সিক্ত প্রেমানুভূতি পর্ব -০১

‘এই মামার বয়সী লোক আমায় বিয়ের জন্যে এখন আংটি পড়াবে বাবা? নিজের ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে এই ৫০ বছরের বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছ তুমি?’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে আয়াত তার বাবাকে প্রশ্ন করল। কন্যা ভারগ্রস্ত পিতা সালাউদ্দিন ইসলাম মেয়ের করা এই প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হলেন । শুধু একা সে নন, স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ইফতেখার উদ্দিন যার সাথে সালাউদ্দিন ইসলাম তার মেয়ে আয়াতের বিয়ে ঠিক করেছেন সে চরম অপমানিত বোধ করলেন। তিনি বললেন,
‘তোমার মেয়ে যে এমনভাবে আমায় অপমান করবে তা তো জানা ছিল না সালাউদ্দিন।’

মাথা নিচু করে ফেললেন আয়াতের বাবা কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। পরবর্তীতে আয়াতের দিকে এগিয়ে এসে আয়াতের হাত ধরে ইফতেখার উদ্দিনকে বললেন,
‘আপনি আংটি পড়ান। আমার মেয়ে তো ছোট অবুঝ বুঝলেন না। আসলে মেয়েটাকে জানায়নি তো প্রথমে তাই একটু রেগে আছে। আয়াতকে দয়া করে মাফ করে দিন। আপনি ওকে আংটি পড়ান। এনগেজমেন্ট সম্পন্ন করুন।’

ঝাঁকি দিয়ে উঠলো আয়াত। বাবার থেকে হাত ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো,
‘তুমি কি এই বুড়ো লোকের সাথে আমায় সত্যিই বিয়ে দিবে বাবা? আজ এই লোকের সাথে আমার এনগেজমেন্ট? কত টাকা দিয়ে তোমায় কিনেছে এরা বলো তো এবার?’

আয়াত কথাগুলো বলা শেষ করলেই তার গালে এক চড় মারে তার বাবা। মাথা নিচু করে নেয় সে। ফুপিয়ে কান্না করে উঠে। তবুও নিজের তেজ বজায় রেখে বলে,
‘তুমি উনার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছ? সেই আয়োজনেই আজ আমার এনগেজমেন্ট। এনগেজমেন্ট মাই ফুট, আমি এই এনগেজমেন্ট কিছুতেই হতে দিব না।’

ইফতেখার উদ্দিনের বৃদ্ধ বাবা বললেন,
‘বাবা সালাউদ্দিন এই তামাশা দেখার জন্যে তো এখানে আমরা আসিনি। এসেছিলাম এনগেজমেন্ট সম্পন্ন করার জন্যে। এখন তুমি কি বলো এনগেজমেন্ট কি আদও হবে?’

ইফতেখার তার বাবাকে থামিয়ে বললেন,
‘এখন সালাউদ্দিন চাইলেও এই বেয়াদব মেয়েকে আমি বিয়ে করব না। সালাউদ্দিন তুমি এই ডিলের আশা ছেড়ে দাও। তোমার সাথে আমার রাজনৈতিক অথবা ব্যবসায়িক কোনো সম্পর্কই আর থাকছে না।’

নিজের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্থান করেন ইফতেখার উদ্দিন। আয়াতের মুখে ফুটে উঠেছে বিজয়ের হাসি। আসন্ন ঝড়ের আশংকা সে করলেও এই মূহুর্তে সে খুবই আনন্দিত। আয়াতের বাবা একবার তার মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ের হাসি দেখে কিছু বলতে চেয়েও যেন বলতে পারলেন না। মেয়ের সাথে আর কোনো কথা না বলেই চলে গেলেন নিজের রুমে। আয়াত এখনো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে উঠতে পারেনি। সে ভেবেছিল এবার তার বাবার লোহার রডের কয়েক ঘা তার পিঠে পড়বেই। কথাটা চিন্তা করেই আরও একবার কেঁপে উঠে আয়াত। পিছনের থেকে আয়াতের মা আয়াতের কাছে এসে কানের সামনে একটা কথাই বাজিয়ে বললেন,
‘তোর বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছে। তুই বিয়েটা করে নিলে আমাদের সকল সমস্যা মিটে যেত। কিন্তু তুই ইফতেখার উদ্দিনকে বিয়ে করতে রাজী হলি না বরং এংগেজমেন্টের দিনই তামাশা বানিয়ে দিলি আমাদের সম্মানকে। কাজটা ঠিক করলি না আয়াত।’

