অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -০৭

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_৭ (উত্তম কিছু)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“হয়তো আপনি আমার জীবনের সেই দ্বিতীয় পুরুষ, যে আমাকে জঘন্য ভাবে বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে! আর এমনিতেও আপনি আমার হাসব্যান্ড, প্রিয় পুরুষের জায়গায় আপনাকে না-রাখাটা অন্যায় বই কিছুই হবে না।”

তনুজার কথায় সিদ্দিক অধর এলিয়ে হাসল। তাড়া দিয়ে বলল, “চা ফিনিস করুন, ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

তনুজা চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে কপাল কুঁচকে শুধাল, “আচ্ছা, আপনি আমাকে ‘আপনি’ করে বলেন কেন?”

“উম.. ভাবার বিষয়!”

“ভাবুন ভাবুন! এরপর বলুন।”

“হুম, শুনুন। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো—আমি আপনার চেয়ে ১২ বছরের বড়ো। ১-২ বছর না! গুনে গুনে ১২ বছর! নিজের চেয়ে এত ছোটো একটা পিচ্চিকে মায়ের পছন্দ মতো বিয়ে তো করেই নিলাম। কিন্তু দাম্পত্য জীবন শুরু করতে গিয়ে বাঁধবে বিপত্তি। এদিকে আপনাকে তুমি বলতেও হেসিটেট হচ্ছে।”

“ইশ! আপনার কথা-বার্তা সুন্দর। মনে হয় না, আমার চেয়ে এত্ত বড়ো আপনি। কী সুন্দর অল্পতেই আমার ভালো লেগে গেলেন!”

“ওহ্ ওয়াও! ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা লাস্ট ইম্প্রেশন, তাই-না?”

তনুজা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, “জি, হ্যাঁ। শুনুন! আপনাকে আমি ‘ওগো হ্যাঁগো’ বলতে পারব না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে কী বলবেন—শুনি!”

“আমি আপনাকে নাম ধরে ডাকব। সিদ্দিক! আচ্ছা এই নামে কেউ ডাকে?”

“জি না, ডাকে না। আপনার ব্যক্তিগত নাম এটা।”

তনুজা হাফ ছেড়ে বলল, “বাঁচলাম! আমার না আপনাকে অন্য কারো ডাকা নামে ডাকতে ভালো লাগত না। আপনি আমার না? এজন্যই।”

সিদ্দিক কিছুটা মজার ছলেই বলল, “যদি অন্য কেউ ডাকত?”

“তবে আমি আপনাকে অন্য নামে ডাকতাম। অন্য নামে ডাকা সম্ভব না হলে, ডাকতামই না।”

“ভারি খুঁতখুঁতে স্বভাবের তো আপনি!”

“অবশ্যই। যা আমার তা আমারই।”

“আর যদি অন্য কেউ নিয়ে নেয়?”

তনুজা সিদ্দিকের দিকে এগিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে বলল, “তনুজার নিজস্ব জিনিসে নজর দেওয়ার অধিকারও কারো নেই। সেখানে নিয়ে যাওয়া!”

“আহা! বলুন না!”

“যদি তার মাঝে সামান্য পরিমাণে অন্য কারো ছোঁয়া আসে, আমার আর তাকে প্রয়োজন নেই। বুঝলেন?”

তনুজা নিজের জায়গায় পুনরায় বসে বলল, “সো বি কেয়ারফুল, মিস্টার!”

সিদ্দিক দু-ধারে মাথা নেড়ে বলল, “যা বলবেন!”

তনুজা হেসে দিলো সিদ্দিকের এমন আজ্ঞাকারী ভাব দেখে। হাসতে হাসতেই তনুজার খানিকটা আগে বলা কথাটি পুরোপুরি মিলে গেল।

_______
সকালে তনুজা ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে বেরোতেই শুদ্ধর মুখোমুখি হলো। ১৫ দিন পর! তনুজা গেইট থেকে বেরোচ্ছিল আর শুদ্ধ বাইকটা পার্কিংয়ে রেখে এখান দিয়ে যাচ্ছিল। হুট করে তনুজাকে দেখতে পেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। খেয়াল করল, তনুজার চোখ দুটো কেমন যেন কালচে হয়ে আছে। ফরসা মুখে এমন ডার্ক সার্কেল কীভাবে যেন মানানসই লাগছে। খু-ব বেশি আকর্ষণীয় লাগছে শুদ্ধর কাছে। তবে এর কারণ সে ধরতে পারল না। সে তো ম্যামকে দেখে চক্ষুতৃষ্ণা মেটাতেই মরিয়া হয়ে আছে।

এতদিন পর জলজ্যান্ত শুদ্ধকে হুট করে চোখের সামনে উদয় হয়ে যেতে দেখে তনুজা মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে গেল। বুকে হাত রেখে প্রায় ছিটকেই সরে দাঁড়াল। তাতে শুদ্ধ হাসল না। একই কাজটি যদি পনেরো দিন আগে করত তনুজা, তবে শুদ্ধ তাকে আরও জ্বালাতে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়িই খেত। কিন্তু সময় পরিবর্তনশীল!

