অপ্রিয় তুমি পর্ব -০৩ (সমাপ্ত)

#অপ্রিয়_তুমি
#অন্তিম_পর্ব
#Eshika_Khanom

মুনতাশার চোখের জল সাদের নজর বন্দী হলো। ইতিমধ্যে মুনতাশার মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মায়া ভরা সেই মুখ। খোদা তায়ালা সকল স্নিগ্ধতা সেই মুখেই যেন দিয়ে দিয়েছে। ঘোরে পড়ে গেল সাদ। নিজের মুখটা মুনতাশার মুখের আরও কাছে আনলো। ঘোরলাগা কন্ঠে বলল,
‘ভালোবাসি মুনতাশা।’

অবাক হলো মুনতাশা। এতোদিন সাদের মুখে এই শব্দটুকু শোনার প্রতীক্ষায় ছিল সে। আজ যেন সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। মাথা তটজলদি উঁচু করে সাদের দিকে তাকালো। সাদের চোখে দেখতে পেল উত্তর পাবার অপেক্ষা। স্থির নয়নে এখনো সে মুনতাশার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুনতাশা উত্তর দিল না। জড়িয়ে ধরল সাদকে। সাদ যেন নিজের মনের গহীনে থাকা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। সন্তোপর্ণে মুনতাশাকে নিজের বুকে আগলে নিল। ঠিক সেই মুহূর্তে মুনতাশার বাড়িতে উপস্থিত হলো ইফাজ। চুলগুলোর মাঝে নেই কোনো শৃঙ্খলতা। দেখতে পেল মুনতাশা কাউকে জরিয়ে ধরে রয়েছে। অবাক হয়ে পারল না। অস্ফুট স্বরে ডাক দিল,
‘মুনতাশা! ‘

সাদ এবং মুনতাশা তাকালো ইফাজের দিকে। মুনতাশার অন্তর কেঁপে উঠলো। সাদ ইফাজকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি এখানে?’

ইফাজ দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আগে বলুন মুনতাশার বাড়িতে এভাবে আপনি কি করছেন?’

ইফাজের অভিব্যক্তি দেখে মুনতাশা প্রচণ্ড রেগে গেলো। কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,
‘আর যাই করতে এসেছে, আপনার মতো আমার ক্ষতি করে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা নেই তার।’

ইফাজ বলল, ‘তোমায় ভালোবাসি মুনতাশা।’

‘ভালোবাসি? অর্থ জানেন এই শব্দের? ভালোবাসি বলেই তো আমায় অন্ত্বসত্তা করে দিয়ে আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তাইনা? একবারও কি আমার খোঁজ করেছিলেন আপনি?’

‘তোমায় ছেড়ে যেতে চাইনি আমি মেঘ।’

সাদ এবার এগিয়ে বলল, ‘ছেড়ে যেতে চাননি তবে গিয়েছিলেন কেন?’

মাথা নিচু করে ফেলল ইফাজ। কোন মুখে উত্তর দিবে সে মুনতাশাকে? সে যে অন্য এক মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল সেটা কিভাবে বলবে?’ পারবেনা সে। মুনতাশা বলল,
‘জানি তো আপনার বলার কোনো মুখ নেই। ভালোভাবে বলছি চলে যান এখানে থেকে।’

‘মেঘ….’

ইফাজকে থামিয়ে মুনতাশা বলল, ‘কোনো কথা শুনতে চাই না আপনার।’

‘বাবা দেখতে চেয়েছে তোমায়।’

‘খালুকে বলবেন মুনতাশাকে যখন চরিত্রের অপবাদ দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে সেদিনই সে মরে গিয়েছে।’

‘এভাবে বলো না মেঘ।’
কাঁদছে ইফাজ, তবুও একটুও মায়া লাগছে না মুনতাশার ইফাজের প্রতি। মুনতাশা বলল,
‘সাদ আর তিয়াশা আমায় সেদিন নতুন জীবন দিয়েছে। সেই রাত ওরা যদি না থাকতো তাহলে রাস্তার হিংস্র জানোয়ারেরা আমায় ছিড়ে খেতো। আর আপনার মেঘ নই আমি ইফাজ, আমি হলাম সাদের মুনতাশা।’

নিজেকে ধাতস্থ করল ইফাজ। সাদ এগিয়ে এসে বলল,
‘আপনি এখন চলে যেতে পারেন।’

ইফাজ হাত দিয়ে সাদকে বাধা দিয়ে মুনতাশাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা চলে যাচ্ছি, আগে বলো আমার সন্তান কোথায়?’

‘আপনার বাবা যেদিন আমায় দুশ্চরিত্রা বলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, মনে করে তার ছেলে আমার জন্যে নষ্ট হয়ে যাবে সেদিনই তার ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গিয়ে আমার সন্তান মারা যায়। মিসক্যারেজ হয় আমার।’
কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মুনতাশা। সাদ ইফাজকে ধরে বলে, ‘দয়া করে এবার আপনি যান এখানে থেকে।’

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ইফাজ সেখানে থেকে প্রস্থান করে। সাদ মুনতাশাকে স্বান্তনা দিতে থাকে।

‘কি বলল আমার মুনতাশা?’ ইফাজকে প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ মাহবুব। ইফাজ বলল,
‘আমার এক ভুলে মেঘ অনেক কষ্ট পেয়েছে। তাছাড়া তোমার জন্যে আমার সন্তান মারা গিয়েছে। কিভাবে আসবে মেঘ? ও আসবে না।’

‘তুই ফিরিয়ে আনবি না ওকে?’

