অপ্রিয় সে পর্ব ১৩+১৪

#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্বঃ১৩

আরিয়ানকে বেধড়ক মারধর করছেন রিয়াজুল করিম। রিমু একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে আর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেঝেতে খোঁচাচ্ছে।
রূপম সোফায় বসে আপেলে কামড় দিচ্ছে। বাসার কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা। সবাই শুধু চুপচাপ কী হচ্ছে তা দেখা নিয়েই ব্যাস্ত।

রিয়াজুল করিম আরিয়ানকে মারতে মারতে বললেন, ” তা এটা নিয়ে কজন মেয়ে কে টার্গেট করলে বাবা? ”

আরিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছিলো না। চুপচাপ সে মার খেতে লাগলো।

রিয়াজুল করিম বললেন, ” এই আরিয়ান তার বাবার পলিটিকাল পাওয়ার ইউস করে অসংখ্য মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি করেছে। সে যখন দশম শ্রেণির ছাত্র তখন থেকে রিমুকে ফলো করতো। রিমু তখন ক্লাস সেভেনে। এই কথা আমার কানে আসে। আরিয়ান রূপমের পাশের স্কুলে পড়তো বলে আমি রূপমকে বলেছিলাম এই ছেলের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। কারণ আমার মেয়ের পিছনে কেউ চিপকে লেগে থাকুক এটা আমি কখনোই চাইতাম না । রূপম খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে আরিয়ান একজন পলিটিকাল লিডারের ছেলে। খোঁজখবর আমিও নিতে পারতাম কিন্তু ভেবেছিলাম রূপমও যেহেতু আরিয়ানের ইয়ার মেট তাই রূপম খোঁজখবর নিলেই ভালো হবে। রিমু ছোট থেকে মারাত্মক সুন্দরী হওয়ায় আরিয়ানের নজর পড়ে রিমুর উপর। কিন্তু সবসময় ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় আরিয়ান কখনো সুযোগ পায়নি রিমুকে নিজের প্রেমের ফাঁদে ফেলার।

তবে রিমুর পিছু ছাড়েনি সে। রিমুকে ফলো করার পাশাপাশি সে অন্য মেয়েদের সাথেও সম্পর্কে থাকতো। তাদের সাথে কয়েকমাস সম্পর্ক রেখেই ছেড়ে দিতো। শারীরিক সম্পর্কও ছিলো তার অনেকের সাথে। ইদানীং সুযোগ বুঝে রিমুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু যেই ছেলে এতগুলো মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি করতে পারে সে কী আসলেও রিমুকে ভালোবাসে?

সবটা শুনে সবাই থমকে গিয়েছে। রিমুর চোখ দিয়ে অবাধ্য নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সে কিছু ভাবতেই পারছেনা। তার সাথেই কেন এমন হয় বারবার?

এদিকে আরিয়ানের বাবা মা পুলিশকে ফোন করার জন্য উদ্যত হতেই রূপম বলে ফোনটা তাহলে আপনিই করুন। নিজের ছেলের জন্য নিয়েই পুলিশ আনুন। আরিয়ানের বহু কুকীর্তির প্রমাণ অনেক সযত্নে রেখেছি আমি। যাদের সাথে আরিয়ান অন্যায় করেছে তারা আরিয়ানের চেয়ে অনেক কম পাওয়ারফুল। আর বাকি যেসব গার্লফ্রেণ্ডদের সাথে কুকাজ করেছে সবারই সম্মতি ছিলো। ক্ষমতার দাপট ওই মেয়েগুলোর ছিলোনা তাই তারা আরিয়ানের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নিতে পারেনি। কিন্তু এবার আমি নেবো।

পরিস্থিতি নিজের বিপক্ষে দেখে আরিয়ান তার বাবা মা কে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সবাই সবার কাজে লেগে পড়ে।

