অপ্রিয় তুমি পর্ব -০২

#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব_০২
#Eshika_Khanom

[২]

হুট করে যেন কেউ বন্দী করে দিল জানালার পর্দা দুইটিকে। স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে সূর্যের কিরণ চোখে এসে লাগছে। অতিশয় বিরক্ত হচ্ছে মুনতাশা। পাশ ফিরে মুখে একটা বালিশ গুজে ঘুমে মগ্ন থাকার চেষ্টা করল। তবে তা আর হতে দিল না তিয়াশা। মুনতাশাকে ঝাকিয়ে বলল,
‘কটা বাজে তোর কি কোনো হুশ আছে? আমি নাস্তা তৈরি করে রেখেছি। রেডি হয়ে অফিসে যা জলদি। আমাকে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।’

ঘুম ঘুম কন্ঠে মুনতাশা বলল, ‘যাবো না তো।’

তিয়াশা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’

‘এমনি।’

অস্থির হয়ে উঠলো তিয়াশা। হুট করেই বিছানায় মুনতাশার পাশে বসে কপালে গলায় হাত ছুইয়ে প্রশ্ন করল,
‘জ্বর ও তো আসেনি। তাহলে কি অন্য কোনো ভাবে শরীর খারাপ লাগে নাকি?’

মুনতাশা উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল,
‘আরেহ না। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’

হতবিহ্বল তিয়াশা প্রশ্ন করল, ‘কি?’

‘কাল নিউজ দেখিস নাই নাকি?’

‘কোনটা?’ প্রশ্ন করেই তিয়াশা আবার বলল,
‘ওহ ইফাজ মাহবুব? কাল বেশ অপমান হয়েছে। ভালো হয়েছে। এসব মানুষের এমনভাবেই সবার সামনে শাস্তি দেওয়া উচিত। ভালো মানুষির মুখোশটা এভাবেই ছিড়ে ফেলা উচিত তার। তাহলে তোর তো খুশির দিন, চাকরিটা ছাড়লি কেন?’

‘কারণ তাদের কমিউনিটির আর আমায় প্রয়োজন নাই। আরে বুঝিস না, এতো বড় মাপের মানুষ তাদের চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিল। আর সে এভাবে অপমান হয়েছে তাও আমার কার্যকলাপে, তাদের ক্ষতি হয়ে যাবে তো। তাই আমাকে ছুটি দিয়ে দিল।’

‘নিজের বুঝ পাগলেও বুঝে, শুধু মনে হয় তুইই বুঝিস না।’

মুনতাশা উত্তরে বলল, ‘হয়তো।’

‘এখন কি করবি?’

‘ফ্রেশ হবো, নাস্তা করব, তারপর চাকরির খোঁজে বেরোবো। পেট তো চালাতেই হয় তাইনা?’

‘কিসের চাকরি নিবি?’

‘দেখি, কোনো স্কুল কলেজের টিচার হওয়ার যোগ্যতা আছে কি না আমার। কোয়ালিফিকেশন তো ভালোই আমার, তাইনা?’

‘হুম আচ্ছা দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম। নাস্তা করে নিস, আল্লাহ হাফিজ।’

‘সাবধানে যাবি আর সাবধানে আসবি। ফি আমানিল্লাহ, আল্লাহ হাফিজ।’

তিয়াশা চলে যাওয়ার পর মুনতাশা উঠে বিছানা গুছিয়ে নিল। ফোনটি অনেক সময় ধরে পাচ্ছে না মুনতাশা। মুনতাশার অনেক খোঁজাখোঁজির পর মনে পড়ে সে বোধহয় কাল ব্যাগ থেকে ফোনই বের করেনি। দ্রুতপদে ব্যাগের কাছে গিয়ে সেখানে থেকে ফোনটা বের করে নিল। তখন মুনতাশা দেখতে পায় তার ফোনটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতিশয় বিরক্ত হয়ে ফোন চার্জে দিয়ে অন করল। তৎক্ষনাৎ অবাক হয়ে গেল মুনতাশা। দেখতে পায়, সাদ ৩২ টি মেসেজ দিয়ে রেখেছে তাকে। মেসেজগুলো পড়ে বুঝতে পারলো বেচারা কাল অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছে মুনতাশার জন্যে। মুচকি হাসে মুনতাশা। সাদের তার প্রতি কেয়ারিং এর বিষয়টি বেশ উপভোগ করে সে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খাটলো তার। লেখনীর মধ্যে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে সাদের মেসেজের রিপ্লাই দিল,
‘এই আপনি কে? কত বড় সাহস আমার হবু স্ত্রীকে আপনি মেসেজ দিচ্ছেন তাও এতো রাতে? বেচারীকে ঘুমোতে দিবেন না নাকি? এমনিতেও গতকাল অনেক ঝামেলা পোহিয়েছে আমার বউটা। ভাগ্যিস কাল ওর ফোনটা বাসায় যাওয়ার আগে আমার এখানেই ফেলে রেখে গিয়েছিল। নাহলে আপনার কৃতকর্মে ও আরও বেশি বিরক্ত হতো।’

মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে পুনরায় হাসলো মুনতাশা।এবার শুধু সাদের রিপ্লাই পাওয়ার অপেক্ষা। মুনতাশা মনে মনে ভাবলো, ইসস মেসেজটা সাদ যখন পড়বে তখন তার মুখের অবস্থাটা কেমন হবে? কেমন অভিব্যক্তি থাকবে তার? হায়! যদি দেখতে পারতাম। এভাবে আজব আজব চিন্তা ভাবনা মাথায় এনে পরবর্তীতে নিজের কাজে মনোযোগ দিল মুনতাশা।

মোটেও কাজে মন বসছে না সাদের। একেতো আর হয়তো কোনো সময় কাজের ফাঁকে আড়ালে আবডালে তার প্রিয়তমার মায়াবী মুখখানা দেখতে পারবে না সে। আবার মুনতাশার কোনো খবরও নেই সাদের কাছে। অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। সাদ তার প্যান্টের পকেট থেকে স্মার্টফোনটি বের করে চেক করল মুনতাশা কোনো উত্তর দিয়েছে নাকি তার মেসেজের। মুনতাশার আইডি থেকে মেসেজ এসেছে দেখে অতি উৎফুল্ল হয়ে পড়ল সে। এক হাতে থাকা কলমটি ডেস্কে রেখে মেসেজটি ওপেন করল। তবে মেসেজটা দেখে মুখে তার আধার ঘনিয়ে এলো। মুনতাশার হবু বর? মানে সে কারো বাগদত্তা!নাহ এটা কিভাবে হয়। মুনতাশা তো তাকে এসব ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। সাদের মনে যে মুনতাশাকে পাওয়ার আশার প্রদীপ জ্বলেছিল তা কি অচিরেই নিভে গেল? নাহ ভাবতে পারছে না সে আর। কল দিলো মুনতাশাকে, কিন্তু রিসিভ হলো না। মেসেজের রিপ্লাইয়ে বারবার মুনতাশার খোঁজ করল, কোনো উত্তর আসলো না। হতাশ হয়ে পড়ল সাদ। এক সহকর্মীকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। গন্তব্য মুনতাশার বাসা। আজ মুনতাশার থেকেই সকল প্রশ্নের উত্তর নিবে সে। প্রচণ্ড অস্থির লাগছে, আর নিজেকে সে পোড়াতে পারবে না। আজ উত্তর চাই, কেন মুনতাশা এভাবে তাকে কষ্ট দিয়ে চলছে? কেন সে তার ভালোবাসা বুঝতে পারছে না? আজ প্রকাশ করবে নিজের মনের কথাগুলো। এরপর যা হওয়ার হয়ে যাবে।

‘বাবা তুমি আমায় ডেকেছিলে?’ প্রশ্ন করল ইফাজ।
জনাব ইমতিয়াজ মাহবুব তার ছেলে ইফাজকে ইশারায় তার পাশে বসতে বললেন। ইফাজও তার বাবার কথামত কাজ করল। ইমতিয়াজ মাহবুব প্রশ্ন করলেন,
‘মুনতাশা এতোদিন কোথায় ছিল? কাল মুনতাশার সাথে কথা হয়েছে আমার জানাস নি কেন? আর মুনতাশা এসব কি আজেবাজে কথা মিডিয়ায় প্রচার করালো ইফাজ?’

‘বাবা…’

ইমতিয়াজ মাহবুব গর্জে উঠলেন। ইফাজকে থামিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
‘কি বলেছে এসব মুনতাশা? তুই কি করেছিস ওর সাথে? আমার মুনতাশা কখনোই মিথ্যা বলবে না আমি জানি। বল তুই কেন ও এসব কাল বলল?’

‘বাবা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না ও এটা কেন করল।’

‘তুই আগে থেকে মুনতাশার খোঁজ পেয়েছিলি তাইনা? শুধু গোপন করে রেখিছিলি?’

