অপ্রিয় সে পর্ব ১৯+শেষ

#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্বঃ১৯

রাত ১ টা বেজে ৫৫ মিনিট। রূপমের চোখে ঘুম নেই। দেয়ালের সাথে লাগোয়া বেডে শুয়ে আছে সে। হাতের মুঠি শক্ত করে একের পর এক দেয়ালে আঘাত করেই যাচ্ছে জোরে জোরে।। দ্রিম দ্রিম একটা শব্দে ছেঁয়ে গেছে পুরো রুম। এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে তার হাত থেকে রক্ত পড়া শুরু করবে। যে অনুপাতে সে নিজের হাতে আঘাত করছে তাতে বিষয়টা অসম্ভব নয়৷

কেন আমি সহজভাবে উপস্থাপন করলাম না নিজেকে? যেসব কাজ বুঝিয়ে করা সম্ভব হতো সেসব কাজ ট্যারামি করে কেন রিমুর মনে নিজের স্থানটা হারালাম? এরকম বোকামি কেউ করে না কি? কী দরকার ছিলো নিজেকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করার? ভালো ভাবে করলেই তো পারতাম। কেন করলাম না তখন? আর এখন অন্তর জ্বালায় জ্বলতে হচ্ছে আমাকে। আমি তো ভালোবাসি রিমুকে। ম্যাচিউরিটির অভাবে সম্পূর্ণ লেইম কারণে তার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। বুঝদার হওয়ার পরে যখন তাকে ভীষণ করে চাইছি তখন তাকে পাওয়া পায় আমাবস্যার চাঁদের মতো। বিড়বিড় করছে রূপম। অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছে। তবে সময় পেরিয়ে সে তার ভুলটা বুঝতে পারলো। এখন এই ভুল বুঝতে পারার মূল্য কী পাবে সে রিমুর কাছে? সে অনন্ত যাইহোক ইচ্ছে করে তো আঘাত করে নি রিমুকে। নির্বুদ্ধিতা, ইমম্যাচিউরিটি মানুষের জীবনের বেঁচে থাকার আশা নষ্ট করে দিতে পারে বিষয়টা এখন বোধগম্য হচ্ছে রূপমের।

দেয়ালে আঘাত করতে করতে রূপমের হাতের অবস্থা বেজায় বাজে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে আঘাত করলেও তার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে না। মনকষ্ট যখন বেশি হয় তখন শারীরিক কষ্টকে তুচ্ছ মনে হয়। হারিয়ে যাবার পর মানুষ মূল্য বোঝে সবকিছুর। রিমু এখন বদলে গেছে, নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে আর এখনই রূপমের ইচ্ছে হচ্ছে শক্ত করে রিমুকে জড়িয়ে ধরে বাকি জীবনটা শান্তি মত
কাটাতে। রাত দু’টো। রূপম ফোন হাতে নিয়ে রিমুর নাম্বারে ফোন দিলো। একবার, দুবার, তিনবার এভাবে পঁচিশ বারের মতো রিমুর নাম্বারে ফোন দিলো রূপম। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। এতো রাতে মানুষ ঘুমাবে এটাই স্বাভাবিক। রিমুও ঘুমাচ্ছে তাই ফোন ধরছেনা বিষয়টা মাথায় এসেছে রূপমের। তবে এতোবার ফোন দিলে যে কারোরই ঘুম ভাঙার কথা। তবে কী ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছে রিমু? সে যাই হোক রূপম ফোন দিয়ে গেলো ক্রমাগত। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে সে বন্ধ ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।

এই রিমু! ফিরে আয় না রে একটিবার। সত্যি বলছি সব শাস্তি মাথা পেতে নেবো। তুই যা শাস্তি দিতে চাস দিস। যেভাবে পারিস কষ্ট দিস। কিন্তু আমার কাছে থেকে। বালিশে মুখ গুঁজেই রূপম এসব বলে কাঁদছে। এতো করুণ কন্ঠের আকুতি রিমু শুনলে সে কী পারবে এতো নিষ্ঠুর হয়ে থাকতে? রিমু হীন জীবনটা কেমন যেন অনর্থক লাগছে রূপমের কাছে। তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মরার কথা ভাবতে গিয়েও রূপমের মনে হচ্ছে রিমুর সান্নিধ্য পাওয়ার পর তার যা খুশি হোক। কিন্তু রিমুকে পেতেই হবে তার। একবারের জন্য হলেও রিমু তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিক তাকে৷

সাদিয়া আর ঋষি সারারাত ধরে কথা বলছে। এক টপিক থেকে আরেক টপিকে। কথা যেন ফুরাতেই চায় না। কথার একপর্যায়ে ঋষি বলে ওঠে আচ্ছা সাদিয়া আমাকে কেমন লাগে?

