নীলচে তারার আলো পর্ব -০১

হিয়া ঘরে এসেই দরজা বন্ধ করে দিল। প্রচন্ড গরম লাগছে তার,এক্ষুনি একটা গোসল দিতে হবে। হিয়া ব্যাগটা এক পাশে রেখে সবে মাত্র জামার চেইনটা হাল্কা খুলতেই কেউ বলে উঠলো,” এই মেয়ে কে তুমি? আমার ঘরে কি করছো?”
ভারী আওয়াজটা যে, কোনো ছেলের সেটা বুঝতেই হিয়ার বুকটা কেপে উঠলো। শক্ত করে জামার খোলা অংশ চেপে ধরে ঘুরে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো সে। কোমরে তোয়ালে জড়ানো একজন কপাল ভাজ করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার গায়ে মুক্তোর মতন পানির বিন্দু চিক চিক করছে। ভেজা চুলগুলো কপালে এসে পরেছে। হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে জামার অংশটি আরো শক্ত করে চেপে ধরে পিছাতে লাগলো। ছেলেটি আরেকটু এগিয়ে এসে চেয়ারের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে শক্ত চোখে বললো,” কি হলো এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? কে তুমি? আমার রুমে এসেছো কেনো?”

ছেলেটার কথাটার গম্ভির্যতায় হিয়ার অসস্তি হচ্ছে। সে কি ভুল করে অন্যকারোর রুমে চলে এসেছে? তাকে তো বলা হয়েছে দোতলার ডান দিকের শেষের ঘরটা। হিয়া ঘাবড়ে গেলো, একে তো কে না কে,তাও আবার ঘরে তোয়ালে পরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। হিয়া পিঠের চেইনটা কোন ভাবে লাগাতে পারলেই দৌড় দিয়ে বের হয়ে যাবে। নইলে এভাবে বের হবে কি করে? যদি বদ লোক হয়, তোয়ালে পরে ঘুরে বেড়ানো ছেলে আর কতই বা ভদ্র হবে।

হিয়া চুপ করে থাকায় শুভ্র এবার রেগে গেলো। কোথা থেকে একটা মেয়ে তার ঘরে এসে এভাবে দাড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে তারও জবাব নেই। এমনিতেই তার রূমে সে কাউকে আসার অনুমতি দেয় না তারওপর কালকে থেকে তার মেজাজও বিগড়ে আছে। এই মেয়ে কি কথা বলতে পারে না? শুভ্রর বিরক্তি লাগছে, সে ধমকের সাথে বলে উঠলো,” কি ব্যাপার কথা বলছো না কেনো? Get out from here”

শুভ্রর ধমকের সাথে হিয়ার বুক কেপে উঠলো। লোকটা এভাবে হুংকার দিচ্ছে কেনো? সে কি চুরি করতে এসেছে নাকি। চেইনটাও বদজ্জাত এই মুহুর্তেই খারাপ হতে হলো। হিয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। অসহ্য লাগছে নিজেকে, না দেখেই রূমে চলে এসেছে সে।কোনো উপায় না পেয়ে চুল খুলে পিঠটা ঢেকে দিয়ে, তাড়াহুরোয় বের হতে গিয়ে দরজার সাথে বাড়ি খেলো। দরজাটা দেখি এই লোকটার মতন হুট করেই পিছনে চলে এলো। অসহ্য!

হিয়া বের হয়ে আসতেই শুভ্র সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলো। সে শব্দে যেনো পুরো বাড়ি কেপে উঠলো। এই লোকটা এমন কেনো? হিয়া বিরক্তির একটা নিশ্বাস ফেললো পরক্ষনেই মনে পড়লো রূমের ভিতরে তার ব্যাগটা সে ফেলে এসেছে। এবার! উফফ, নিজেকেই নিজের চর মারতে ইচ্ছে করছে তার। আবার তোওয়ালে ওয়ালাটার চেহারা দেখতে হবে! হিয়া কোনো উপায় না পেয়ে দরজায় টোকা দিলো। খুব আস্তে করেই দিলো। কোনো সাড়াশব্দ এলো না ভিতর থেকে। আরো একবার টোকা দিলো। হিয়া এবার হাত কচলাতে শুরু করলো। লোকটা কি বয়রা নাকি? দরজায় নক করা হচ্ছে শুনতে পাচ্ছে না? সে কি আবার নক করবে? যদি আবারো চেঁচায়? আর না ভেবেই হিয়া আবারো দরজায় টোকা দিতেই রাগী চোখে শুভ্র দরজা খুললো। পরনে এখনো তোয়ালে, মাথার চুলগুলো হাল্কা ভেজা। শুভ্র স্থির চোখে জিজ্ঞেস করলো,” কি চাই তোমার? জ্বালাচ্ছ কেনো আমাকে?”