রিমু উপরে নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কী হবে ভেবেছিলো আর কী হলো। রিমু মনে মনে বলতে থাকে, ” আল্লাহ এতো কষ্ট কেন দিচ্ছে আমাকে। সুখ জিনিসটা কী আমার কপালে নেই? বিয়ে করে এই জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম অথচ কী হয়ে গেলো। আসলে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ব্যাতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না। খানিক আগেই তো সবটা ঠিকঠাক ছিলো। রিয়াজুল করিম বাসায় এসে বললেন, ” রিমুকে যারা দেখতে এসেছে তাদের সঙ্গে ইমিডিয়েটলি কথা বলতে চায় তিনি। সেই অনুয়ায়ী আরিয়ানকে ফোন করে রিমু বলে, ” বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসলে আপনারা যখন আমাকে দেখতে এসেছিলেন তখন আমার বাবা বাসায় ছিলেন না। তিনি আপনাদের সাথে কিছু জরুরি কথা বলতে চান। আমি জানি আপনারা সবাই ভীষণ ব্যাস্ত মানুষ। তারপরও যদি একটু সময় দিতেন। ”

রিমুর ফোন পেয়ে উচ্ছসিত আরিয়ান চলে আসে রিমুদের বাসায়। আরিয়ান আসার পরপরই রিয়াজুল করিম এক কথায় দু কথায় রহস্যময়ী হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন বাবা তোমার চরিত্র ঠিক আছে তো?

এ ধরনের প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যায় আরিয়ান। সাথে প্রচন্ড রকম বিব্রতও হয়। সে বলে দায়সারা একটা হাসি দিয়ে বলে জি আঙ্কেল। আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।

আর এই কথা শুনেই রেগে গিয়ে ইচ্ছে মতো আরিয়ানকে পিটাতে থাকে রিয়াজুল করিম।
তারপরই এলোমেলো হয়ে যায় সব।

রিমু তার ফোন হাতে নিয়ে সাদিয়াকে ফোন দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কী করা ভালো হবে সাদিয়া তা খুব সহজেই বলতে পারবে। এই মেয়েটা অনেক বেশি বুদ্ধিমতী, স্মার্ট আর এক্সট্রোভার্ট৷ সব সমস্যার সমাধান যেন তারই কাছে। রিমু সবার উপকার করে, আগলে রাখে। কিন্তু সে ততটা চালাক চতুর নয় সাদিয়ার মতো। রিমু সবার জীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারলেও নিজের জীবনের সমস্যায় ডুবে থাকে। আর এই সমস্যা থেকে উদ্ধারের জন্য ভালো পরামর্শ দাতা সাদিয়াই হতে পারে।

রিমুর কাছে সবটা শুনে সাদিয়া রেগে যায় রিমুর প্রতি। সে বলতে থাকে, ” তুইও গতানুগতিক ধারার চিন্তা নিজের ভেতরে পোষণ করিস রিমু! এটা ভীষণ হতাশাজনক।
বিয়ে করেই কেন মুক্তির পথ বেছে নিতে হবে? বিয়ে করলেই যে তুই মুক্তি পাবি এটা বলছিস কী করে? এমনও তো হতে পারে এক জেলখানা থেকে অন্য জেলখানায় ঢুকে পড়লি? তখন কীসে মুক্তি খুঁজবি? আমার কথা মন দিয়ে শোন রিমু! নিজের মুক্তির উপায় নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। তুই নিজের পায়ে দাঁড়া। নিজের আইডেন্টিটি তৈরি কর। আর বিয়ের মাধ্যমে মুক্তি এসব আজাইরা চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেল৷ তোকে নিয়ে কী যে করবো আমি। ”

সাদিয়ার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো রিমু। প্রচন্ড গরমে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে রইলো।

রূপম বাইরে থেকে কড়া নাড়ছে রিমুর দরজায়। রিমু ভেতরে আসার অনুমতি দিলো।

রূপম ভেতরে এসে বললো, ” কী রে রিমু? মুখটা ওরকম পেঁচির মতো করে রেখেছিস কেন? আরিয়ানকে বুঝে মনে ধরে গিয়েছিলো
ইশ রে! প্রেম না করেই ছ্যাঁকা খেলি!”