সাদিয়া ঝটপট উত্তর দেয়, ” একদম ভালো লাগে না। ”

বাচ্চাদের মতো কন্ঠ করে সাদিয়ার বলা, ” একদম ভালো লাগে না ” কথাটা ঋষির বুকে ঝড় তুলে দেয়৷ বারবার তার মনে হতে থাকে মেয়েটা এতো সুন্দর করে কথা বলে কীভাবে? অথচ কথাটা একদমই স্বাভাবিক। আহামরি বিশেষত্ব নেই।

ঋষি বোধহয় প্রেমে পড়েছে। ভালোবেসে ফেলেছে সাদিয়াকে। তাই তো সাদিয়ার বলা অতীব সাধারণ কথাটা মধুর মতো ঠেকলো তার কাছে।

ঋষি ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করে এই অল্প কদিনেই আপনি আমার অনেক প্রিয় হয়ে গিয়েছেন।

সাদিয়া উ জাতীয় ভেঙচি কাটার শব্দ করে বলে আর আপনি দিনদিন অপ্রিয় হচ্ছেন আমার। ঋষি মনঃক্ষুণ্ন হয়। তবে সেটা প্রকাশ না করে বলে আজ অপ্রিয় তো কী হয়েছে? কাল হয়তো প্রিয় হয়ে যাবো৷

উহুম আপনি কখনোই আমার প্রিয় হতে পারবেন না। আজীবন অপ্রিয়ই থাকবেন। নাতী নাতনীদের সঙ্গে গল্প করার সময় বলবো, জানিস তোর দাদু আমার ” অপ্রিয় সে ” কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অপ্রিয় সম্মোধন টা আক্ষরিক অর্থে অপ্রিয় বোঝাতে ব্যাবহৃত হয়না। সবার সামনে তাদেরকে অপ্রিয় বলেই বরং বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায়। কারণ তারা হয় সবচেয়ে প্রিয়। তাদের ধারেকাছে আসার ক্ষমতাও কারো থাকে না। এটা আমার ব্যাক্তিগত মতামত। একান্তই ব্যাক্তিগত। কথাগুলো এক ধ্যানেই বলতে থাকে সাদিয়া। এদিকে ঋষির মনে হচ্ছে সে বোধহয় দুনিয়াতেই নেই। অলীক স্বপ্নে ভাসছে। এই সাদিয়াটা কী বলছে এগুলো? সুখানুভূতি দিয়ে খুন করার তালে আছে না কি? কষ্ট করে যে জিনিস পাওয়া যায় তার কদর না কি সবচেয়ে বেশি হয়। তবে এতো সহজে যেটা পাওয়া যায় সেটা যে স্বর্গীয় অনুভূতি দেয় সেটাকে কীভাবে প্রকাশ করবে ঋষি?

এতক্ষণ আপনমনে কথাগুলো বললেও কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পায় সাদিয়া। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। কীসব বলে ফেললো সে। জ্বিবে কামড় দেয় সে। আস্তে করে দিতে গিয়ে কামড়টা জোরেই বসে যায়। সে ধুর বলে চেঁচিয়ে উঠতেই উদ্বিগ্নতা দেখা যায় ঋষির গলায়। মধ্যরাতে সূচনা হয় এক নব প্রেম কাহিনীর। দুজনের অজান্তেই।

ঋষি তার নাতী নাতনীর কী নাম দেবে সেসব নিয়ে সাদিয়াকে জ্বালাতন করছে। এদিকে সাদিয়ার রাগে ফোসফাস করাটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে ঋষি।

এই যে কী শুরু করলেন? নিজের লিমিটে থাকেন। আর কীসের নাতী নাতনী?

