সিক্ত প্রেমানুভূতি পর্ব -০২

#সিক্ত_প্রেমানূভুতি
#অন্তিম_পর্ব
#Eshika_Khanom

‘আরে আপনারা? আয়াতের বাবা দেখে যাও ইফতেখার সাহেব এসেছেন।’

আয়াতের মায়ের ডাকে আয়াতের বাবা তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হয়। আহ্লাদে আটখানা আয়াতের বাবা। এক টুকরো আশা যেন খুঁজে পেয়েছেন সে নতুন করে। ইফতেখার সাহেবের হাত ধরে তাকে বসার ঘরে নিয়ে সোফায় বসেন। আপ্যায়নের ত্রুটি নেই। আদ্রাফ বেশ অস্বস্তি অনুভব করছে। আখিযুগল বারবার আয়াতকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কথার মাঝেই আদ্রাফের মামা আদ্রাফকে কানে কানে বলে,
‘আদ্রাফ যাকে খুজছো তার ঠিকানা তো এখন তোমায় বলতে পারছি না তাই বলে বারবার আশেপাশে ঘুরে তাকিয়ো না ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। দেখি আমি সেই মেয়ের ঠিকানা পাকাপাকি তোমার কাছে ট্রান্সফার করতে পারি কি না? প্ল্যান তো সাক্সেসফুল হবে বলে মনে হচ্ছে।’

আয়াতের বাবা পরম ভদ্রতা নিজের কথার মাঝে এনে বললেন,
‘তবে বিয়েটা হচ্ছে তো?’

ইফতেখার উদ্দিন বললেন,
‘ভাই রাগের বশবর্তী হয়ে এক ভুল প্রস্তাব দিয়েছিলাম আপনায়। আপনি তা নিয়ে এখনো বসে আছেন? হ্যাঁ আমি বিয়েটা চাই। তবে আয়াতের সাথে আদ্রাফের। আর চিন্তা নেই, আপনায় আমি পরিপূর্ণ ভাবেই সাহায্য করব।’

চমকে উঠলেন আয়াতের বাবা। দুই কান যেন কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না। ইফতেখার উদ্দিন বললেন,
‘তার আগে আমি আয়াতের কাছে ক্ষমা চাইব। তারপর মেয়েটার কাছে জিজ্ঞেস করব ও আদ্রাফকে বিয়ে করতে রাজী কি না। আয়াত কোথায়?’

আয়াতের মা বললেন,
‘আয়াত তো মনে হয় এখন ছাদে। মেয়েটা জ্বর সেরে এসেছে আবার ছাদেই চলে গিয়েছে।’

ইফতেখার উদ্দিন বললেন, ‘তাকে ডাকা যাবে?’

‘হুম।’

আয়াতের মা আয়াতকে ডেকে নিচে নামিয়ে আনলেন। আয়াত বসার ঘরে ইফতেখার সাহেবকে দেখে যতোটা বিরক্ত হয় তার চেয়ে বেশি অবাক হয় আদ্রাফকে দেখে। এই ছেলেটা কি সত্যি সে সময় ছাদে এসেছিল তার কাছে? তবে ওতো ভাবার সময় নেই। আয়াত বিরক্তি নিয়ে বলতে গেল,
‘আপনি…’

আয়াতের কথার মাঝেই ইফতেখার উদ্দিন বললেন,
‘আগে আমায় বলতে দাও। আমি জানি তোমার আর আমার মধ্যের বিষয়টা অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যিই আমি রাগের বশে ভুলটা করেছি। তবে আয়াত আমি তোমায় এখনও চাই, আমার ভাগ্নের বউ হিসেবে।’

আয়াতের চক্ষু চড়কগাছ। আদ্রাফ মিটিমিটি হাসছে। ইফতেখার উদ্দিন আয়াতকে প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি কি রাজী আছো? এর আগে বলো আমায় মাফ করেছো?’