শুভ্রর কথা শুনে হিয়ার ভ্রু কুচকে গেলো। রাগও হচ্ছে প্রচুর কিন্তু রাগটা সে চেপে গেলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ঘরের ভিতরে ঈশারা করে নিচু গলায় বললো,” আমার ব্যাগটা।”

” what?”, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো শুভ্র। মেয়েটা কথাও বলতে পারে! বাহ্। কিন্তু হিয়া এতো নিচু স্বরে বললো যে শুভ্র কিছুই বুঝলো না। ভারী যন্ত্রণা করছে মেয়েটা।

হিয়া একটা ঢোক গিলে বললো,” আমার ব্যাগটা আপনার রূমে ফেলে এসেছি।”

” হ্যা, তাহলে সোজাসুজি বললেই পারো ব্যাগ লাগবে। আমার সময় নষ্ট করছো কেনো? আমার সময়ের দাম আছে।”, বলেই শুভ্র ব্যাগ আনতে ভিতরে চলে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।

এই বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে থেকেই হিয়ার অসস্তি বাড়ছে। এইটা তার শ্বশুরবাড়ি আইনত সেটাই। যা তার অসস্থির মূল কারণ। সে হয়তো পৃথিবীর প্রথম মেয়ে যে কিনা কার সাথে তার বিয়ে হয়েছে, সেটা বিয়ের দুদিন হবার পরও জানতে পারলো না। মানুষটা দেখতে কেমন সেটাও সে জানে না। নিয়তির এক অদ্ভুত খেলার পুতুল এখন সে। নিয়তি তার সাথে যা খেলবে তাকে সেটাই মেনে নিতে হবে।

দুবছর আগে গাড়ী অ্যাকসিডেন্টে হিয়া তার বাবা, মা ও ছোট ভাইটাকে হারিয়েছে। খুব সচ্ছল ফ্যামিলির মেয়ে হলেও মা বাবার মৃত্যুর পর তার জায়গা হয়েছিলো ছোটো মামার বাড়িতে। ছোটো মামা খুব ভালো মানুষ হলেও মামীর দুচোখের বিষ ছিলো হিয়া। মামা তাকে কলেজে ভর্তি করাতে চাইলো মামীর অশান্তিতে মামা আর সাহস করলো না। এসএসসিতে গোল্ডেন পাওয়া হিয়ার আর কলেজে পড়া হলো না। কতো রাত সে যে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সেটা শুধু সে জানে। মামীর মুখে এমন সব কথা সে শুনেছে যেটা শুনার পর বহুবার সে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে।

তারপর হুট করে তার এমন বিয়ের ঘটনা। যা এখনো তার কাছে পরিষ্কার নয়। কয়েকদিন আগে বাবার এক বন্ধু তার খোজ নিতে তার মামার বাড়িতে আসে l লোকটাকে তার চেনা চেনা লাগলো বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন রবীউল আংকেল। ক্লাস সেভেনে থাকতে হয়তো তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। মামা চিনতে পেরে বেশ যত্নআত্তি করলেন। হিয়ার ধারণা মামাই রবীউল আংকেল কে বলেছে যে করে হোক তাকে যেনো এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ ছোটো মামা হিয়াকে প্রচুর স্নেহ করে। এর ফলস্বরূপ হয়তো মামীর অমতেই এই বিয়ের আয়োজন। বিয়ের পর তার মামাতো বোন রূপা এসে বলেছিলো তার বর নাকি খুব সুন্দর দেখতে। কিন্তু হিয়ার সেটা মনে হয় না হবে হয়তো কোনো দাড়িওয়ালা বুড়ো ব্যাটা। কিন্তু হিয়ার বিয়ে যে রবীউল আংকেলের ছেলের সাথে হয়েছে সেটা সে বিয়ের পর জানতে পারে। ওনার ছেলেটাও কি বুড়ো? হবে হয়তো। সেটা এখণ ভেবেই বা কি হবে।