ঋষি বুঝলো সাদিয়া ভাঙবে তবু মচকাবে না। কথার মার প্যাঁচে দুজনেই প্রবেশ করলো নতুন দুনিয়ায়।

কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে সাদিয়া। খানিকক্ষণ পরে ফোন কেটে দিলো ঋষি। তারপরই ডায়াল করলো রূপমের নাম্বারে। রূপমকে সবটা জানাতে না পারলে মোটেই শান্তি পাবে না ঋষি। আর সে খুব ভালো করেই জানে রূপম বিষয়টা শুনলে ভীষণ খুশি হবে।

ফোনের রিংটোন বাজতেই লাফিয়ে উঠলো রূপম। রিমু কল ব্যাক করেছে ভেবেই আনন্দে নাচানাচি করার জোগাড় রূপমের। অনন্ত যাইহোক একটু তো কথা বলতে পারবে সে। কিন্তু ফোন স্ক্রিনে ঋষির নাম দেখে ভীষণ হতাশ হলো রূপম। সাথে তার মেজাজটাও বিগড়ে গেলো চরম পর্যায়ে। ধুর বাল বলে সে রিসিভ করলো ফোন। তারপর অকথ্য ভাষায় ঋষিকে গালিগালাজ করে কেঁদে ফেললো।

কিচ্ছু বুঝতে না পারে ঋষি কী করবে সেটাও বুঝতে পারছে না।

এই রূপম কী হয়েছে তোর? এভাবে কান্নাকাটি করছিস কেন? সব ঠিক ঠাক আছে তো? আর গালিই বা দিলি কেন? এতো রাতে ফোন দিয়ে আমি কী ডিস্টার্ব করে ফেললাম তোকে? সরি রে। কিছু কথা জানানোর ছিলো।

ঋষির কথা শুনে ভাবান্তর হলো না রূপমের। সে বাচ্চা ছেলেদের মতো করে কাঁদতে লাগলো।

এইবার ঋষি চটে গেলো।

এই মাইয়া মাইনসের মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্না থামাবি? কী হইছে কস না ক্যান? কাহিনী করো মিয়া? এরপর লাগাতার গালি।

ঋষি চটে যাবে বুঝেনি রূপম। তৃপ্তির সামনে কান্নাকাটি করলে সে তো শুধু স্বান্তনা দেয়। কিন্তু ঋষি তো ছেলে। তারউপর বেস্টফ্রেন্ড। গালিগালাজ শোনা লাগবে এটাই তো নরমাল।

আমি রিমুকে হারিয়ে ফেলছি ঋষি। সম্পূর্ণ নিজের দোষে ওকে হারিয়ে ফেলছি। এখন ওকে ছাড়া থাকবো কী করে? তুই বল! বলনা রে! কথাগুলো বলতে বলতেই হেঁচকি তুলে কান্না।

রূপমের বলা প্রত্যেকটা কথা তীরের মতো বিঁধলো ঋষির বুকে। অপর পক্ষের কান্নাকাটি যেকারো পক্ষেই বিব্রতকর এবং কষ্টদায়ক। তা সে ছেলে কিংবা মেয়ে যেই কাঁদুক না কেন। ছেলেদের কান্না তো আরো বেশি মারাত্মক।

এই রূপম কান্না থামাবি তুই? কী শুরু করলি? তোর যে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করা স্বভাব এজন্যই হয়তো রিমু আসছে না তোর কাছে।

রিমু তো কখনো আমার চোখের জ্বল দেখেনি ঋষি। দেখলে কী পারতো আমাকে ফেরাতে? তুই বল পারতো?

হ্যাঁ পারতো। কারণ তোর কারণে তাকে অনেক কাঁদতে হয়েছে। তাই না পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঋষির ঠোঁটকাটা জবাব ভেঙে দিলো রূপমকে।

ফোনটা কাট ঋষি। তোর সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

ঋষি বুঝলো এমন মানসিক অবস্থায় এতটা কড়া কথা শোনানো ঠিক হয়নি। তাই নিজের মন্তব্য পাল্টালো সে।

আরে রিমু ফিরবে তো। মেয়ে মানুষের মনে অনেক দয়া। আগাগোড়া তাদের মায়া, দয়া, ভালোবাসা দিয়ে মোড়ানো। তোর এতো কষ্ট দেখে ফেরাবে না দেখিস।

এই মিথ্যা স্বান্তনা শুনে রূপম ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললো, ” স্বান্তনা টা শুরুতে দিতে হতো। এখন আর মিথ্যা স্বান্তনায় প্রশান্তি আসবে না। অবশ্য মিথ্যা স্বান্তনা না দিয়ে ঠিকই করেছিস। সত্যি অনেক বেশি তিক্ত হয়। আর এটা যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা সম্ভব ততই মঙ্গল। তবে সত্য তিতা হলেও পরবর্তীতে এই সত্যই সাহস জোগায়। রিমু বোধহয় ফিরবে না রে। আমিও জানিনা কী করবো। ভালো থাক। ”