রূপমের কথা অন্য রকম লাগছে রিমুর কাছে। রূপম কখনো এতো বেশি ফ্রি হয়নি রিমুর সাথে। তবে আজ কেন যেন বন্ধুর মতো আচরণ করছে। রিমু কিছু বুঝলোনা।

রূপম আবার বললো, ” দ্যাখ যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। তোর যদি ওই লুচুটার সাথে বিয়ে হতো তাহলে কী হতো ভাবতো। না জানি শরীরে কোন রোগ বাঁধিয়ে বসতি। ইউ নো না কি বুঝাচ্ছি আমি? উ উ ( এক ভ্রু উচিয়ে) ”

রিমু শুরুতে না বুঝলেও পরে যখন বুঝলো তখন ভীষণ লজ্জা পেলো। বালিশে মুখ গুঁজে সে হেসে ফেললো। তারপর বললো, ” রূপম ভাই আপনি যান! ”
রূপম বললো কী বললি? আমি তোর জান?

রিমু রেগে বললো, আমি কখন বলেছি আপনি আমার জান? আমি বলেছি এখন থেকে চলে যেতে!

রূপম বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো, ইশ আমি আরো ভাবলাম তুই আমাকে তোর জান বললি। আচ্ছা চলে যেতে বলছিস চলে যাচ্ছি। কিন্তু আবার ফিরে আসবো।

রিমু বুঝছেনা তার সাথে ঠিক কী হচ্ছে! রূপম তার সাথে এমন আচরণ করবে এটা তো অবিশ্বাস্য। আর এতো ফ্রি হয়ে তো অসম্ভবই।

রিমুর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হলোনা। সে এসি অন করে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

ঋষি সাদিয়ার নম্বরে ভয়ে ভয়ে ফোন করলো। না জানি এই মেয়ে কখন কী রিয়্যাক্ট করে। ঋষি সাদিয়াকে বললো, ” আপনি আজ রূপমদের বাসায় আসবেন। কিনা প্রয়োজন ছিলো।”

সাদিয়া খানিকটা রেগে বললো আমি আপনার কথায় কেন রূপম ভাইদের বাড়িতে যাবো? আর তার জন্য কেন যাবো? ওই বাড়িতে যাওয়ার কারণ তো রিমু। সে যখন আমাকে যেতে বলেনি তাহলে কেন আমি যাবো?”

সাদিয়া একনাগাড়ে অনেকগুলো কথা বললো। ঋষি তাকে থামিয়ে যতটা শর্টকাটে সবটা বলা যায় বললো।

সাদিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। এতো কিছু হতে পারে তা সাদিয়ার ধারণাতীত। তার মনে এখন একটাই ভয় সে রিমুকে এতো জ্ঞান দিলো সেই যদি এখন রিমুকে প্রপোজ করতে রূপমকে সাহায্য করে তবে কীভাবে সেটা নেবে রিমু?
#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্বঃ ১৪

ঋষি, রূপম, তৃপ্তি, সাদিয়া,সাজ্জাদ, রিংকি সবাই মিলে রূপমকে আইডিয়া দিচ্ছে কীভাবে প্রপোজ করা যায়। সাদিয়া আজ রূপমের ব্যবহার দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে । রূপম এতো মিশুকে এটা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। যেই রূপমের প্রতি সবসময় ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাতো সে, সেই রূপমের প্রতিই আজকে একটা প্রশান্তি ভাব আসছে। কিন্তু রূপমের এতবছরের করা ভুলগুলোর শাস্তি হিসেবে রূপমকে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উপর রেখে যদি পোড়াতে পারে তাও বোধহয় শান্তি মিলবে না।