হিয়া অনেক্ষন হলো দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে লোকটার দরজা খোলার নাম নেই। লোকটা ইচ্ছে করে তাকে দাড় করিয়ে রাখে নি তো? আর কতক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকতে হবে! এতক্ষণে রহিমা খালা চলে এলো। হিয়াকে এভাবে বাহিরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে ছুটে এলো চিন্তিত গলায় বলল,” আহা রে, এইখানে দারাইয়া আসেন কেনো? আপনারে তো কইলাম শেষের রুমটা আপনার। চুলায় ভাত বসানো আসিলো, এই জন্য দেরী হইসে আইতে।”

” কিন্তু শেষের রুমটায় তো তালা দেওয়া।”, নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো হিয়া। রহিমা খালা মাথায় হাত দিয়ে ফেললো,” আহা রে, আমি তো চাবি আনতেই ভুইল্যা গেসি। একটু কষ্ট কইরা খাড়ান।”, বলেই তিনি সিড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চাবি হাতে উপড়ে উঠে রুমটা খুলে দিল হিয়াকে তারপর বললো,” এইটা অখন থেকে আপনার রুম। আইচ্ছা আমি যাই বড় সাহেব বলছে আপনার খাবারের বেবস্থা করতে।” বলেই তিনি ছুটতে লাগল। মহিলাটাকেই হয়তো এ বাড়ির সব কাজ করতে হয়, ভেবেই হিয়ার মায়া লাগছে।

রুমটা হিয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে কারণ সঙ্গে কি সুন্দর লম্বা একটা বারান্দা। এই ঘরটা কি লাইব্রেরী ছিলো? বিশাল একটা বুকশেলফ। একপাশে একটা বেড তার পাশে সুন্দর একটা টেবিল। রুমটা ভালো কিন্তু তার ব্যাগ? হিয়া রুম থেকে বাহিরে এসে আবার তাকালো, দড়জাটা এখনো বন্ধ। কি করবে এবার সে! এই রূমে তালা মারা ছিলো তাই সে ঐ রূমে ঢুকেছিল। কে জানতো যে এমন বিপদ হবে?

হিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। লোকটা তাকে আর কতক্ষন দাড় করিয়ে রাখবে কে জানে? দরজায় আরেকটা টোকা দেওয়া দরকার। হিয়া এগিয়ে গিয়ে আরেকবার নক দেওয়ার আগেই হুট করেই দরজা খুলে লোকটা বের হয়ে এলো। পরনে এখন আর তার তোয়ালে নেই নেভী ব্লু শার্ট আর জিন্স। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা আর হাতে একটা সাদা এপ্রন। চশমার কারণে চেহারায় যেনো অন্যরকম সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে। চশমা পড়ার পর কি সব ছেলেই এমন সুন্দর হয়ে ওঠে? এক মিনিট সে এসব কি ভাবছে? ছি: ছি! এই লোকটা তাকে এতক্ষণ দাড় করিয়ে রেখে,এখন সেজেগুজে বের হয়েছে। একটা মেয়ে যে বাহিরে দাড়িয়ে আছে সেটা সে একবারও ভাবলো না! হিয়া গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,” আমার ব্যাগ?”রাগ তো তার প্রচুর হচ্ছে কিন্তু সেটা দমিয়ে রেখেছে সে।

” কে তুমি?”, দুই হাত গুজে প্রশ্ন করলো শুভ্র। শুভ্রের এই ব্যাবহার হিয়ার রীতিমত অসহ্য লাগছে। মানছে যে ভুল করে সে তার ঘরে এসেছিল তাই বলে এতক্ষণ দাড় করিয়ে রেখে আবার প্রশ্ন করবে সে কে? হিয়া চাইছে না রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে কারণ উনি হয়তো এই পরিবারেরই কেউ। কিন্তু এবার তার কপালে ভাঁজ পড়ল কথা না বাড়িয়ে হিয়া আবার নিজের ব্যাগ চাইতেই শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো হিয়ার দিকে। হিয়া বিরক্তি নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আর কতক্ষন! লোকটা চাইছে টা কি?