কথাগুলো বলেই খট করে ফোন রেখে দিলো রূপম। হতবুদ্ধি ঋষি আফসোস করতে লাগলো বন্ধুর মন ভেঙে দেওয়ার জন্য। তার জীবনের সুখসংবাদটাও এই প্রথম রূপমকে জানাতে পারলো না সে। কে জানে সামনে কী হবে।
#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্ব:২০

ফোন হাতে নিয়ে রূপমের অসংখ্য কল দেখে ঘাবড়ে গেলো রিমু। কোনো অঘটন ঘটেছে ভেবে সাথেসাথে কল ব্যাক করলো। এদিকে সারারাত জেগে কান্নাকাটি করে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছে রূপমের। চার পাঁচটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে শান্তি মতো ঘুমাচ্ছে এখন।
রায়হান খান কোনো একটা দরকারে রূপমকে ডাকতে এসে বেশ কয়েকবার দরজায় সজোরে ধাক্কালো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পরও যখন রূপম দরজা খুললো না তখনই অজানা আতঙ্ক ভর করলো রায়হান খানের মনে। রূপম বরাবরই অনেক সময়ানুবর্তী একটা ছেলে। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠা তার অন্যতম একটা অভ্যেস। রূপমের ঘুম অনেক পাতলা। একটু শব্দেই ঘুম ভেঙে যায় তার। এতবেলা অবধি ঘুম তারউপর এতবার ডাকাডাকির পরও দরজা না খোলায় রায়হান খানের মনে খটকা লাগলো। তিনি মোটামুটি সবাইকেই জড়ো করলেন।

সবার মধ্যে একপ্রকার গুঞ্জন চলছে। রিমুর বাবা মা দুজনের কারো মুখের দিকেই তাকানো যাচ্ছে না৷ শুধুমাত্র তাদের দোষে তাদের মেয়ে আজ ঘরছাড়া। আদরের ছেলেটাও কেমন ঝিমিয়ে গিয়েছে। মা বাবা হিসেবে তারা চরম ব্যার্থ। বিষয়টা হারে হারে টের পাচ্ছেন তারা।

রূপমের দরজায় ধাক্কাধাক্কি, চিল্লাচিল্লি করেও যখন লাভ হলো না সবাই একপ্রকার হাল ছেড়ে দিলো। সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলো।

এদিকে রূপমের নাম্বারে ফোন দিয়ে যাচ্ছে রিমু। কল হচ্ছে কিন্তু রেসপন্স নেই। রিমুও খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। বাড়ির কেউও ফোন ধরছে না। আহানাকে বলে রিমু বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো। কিছুক্ষণ পরে পৌঁছানোর পরে সবার একটা কান্নার রোল কানে এলো রিমুর। বুকটা ধক করে উঠলো তার। রূপমের ঘর থেকে আওয়াজ আসছে দেখে সে ছুট লাগালো সেদিকে। কী বিদ্ধস্ত অবস্থা সবকিছুর। দরজা ভাঙা। রূপমকে ঘিরে সবার কান্নাকাটি। রিমু পেছন থেকে ডাক দিলো সবাইকে। রিমুকে দেখে রায়হান খান ছুটে আসলেন তার কাছে। এসেই শক্ত করে হাত চেপে ধরলেন।

মা আমার ছেলেটা অনেক ভালোবাসে তোকে। নিজের অনিচ্ছায় অনেক ভুল করেছে সে। মাফ করে দে মা। আমরাও তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। মাফ করে দে। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়। আমরাও তার উর্ধ্বে নই।

রিমু জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো রূপম ভাইয়ের কী হয়েছে?

