অবশেষে তুমি এলে কাছে পর্ব -০৬ ও শেষ

#অবশেষে_তুমি_এলে_কাছে
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী(ছদ্মনাম)
#পর্ব_ষষ্ঠ (শেষ)

নুসাইবা কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন করতেই জোরে কোনো কিছু ভাঙার শব্দ পেতেই হকচকিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই পুলিশ দেখতে পেলো।পুলিশের পাশেই তিশান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নুসাইবা যেনো আকাশ থেকে পড়লো সাথে রায়হান মির্জার মাথায় বাজ পড়লো।রায়হান মির্জা একবার সাহেরিকার পাশে দাড়িয়ে থাকা তিশানের দিকে আরেকবার ঝুলন্ত তিশানের দিকে চেয়ে আছে।নুসাইবা ও দুইদিকে তাকাচ্ছে।ওদের দুজনের এমন অবস্থা দেখে তিশান মুচকি হেসে বলতে লাগলো…..

–কি মিস্টার ভাবছেন তো যদি তিশান ওইখানে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে তাহলে আপনার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই তিশান কে?তাহলে চলুন একটু ফ্লাসব্যাকে ঘুরে আসি….
___________________________________________
ফ্লাসব্যাক””

তিশান আসার সময় ওর সাথে ওর বন্ধু রামিম কে নিয়ে এসেছিলো।রামিম পুলিশ অফিসার।ওরা দুজন বেড়িয়ে যেতেই পেছনে ওদের কেউ ফলো করতে করতে আসছিলো।সেটা তিশান বুজতে পেরে একটা শপিংমলের সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে ওরা দুজনেই ভেতরে ঢুকে গেলো।ভেতরে গিয়ে তিশানের জামা কাপড় গুলো রামিম পড়ে ফেললো।আর রামিমের জামা কাপড় গুলো তিশান পড়ে।ফেললো।ওদের দুজনের মুখেই কালো মাস্ক পড়া ছিলো।তিশান কে ভেতরে রেখেই রামিম আগে বেড়িয়ে আসতেই রায়হান মির্জার লোক রামিম কে তিশান ভেবে তুলে নিয়ে আসে।তিশানের জামা কাপড় পড়ায় আর মুখে মাস্ক থাকায় নুসাইবা বা রায়হান মির্জা কেউই চিনতে পারেনি?
____________________________________________
তিশানের কথা শুনে রায়হান মির্জা গার্ড দের ইশারা করতেই ওরা ঝুলন্ত ব্যাক্তিটাকে নিচে নামিয়ে মাস্ক খুলতেই রামিম কে দেখতে পেলো।রায়হান মির্জা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পকেট থেকে গান বের করে নুসাইবার মাথায় ঠেকাতেই তিশান হা হা করে হেসে উঠলো।তিশান কে এমন ভাবে হাসতে দেখে রায়হান মির্জার রাগ আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলো।রেগে গান প্রেস করতেই কোনো কিছুর শব্দ হলোনা।কয়েকবার প্রেস করতেই রায়হান মির্জা শিউর হলো এতে বুলেট নেই।রায়হান মির্জা রাগে চিৎকার করে বলে উঠে…..

—-তিশান আমি তোকে ছাড়ব না।

তিশান প্রতিউওরে মুচকি হেসে জবাব দিলো….

—রায়হান মির্জা আপনার খেলা শেষ। অফিসার এরেস্ট হিম।

রামিম অফিসার দের ইশারা করতেই ওরা রায়হান মির্জা কে এরেস্ট করে নিয়ে গেলো।এত কিছু চোখের সামনে দেখে নুসাইবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।ঢুলে নিচে পড়ে গেলো।
____________________________________________
হসপিটালের বেডে সুয়ে আছে নুসাইবা।ওর হাত ধরেই ওর পাশে বসে আছে তিশান।কিছুক্ষনের মধ্যে নুসাইবার জ্ঞান ফিরে আসতেই নুসাইবা নিজেকে সামলে তিশানের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই।তিশান ওকে সব টা খুলে বলে।রায়হান মির্জা ওর নিজের বাবা না শুনে নুসাইবা অনেক টা ভেঙে পড়েছে।নুসাইবা নিজেকে সামলে আবারো তিশানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো….