শুভ্র কিছুক্ষণ পর নিজের রুম থেকে ব্যাগটা নিয়ে এসে সজোরে মেঝেতে ফেললো। হিয়া চমকে তাকালো। লোকটার এমন দুর্ব্যবহারের কারণ সে বুঝে উঠতে পারছে না। হিয়ার চোখে পানি চলে এলো। এই ব্যাগে তার বাবা মার ছবি ছিলো কথাটা মনে পড়তেই রাগে তার শরীর কাঁপতে লাগলো। লোকটার সাহস কত বড়! হিয়া প্রচন্ড রেগে বললো,” আপনি ব্যাগটা নীচে ফেললেন কেনো এভাবে? মানছি ভুল করে আপনার রূমে গিয়েছিলাম তাই বলে আপনি এমন দুর্ব্যবহার করবেন? ঐ ব্যাগে আমার…..”

বাকিটা বলে শেষ করার আগেই শুভ্র এগিয়ে এসে কড়া গলায় বললো,” ভুল করে এসেছো নাকি ইচ্ছে করে? অবশ্য তোমার মত মেয়েদের থেকে আর কি ই বা এক্সপেক্ট করা যায়? শুনে রাখো এইসব নোংরা ট্রিকস আমার উপর কাজ করবে না…।”
শুভ্র আরো কিছু বলার আগেই রবীউল সাহেব প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলো,” শুভ্র…! মুখ সামলে কথা বলো।” তিনি হিয়ার খোজ নিতে উপরে আসায় শুভ্রের বলা সব শুনে ফেলেন। প্রচন্ড রেগে আছেন তিনি।

কিন্তু শুভ্র সে ধমক গায়ে মাখলো না ” আমাকে বলে লাভ নেই। বিয়েটা আমি তোমার কথায় বাধ্য হয়ে করেছি তার মানে এই না যে এই মেয়েকে আমি বউ হিসাবে মানবো। আমার জীবনটা তোমার হাতের মোয়া নয়। আমি সেটাই করবো যেটা আমার ইচ্ছে। তাই এইসব ট্রিকস খেলা বন্ধ করে দিও” বলেই রাগী চোখে একবার হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বেড়িয়ে গেলো। হিয়া অবাক হয়ে শুভ্রর চলে যাওয়া দেখছে। এই লোকটার সাথে তার বিয়ে হয়েছে? ভাবতেই সাড়া শরীর শিউরে উঠলো তার।
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্বঃ২

” বাবা! আর যাই বলো এটা কিন্তু তুমি অন্যায় করেছো। তুমি কি একবার ভেবে দেখেছো শুভ্রের বিয়ের কথা শুনলে প্রভা কিভাবে রিয়েক্ট করবে? ছোটো বেলা থেকে প্রভা আমাদের পরিবারের সাথে মিশে আছে আর আজ অন্য একটা মেয়ের জন্য তুমি ওর এতো বড়ো ক্ষতি করলে?”, রবীউল সাহেবের ইজি চেয়ারের সামনে বসে আছে মোহনা। মোহনা রবীউল সাহেবের বড়ো মেয়ে। রবীউল সাহেবের মাথা গরম থাকলে একমাত্র মেয়ের কথাই সে শুনেন।

রবীউল সাহেব চোখ বন্ধ করে ছিলেন মোহনার কথায় এবার তিনি চোখ খুলে তাকালেন। কতক্ষন স্থির দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,”তোর ভাইকে আমি জোর করে বিয়ে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু সে তো বিয়ের পর কাউকে না জানিয়ে ফিরেও এসেছে। আমার মান সম্মানের কথা একবারো ভেবেছে? তাকে তো আমি সংসার করার জন্য জোর করিনি। হিয়ার বাবা আমার খুব কাছের কিছু মানুষের মধ্যে একজন ছিলেন। তোদের কোনোদিন বলিনি কিন্তু আজ শোন। ঐ লোকটা যদি সেদিন নিজের সঞ্চয়পত্র না ভেঙে আমার অপারেশন করাতো আজ হয়তো আমি হুইল চেয়ারে বসা থাকতাম।”