কালবিলম্ব না করে সেখানে থেকে আয়াতের মাও প্রস্থান করলেন। আয়াত তার মায়ের পক্ষ থেকে এই শব্দগুলো আশা করেনি। ঝড়ো হাওয়া বইছে বাহিরে। বৃষ্টির সুবাস আয়াতের নাসিকা দিয়ে প্রবেশ করছে। ভেঙ্গে পড়েছে আয়াত তুফানে ভেঙ্গে যাওয়া গাছের মতো। পরিবারকে পাশা পাওয়া জীবনে বড় একটা অর্জন হয়ে থাকে যা আয়াত পায়নি কখনোই। হয়তো পাবেও না কোনোদিন। ভারী লেহেঙ্গা নিয়েই ছাদে প্রবেশ করল সে। বৃষ্টির কিছু ফোঁটা ছাদকে ছুয়েছে মাত্র। ফরমাল পোশাক পরিহিত এক যুবককে দেখতে পেল আয়াত সেখানে। সে পিছনে মুখ করে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে। খানিক অবাক হয় আয়াত। এই ছেলেটাকে সে চিনে না। হতে পারে ইফতেখার সাহেবের কোন আত্মীয়। তাই ভেবে নিল আয়াত। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে মাত্র। বৃষ্টির ফোঁটা ছাদে উপস্থিত এক যুবক ও এক যুবতীকে ছুয়ে দিয়ে যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছে। বাতাস অন্তরে বইয়ে দিচ্ছে অদ্ভুত কিছু অনূভুতি। লেহেঙ্গা কিছুটা উঁচিয়ে ধরে আয়াত এগিয়ে গেল ছেলেটার কাছে। কপালে লেপ্টে থাকা ভিজে চুল এক আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে নাক টেনে বলল,
‘আপনি কে? আমার বাড়ির ছাদে কি করছেন? জানেন না অনুষ্ঠান শেষ। তামাশা শেষে তো সবাই সবার বাড়িতে চলে গিয়েছে। আপনি একলা কেন রয়ে গিয়েছেন হু? তাও আমার সাজানো ছাদে। বেরিয়ে যান এক্ষুনি এখানে থেকে। আর কোনো নাটক এখানে হবে না, চলে যান।’

বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা কিছুটা চেপে ধরেছে এবার আয়াতকে। সাথে চেপে ধরেছে সামনে থাকা ব্যক্তি। অবাকের চরম সীমানায় পৌছে গিয়েছে আয়াত। সামনে থাকা ব্যাক্তির সাথে পুনরায় দেখা হবে বলে সে একদমই আশা করেনি। তাও আবার সে তার হাত ধরে রেখেছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে আয়াত বলল,
‘আপনি!’

সামনে থাকা ব্যাক্তি বলল, ‘আমায় আশা করোনি তাইনা আয়াত?’

‘আপনি আমার বাড়িতে কীভাবে?’

‘তোমার মনেই তো বিরাট জায়গা জুড়ে বসে আছি আমি। এই বাড়ি আবার কোন ছাই!’

‘মানে?’

‘মানে তুমি ভালোই জানো। একজন ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে তো আর বলে বুঝিয়ে দিতে হয় না যে সে আমায় ভালোবাসে।’

‘আপনি কীভাবে জানলেন?’ চোখযুগল সংকুচিত করে প্রশ্ন করল আয়াত।

সামনে থাকা ব্যাক্তি আয়াতের নরম ঠোঁট দুই আঙ্গুল দিয়ে ছুয়ে দিয়ে বলল,
‘আদ্রাফের কাছে এসব জানা কোনো ব্যাপারই না।’

আদ্রাফের এমন পরশে কেঁপে উঠলো আয়াত। চোখ বন্ধ করে নিল। ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। আয়াতের হৃদয় অদ্ভুতভাবে যেন দোল খেয়ে যাচ্ছে। চাইলেও কেন আর চোখ খুলতে পারছে না সে। নিভু নিভু তাকাতেই সামনের সব ঘোলা হয়ে আসতে লাগলো। শুধু চোখে পড়ল প্রিয় মানুষের মুখের স্নিগ্ধ এক হাসি। তারপর, তারপর আর কিছুই মনে নেই।
.
.
.

‘মামার মুখ এমন শুকনো হয়ে রয়েছে কেন আম্মু?’
আরেকটা চিপসের প্যাকেট খুলে তার মধ্যে থেকে এক পিস মুখে ঢুকিয়ে প্রশ্ন করল আদ্রাফ। রান্নাঘরে টেবিলের উপর বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে একটার পর একটা চিপস পেটে চালান করছে সে। আদ্রাফের মা বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘এমনভাবে প্রশ্ন করছিস যেন কিছুই জানিস না?’

আদ্রাফ প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে টেবিল থেকে নেমে হাতটা ঝেড়ে মায়ের সামনে এসে বলল,
‘ওমন কচি পাত্রী তো আমার জন্যে দেখা উচিত আম্মু। মেয়েটাকে দেখে তো আমিই ক্রাশ খেয়েছি। ভালোই হয়েছে এনগেজমেন্ট টা হয়নি। নাহলে আমার জীবনে নতুন এক গল্প শুরু হতো, ক্রাশ যখন মামী।’

‘কানের নিচে দিব এক থাপ্পড়। একেতো আমার ভাইয়ের মন খারাপ আর তুই ফাজলামি শুরু করছিস?’