আয়াতের অনেক বড় স্বপ্ন যেন পূরণের পথে। কিভাবে সে না করতে পারে! যা হচ্ছে তা কি সত্যিই হচ্ছে? এখনও ঘোরের মধ্যে বর্তমান আয়াত। ইফতেখার সাহেবের করা প্রশ্নে শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আদ্রাফ বাদে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘
.
.
.
‘আপনি সত্যিই কাল এসেছিলেন নাকি?’ আদ্রাফকে প্রশ্ন করল আয়াত। আদ্রাফ বিনিময়ে আয়াতের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কেন তোমার কি মনে হচ্ছে?’

‘আমি আসলে বুঝতে পারছিনা।’

‘এসেছিলাম কালকে।’ শান্তস্বরে বলল আদ্রাফ।

‘ওহ আচ্ছা। একমিনিট, হ্যাঁ? আপনি কাল আমার ঠোঁটে? উফফ না।’ নিজের ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে নিল আয়াত।

আদ্রাফ আয়াতের কিছুটা কাছে এসে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘এমন ভাব করছ যেন আমি তোমায় লিপ কিস করেছি।’

আয়াত বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ছি আপনি প্রথম থেকেই অসভ্য।’

আদ্রাফ ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘অসভ্য না হলে কি মামার সাথে প্ল্যান সাজিয়ে তোমার সাথে আমার ব্যাপারটা পাকা করতাম বলো?’

আয়াত বলল, ‘কথায় যুক্তি আছে।’

‘হুম।’

‘আচ্ছা আপনি যে একদম প্রথম দিন সামান্য বাসের টিকিট নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করেছিলেন সেটাও কি আপনার এই জগাখিচুড়ি প্ল্যানের অংশ ছিল?’

‘উম্ম না। এটা তো অটোমেটিক হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই তো তুমি আমার নজরবন্দি হয়ে গিয়েছিলে। আমার প্ল্যান না হলেও এটা আল্লাহ তার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। আল্লাহর বিচার সদা উত্তম বিচার।’

‘সেটা ঠিক।’

আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি আমায় ভালোবাসো আয়াত?’

আয়াত পালটা প্রশ্ন করল, ‘এই প্রশ্ন কেন?’

আদ্রাফ উত্তরে বলল, ‘সেদিন বৃষ্টির সময় যা ঘটেছে তার জন্যে মনে হলো।’

‘আপনি কি আমায় ভালোবাসেন আদ্রাফ?’

‘ইনশাল্লাহ ভালোবাসতাম, ভালোবাসি এবং ভালোবেসে যাব।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না?’

‘কি দিব?’

‘মনে করিয়ে দিতে হবে?’

‘চলার পথে তো এখন থেকে একসাথেই থাকতে হবে, হাঁটতে হবে। মাঝে মাঝে হোঁচট খেয়ে আমি পড়লে আপনিই তো আমায় ধরে উঠাবেন। আপনার বেলায় আমি। তাহলে আমায় মনে পড়ায় গেলে সমস্যা কোথায়?’

‘আমায় ভালোবাসো?’

