হঠাৎ এলে তুমি পর্ব -০১

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১
#সুলতানা_পারভীন

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে গেস্টরা চলে যেতেই গট গট করে পা ফেলে রুমের দিকেই পা বাড়ালো প্রজ্ঞা। কাজের লোকেরা কিছু বলতে গিয়েও শেষমেষ ভয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। ওরাও বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে এই মূহুর্তে প্রজ্ঞার রাগটা জ্বালামুখীর রূপ নিয়েছে। ধূসর বাসায় ফিরে সমস্ত ব্যাপারটা কি করে সামলাবে সেটা ভেবেই সবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ওদেরই একজন সাহস করে ধূসরকে কল করেছিল একবার৷ কলটা রিসিভ না হওয়ায় আর কেউ সাহস করে নি আরেকবার কল করার বা প্রজ্ঞাকে এই নিয়ে কিছু বলার। পুরো বাড়িটা কেমন খা খা করছে এই মূহুর্তে। আর পুরো বাড়িটায় কেমন যেন একটা অসহ্য নিস্তব্ধতা খেলা করছে। কোনো শব্দই যেন আজ এই নিরবতা ভাঙতে পারবে না। কেমন একটা গা ছমছম করা গুমোট ভাবে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বাড়িটায়।

ধূসর বাড়ি ফিরে সব কজন কাজের লোক চুপচাপ এদিক ওদিক হতাশ ভঙ্গিতে গালে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে অবাকই হলো। ধূসরকে দেখে বাড়ির মেইড সার্ভেন্ট সবাই তড়িঘড়ি করে ধূসরের কাছেই ছুটে এলো৷ ধূসর একটু বিব্রত হেসে ওদেরকে খাওয়া দাওয়া শুয়ে পড়তে বলে রুমের দিকেই ছুটলো। আজকে যে তার কপালে নির্ঘাত শনি আছে সেটা ধূসর খুব ভালোই টের পাচ্ছে। অন্তত পুরো বাড়ির এতো এতো ডেকোরেশনের পরও এই নিস্তবতা অন্তত সেটাই বলছে। অবশ্য নিজের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানেই মিসিং থাকার পানিশমেন্টটাও যে বড়সড়ই হবে এটা বেশ ভালোই জানে ধূসর। শাস্তিটা কতো বড় হতে পারে সেটার জন্যই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েই রুমে ঢুকলো ধূসর। প্রজ্ঞা রুমে নেই দেখে ধূসর আর দেরি না করে ওয়াশরুমে ঢুকে দুই মিনিটের মধ্যেই চোখেমুখে কোনোমতে একটু পানি ছিটিয়ে নিয়েই টাওয়াল দিয়ে মুখটা মুছে নিলো। তারপর বারান্দার দিকে পা বাড়ালো৷ তার পাগলিটা যে গাল ফুলিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা খুব ভালো করেই জানে ধূসর৷ ধূসর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পিছন থেকে প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরে প্রজ্ঞার কাঁধে চিবুক ঠেকালো। প্রজ্ঞা কিছুটা বিরক্ত হয়ে নিজেকে ধূসরের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। রাগে একটা কথা পর্যন্ত বলছে না মেয়েটা, শুধু ধূসরের শক্ত বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আর প্রজ্ঞার এমন অভিমান ভরা ছটফটানি দেখে ধূসর সব ভুলে হেসে ফেললো।

-প্রজ্ঞা? সরি না? প্লিজ মাফ করে দাও আজকের মতো? আর কখনো হবে না বাবা প্রমিস?

-এতো কষ্ট করে তুমি বাসায় আসতে গেলে কেন? আজকে নাহয় অফিসেই থেকে যেতে—। সেটাই তো ভালো হতো তাই না মিস্টার ধূসর?

-সরি তো বউ? ভিষণ ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল–। সত্যি বিলিভ মি।

-রাত সাড়ে ১০ টার সময়ও তোমার কি এমন ইম্পর্ট্যান্ট কাজ থাকতে পারে হ্যাঁ? তাও আবার আমাদের ফার্স্ট এনিভার্সারির দিনেও—? কাজ শিখাও তুমি আমাকে? নাকি ব্যস্ততার অযুহাত দেখাও?

-সত্যি অনেক জরুরি ছিল কাজটা–।

-সে তো বুঝতেই পারছি। অনুষ্ঠানও শেষ, আর তোমার জরুরি কাজও শেষ।

-এই প্রজ্ঞা? শোনো না?