ইফাজ হতাশ গলায় বলল, ‘নাহ। ও সাদকে ভালোবাসে। আমার বেইমানীর ফলে অন্তত এক ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে ও। যে ওকে সযত্নে নিঃসার্থে আগলে রাখবে।’

বাবার কোনো উত্তরের আশাও করেনি ইফাজ। সোজা ছাদে চলে যায়। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগলো। ইচ্ছে করছে তার সিগারেটের ধোয়ার সাথে মিলিয়ে যাতে। গন্তব্যহীন অনুভব করছে ইফাজ নিজেকে। একটা ভুল ওর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। ইফাজের কাছে অর্থ আছে, কিন্তু সুখ নেই। ভালোবাসা নেই। সম্মান আছে, কিন্তু সেই সম্মানের প্রাপ্তি তার কাছে অর্থবহ মনে হয় না। একসময় তার পিচ্চি মেঘের প্রিয় মানুষ হিসেবে ছিল, নিজের এক ভুলের কারণে তার অপ্রিয় রয়ে গেল। জীবনকে বিষের সাথে তুলনা করতে পারবে ইফাজ। যে জীবনে ভালোবাসা নেই, শুধু রয়েছে ব্যস্ততা তা নিতান্তই অসুখের। তবুও এই ব্যস্ততার চাদরেই নিজেকে আড়াল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইফাজ। আর কখনো খোঁজ করবে না সে তার মেঘের, কারণ সে জানে মেঘ ভালো আছে। তার অপ্রিয় মানুষটা তার জীবনে নেই তাই সে খুব বেশি ভালো আছে।

[৩]

পার্কে শিশুদের সাথে খেলা করছে মুনতাশা। সাথে রয়েছে সাদ, তিয়াশা এবং গুটিকয়েক বন্ধু। জমিয়ে খেলা আড্ডার মাধ্যমে নিজের ছুটির দিন কাটালো মুনতাশা। মাঝরাতে সাদের কল আসলো মুনতাশার ফোনে। মুনতাশার চোখে ঘুম তখন ভর দিতে যাচ্ছিল আর কি। তবে সেটাও হলো না। রিসিভ করার পরপর সাদ প্রশ্ন করল,
‘ঘুমিয়েছ?’

‘হুম ঘুমিয়েছি। ঘুমালে কি আর কল রিসিভ করতে পারতাম?’

‘তা হয়তো ঠিক। তা আজকের দিনটা কেমন কাটলো?’

‘বেশ ভালো।’

‘আমায় কেমন দেখাচ্ছিল?’

‘উমম.. সুন্দর।’

‘কি করছ?’

‘কথা বলছি।’

‘কার সাথে?’

‘সদ্য পাবনা হতে পলায়িত পাগলেত সাথে।’

‘এই আমি পাগল?’ (রেগে)

‘স্বীকার করলেন।’

‘তোমাকে আমি…’

‘কি করবেন হ্যাঁ কি করবেন?’

‘ঐটা তোমায় সামনে পেয়ে নেই তারপর বলব।’

‘হুহ।’

‘ঝগড়া না করে ঘুমাও।’

‘ওকে আল্লাহ হাফিজ।’

‘আল্লাহ হাফিজ।’

এখনো হাসছে মুনতাশা। রোজই এভাবে তারা ঝগড়া করে। পরে সাদ না পেরে বলে, ‘ঝগড়া না করে ঘুমাও।’ এভাবেই তাদের রাতের কথা শেষ হয়। আরেকটু সেটল হতে পারলেই সাদ আপন করে নিবে তাকে। মুনতাশা পুনরায় বিশ্বাস করা শিখেছে। মানুষকে পুনরায় প্রিয় করতে শিখেছে। ভালোবাসতে শিখেছে নতুন করে। তবুও কি প্রথম ভালোবাসা ভোলা যায়? আজও ভুলতে পারেনি ইফাজকে, ইফাজের ভালোবাসাকে। ভুলতে পারেনি ইফাজের বেইমানীকে। তবুও মাফ করে দিয়েছে প্রথম ভালোবাসাকে। হঠাৎ কি মনে করে আজ অনেকদিন পর নিজের ডায়েরীটা খুললো। এই ডায়েরীতে সুখের দুঃখের অনেক স্মৃতি লিপিবদ্ধ। আজ কেন যেন ইচ্ছে হলে নিজের জীবনে থাকা মানুষের নামগুলো লিখতে। তারপির এদের তার জীবনে স্থানটা লিখতে। একে একে সকলের নাম লিপিবদ্ধ হলো। মৃত মা বাবা থেকে শুরু করে সকল বন্ধুবান্ধব। ব্যক্ত করল সকলের ভূমিকা। ইফাজও স্থান পেল সেই তালিকায়। মনে পড়ল পুরোনো কিছু স্মৃতি। আগে মেঘ মেঘ বলে সারাদিন খেলতো। শৈশব কতোই না সুন্দর ছিল। সাথে এখন বর্তমানও সুন্দর। আসলে সুখ দুঃখ মানুষের জীবনে পালাক্রমে আসে। একটু দুঃখের প্রবেশেই নিজের চিরসুখ হিসেবে সাদকে খুঁজে পেয়েছে মুনতাশা। সাদের নামের পাশে তার ভূমিকা হিসেবে দিল ভালোবাসা। রয়ে গেল আর একজন ব্যাক্তি, ইফাজ। মৃদু হাসলো মুনতাশা। ইফাজের নামের পাশে একটি হাইফেন বসিয়ে লিখে ফেলল নিজের জীবনে ইফাজের চরিত্র, ‘অপ্রিয় তুমি।’

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here