—এত সব কিছু আপনি কিভাবে জানলেন?আর যেই মেয়েটাকে আপনি বিয়ের দিন থেকে সহ্য করতে পারেন নি সেই মেয়েটার জন্য আপনি এত কিছু কেনো করলেন তিশান?

তিশান নুসাইবার প্রশ্নের প্রতিউওরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো…..

—আমি জানি এই মুহূর্তে তোমার শৈশবের কোনো স্মৃতি মনে নেই?তাই আমি যা যা বলব সব তোমার কাছে হাস্যকর বা মিথ্যা কথা ও মনে হতে পারে?
____________________________________________
অতিত”””

নুসাইবার তখন ৭-৮ বছর হবে।ছোট থেকেই নুসাইবার শ্যামবর্নের অধিকারী হলেও ওর চেহারায় ছিলো একটা আলাদা সৌন্দর্য। কথায় আছেনা শ্যামবর্নের মেয়েরগুলোর মধ্যে আলাদা সৌন্দর্য বিরাজ করে নুসাইবার ক্ষেত্রে ও ঠিক তেমন ছিলো।নুসাইবা আর তিশান একি স্কুলে পড়তো।সেই সুবাধে ওদের পরিচয় হয়েছিলো।নুসাইবা ছিলো তিশানের জুনিয়ার ব্যাচ।নুসাইবা সব সময় শান্ত শিষ্ট থাকায় তিশানের চোখ টা ওর উপরেই পড়েছিলো।প্রথমে নুসাইবা তিশানের সাথে কথা না বললেও পরে তিশানের সাথে ওর ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।নুসাইবার ছুটির পর তিশান ওর সাথে প্রতিদিন খেলতো।ওকে গল্প শুনাতো।এইভাবেই ওদের চলছিলো।তিশান তখন সব কিছু বুজলেও নুসাইবা তিশানের তুলনায় অনেক টাই ছোট ছিলো।নুসাইবা মাঝে মাঝেই তিশান কে প্রশ্ন করে বসতো….

—তিশানদা তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো।

তিশান মুচকি হেসে নুসাইবার হাত জোড়া শক্ত করে ধরে উওর দিতো…..

—আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা শ্যামকন্যা।তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো শ্যামকর্ন্যা.

তখন নুসাইবা আধো কন্ঠে জবাব দিতো….

—আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারব না তিশানদা। তুমি ছাড়া আমাকে গল্প শুনাবে কে?খেলবে কে আমার সাথে।আমি না খুব করে কাদবো তুমি চলে গেলে।

তিশান নুসাইবার কথা শুনে হাসোজ্জল মুখে বলতো…

–তোমার তিশানদা তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা শ্যামকর্ন্যা।।

নুসাইবার গায়ের রঙ শ্যামবর্ন হওয়ায় তিশান নুসাইবাকে শ্যামর্কন্যা বলে ডাকতো।মাঝে মাঝে নুসাইবা তিশান কে আধো গলায় জিজ্ঞেস করতো…

—আচ্ছা তিশানদা শ্যামকর্ন্যা মানে কি?

