অপ্রিয় তুমি পর্ব -০১

[১]

‘অনাকাঙ্ক্ষিত তুফানের মতো আমার জীবনে প্রবেশ করে আমাকে অন্তঃসত্ত্বা বানিয়ে ছেড়ে চলে না গেলেই গেলেই কি হতো না মিস্টার ইফাজ মাহবুব? আমার জীবনটাকে নরক না বানালে কি খুব ক্ষতি হতো আপনার? কত মানুষের কত প্রশ্নেরই তো উত্তর দেন আপনি। আমি আমার এই প্রশ্নের উত্তর চাই আপনার থেকে। আশা করি আজ বঞ্চিত হতে হবে না আমায়।’

এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পরে গেল ইফাজ। এতো এতো মানুষের সামনে যে অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল সেখানে মুনতাশার উপস্থিতি সে একদমই আশা করেনি। মুনতাশা ইসলাম আজ তার ইন্টারভিউ নিবে এই সম্পর্কে সে জানতো। কিন্তু এই মুনতাশা যে তার অতীতের পিচ্চি মেঘ তা সম্পর্কে সে অবগত ছিল না। শুরুতেই মুনতাশাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে পড়ে সে। আর এখন এক অসহ্যকর পরিস্থিতি! জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উত্তরের আশায় যেন সকলে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে। ইতিমধ্যে এটা আজকের ব্রেকিং নিউজ হিসেবে যাওয়ার জন্যেও অনুমোদিত হয়েছে। ইফাজ কোনো উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতিতে যেন নেই। অপরদিকে ম্যানেজার মুনতাশার আচরণে হতবাক। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ভীতি। ইফাজ মাহবুব খুবই ক্ষমতাধর একজন ব্যাক্তি। আল্লাহ না করুক, তার চ্যানেল যদি আজ মুনতাশার এহেন আচরণে বন্ধ হয়ে যায়?

‘কি হলো মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন কেন? হাজার হাজার মানুষ প্রশ্নের উত্তরের আশায় আপনার দিকে চেয়ে আছে সেটা দেখতে পারছেন? কি হলো এইযে এই মাথা নিচু করে ফেলছেন কেন আমায়? উত্তর দিন বলছি।’ কিছুটা চেঁচিয়েই বলল মুনতাশা।

‘দুঃখিত,’ শব্দটি উচ্চারণ করে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে ইফাজ। আশেপাশে থেকে সাংবাদিক ঘিরে ফেলে তাকে। ইফাজের সহযোগীরা কোনো ঝামেলায় পড়ার পূর্বেই ইফাজকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সেখানে থেকে। স্টেজ থেকে এখনো ইফাজের হেনস্তা হওয়ার দৃশ্যটি প্রাণভরে দেখছে মুনতাশা। তৃপ্তির হাসি লেগে রয়েছে তার ওষ্ঠাধরে। আজ মুনতাশা তার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ করতে পেরেছে যেন।

যেখানে মুনতাশা দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে নিজের জয়কে উদযাপন করছে ঠিক তার বিপরীত পাশ থেকে অপর একজন দাঁড়িয়ে নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে মুনতাশার খুশির। তবে এক আশংকায় কাজ করছে তার মনে। যদি মুনতাশাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়? মুনতাশার আবার সেসব দিকে খেয়াল নেই। কিছু সময় পর মুনতাশার মনে পড়ে সাদের কথা। যে আজ নিজের শো কে মুনতাশাকে হোস্ট করতে দিয়েছিল শুধু মুনতাশার প্রতিশোধ পূর্ণ করতে। একমাত্র সাদই মুনতাশার সকল কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত থাকে এবং তাকে নিজের সবকিছু দিয়ে সাহায্য করে। সাদকে খুজে না পেলেও বসের দেখা পেতে তার দেরি হলো না। বর্তমানে মুনতাশার বস তার বরাবর দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতে রয়েছে একটা বাঁশ কাগজের তৈরিকৃত খাম। সে মুনতাশার হাতে খামটি দিয়ে বলল,
‘ধন্যবাদ আমাদের সাথে এতোদিন থাকার জন্যে। আজকের আপনি যে ঘটনা ঘটিয়েছেন তারপরে আমাদের চ্যানেলের কমিউনিটির আর আপনাকে প্রয়োজন নেই মিস মুনতাশা ইসলাম।’