‘না বাবা আমি জানতাম না মেঘ এর খোঁজ খবর। কাল জানতাম মুনতাশা নামে একটা মেয়ে আমার ইন্টারভিউ নিবে। তবে ওই যে আমাদের মেঘ সে সম্পর্কে আমার জানা ছিল না বাবা।’

‘আচ্ছা আমি বিশ্বাস করলাম। তবে সকল সত্য আমি মুনতাশার মুখ থেকে শুনব। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমার মুনতাশাকে খুঁজে বের করবি।’

‘জ্বি বাবা,’ নিচু স্বরে উত্তর দিয়ে সেখানে থেকে উঠে পড়ল ইফাজ। পকেট থেকে ফোন বের করে একজনকে কল দিয়ে বলল,
‘এখনো খুজে পাওনি কেন ওকে? টাকা দিয়ে কেন রাখি তোমাদের? একটা মানুষকে এই যুগে খুঁজে বের করতে এতো সময় লাগে নাকি? জলদি মুনতাশাকে খুঁজে বের কর। ‘

নিজের এক লোককে ধমকিয়ে ফোনটা বিছানায় ছুড়লো ইফাজ। কিছুই ভালো লাগছে না তার। এতোদিন তার মেঘবিহীন জীবন পার হলেও গতকাল মেঘকে দেখার পর থেকে মেঘবিহীন প্রতি মূহুর্ত অসহনীয়। মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে জীবনে, আর তাকে ইফাজ নিজে কষ্ট দিয়েই কষ্ট পেয়েছে।

কিছুটা ভয় ও কিছুটা বিরক্তির সংমিশ্রণ এক অনূভুতি কাজ করছে সাদের মনের মধ্যে। আজ জবাব চাই তার মুনতাশার প্রতি কাজের। কেন সে এতো অবুঝ? কেন বুঝতে পারেনা সে সাদকে? মুনতাশার ফ্ল্যাটের মেইন গেটের বিপরীতে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। হাতে রয়েছে একগুচ্ছ গোলাপ। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল বাজালো সাদ। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরই দরজা খুলে গেলো। মুনতাশা দরজা খোলার পর সাদকে দেখে এমনভাবে চমকালো যেন সে ভূত দেখতে পেয়েছে। সাদের চোখ তখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে মুনতাশাকে দেখে। মুনতাশা এক মেকি জাসি দিয়ে সাদকে ঘরের ভিতরে বসালো। সাদ অতি সাবধানের সাথে গোলাপ মুনতাশার থেকে আড়াল করে ভিতরে প্রবেশ করল। মুনতাশা সাদকে প্রশ্ন করল,
‘কি খাবে? চা নাকি কফি?’

গাম্ভীর্য বজায় রেখে সাদ পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘তুমি কার বাগদত্তা মুনতাশা? আমায় জানাওনি কেন?’

মুনতাশা মনে মনে বলল, ‘এই খেয়েছে। একটু মজাই নাহয় করলাম, বাসায় এসে পড়লে। আর বদলাবে না তুমি সাদ। অনেক চিন্তায় আছ মনে হয়? আচ্ছা আর চিন্তায় রাখব না তোমায়। বলেই দেই সব।’ অতঃপর মুনতাশা সোজা উত্তর দিল,
‘আমি ঐটা মজা করেছি। খবরটা শুনে তুমি কেমন করবে তা দেখতে চেয়েছিলাম।’

তেঁতে উঠলো সাদ। বসা থেকে উঠে মুনতাশার দুই কাঁধ চেপে ধরে প্রশ্ন করল,
‘সবসময় আমার অনুভূতি নিয়ে মজা তাইনা? গতকাল রাত থেকে তোমার ফোন বন্ধ। আবার মজা? আমাকে কি পেয়েছ তুমি?’

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো মুনতাশা। চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। মুনতাশা মাথা নিচু করে বলল,
‘সরি সাদ।’

মুনতাশার চোখের জল সাদের নজর বন্দী হলো। ইতিমধ্যে মুনতাশার মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মায়া ভরা সেই মুখ। খোদা তায়ালা সকল স্নিগ্ধতা সেই মুখেই যেন দিয়ে দিয়েছে। ঘোরে পড়ে গেল সাদ। নিজের মুখটা মুনতাশার মুখের আরও কাছে আনলো। ঘোরলাগা কন্ঠে বলল,
‘ভালোবাসি মুনতাশা।’

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here