা আমাকে গিফট করেছিল। সেদিনই তোদের উপর থেকে আমার সহানুভূতি সব উঠে গেছে। আমি ঘৃণা করি মেয়েদের ….

মেঘা: কি বলছেন আপনি এসব….? আমি আর এবরশন……

প্রবীশ: চুপ !একদম চুপ! একটাও কথা না। মুখে মুখে তর্ক আমি একদমই মেনে নিব না।

কথাটা বলেই আমাকে ধাক্কা মেরে বেডের উপর ফেলে দিল। চলে গেল ঘর থেকে। আমি পিছন থেকে বারবার ডেকেই যাচ্ছি…

মেঘা: শুনুন আমার কথা… প্লিজ একটা বার শুনুন…..

প্রবীশ বাবু দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিল। আমি দরজার সামনে বসে পরেছি।ওনি যে বলল, মেঘা উনার বাচ্চাকে অ্যাবরশন করিয়েছে। কিন্তু আমি তো ওনাকে কোনদিন চিনিই না। এবরশন কোথা থেকে এলো। উনি কি আমার কথা বলছেন? নাকি উনার জীবনে কোন মেঘা ছিল ,তার কথা বলছেন…?

কিন্তু এই সবকিছু সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? উনি আমাকে কেন কষ্ট দিতে চান? সবকিছুই আমাকে জানতে হবে। কিন্তু কিভাবে জানবো আমি….?. হ্যাঁ অমিত বাবু? হ্যাঁ উনিই এই বিষয় আমাকে বলতে পারবেন। এই সব কিছুর সাথে আমার সম্পর্কটা কোথায় আর কি চান উনি। সব জানতে হবে আমাকে।

দুপুরে রামু চাচা এসেছিলেন খাবার নিয়ে। আমি তখনো দরজার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছি। কাব্যকে ভীষণ মিস করছি। আমার জীবনটা এমন না হলেও পারতো। কি হতো সেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা না করলে। আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হতো। ফুটফুটে একটা বাচ্চা হত। সূখে থাকতাম আমরা তিনজন। আজ এই দিনটা দেখতে হতো না।

অনেকদিন হলো আল্লাহর নিকট ইবাদত করা হয়নি। দুই হাত তুলে ফরিয়াদ করতে ইচ্ছে করছে আজ। এখনো গোসল করেনি আমি। রামু চাচা খাবার দিয়ে যায়। আর বললেন,

রামু চাচা: মামনি খাবারটা খেয়ে নাও। ওষুধ খেতে হবে তোমার।

মেঘা:রামু চাচা….? আমাকে একটা জায়নামাজ ম্যানেজ করে দিতে পারবে???

রামু চাচা: জায়নামাজ…?

মেঘা: হুম…!সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করা আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের প্রয়োজন। অনেকদিন হয় তার ইবাদত করা হয়নি। আমার চাওয়া-পাওয়ার এখন তো শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে সীমাবদ্ধ। কারোর কাছে কিছু চাইতে তো পারব না। দুই হাত তুলে আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চাইতে মন চাচ্ছে। দেবে আমায় একটা জায়নামাজ ম্যানেজ করে?

রামু চাচা: আমি জায়নামাজ ম্যানেজ করে দিব ,কিন্তু তুমি নামাজ পড়বে কোথায়? আর একটা অমুসলীম বাড়িতে তুমি কি নামাজ পড়তে পারবে? তোমাদের ধর্মে কি এটা মেনে নিবে?

#চলবে ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here