মুনতাশা বুঝতে পারলো খামের ভিতরে কি রয়েছে।এমন একটা কিছু ঘটতে পারে তা সে আন্তাজ করতে পেরেছিল। প্রশস্ত এক হাসি টেনে সে খামটি নিয়ে বসকে জানালো,
‘ধন্যবাদ আমার সাথে সবার এতোদিন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার জন্যে। এতোদিন আমার পাশে থাকার জন্যে।’

নিঃশব্দে প্রস্থান করল মুনতাশা সেখান থেকে। তবে নয়নজোড় তখনও সাদকে খুজে যাচ্ছে। অন্তত সাদকে তার বলে যাওয়া হলো না যে সে আর চাকরিটা করতে পারবে না।

মায়ের জন্যে খাবার পরিবেশন করছে সাদ। অসুস্থ মায়ের খেয়াল রাখার জন্যে কেউ নাই। কাজ থেকে ফিরে মায়ের খেয়াল রাখতে হয় তাকে। সাদ যেন এক অলরাউন্ডার। পরিস্থিতি তার অলরাউন্ডার হওয়ার পিছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। দরিদ্র, এতিম এক সন্তানের অসুস্থ মাকে নিয়ে জীবনে রুখে দাঁড়ানোর গল্পটি বেশ লোমহর্ষক। সাদের জীবনের অতীতের পাতাগুলো দেখলে অন্ধকার কিছু পাতা নজড়ে পড়বে। কষ্ট, নিন্দুকদের আলোচনা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে সে৷ পিছন থেকে তা জন্যে দোয়া করে গিয়েছেন তার রুগন মা। সাদ একাই প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে নিজে বড় হয়নি, অন্যকেও বড় হতে সাহায্য করেছে। এমনকি এখনো করে যাচ্ছে। মুনতাশার সফলতার পিছনে বিশেষ ভূমিকা সাদের। সদা সর্বদা পাশে থেকে সাহায্য করেছে সে তাকে।

‘বাবারে আজ মুনতাশা আসল না?’ কাপা কাপা কন্ঠে সাদকে প্রশ্ন করলেন সাদের মা হাফসা বেগম। সাদ তখন তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, ‘মুনতাশা ব্যস্ত আম্মু।’

‘ওহ তাই বল, ব্যস্ত দেখেই মনে হয় আজ আমার খবর নেয়নি।’

‘হুম হয়তো তাই।’

মাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল সাদ৷ এক কাপ কফি বানিয়ে বসে পড়ল তার রুমের বারান্দায় থাকা ইজি চেয়ারে। মোবাইলে থাকা প্যাটার্ন লকটি খুলে মিউজিক প্লেয়ারে ঢুকে ছেড়ে দিল পছন্দসই এক গান। গান শুনতে শুনতে রাতে কফি খাওয়াটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে ল্যাপটপ সাথে করে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তব আজ তার মন টানছে না কোনো কাজে। মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় খুব প্রিয় মানুষটার মাঝে। স্নিগ্ধ স্পর্শে চারপাশ মুখরিত করে তোলার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু সেই প্রিয় মানুষ কবে বুঝবে যে সে কারো অনেক বেশি প্রিয়?

‘যদি পথ হারিয়ে যায়, স্মরণ করো আমায়,
আমায় পাবে পাশে
যদি ভয় হয়, চোখ বন্ধ করে নিও,
আমায় দেখতে পাবে
ভয় নেই তোমার, আমার হৃদমাঝারে
শুধু তুমিই থাকবে।’