-কাল সকাল থেকেই তো আবার জরুরি কোনো কাজ থাকবে তোমার৷ তাই না ধূসর? এখন যাও এখান থেকে। ছাড়ো?

-রাগ করে বললে ছাড়বো না তো ম্যাডাম–।

-ধূসর? ছাড়ো বলছি—।

-প্রজ্ঞা? এই বউপাখিটা? সরি তো? এমন করো কেন সবসময় বলো তো? তুমি তো জানো আমি এসব ফর্মালিটি পছন্দ করি না–। আর আমাদের এনিভার্সারি সেলিব্রেট আমরা করবো। বাকিদের কাজ কি আমাদের পারসোনাল স্পেইসে?

-আমি কাউকে আসতে বলি নি ধূসর–। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা এলে তো তাদেরকে আমি ‘সরি আমার স্বামী এসব অনুষ্ঠান পছন্দ করে না’ বলে তাড়িয়ে দিতে পারি না–। আর এমন নয় যে তারা তোমাকে না বলে এসেছে বাড়িতে—। কি ভেবে গেল সবাই বলতে পারো? তোমার আমার রিলেটিভরা?

-প্রজ্ঞা? বাদ দাও না ওদের কথা?

-হ্যাঁ–বাদই দিয়েছি–। ছাড়ো এখন। আর কিচ্ছু বলবো না আমি। পরেরবার থেকে কেউ আমাকে যেন তোমার কথা জিজ্ঞেস না করে সেটাও বলে দিও সবাইকে–।

-আচ্ছা বাবা। বলে দিবো। কেউ কিচ্ছু বলবে না তোমাকে। জিজ্ঞেসও করবে না—।

-তা করতে যাবে কেন? আমি কে?

-আরে! কি মুশকিল! সবই দেখছি তুমি নিজেই বলছ! এটা কিন্তু ঠিক না বুঝসো মেয়ে?

-সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে–। ক্ষমা করুন এবারের মতো? এবার ছাড়ুন? আমি সারাদিন আপনার মতো এতো ইম্পর্ট্যান্ট কাজে ব্যস্ত না থাকলেও কিছু হলেও কাজ করেছি–। টায়ার্ড লাগছে–। ঘুমাবো–।

-আরে? প্রজ্ঞা? শোনো তো?

-কারো নিজের বিবাহ বার্ষিকীর কথা মনে না থাকতে শুনেছি সারাজীবন। কিন্তু ইচ্ছে করে নিজের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে না আসতে শুধু তোমাকেই দেখেছি। আবার এখন সে আমাকে শোনাচ্ছে তার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল—।

-সত্যি বলছি—।

-এই এই? কি সত্যি হ্যাঁ? কি সত্যি? তুমি অফিসেই ছিলে না আজকে সন্ধ্যার পর। আবার কথাও বলতে আসছো—?

-আরে! আমি কখন বললাম অফিসে কাজ ছিল!

-ও হ্যাঁ তাই তো! আপনার তো অফিসের বাইরেও কতো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। কত ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং থাকে আপনার অফিসের বাইরে। তাই না মিস্টার ধূসর?

-প্রজ্ঞা?

-একটাও কথা বলবা না তুমি। আমি বুঝসি তো—। আমাকে এখন আর ভালো লাগে না৷ তাই কতো অজুহাত তৈরি হবে এখন—।

-প্রজ্ঞা? এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা–। মানছি আমি দোষ করেছি না এসে–। কিন্তু–।

-তুমি দোষ করো নি। তুমি আসবে সেটা আশা করে আমিই দোষ করেছি। বোকার মতো আশা করে বসেছিলাম– কারো পথ চেয়ে–।

-এই প্রজ্ঞা? কথাটা তো শোনো আমার?