হালকা কেশে সালাম দিয়ে বলল, “ভালো আছেন?”

তনুজা গলা ঝেড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “জি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”
এরপর মনের কোনের সেই কিঞ্চিৎ চিন্তা থেকে আনমনেই শুধাল, “এতদিন আসোনি যে?”

উফফ! তনুজার নিজের কাছেই কেমন যেন অপরাধী লাগছে। এই ছেলের কাছে এসব জিজ্ঞেস করার আছেটা কী? কিছুই নেই। তবুও কেন? নিজের বিষয়ে প্রিয় নারীর এমন উদ্বেগ দেখে শুদ্ধ মিহি হেসে জবাব দিলো, “অসুস্থ ছিলাম, ম্যাম।”

“সে কী!”
আহ! মুখটা ফসকে গেল! বের হয়ে গেল অতিচিন্তিত স্বর। কণ্ঠে চাপা ভয়। সেটুকু চেপে গিয়ে পুনরায় বলল, “কী হয়েছিল?”

নাহ! এতেও অধীরতা! নিজের এমন উদ্দাম কথা-বার্তার জন্য মনে মনে ভারি লজ্জা পেল তনুজা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে নিল। তনুজার এহেন অবস্থা শুদ্ধ নিষ্পলক চোখে দেখল কেবল। সরলো না, এগোল না, কিছু বললও না। তনুজাই নিজেকে শোধন করে বলল, “সামনে এক্সাম তো! অসুখ বাঁধালে! কী.. আব্.. এখন ঠিক আছ?”

শুদ্ধ মাথার পেছনের চুলগুলো আঙুলের ভাঁজ দিয়ে আঁচড়ে বলল, “ভালো আছি। ওই একটু জ্বর ছিল।”

“একটু জ্বরে পনেরো দিন বেড রেস্টে? নাকি ইচ্ছে করেই আসোনি?”

“ম্যাম, সেটা আপনি জেনে কী করবেন?”

তনুজা থতমত খেয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “আমার ডিপার্টমেন্টের কোনো স্টুডেন্ট.. রেগুলার স্টুডেন্ট এতটা সময় গ্যাপ দিলো, আমার জানার প্রয়োজনীয়তা নেই?”

“আমি আপনার ডিপার্টমেন্টের কেবল ‘স্টুডেন্ট’ নই। এটা আপনি ভালো করেই জানেন। আপনার সাথে আমার এটা বাদেও একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।”

তনুজা চুপ করে তাকিয়ে রইল। শুদ্ধ কিছুটা এগিয়ে তনুজার পাশে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড়াল। বরাবরের মতোই এক হাতের দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বড্ড হালকা ও গম্ভীর গলায় বলল, “এটাই তো চাইছিলেন না—দূরে দূরে থাকি? থাকছি। খুশি?”

তনুজা ডানে ঘুরে তাকাল। শুদ্ধও তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ রেখেই বলল, “আমিও খুশি, আপনার খুশিতেই আমার খুশি।”

তারপর ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে শুদ্ধ সোজা বটতলায় চলে গেল। সেখানে প্রাপ্তি, শাওন আর তুহিন দাঁড়িয়ে এতক্ষণ একসাথে শুদ্ধ আর তনুজাকে কথা বলতে দেখল। এতটা দূর থেকে ‘কী কথা হয়েছে এদের মাঝে’ তা শুনতে পারেনি। তাই উদ্দীপনা মাত্রা ছাড়িয়েছে। শুদ্ধকে নিজেদের সীমার পাঁচ ফিটের মধ্যে আসতে দেখেই এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজন। শুধাল বিভিন্ন প্রশ্নাবলী। কমন ছিল একটাই—ম্যাম কী বললেন!