বাবার মুখে এমন কথা শুনে মোহনা চমকে তাকালো। রবীউল সাহেব একটু দম নিয়ে বললেন,” তখন আমি নতুন এ শহরে, চাকরির খোঁজে এসেছিলাম। আমি থাকতাম রফিক মানে হিয়ার বাবার বাসায় তখন রফিকের ছোট্ট একটা বাসা। রফিকের মা, ভাবি, রফিক আর আমি। তখন আমি ছোট্ট একটা কারখানায় কাজ করতাম। একদিন বাড়ি ফেরার সময় একটা দুর্ঘটনায় আমার পা প্রায় অচল হয়ে যাবার উপায় হয়। সে লোকটা তখন নিজের কথা না ভেবে আমার জিবনটা অচল হওয়া থেকে বাঁচায়।”

বলেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বললেন,” বিয়ের এগারো বছর পর রফিকের ঘর আলো করে এসেছিল হিয়া। খুব আদরের ছিলো হিয়া। এই মেয়েকে মাথায় তুলে রাখতো সে, আজ সে নেই বলে তার মেয়ে মামীর অত্যাচারে বড়ো হবে। লোকটা অনেক ঋণ রেখে গেছে আমার কাছে। আমি যে মরেও শান্তি পেতাম না রে।” বলতে বলতে রবীউল সাহেবের চোখ ভিজে এলো। তিনি চোখ বন্ধ করে ইজি চেয়ারের হ্যান্ডেলে হাত রেখে চোখ চেপে ধরলেন। মেয়ের সামনে তিনি চোখের জল ফেলতে চান না।

মোহনা এসেছিল বাবাকে কথা শুনাবে বলে কিন্তু এসব শুনে সে নিজেও থমকে গেলো। তার বাবা যে কাজটা করেছে সেটা সে অন্যায় কিছু করেনি, গভীর ভালবাসার বশে করেছে। কিন্তু এতে যে তিনটা জিবন নষ্ট হবে। শুভ্র যদি কোনোদিনই মেনে না নেয় হিয়াকে। মোহনা বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,” কিন্তু বাবা এতে যে ওরা কেউই সুখী হবে না।”

” বিয়েটা না করালে হিয়ার মামী ঝামেলা করতো। আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলো না। আমি তো বলেছি হিয়ার বয়স উনিশ হলেই শুভ্রর সাথে ওর ডিভোর্স করিয়ে দিবো। এক রুমেও তো থাকতে বলিনি। তোমার ভাইয়ের ইচ্ছে মতোই তো সব হচ্ছে।একটা কাগজে সই করে বিয়ে হয়েছে আরেকটা কাগজে সই করলেই ডিভোর্স হয়ে যাবে। চিন্তার কি আছে? হ্যা মেয়েটাকে সারা জিবন নিজের কাছে আগলে রাখবো ভেবেছিলাম তা তো আর হবে না। থাক তাও তোমার ভাই সুখী হোক।” শেষের কথাটা যে তার বাবা এক রাশ অভিমান নিয়ে বলেছে সেটা মোহনার বুঝতে বাকি রইলো না।

শুভ্রের সকালের আচরণে তার বাবা সত্যি ব্যাথিত। এমনিতেই বিয়ের পর পরই সে ঢাকায় রওনা দেয়। এতেও অভিমান জমে আছে তার বাবার মনে। তবে এতে তার বাবার ও ভুল হয়েছে শুভ্রকে না জানিয়ে নিয়ে গিয়ে হুট করে জোর জবদস্তি করাও উচিৎ হয় নি।

” যা করার সেটা তো তুমি করেই ফেলেছো। এখন চিন্তা করে করে ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে দয়া করে আমাকে আর জ্বালিয় না।”, মায়ের কণ্ঠে মোহনা দড়জার দিকে তাকালো। রান্না ঘরে মাকে তো প্রচন্ড রেগে আছে মনে হয়েছিল হটাৎ এমন শান্ত হয়ে গেলো কেনো? তাহলে কি সবটা জেনে মায়ের ও রাগ কমেছে?