প্রজ্ঞা আবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল । ধূসরের উষ্ণ স্পর্শে একবার কেঁপে উঠে প্রজ্ঞা আবার সরে আসার চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে ধরলো। প্রজ্ঞার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু বিন্দুতে চোখ পড়তেই ধূসর আলতো হাতে প্রজ্ঞার চোখের পানিটা মুছে দিয়ে দু হাতের আঁজলায় প্রজ্ঞার মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-ইটস ওকে বউপাখিটা৷ রাগ করেই থাকো নাহয় আরো কিছুক্ষণ। এখন আপাতত আমাকে বাধা না দিয়ে চলো—। একটু ঘুরে আসি–।

-অসম্ভব–। আমি যাবো না কোথাও।

-প্রজ্ঞা প্লিজ? বাধা দিও না? আমাদের এনিভার্সারিটা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি–। ঘড়ির কাটায় হিসেব করলেও আরো একটা ঘন্টা সময় আছে হাতে। আর তুমি এটা জানতে চাও না কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আমার আসতে দেরি হয়েছে? হুম?

ধূসরের কথাটা শুনে প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে ধূসরের মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক হলো। ধূসর নেশা জড়ানো চোখে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে প্রজ্ঞারও কেমন ঘোর লাগতে শুরু করেছে। ধূসর কিছুক্ষণ অপলকে প্রজ্ঞার অভিমানি, হতভম্ব, ঘোরলাগানো মুখটার দিকে চেয়ে থেকে আলতো করে প্রজ্ঞার কোমড় পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে নিজের সাথেই জড়িয়ে নিল। ধূসরের এমন নিবিড় আলিঙ্গনে প্রজ্ঞার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে অন্য কোনো জগতে। কথাটা মনে আসতেই আবার ধূসরের উপরে অভিমানটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো মেয়েটার। ধূসরের নিবিড় বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে একটু উশখুশ করতেই ধূসর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আলতো করে প্রজ্ঞার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কিছুটা দূরত্ব রেখেই দাঁড়ালো প্রজ্ঞার পাশে।

-এখনই আমাকে এতোটা ব্যাকুল করো না মেয়ে? আগে কাজটা কমপ্লিট করি—। তারপর যত ইচ্ছে হয় তোমার চোখের সাগরে ভাসিয়ে নিও। যত ইচ্ছে ঠোঁটের আদরে হারাতে দিও—। যত ইচ্ছে তোমার আদুরে শরীরে ভালোবাসার ছবি আঁকতে দিও—। কিচ্ছুটি বাধা দিবো না তখন—। আর তুমি বাধা দিলেও মানবো না—।

ধূসরের কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্রজ্ঞা রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই এবারে ধূসর ব্যস্ত হাতে প্রজ্ঞার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে পা বাড়ালো বাইরের দিকে। প্রজ্ঞা ধূসরের গলা জড়িয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। এই লোকটার মাথায় কখন কি চলে বোঝা মুশকিল। আর ধূসর ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে প্রজ্ঞাকে নিয়েই নেমে এলো রুম থেকে। তারপর একেবারে বাইরে এসে প্রজ্ঞাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে স্টিয়ারিং ধরলো ধূসর। ধূসর প্রজ্ঞার একদম কাছে এসে সিটবেল্টটা বেঁধে দিয়ে সরে এসে নিজের সিটবেল্ট বেঁধে নিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলো। আর প্রজ্ঞা একমনে বসে ভাবার চেষ্টা করছে ওরা যাচ্ছেটা কোথায়।

দশ মিনিটের মাথায় ধূসর গাড়িটা একটা বিশাল বাংলো টাইপের বাড়ির সামনে থামাতেই প্রজ্ঞা অবাক হয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। এই বাড়িটা কার বা কোথায় সেটা বুঝতে পারছে না মেয়েটা। কিন্তু পুরো বাড়িটায় এতো আলো জ্বলছে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো অনুষ্ঠান চলছে বাড়িতে। মনে হচ্ছে কোনো বিয়ে বাড়িতেই নিয়ে এসেছে ওকে ধূসর। অথচ কোথায় কার বিয়ে! বাড়িটার আশেপাশেও একটা মানুষের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। প্রজ্ঞা গাড়ি থেকে নামতে নামতেই চারদিকটা দেখে নিচ্ছে অবাক চোখে। এখানে কেন এনেছে ওকে ধূসর সেটাই বুঝতে পারছে না। কিন্তু বাড়ির ফটকের বাইরে একটা নাম দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রজ্ঞার পা যেন থমকে গেল। থতমত খেয়ে আরেকবার নামটা পড়লো প্রজ্ঞা। আলোর ঝিকিমিকির মাঝেও নামটা আবার স্পষ্ট পড়তে পারলো প্রজ্ঞা।

“স্বপ্নকুটির”।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here