ডায়েরীর মধ্যে লিপিবদ্ধ হলো আরও এক কবিতা। তবে এ কি শুধুই কবিতা নাকি কারো জ্বলন্ত হৃদয়ের কথা? জানা নেই। সাদের ডায়েরী এভাবেই অনেক কবিতা নিজের মধ্যে ধারণ করে তার হৃদয়ের অনূভুতিসমূহের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। প্রেমবিরহে যখন পাখি একলা গান গায়, সাদ তখন পাখির দুঃখের সাক্ষী হয়। তবে সেও জানেনা তার দুঃখ কারো দৃষ্টির মধ্যে পড়ছে। আজ যেন একটু বেশিই খারাপ লাগছে তার। মুনতাশার কথার মাধ্যমে তার চোখে ইফাজের প্রতি ক্রোধ আর ঘৃণাই দেখতে পারতো সাদ। তাহলে কেন আজ ইফাজকে দেখার পর মুনতাশার চোখে ছিল নোনাজল। কেন সেই জল দূর থেকেই সাদকে ইশারা দিয়ে দেখাচ্ছিল, ভালো করে দেখ আজও হৃদয় গহীনে জমে রয়েছে ভালোবাসা। শত ক্রোধ থাকার পরেও মিলিয়ে যেতে পারেনি সে। অন্তরের কোনো এক অংশে আজও প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে ভালোবাসার মানুষকে মন ভরে দেখতে পাওয়ার আনন্দ। তাও সে ভালোবাসার মানুষকে দেখেই, যার জন্যে সে হৃদয় দগ্ধ হয়েছিল। সাদের চোখ এড়ায়নি এসব কিছুই। ডায়েরীটি টেবিলে রেখে দিয়ে ফোনটা পুনরায় হাতে নিল। এখনো ভেসে আসছে,
আজও ভাবি
কেন বেদনার মতো
হৃদয়ে আঁকি
নীল প্রজাপতি শত…

গানটা বন্ধ করে দিল সাদ। মনে পড়ছে মুনতাশার কথা। না মুনতাশার তো কোনো খবর নেওয়া হয়নি। সে ঠিকমতো বাসায় পৌছিয়েছে কিনা এখনো জানা হয়নি সাদের। হুট করেই এরকম কেয়ারলেসের মতো একটা কাজ করল সে কিভাবে? নিজেকেই ধিক্কার জানাচ্ছে সাদ। ঝটপট কল দিল সে মুনতাশাকে। কিন্তু মুনতাশার বিপরীতে একজন মহিলার অবাধ্য কন্ঠে ধ্বনিত হলো, আপনি যে নাম্বারে কল দিয়েছেন তা এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার ট্রাই করুন। ধন্যবাদ।
থামলো না সাদ, কল দিতে থাকলো মুনতাশাকে। কিন্তু মুনতাশাকে পাওয়া গেল না। বারবার সেই অপ্রত্যাশিত অবাধ্য কথাগুলোই শোনা গেল।

একেরপর এক কল এসেই চলেছে ইফাজের ফোনে। সে আজ খুবই বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এই হয়তো কোনো বন্ধুর কল, অথবা কোনো সংবাদ মাধ্যমের। অবশ্য তারাই বা ছাড়বে কেন? এক ভালো সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। বিস্তারিত জানার অদম্য ইচ্ছা তাদের। ফোন বেজেই চলছে কিন্তু ইফাজ তা রিসিভ করছে না। ইতিমধ্যে একটু আগের ঘটনা সকল টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে স্থান পেয়েছে। আগামীকাল সকালের খবরের কাগজের তাজা খবর হিসেবেও হয়তো কাল পাওয়া যাবে তাকে। হট নিউজ যে এটা। ইফাজ আর চায় না সে নিউজে এটাও উল্লেখ থাকুক যে স্বনামধন্য ইফাজ মাহবুব উক্ত ঘটনার পর সবকিছু এড়াতে নিজের ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। ইফাজ এড়িয়ে যাওয়া পছন্দ করে না, সকল বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করাই তার ধর্ম। খুব জলদি এই সমস্যাও সমাধান করে ফেলবে সে। শুধু প্রয়োজন কিছু সময়ের। তার খোঁজ চাই, তার মেঘের খোঁজ চাই।

একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে ইফাজম অশান্ত মনের শান্তনা চায় সে। পাগলামীর একটা সীমা থাকা উচিত, এতোই যেহেতু মেঘের জবাবদিহি চাই তাহলে সেটা একান্তে কেন প্রশ্ন করল না? কেন মিডিয়ার সামনে তার সম্মান নিয়ে খেলল? প্রশ্নের জবাব তাকে দিতেই হবে। কালই সে তার মেঘের ব্যাপারে খোঁজ করবে। সকল বিপত্তি পার করে আবারও নিজের মাঝে আগলে রাখবে তার মেঘকে। আগের বারের মতো ভুল করা যাবে না, ইফাজ আগলে রাখবে তার মেঘ মুনতাশাকে।

#চলবে

#অপ্রিয়_তুমি
#সূচনা_পর্ব
#Eshika_Khanom

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here