সাদিয়া রূপমকে জিজ্ঞেস করলো, ” আচ্ছা রূপম ভাই আপনিও কী তথাকথিত প্রেমিকদের মতো রিমুর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে তাকে ভালোবেসেছেন? আমার তো সেটাই মনে হয়। ”

রূপম বললো, ” সাদিয়া এখন যদি আমি তোমাকে বলি আমি রিমুকে কেন ভালোবাসি জানিনা। শুধুমাত্র ভালোবাসি এটাই জানি তবে কী তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে? বোধহয় না। তবে তুমি বিশ্বাস করো বা না করো সত্যি সবসময় সত্যিই থাকবে। যেই জিনিসটা আমি চেষ্টা করলেও অপরজনকে বোঝাতে পারবো না। সেই জিনিসটা বোঝানোর চেষ্টাই করিনা।”

সাদিয়া নিরুত্তর রইলো। রূপম বললো, ” যদি কখনো কাউকে ভালোবাসো তবে কোনো কিছুর পরোয়া না করে বলে দিও। শুদ্ধতম ভাবে। যাতে অপর মানুষটার মনে তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র ভুল ধারণা না থাকে। এতে কী হবে জানো? তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে যদি না পাও কোনো কারণে তবে তোমাকে ভালোবাসা প্রকাশ না করতে পারার ব্যার্থতা নিয়ে মানসিক যন্ত্রণা পেতে হবে না। ”

সাদিয়া ছোট্ট করে শুধু হু বললো।

ঘুম থেকে উঠে রিমু সিদ্ধান্ত নিলো সে চলে যাবে বাসা থেকে। তারপর হোস্টেলে গিয়ে উঠবে। রিমুর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হতে আরো এক বছর লাগবে। রিমুর বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে মিনিমাম ২০ মিনিট লাগে। তাই সে বাসা থেকেই যাতায়াত করতো। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে এখানে থাকলে বুঝি সে বাঁচতে পারবেনা। আর একবার যদি সে বাড়ি থেকে বের হয় তবে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে ফিরবে না। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো এই বিষয়টা তার জন্য অনেক বেশি কষ্টকর হবে। তারপর ভাবলো, মানুষ চাইলো যেকোনো কিছু করতে পারে। রিমু প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র ব্যাগে গোছাতে শুরু করলো। রিমুর রুমটা প্রচন্ড এলোমেলো হয়ে আছে। বিয়েতে তার জন্য কেনা সমস্ত জিনিসপত্র তার রুমে স্তুপ আকারে রয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে সে গোসলে ঢুকলো। এখন গোসল না করতে পারলো মরেই যাবে সে।

এদিকে রিমুকে কীভাবে প্রপোজ করা যায় তার সমস্ত প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেছে সবাই। রূপম রিংকি কে বললো, ” যা তো! গিয়ে দেখ রিমু কী করছে।”

রিমু তখন গোসল করে সবে বেড়িয়েছে। হাঁটুর
নিচ অবধি থাকা চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে।

রিংকি সবার কাছে ফিরে গিয়েই ছোট খাটো চিৎকার দিলো একটা। উচ্ছসিত হয়ে বললো, ” ইশ রিমু আপুর চুলগুলো কতো সুন্দর। আমি তো পুরাই ফিদা তার চুলে!”