আদ্রাফ জিভ কেটে বলল,
‘না আম্মু আমি সিরিয়াস। মেয়েটা কিন্তু সেই।’

আদ্রাফের মা বললেন,
‘মেয়েটা ভালোই ছিল। মেয়েটার আর দোষ কি বল, আজ ওর জায়গায় আমি থাকলেই কি কোনো বয়স্ক লোককে বিয়ে করতে চাইতাম? ভাইয়াও ভুল করেছেন।’

‘এক্সেক্টলি আমিও সেটাই বলছি আম্মু।’

‘থাক আর এটা নিয়ে কথা বলিস না বাসায় কোনো।’

আদ্রাফ মুখের সামনে এক আঙ্গুল দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা বলব না।’

বারান্দার রকিং চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন ইফতেখার উদ্দিন। আসলেই তিনি যা করলেন আদও কি ঠিক করেছেন? বয়স তো বেশ হলোই। এতো ছোট মেয়ের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা উচিত হয়নি তার। নাহ বেশ বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন। মেয়েটার কাছে তার নিজে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সাথে সালাউদ্দিনকেও সাহায্য করবেন বলে চিন্তা করলেন তিনি। লোকটার টাকার বড্ড প্রয়োজন। নাহলে কি এতো সহজে কোনো পিতা তার মেয়েকে এমন বয়স্ক মানুষের সাথে বিয়ে দিতে চায়? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন ইফতেখার উদ্দিন, ‘আচ্ছা তার যদি আয়াতের বয়সী কোনো মেয়ে থাকতো তবে কি সে এমন করতে পারতো?’

খটখট শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে ইফতেখার উদ্দিনের। তাকিয়ে দেখে আদ্রাফ দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। ইফতেখার সাহেব আদ্রাফকে ইশারা করে আসতে বলে তার কাছে। আদ্রাফ হাঁটু মুড়ে তার সামনে এসে বসে। ইফতেখার উদ্দিন প্রশ্ন করেন,
‘কিছু বলবি?’

‘মামা তোমার মন খারাপ তাইনা?’

‘না রে, আমার কেন মন খারাপ থাকবে?’

কি জবাব এর বিপরীতে দেওয়া উচিত সেটা ভেবে পেল না আদ্রাফ। আদ্রাফের মামা ইফতেখার প্রশ্ন করলেন,
‘কোন মাথায় যে কি কাজ করে বসলাম আদ্রাফ? অনেক আফসোস হচ্ছে। ছোট মেয়েটা বেশ কষ্ট পেয়েছে তাইনা?’

‘ওই মেয়েটার কথা বলছ? আয়াত?’

‘হুম।’ পরক্ষণেই ইফতেখার বললেন,
‘ভাবছি কি আদ্রাফ মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসব।’

কিছুটা অবাক হলো আদ্রাফ। তার মামাকে আজ পর্যন্ত কারো কাছে মাথা নিচু করতে দেখেনি সে। আর সে বলছে কিনা আয়াতের কাছে ক্ষমা চাইবে? অবাক হয়েও বেশ খুশি হলো আদ্রাফ। বলল,
‘সত্যিই নাকি?’

‘হুম। কাল তুইও আমার সাথে মেয়েটার বাড়িতে যাবি।’

মনে মনে বেশ আনন্দিত হলো আদ্রাফ। স্বভাব বশত মামার কাছে ডান হাত এগিয়ে দিল হাই ফাইভ করার উদ্দেশ্যে। খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলেন ইফতেখার৷ হাই ফাইভ দিয়ে বললেন,
‘এখনো ছোটই রয়ে গেলি দেখি আদ্রাফ।’

আদ্রাফ উঠে তার মামাকে আলিঙ্গন করে বলল,
‘আমি জানি আমার মামা কখনোই কোনো অন্যায় করবে না। কারো ক্ষতি হতে দিবে না। আয়াতের সাথে তো একদমই না।’
.
.
.
পিটপিট করে চোখ খুললো আয়াত। এখনো যেন কোনো ঘোরের মাঝেই আছে সে। শরীর নাড়াতে পারছে না। চোখ খোলামাত্রই বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করল আয়াত। পাশে মাকে দেখতে পেল। উঠার চেষ্টা করতে চেয়েও পারলো না। আয়াতের মা পাশে থেকে বলল,
‘হয়েছে আর কাজ বাড়াবি না আমার। এমনিতেও তোকে বাড়ির কোথাও খুঁজে না পেয়ে অনেক ভয় পেয়েছিলাম। ভাগ্যিস ছাদের কথা মনে পড়েছিল। তোর বাবাকে পাঠিয়েছিলাম। সে গিয়ে দেখে বৃষ্টির মধ্যে তুই ঐ ভারী লেহেঙ্গা পড়ে লুটিয়ে পড়ে আছিস। পুরো ভিজে গিয়েছিলি। তোর বাবা তোকে উঠিয়ে আনে। আজ তো মরতি!’

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় আয়াত। কিছুটা অভিমান গাঁথা আছে তার মুখমন্ডলে। সাথে এক অজানা প্রশ্নও কাজ করছে। সত্যিই কি ওখানে আদ্রাফ ছিল নাকি সে ছিল আয়াতের কল্পনা?

#চলবে

#সিক্ত_প্রেমানুভূতি
#সূচনা_পর্ব
#Eshika_Khanom

[ভুলত্রুটি মাফ করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের আশা করছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here