রূপম ঘুমের ঔষধ খেয়েছে কয়েকটা। বেড সাইটে খালি পাতা দেখলাম ঔষধের।

ওহ্ আচ্ছা বলে রিমু বাড়ি থেকে বের হলো। সবাই কয়েকবার ডাকলে বললো, চার পাঁচটা ঔষধ খেলে কেউ মরে না। তার খেয়াল রাখুন। আর অহেতুক জ্বালাতন বন্ধ করুন আমাকে।
আপনাদের ছেলে আমার অপ্রিয়, অপ্রিয় এবং শুধুই অপ্রিয়।

রাস্তার ধার দিয়ে আনমনে হেঁটে চলছে রিমু। তার এখন হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এ কোন রূপমকে দেখছে রিমু? রূপমের এসব পাগলামি রিমুকে দূর্বল করে দিচ্ছে। তার স্থানে যেকোনো মেয়ে হলেই হয়তো দূর্বল হত। কিন্তু এখন রূপমের কাছে ফিরলে তার স্থানটা কেমন হবে? তার আত্মসম্মান ইগো এসবের কী হবে? ইগো বিসর্জন দিয়ে সে কী ফিরবে রূপমের কাছে? ভালোবাসা দিয়ে সুন্দর একটা সংসার গড়বে? না কি দূরেই থেকে যাবে রূপমের?অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে রাস্তাতেই জ্ঞান হারালো রিমু।

হুট করে ঘুম ভেঙে যায় রূপমের। মাথার উপরে কান্নাকাটির শব্দে তার ভীষণ খারাপ লাগা শুরু করলো। একই জীবনে প্রথমবার এতগুলো ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় রূপমের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। মাথাটা অসহ্যরকম ভারী হয়ে আছে আর চোখদুটো অসম্ভব রকমের লাল। তাকে জাগতে দেখেই সবাই ব্যাস্ত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করলো। রূপমের ভীষণ খারাপ লাগায় হাতের ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলে লেবু পানি চাইলো। খানিক ভালো বোধ করতেই রূপম মুখ খুললো।

আমি রিমুকে অসম্ভব ভালোবাসি৷ তাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক আমার জন্য। আমার জীবনে তাকে ভীষণ করে চাই। কাল রাতে অনেক বার ফোন দিয়েছিলাম তাকে। সে রিসিভ করে নি৷ আমার ভীষণ খারাপ লাগছিলো। ঘুম আসছিলো না। কিছুদিন আগে ডক্টরের কাছে শারীরিক অসুস্থতার কারণে যাওয়ার তিনি কিছু ঘুমের ঔষধ সাজেস্ট করেন। যেগুলো পরবর্তীতে খাওয়া হয়নি আমার। তাই আজকে সেগুলো বের করে খেয়েছি ঘুমের জন্য। এখন নিজের উপরই অনেক রাগ লাগছে৷ কেন করলাম এরকম ফালতু কাজ।

সবটা শুনে রায়হান খান ধরা গলায় বললেন, “রিমু এসেছিলো বাবা! কিন্তু তারপর সে চলে গেলো। ওকে দেখে স্পষ্ট বুঝেছি অন্তত যাইহোক সে আর ফিরবে না তোর জীবনে। স্বাভাবিক হয়ে যা বাবা। তোকে এভাবে দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না আমাদের। ”

রিমু এসেছিলো কথাটা শুনে রূপমের মুখে যে হাসির রেখা ফুটে উঠেছিলো পরের বাক্য শুনেই কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো সেটা।

রূপমের ভগ্ন দশা সবাইকেই পীড়া দিচ্ছে সমানভাবে। তবে কারোরই আজ কিছুই করার নেই। শুধুমাত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া।

সেদিনের পর অতিবাহিত হয়ে তিনমাস বারো দিন। রূপম সবকিছু ভুলে গিয়ে পাগলের মতো পড়ে আছে রিমুর পেছনে। এদিকে রিমুর পারছেনা রূপমের ভালোবাসা থেকে পালিয়ে বাঁচতে। যখনই ভাবছে রূপমের কাছে সে আসবে ঠিক তখনই অতীতের কথাগুলো তাকে বিরত রাখছে।

আজ তেমনই এক দিন। রিমু টেবিলে বইখাতা রেখে চেয়ারে বসে মনযোগ দিয়ে বই পড়ছে। সামনেই তার মিডটার্ম। তারপর ফাইনাল দিয়ে লেখাপড়ার পর্ব চুকিয়ে একটা চাকরীর ব্যাবস্থা করতে পারলেই হলো। রিমু টিউশানি করানো শুরু করেছে। চারটা বাচ্চাকে পড়িয়ে যা পায় তাতে তার মাস সুন্দর চলে যায়। আহানার সাথেই থাকে সে। সাদিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। বাকি বন্ধুদের সাথে সব ঠিক ঠাক।

সাদিয়া ঋষি চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এখন ইউকে তে আছে। হানিমুন পর্ব বলা চলে। ঋষি নিজে এসে রিমুকে দাওয়াত দিয়েছিলো। কিন্তু যায়নি রিমু।