সাহারা খাতুন তোয়ালে হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আরো বললেন,” বিয়েটা কি খেলা মনে হয় তোমার? একবার সই করে বিয়ে আবার সই করে ডিভোর্স। আমি পরিষ্কার করে বলছি আমার ছেলে খুশী না থাকলে ওদের ডিভোর্সের জন্যে আমি তোমার কাছেও অনুমতি নিবো না।”, কড়া গলায় বলেই তোয়ালে এগিয়ে দিলেন রবীউল সাহেবের দিকে।

রবীউল সাহেব স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিজের স্ত্রীর তাকিয়ে থেকে তোয়ালে হাতে ফ্রেশ হতে গেলেন। মোহনা কখনো বাবা মাকে ঝগড়া কিংবা চিৎকার চেঁচামেচি করতে দেখেনি। এদের রাগটা এরা কিভাবে জানি সামলে নিয়ে সবটা স্বাভাবিক করে রাখে। বাবা চেঁচামেচি করতে চাইলেও মা এতে বাবাকে উৎসাহমুলুক কোনো সঙ্গ দেন না।

হিয়া গোসল সেরে বেড়িয়ে এলো মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে। এখন তার অসস্তি কিছুটা কমলেও ভয় লাগছে কেনো জানি। নিচে শাশুড়ির মুখটাও বেশ ভার হয়ে ছিলো। এর চেয়ে তো মামী বেশী ভালো ছিলো আর যাই হোক চিল্লাচিল্লি করে সব রাগ ঝেড়ে ফেলতো। এরা কি সব রাগ ফিক্স ডিপোজিট করে রাখে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। কেনো জানি খুব ঘুম পাচ্ছে হিয়ার। মাথা থেকে তোয়ালেটা খুলতেই মোহনা রুমে এসে বললো,” অনুমতি না নিয়েই ভীতরে চলে এলাম। কিছু মনে করোনি তো?”

মোহনার এমন কথায় হিয়া অপ্রস্তুত হয়ে না সূচক মাথা নাড়লো। এ বাড়ি তো তার নয় তাই এই রূমের আসার জন্য তার অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না। মোহনা ভিতরে এসে দেখলো টেবিলে এখনো নাস্তার প্লেট ঢাকা পরে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মোহনা ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি ব্যাপার তুমি এখনও নাস্তা করোনি?”
মোহনার প্রশ্নে হিয়া খাবারের প্লেটের দিকে তাকালো। নাস্তা না করেই সে গোসলে গিয়েছে আর হিয়ার গোসলে অনেক সময় লাগে। হিয়া নিচু গলায় বললো,” ভুলে গেছিলাম আর গোসল সারতেও দেরী হয়েগেছে।”

” জলদি নাস্তা করো, বাবা শুনলে রাগ করবে কিন্তু।”, একটু রাগ দেখিয়ে বললো মোহনা আবার পরক্ষনেই হিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল,” এতো ভয় পেয়ো না।আমাকে আর বাবাকে তো একদমই না। বাবা আর আমি একরকম খালি ভাই আর মা একটু সাধু সন্ন্যাসী টাইপ। মানে গম্ভীর মুখে কথা বলে আর কি! দেখবে ভালো কথা বলার সময়ও এদের কপালে ভাজ পরে।”

মোহনার কোথায় হিয়া হেসে ফেললো। মুহূর্তেই কেনো জানি খুব আপন হয়ে গেলো মোহনাকে, যার দিকে তাকিয়ে হিয়া সস্থির নিশ্বাস ফেলতে পারে। ভাবতেই অবাক লাগছে তোয়ালেওয়ালাটা নাকি এর ভাই! মোহনা যেতে যেতে বলল,” হাসলে সুন্দর লাগে, হাসবে সবসময়। আর আমি আবার আসবো এসে যেনো দেখি খাবার শেষ করেছো।”

মোহনাকে হিয়ার ছোটো মামার মতন লাগলো। ছোটো মামাও এমনভাবে আদর করে কথা বলেন।


” সারাদিন কোথায় ছিলি? ভার্সিটিতেও নাকি যাস নি?”, সাহারা খাতুনের এমন প্রশ্নে হিয়া সামনে তাকালো। তাকাতেই বুঝতে অসুবিধে হলো না যে কাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটি করা হয়েছে। সামনে তাকাতে শুভ্রের চোখে চোখ পরতেই হিয়া চোখ নামিয়ে ফেললো।

“কিছু না এমনিই।”, জবাবে বললো শুভ্র। মোহনা কিছু বলার আগেই শুভ্র সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।রবীউল সাহেব হিয়ার দুই চেয়ার পরে ঠিক মাঝের চেয়ারে বসে চুপ করে আছেন। ডাইনিং টেবিলের পরিবেশ হটাৎ কিছুটা থমথমে হয়ে গেলো।

শুভ্র নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু দড়জার সামনে এসে একটু চমকালো। প্রভা ভীত চেহারায় দাড়িয়ে আছে। এতো রাতে প্রভা কি করছে? শুভ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,” কি ব্যাপার তুই? আমার ঘরের সামনে পায়চারি করছিস কেনো?”