রিংকির কথা শুনে রূপম একটু গলা খাকাড়ি
দিলো। তারপর সবার উদ্দেশ্য বললো, ” সেবার রিমু ক্লাস এইটে। পুরাই কিউট একটা বাচ্চা। নিজেকে সামলাতে পারে না তখনও।কীভাবে নিজের যত্ন নিতে হয় সেটাও তার জানা নেই। কিন্তু তার লম্বা চুলের প্রচন্ড রকমের শখ। জুন- জুলাই মাস তখন। প্রচন্ড গরম। রিমু সকালবেলা গোসল করে স্কুলে যেত। লম্বা চুল হওয়ায় শুকাতো না বলাই বাহুল্য। ভেজা চুল, হিজাব পড়া অবস্থায় গরমে মাথা ঘেমে যেত। সাথে মাথা হিজাব দিয়ে আবদ্ধ থাকায় বাতাস পেতোনা ঠিকঠাক। সবকিছু মিলিয়ে সে ভীষণ ঠান্ডা লাগিয়ে বসলো। টানা আঠারো দিন বিছানায় পড়ে। সবাই বলেছিলো চুল কেটে ছোট করতে। কিন্তু সে কী করবে না কি? তাই যখন সে এক্সামে ফেল করলো তখন আমি তার চুল কেটে দিলাম। যেই মেয়ে নিজের যত্ন নিতে পারে না তার কাছে লম্বা চুল মানে নিজেরও ক্ষতি, চুলেরও ক্ষতি। এই চুল কেটে দেওয়ায় সে আমার থেকে দূরে দূরে থাকতো। আফসোস ছিলোনা আমার। অন্তত এই লম্বা চুল সামলাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে তো পড়বে না।”

সাদিয়া, সাজ্জাদ চমকে গেলো। এই চুল কাটার বর্ননা দিয়ে রিমু অনেকক্ষণ কেঁদেছিলো তাদের কাছে। তখন ভীষণ রাগ হয়েছিলো রূপমের প্রতি। আজ কেন যেন রাগটা আসছে না। বরং মনে হচ্ছে যা করেছে ভালোর জন্যই করেছে।

রূপম আবার বলতে লাগলো, ” আগের দিনগুলো কতো সুন্দর ছিলো। জানো রিমু না ম্যাথে কাঁচা ছিলো। টেনেটুনে পাশ মার্কস আসতো তার। সে চাইলেই পরিশ্রম করে ভালো রেজাল্ট করতে পারতো। কিন্তু তার মধ্যে সেরকম ইচ্ছে কমই দেখেছি আমি। রিমুর মডেল টেস্টের সময়কার ঘটনা। যেই পরীক্ষায় ফেলের পরে ওর চুল কেটে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেছিলাম আমি। সারাবছর ম্যাথ না করে ওর প্রিপারেশন জিরো। তবে সে জানতো সে পাশ করবেই। খুব টেনেটুনে হলেও করবে। সে যখন ম্যাথ করছিলো তখন আমি পিকনিকের অ্যারেঞ্জ করি বাড়িতে। যাতে তার পরীক্ষা খারাপ হলে দোষটা তার ঘাড়ে না পড়ে। এর আগের পরীক্ষাগুলোতে ভালো মার্কস না পাওয়ায় চাচ্চু খানিকটা বকাঝকা করেছিলো তাকে। আর বলেছিলো এবার ভালো মার্কস তুলতে না পারলে যেন কথা না বলে। রিমু কথা দিয়েছিলো চাচ্চুকে। কিন্তু অসুস্থতা সহ নানান ঝামেলায় তার ম্যাথটা করা হয়ে ওঠেনি ভালো মতো। যখন সে ফেল করলো তখন আমি বলেছিলাম চাচ্চুকে পরীক্ষার আগের দিন এসব গানবাজনা হওয়ায় রিমুর সমস্যা হয়েছিলো। পরীক্ষার টেনশন, আর উচ্চ শব্দে যে কেউই অসুস্থ হবে এটা স্বাভাবিক। এবারের বিষয়ে তার দোষ নেই। যা বলার আমাকে বলো। সেবার চাচ্চু আর কিছু বলেনি।”

কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো সবাই। সবটা শুনে সাদিয়া ডিসাইড করলো অন্তত আর যাই হোক কখনো কোনো বিষয়ের দুপিঠ না জানা পর্যন্ত সে জাজ করবে না। যেকোনো বিষয়ের দুটি দিক থাকে। বিষয়টা নিয়ে মানুষদের মধ্যে একেক জনের একেক রকম মন্তব্য থাকে। তাই সবটা জানার পরেই বিচার করা ঠিক হবে। তাছাড়া সবসময় চোখের সামনে যা দেখতে পাওয়া যা তা যে সত্যি হবে এমনটা তো নয়। ঘটনার পেছনেও অনেক ঘটনা থাকে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হয় ধৈর্য নিয়ে সবটা জেনে তারপর মন্তব্য করা।