রূপমের নম্বর থেকে ফোন আসছে রিমুর ফোনে। রিমু ফোন সাইলেন্ট করে বইয়ে মনযোগ দিলো। দীর্ঘ দু-ঘন্টা পরে বই থেকে মুখ তুলে ফোন হাতে নিলো সে। রূপম তখনও ফোন দিয়েই যাচ্ছে। একটা মানুষের এতো ধৈর্য হয় কীভাবে সেটাই মাথায় আসেনা রিমুর। এ কয়েকমাসে রূপমের সম্পূর্ণ আলাদা রূপ দেখেছে সে। রিমু না পারতে ফোন ধরলো। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। নেটওয়ার্ক সমস্যা। রিমু বাজে নেটওয়ার্কের মধ্যে থেকেই রূপমের কথা শুনতে পেলো।

এই রিমু! কোথায় রে তুই? একটু বের হবি? তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে আমার। চিন্তা করিসনা তোকে ভিজতে হবে না। আমি গাড়ি নিয়েই বাইরে আছি। তুই শুধু দরজা পর্যন্ত বের হ। আজকে বুকটা কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে রে। তোকে দেখার জন্য মস্তিষ্কের নিউরনে আন্দোলন চলছে। হৃদপিণ্ডটা এতো জোরে জোরে বিট করছে কেন বলতো? মনে হচ্ছে ফেটেই যাবে। আমার সারা বুকে একপ্রকার শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা তোকে দেখার পরই মিটবে। তুই একবার আয় লক্ষ্মীটি।

রিমু বরাবরের মতোই পাত্তা দিলোনা রূপমের কথাকে। ততক্ষনে তারও একপ্রকার শূন্য শূন্য লাগছে। রূপমকে আর ফেরাবে না সে। আপন করে নেবে এবার। রূপম শুধু আর একটিবার বলুক।

কিন্তু রূপম এবার আর তার কাছে আসতে বললো না। কিংবা একবারও বললো না দেখা দিতে।

রিমু রে! আমিও তো মানুষ বল? আমারো তো অনুভূতি আছে। বুঝলাম তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু ভালোও তো বাসি। কেন জানি আজকে ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে তোকে দেখতে না পারার তীব্র হাহাকার বুকে পুষেই তোর থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। আমার কেন এরকম মনে হচ্ছে বলতো? তোকে গ্রহণ করতে হবে না আমাকে। কিন্তু আমি সবসময় তোর কাছেই থাকতে চাই। তোর থেকে দূরে গিয়ে আমি ভালো থাকবো না রে৷ নিজের মনকে বুঝাবো তুই কাছেই আছিস আমার। আমি তোকে জ্বালাবো না আর। আগের মতো হয়ে যাবো। তারপরও এসব ভালো লাগছে না আমার। কেমন একটা অদ্ভুত বাজে অনুভূতি আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে চলছে। আমি যাই রে। ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস।

রিমুর বুকটা সমানে মোচড় দিয়ে উঠছে। রূপম এভাবে কেন বললো? এভাবে তো বলেনা কখনো। রিমু প্রতিত্তোর করার সুযোগ পেলো না। রূপম ফোন কেটে দিয়েছে। পাল্টা ফোন দিলোনা রিমু। কাল সে নিজে যাবে রূপমের কাছে। সবকিছু মিটিয়ে তাকে আপন করে নেবে।

সকাল ৮ টা। সারাদেশের পত্র পত্রিকায় ঝড় উঠেছে। দেশের বিশিষ্ট গায়ক রূপম খান খুন হয়েছেন৷ মাঝরাস্তায় কেউ তাঁর গাড়ি থামিয়ে ২৯ টি ছুরি চালিয়েছে তার বুকে। বৃষ্টির পানিতে ভিজেছেন তিনি সারারাত। দেশের মন্ত্রী, মিনিস্টার সবাই শোক প্রকাশ করেছেন। জরুরি বিভাগ গঠন করা হয়েছে খুনিদের সম্পর্কে জানার জন্য। সারাদেশে এখন উত্তাল। রূপম খানের ফ্যান ফলোয়ার, আত্মীয়, স্বজন সবাই পাগলের মতো কাঁদছে। কেউ কাউকে স্বান্তনা দেওয়ার অবস্থায় নেই।