শুদ্ধ পিছে ঘুরে দেখল না—তনুজা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। সে সামনে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। গতকাল যখন রাবেয়ার নম্বরে কল করল, তখন ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা মেয়েলি আওয়াজ, “আপনি ভুল নম্বরে কল করেছেন। ইউ’ভ ডায়াল্ড অ্যা রং নম্বর!”

খেয়াল করে দেখল—মোট ডিজিট দশ সংখ্যার। কোথায়, কোনটা মিস করেছে—বুঝতেই পারল না। বিভিন্ন ডিজিট দিয়ে চেষ্টা করে সে-রাতে কত মানুষের ক্ষোভের মুখে যে পড়ল, বলা দায়! শেষমেশ হার মেনে সপাটে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে আশা ছাড়তে দেয়নি তুহিন। এ-নিয়ে প্রাপ্তি-তুহিনের দ্বন্দ্ব কাল থেকেই। প্রাপ্তির মতে—মিছে আশা ধরে লাভ কী?

শুদ্ধ চাপা শ্বাস ফেলে সামান্য হেসে বলল, “ও-কিছুই না। এতদিন আসিনি কেন, সেটাই জিজ্ঞেস করছিলেন।”

শাওন অবাক হয়ে বলল, “ইজ ইট অ্যা কাইন্ড অব্ কনসার্ন?”

প্রাপ্তি শাওনের কথাকে মাটিতে এক প্রকার পিষেই বলল, “ধুরু না। এতদিন যে-কেউ না এলে, ম্যাম জানতে চাইতেনই।”

শুদ্ধর ঠোঁটের আঁট করা হাসিটা বেশ চওড়া হলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথাটা হালকা ডান দিকে বাঁকিয়ে হাত দুটো প্যান্টের পকেটে পুড়ল। শুদ্ধর এমন ভাব দেখে তুহিন ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “কী?”

প্রাপ্তির কথার প্রেক্ষিতে শুদ্ধর একটাই কথা, “আমি যে-কেউ নই।”

________
বাসায় গিয়ে আর চেঞ্জ করার প্রয়োজন মনে করেনি তনুজা। যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবেই বাসে চেপে বসল। জানালায় মাথা এলিয়ে দিয়ে ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মাঝেই বাস ছাড়ল। বাতাসের বদৌলতে আঁট করে বাঁধা খোঁপা ছেড়ে সামনের দুগাছি চুল কপালে লেপ্টে রইল। দুচোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ল সেই কথাটি, “মিসেস তনুজা, আপনাকে আমি কোনোদিনও ছাড়ছি না।”

এই কথাটি সিদ্দিক প্রায়শই বলত। তনুজা প্রতিবার জবাবে একটা কথাই বলত, “প্লিজ, ছাড়বেন না।”

কিন্তু! কী থেকে যে কী হয়ে গেল! তনুজার বন্ধরত চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পাশের সিটে একটা আধ-বয়স্ক মহিলা বসে এতক্ষণ তনুজাকে লক্ষ করছিলেন। তাকে কাঁদতে দেখেই চিন্তিত সুরে শুধালেন, “কী হয়েছে, মা! কোনো সমস্যা? শরীর খারাপ করছে?”

তনুজা চোখ খুলল। ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণে এই কান্না শুষে নেওয়ার চেষ্টা করে গেল। আজও সেই চোখের জল শুকোয়নি! এই মমতাকে উপেক্ষা করতে না পেরে চোখ দুটো দিয়ে শেষমেশ অশ্রু ঝরল। বৃদ্ধা কিছুটা আন্দাজ করে বললেন, “জগৎ-টা বড়োই বিচিত্র, মা। না-পাওয়া সব মেনে নিতে হয়।”

তনুজা অবাক হলো। বুঝতে পারল না, মহিলাটি কীসের প্রেক্ষিতে এটা বলল। তবুও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “এমন তো নয় যে, আমি তাঁকে পাইনি। পেয়েছিলাম। পেয়েও কেন হারালাম?”

বৃদ্ধা তনুজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই তুমি পাবে—যা তোমার থেকে চলে গেছে তার চেয়েও উত্তম কিছু।”

তখনই বাসের জানালার ওপাশের রাস্তা থেকে আগত এক স্বরে তনুজার গা শিরশির করে উঠল। পরিচিত এক আওয়াজ বড্ড এলোমেলো ভাবে তনুজার কানে বিঁধল, “মিস তনুজা, আমি আপনাকে কোনোদিনও ছাড়ব না।”

তনুজার দু-ঠোঁটের ভাঁজ আলগা হয়ে বেরিয়ে এলো, “শুদ্ধ!”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here