কথা অন্য দিকে যাচ্ছে দেখে ঋষি বললো, ” তবে তুই ওর ভালোর নাকি খারাপের জন্য কাজগুলো করেছিস সেগুলো কী সে জানে? তুই যে কারণেই করিসনা কেন তোর জন্য সে কষ্ট পেয়েছে। তাই তোকে শাস্তি পেতেই হবে। ”

রূপম মুচকি হেসে বললো, ” দুনিয়ার সব শাস্তি পেলেও যেন সে আমার হয়। ”

সাদিয়া বললো, ” ভালোবাসায় পূর্ণতা এতটাই জরুরি কি? যেসব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না সেগুলো কি ভালোবাসা নয়? দেখুন সে আপনার হবে কী না সেটাতো সৃষ্টিকর্তাই জানে একমাত্র। আপনাকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় তিনি আপনার জোড়া ঠিক করে রেখেছেন। তাই ধৈর্য ধরে থাকুন। ”

সাদিয়ার কথা শুনে ঋষি তার দিকে খানিকটা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে দেখতে বাচ্চা বাচ্চা হলেও বয়স অনুযায়ী তার ম্যাচিউরিটি অসাধারণ।

সবাই সিদ্ধান্ত নিলো একটু পরই রিমুকে ছাঁদে ডেকে আনা হবে। রিমু এখনো জানে না বাসায় সাদিয়া, সাজ্জাদ এসেছে। বা তার সাথে আজ কী হতে পারে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি রেডি হয়েছে।
রিমু শুনতে পেলো রিংকি ছাঁদের উপর থেকে তাকে ডাকছে জোরে জোরে। বিষয়টা কিছু বুঝলোনা সে। তবে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে ভেবে ছাঁদের দিকে ছুটে গেলো। প্রতিদিন রাতের বেলা ছাঁদ আলোকিত থাকলেও আজ ঘুটঘুটে অন্ধকার। রিমু তার হাতে থাকা ফোনের ফ্লাশলাইট অন করে উপরে রিংকি, রিংকি বলে উঠতে থাকলো। ছাঁদের দরজা খুলে রিমু তার সামনে কতগুলো মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো। কিছুক্ষণের জন্য তার আত্মা কেঁপে উঠলো। এমন পরিস্থিতিতে যে কেউই ভয় পাবে। রিমু ফ্লাশলাইটটা তাদের মুখের দিকে দিয়ে দেখতে যাবে অমনি শব্দ করে আতশবাজি ফুটে উঠলো। ” I LOVE U RIMU ” আকাশের ভেসে ওঠা এই লেখাটা দেখে রিমুর মনে হলো কিছুক্ষণের জন্য তার হৃদ স্পন্দন মনে হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এরপর পরই আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো ছাঁদ। রিমুর সামনে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে রূপম দাঁড়িয়ে। তার হাতে অনেক গুলো গোলাপ। পাশে অনেকগুলো পরিচিত মুখ। রিমু কী করবে বুঝলোনা। সাদা পাঞ্জাবিতে শুভ্র লাগছে রূপমকে। চাপ দাঁড়ি সংবলিত এই ছেলেটাকে এই অবস্থায় কেউ দেখলে নিঃসন্দেহে থমকে যাবে। রিমুর বুঝলো তার হাত পা কাঁপছে। এর মধ্যেই রূপম তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বললো, দেখ হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করতে পারবোনা। হাঁটুতে অনেক ব্যাথা। এসব তথাকথিত প্রপোজে যদিও আমি বিশ্বাসী নই তবুও এভাবেই করলাম , ” শোন রিমু! আমি তোকে ভালোবাসি!”

চলবে,,,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here