রিমুর ঘুম ভাঙে বেলা বারোটায়। আহানা তার দেশের বাড়িতে যাওয়ায় সে এখন একা। সারারাত কারেন্ট না থাকায় রিমুর ফোনও বন্ধ রয়েছে। কারেন্ট এসেছে এখন। রিমু ফোনটা চার্জে দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে টিভির সামনে বসলো। আজ সে কীভাবে সাজবে সেই চিন্তা করছে৷ রূপমের কাছে যেতে হবে না তার? টিভি অন করতেই একটা খবরের চ্যানেলে চোখ আটকে গেলো তার। হাতে থাকা গরম চায়ের কাপটা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে তার পায়ে পড়ে গেলো। তবে গরম চা পায়ে পড়ায় তার কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। সে এখন অনুভূতিহীন স্তব্ধ পাথরের ন্যায় আছে। কী বলছে এরা? রূপম মারা গিয়েছে? কেউ তাকে খুন করেছে? রূপম আর এই পৃথিবীতে নেই? তাহলে রিমু কার জন্য আজ সাজবে? নিজের মনকে এতো বুঝিয়ে কী লাভ হলো? কার সাথে ভালোবাসার সংসার গড়বে রিমু?

রিমুর বাসার কলিংবেল বেজেই চলেছে৷ কোনো রকমে টলতে টলতে রিমু দরজা খুললো। সাজ্জাদ আহানা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রিমুকে৷ তারাও এতদিনে রিমুর সাথে হওয়া সব ঘটনার স্বাক্ষী। রিমু কাল দুজনকেই জানিয়েছে আজ তার প্ল্যানের কথা।

রিমু কাঁদছে না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। সাদিয়া সাজ্জাদের ফোনে ফোন করেই ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ সে রিমু রূপমের সব খোঁজখবর নিতো৷ রূপমের সাথে তো ভাই বোনের এক অসাধারণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। রিমু সাজ্জাদের হাত থেকে ফোন নিয়ে হ্যালো বললো। দুই বান্ধবীই চুপচাপ।
রিমু শক্ত গলাতেই বললো তোকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে রে। কেন যে সেদিন বলেছিলাম তোর মুখ দেখতে চাইনা। সাদিয়া, সাজ্জাদ, আহানা হু হু করে কাঁদছে। রিমু চুপচাপ। এরপর একসময় হুট করেই পিনপতন নিরবতা চারিপাশে।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে রূপমের। সবার মধ্যে হাহাকার। পাগলপ্রায় দশা। রিমু বাড়ি ফিরেছে। শেষ বারের মতো সে দেখেনি রূপমকে। এই না দেখার আক্ষেপ নিয়ে সল ধুঁকে ধুঁকে শেষ হতে চায়। রিমুকে দেখতে পেয়েই সবার আরো কান্না। সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদছে। রিমু স্বান্তনা দিচ্ছে সবাইকে।

রাত দশটা। আরিয়ান জেলে। সেই খুন করেছে রূপমকে। তবে খুন করার সময় বিশাল বিশাল ভুল করেছে। মার্ডারের সময় তার পকেট থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পড়ে যায়। পুলিশ খুব দ্রুত ইনভেস্টিগেশন করে সবটা খুঁজে বের করে। আরিয়ানও স্বীকার করে নেয় সবটা। খুনির সর্বোচ্চ শাস্তিই এখন সবার কাম্য।

রূপমের বিছানায় শুয়ে আছে রিমু। রূপমের একটা ছবির দিকে তাকাতেই সে হু হু করে কেঁদে উঠলো। রাতের আঁধারে কেউ তার কান্না শোনার মতো নেই। রূপমের ছবি বুকে জড়িয়ে রিমু কাঁদছে।

আপনি আমার অপ্রিয়ই রয়ে গেলেন রূপম ভাই। যখন আপনাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখলাম তখন আমার থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে আমার স্বপ্নকে ভেঙেচুরে আপনি আমার অপ্রিয়ই রয়ে গেলেন। বিরবির করে কান্না একসময় গগনবিদারী চিৎকারে পরিণত হলো। আপনি আমার “অপ্রিয় সে ” রূপম ভাই। আপনি আমার” অপ্রিয় সে”।

সমাপ্ত।

গল্পটার শুরু থেকে শেষ অবধি যারা পাশে ছিলেন সবাইকে অনেক অনেক ভালোবাসা। সবার মতামত আশা করছি। দোয়া রাখবেন ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here