আয়াত প্রত্যুত্তরে বলল,
‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার কল্পনায় এসেছিলেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম বাস্তব ছিল সেটা। আমার শয়নে স্বপনে আপনার আগমন। চোখ বন্ধ করলে আপনার ছবি ভেসে উঠে। আর এই ক্ষেত্রে আপনার প্রশ্নটা নিছক তুচ্ছ এক প্রশ্ন। ভালোবাসি আপনাকে।’
.
.
.
‘এইতো আজ বাবা আসবে, তারপর যা চাইবে তা বলবা এনে দিবে।’ মেয়ে আয়রাকে বলল আয়াত। ইতিমধ্যে ৬ বছর কেটে গিয়েছে। আদ্রাফ এখন আর্মির ক্যাপ্টেন। পরিবারকে সদা সর্বদা সময় দিতে পারেনা। আজকে আদ্রাফের আসার সময় হয়েছে। কয়েকদিন এর জন্যে ছুটি পেয়েছে আদ্রাফ। তাই তার বাড়িতে আসা হচ্ছে। এই উপলক্ষে আদ্রাফের চার বছরের মেয়ে আয়রার উৎফল্লতা দেখার মতো। অনেকদিন পর আবার বাবাকে দেখা হবে যে। একটা লিস্ট তৈরি করছে আয়রা। বাবার সাথে এই কয়টা দিন কি করবে, কিভাবে কাটাবে তারই লিস্ট। মামা ইফতেখার উদ্দিন আদ্রাফকে রিসিভ করতে গিয়েছে। আয়াত ও তার শাশুড়ী ব্যস্ত রান্নাবান্নায়। পুরো বাড়িতে উৎসবের আমেজ প্রতিবারের মতো। এখানে ওখানে লেগে রয়েছে আয়রার দৌড়াদৌড়ি। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাড়িতে উপস্থিত হলো আদ্রাফ। বাবার কন্ঠ পেয়ে যেন নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না আয়রা। দৌড়ে ক্লান্ত বাবার কোলে উঠে পড়ল সে। পিচ্চি মেয়েটাও আজ অশ্রুসিক্ত। পরিবারের সকল সদস্যের চোখে দেখা যাচ্ছে জল। প্রিয় মানুষটাকে এতোদিন পর দেখার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ যেন এটি। চুমুতে চুমুতে মেয়েকে ভরিয়ে দিচ্ছে আদ্রাফ। আয়রা তখনো তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আয়াতের মন আনচান করছে আদ্রাফকে দেখার জন্যে। কাজের ব্যস্ততায় তা হয়ে উঠছে না। আদ্রাফের মা হাতের কাজটুকু আয়াতকে বুঝিয়ে দিয়ে ছেলের সাথে দেখা করতে চলে গেলেন। মাকে এতোদিন পর দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না আদ্রাফ। জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। মা তার থেকে সকল দোয়া আশীর্বাদ প্রদান করলেন তার ছেলেকে। দোয়া করলেন তার বাবার মতো যাতে সফল আর্মী হতে পারে আদ্রাফ। কথাটুকু শুনে অন্তরআত্না কেঁপে উঠলো আয়াতের। আদ্রাফের বাবা তো শহীদ হয়ে অনেক আগেই চলে গিয়েছেন তাদের ছেড়ে। তার স্বামীর সফলতা যদি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হয় তবে সেই সফলতা চায় না আয়াত। আদ্রাফের নয়নজোড় খুঁজে চলেছে আয়াতকে। তবুও দেখা মিলছে না তার। আয়রা তাকে ধরে নিয়ে চলে গেল নিজেদের রুমে। আদ্রাফের মা রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। আয়াতের হাতের কাজটুকু কেড়ে নিয়ে বললেন,
‘যাও মা আদ্রাফের কি লাগবে দেখ তো। রান্নাঘরে আর তোমার কাজ নেই। নিজের স্বামীকে সামলাও।’

বাধ্য মেয়ের মতো আয়াত চলল নিজের রুমে। বেডরুমের দরজা তখন ভেজানো। আয়াত একবার থেমে অতঃপর আবার দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল। আয়রা এবং আদ্রাফ উভয়েই দরজায় শব্দ শুনে আয়াতের উপস্তিতি টের পেয়ে তার দিকে আয়াতের দিকে তাকালো। আদ্রাফের চোখ যেন জুড়িয়ে গেল, অন্তর এবার শান্ত হলো ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে। আয়াত আয়রাকে বলল,
‘আম্মু এবার যাও তোমার বাবাকে ফ্রেশ হতে দাও। তুমি দাদা ভাইয়ার সাথে খেল।’

আয়রা প্রথমে যেতে না চাইলেও পরবর্তীতে চলে গেল। আয়াত আদ্রাফের জামা কাপড় ঠিক করে দিল গোসলের পরবর্তীতে যাতে এসে পড়তে পারে৷ আয়াতের ব্যস্ত দুই হাত আকঁড়ে নিল নিজের মাঝে আদ্রাফ। দুইজনের মাঝে কোনো কথা নাই, নীরবতায় ভালবাসার বিনিময় হচ্ছে। আয়াত ও আদ্রাফ এর সিক্ত প্রেমানূভুতি যেন এভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে। এবারও তারা হলুদ বসন্তে হারিয়ে যেতে চাই, তবে প্রথমে দুনিয়ার বসন্তে তোমায় এবং পরে আখিরাতের। দুটো জীবনই এক সাথে থেকে উপভোগ করতে চায় এই দুই ভালোবাসার পাখি।

—সমাপ্ত—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here