তখন তিশান হাসতে হাসতে উওর দিতো…

–শ্যামকর্ন্যা মানে তুমি।আর তুমি মানে শ্যামকন্যা

নুসাইবা তিশানের উওর বুজতে না পারলেও খিল খিল করে হেসে দিতো।আর তিশান মুগ্ধ হয়ে ওর শ্যামকর্ন্যা কে দেখতো।
.
.
.
হঠাৎ করেই একদিন নুসাইবাকে স্কুলে না দেখে তিশান অনেক টা হন্নে হয়ে নুসাইবার খোঁজ করে জানতে পারে নুসাইবারা এখান থেকে চলে গেছে।নুসাইবার চলে যাওয়ার পর তিশান অনেক টাই ভেঙে পড়েছিলো।সেই সাথে নুসাইবার প্রতি একটা চাপা অভিমানের পাহাড় জমতে থাকে ওর মনে।তিশান অনেক খুঁজেও নুসাইবার কোনো খোঁজ পায়নি।
____________________________________________
বর্তমান””

এইটুকু বলে তিশান থামলো।ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে।নুসাইবার চোখ থেকেও পানি ঝড়ছে কারন ওর এইসব কিছুই মনে নেই।নুসাইবা তিশান কে চুপ থাকতে দেখে উচ্ছুক কন্ঠে আবারো প্রশ্ন করলো….

—কিন্তু আপনি কিভাবে এতটা শিউর হচ্ছেন যে আপনার হারিয়া যাওয়া শ্যামকর্ন্যাই আমি।হতেও পারে সে অন্য কেউ?

তিশান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলতে শুরু করলো….

—সেদিন যখন তুমি সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলে তখম তোমার কোমরের দিকের কাপড়টা একটু সরে গিয়েছিলো।সেখানে একটা পুড়ে যাওয়া চিহ্ন দেখতে পেয়েই আমার পুরনো ঘা আমার জেগে উঠেছিলো।কারন আমার শ্যামকর্ন্যার ও ঠিক এই জায়গায় এই চিহ্নটাই ছিলো।তখনেই আমার প্রথম সন্দেহ টা হয়েছিলো।আমি সেদিন রাতেই তোমাকে বাড়ি রেখে বেড়িয়ে গিয়েছিলো।সারারাত তোমার পুরো ডিটেইলস খুঁজে বের করেছিলাম।কিন্তু রায়হান মির্জাকে তোমার বাবা দেখে আমি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম বার বার।সেই রাতেই আমি লুকিয়ে তোমার বাসায় গিয়েছিলাম, তোমার বাবার রুম সার্চ করতে গিয়ে একটা ডিভিডি হাতে চলে এসেছিলো। মনের জড়তা দূর করার জন্য ডিভিডিটা বাসায় এনে দেখতেই আমার সমস্ত কিছু গুলিয়ে গিয়েছিলো।কারন ডিভিডিটায় ছিলো তোমার বাবা মায়ের খুনের ভিডিও।তারপরের দিন সকালেই তোমার বাবার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম।(বাকিটা আপনারা জানেন)

তিশান একএক করে পুরোটা খুলে বললো নুসাইবাকে।নুসাইবা নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে।তিশান নুসাইবার সামনে গিয়ে আলতো করে নুসাইবাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।তারপর নুসাইবার মাথায় নিজের ঠোঁট দুটো ছুয়ে বলে উঠলো,,,

—একবার যখন তোমাকে পেয়ে গেছি এইবার আর হারিয়ে যেতে দিব না শ্যামকর্ন্যা।আমি জানি তোমার কিছু মনে নেই।আমরা আবার সব নতুন করে শুরু করবো।কি করবে তো শ্যামকর্ন্যা।

নুসাইবা কিছু না বলে এইবার আরো শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
___________________________________________
কিছুদিন পর….

এই কয়েক দিনে নুসাইবা তিশানের থেকে নিজেকে আলাদাই রেখেছে।তিশান ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছি।কারন হঠাৎ সব কিছু পরিবর্তন হওয়ায় নুসাইবার মেনে নিতে একটু সময় লাগবে। তাই তিশান ও নুসাইবার থেকে দূরে দূরে আছে।সারাদিন অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে তিশান রুমে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো।কারন ওর রুম টা বিভিন্ন রঙিন লাইট আর নানারকম ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো।তিশান হা করে চারদিকে চেয়ে আছে।তিশান ভেতরে ঢুকতেই উপর থেকে ফুলের পাপড়ি পড়তে লাগলো।তিশান কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওর কানে আসলো……

—সারপ্রাইজজজ…….

তিশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে পেছনে ফিরতেই নুসাইবা আর সাহেরিকাকে একসাথে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অনেক টা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।তিশান খানিক টা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো…..

—সারু তুই এখানে?

সাহেরিকা তিশানের সামনে এসে মুখে একটু হাসির রেখে টেনে বলে উঠলো….

—আমি জানি তুই অবাক হয়েছিস।আমি এই কয়েকদিন অনেক ভেবে দেখছি যে জোর করে আসলেই কাউকে পাওয়া যায়না যদি পাওয়া যেতো তাহলে নুসাইবা তোর লাইফে আসার আগেই আমি তোকে পেয়ে যেতাম।কিন্তু আমি পাইনি।তোদের ক্ষতি করার চিন্তায় দিন রাত যখন মশগুল হয়েছিলাম তখন নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছিলাম আমি মরিচিকার পেছনে ছুটছিনা তো।তাই ভাবলাম ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবেসে নিজের কাছে পাওয়াটা বড় নয়।ভালোবাসার মানুষটা ভালো আছে সেটা দেখতে পাওয়াই অনেক বড় কিছু।হোক না অন্য কারোর সাথে তাতে কি?ভালো তো আছে।তাই আমার তরফ থেকে তোদের জন্য এইসব কিছু।খুব ভালো থাকিস তোরা দুজন।

সাহেরিকার কথা শুনে তিশান একটু হেসে সাহেরিকা কে জড়িয়ে ধরলো।তারপর বললো….

—আমি আর নুসাইবা তোর পাশে সারাজীবন থাকব। আমাদের বন্ধুত্ব কখনো শেষ হবেনা।

সাহেরিকা প্রতিউওরে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ওদের রুমে দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা লক করে দিয়ে গেলো।
____________________________________________সাহেরিকা চলে যেতেই তিশান নুসাইবার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।ওদের মাঝে পিনপতন নিরবতা চলছে।নিরবতা ভেঙে নুসাইবা বলে উঠলো…..

–এই কয়েক দিন আপনার থেকে দূরে থাকার কারন একটাই আমার যেহেতু শৈশবের কিছুই মনে নেই তাই নিজেকে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।আজ এখন থেকে আমরা সব কিছু নতুন করে শুরু করব…..

তিশান কিছু না বলে নুসাইবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছে মনে হচ্ছে তিশান নুসাইবাকে ছেড়ে দিলেই নুসাইবা হারিয়ে যাবে।তিশান কান্না ভেজা কন্ঠে বলতে লাগলো…..

—একবার তোমাকে হারিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম খুব কষ্টে নিজেকে আবার নতুন করে গড়ে তুলেছি।এইবার তুমি হারিয়ে গেলে আমি আবার ভেঙে যাবো এইবার আর নিজেকে গড়ে তুলতে পারব না শ্যামকর্ন্যা প্লিজ ছেড়ে যেও না আমাকে……

নুসাইবা তিশানের কথা শুনে তিশান কে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরে বলে উঠলো….

—যাব না তিশান দা……

অনেক দিন পর নুসাইবার মুখে তিশান দা নামটা শুনে তিশান নিজের ঠোঁট যুগল নুসাইবার কপালে ছুয়ে দিয়ে বলে উঠলো…

—যখন #অবশেষে_তুমি_এলে_কাছে।তখন আর তোমাকে ছাড়ছিনা…..

বলেই নুসাইবাকে কোলে তুলে নিলো।নুসাইবা ও তিশানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।যে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যায় হয়তো সে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষটা হয়ে যায়।ওরা সব অতীত ভুলে ভালো থাকুক ওদের ভালোবাসায়।

#সমাপ্ত

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here