শুভ্রের আওয়াজে অশ্রু চোখে প্রভা তাকালো। নিজেকে সামলাতে না পেরে ছুটে এসে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো। শুভ্র স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রভার এমন অদ্ভূত আচরণের কারণ শুভ্রর জানা নেই। মেয়েটা এইভাবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেই বা কেনো?

“কি হলো কাদছিস কেনো এভাবে?”, চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো শুভ্র। এমনভাবে প্রভাকে সে আর কোনোদিন কাদতে দেখে নি।

“শোন কাদতে এতই ইচ্ছে করলে পর্দা জরিয়ে ধরে কান্না কর, আমার শার্টটা ভিজিয়ে দিস না।”, তাও প্রভার কান্না থামছে না। শুভ্রের কাছে কান্না জিনিসটা খুবই অপছন্দের।

” বুঝলাম না, বিয়ে হয়েছে আমার কান্না করার কথা আমার তুই কেদে ভাসাচ্ছিস কেনো?”, ভ্রূ কুচকে প্রশ্ন করলো শুভ্র।

হিয়া সবে উপরে উঠে নিজের রূমের দিকে যাবে এমন সময়ে শুভ্র আর প্রভাকে এতো ঘনিষ্ট দেখে একটু থমকে দাড়ালো। তার এখন নিজের রূমের দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে ঐ লোকটা আবার বলবে সে ইচ্ছে করে ওদের মাঝে আসতে চাইছে। এমনিতেই কম কথা শোনায় নি তোয়ালেওয়ালাটা। কিন্তু কি করবে সে? এইখানে দাড়িয়ে থাকাটাও ভালো দেখাবে না। এদিকে ওদিক তাকাতেই ছাদের সিড়ির দিকে চোখ গেলো হিয়ার। আপাদত ছাদে উঠে বসে থাকলেই হয়। পরে নেমে আসা যাবে।

শুভ্র প্রভার বাহু ধরে বুক থেকে সরালো। তারপর ধমকের সুরে বলল,” কাদছিস কেনো এভাবে? ”
শুভ্রের এমন ধমকে প্রভা চোখ বড় বড় করে তাকালো তারপর চোখের জল মুছে রেগে গিয়ে বললো,” তুই বিয়ে করেছিস কেনো?একবারও কি তোর আমার কথা মনে পরে নি। এতো সার্থপর কেনো তুই?”

” কি যে বলিস তুই মাঝে মধ্যে? নিজেও জানিস? আর এই বিয়ে আমি ইচ্ছে করে করিনি। আর তুই নিশ্চই বিয়ের দাওয়াতের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছিস না?”, বলেই শুভ্র নিজের রূমের ভিতরে চলে গেলো।

প্রভা হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলেটা কি কোনদিন বুঝবে না তার ভালোবাসা? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে।

শুভ্রের মা প্রভাকে সবটা বুঝিয়ে বললেও প্রভা ভীষন ভয়ে আছে। শুভ্র যদি ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়? প্রভার মনের অস্থিরতা কিছুতেই দূর হচ্ছে না। প্রভা শুভ্রের রূমের ভিতরে যাওয়ার আগে থমকে দাড়ালো। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বললো,” আসবো তোর রূমে? নইলে তো আবার চেঁচিয়ে উঠবি।”

” হ্যা আয়। কিন্তু কান্নাকাটি করা আরো বাকি থাকলে শেষ করে আয়।”, বলতে বলতে শুভ্র এসির রিমোট হাতে নিয়ে এসি অন করে দিলো। তারপর শার্টের হাতা ভাজ করে কনুই পর্যন্ত তুলতে ব্যস্ত সে। প্রভা দরজায় হেলান দিয়ে অপলকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো শুভ্রের দিকে। শার্টের বুকের কাছের প্রথম দুইটা বোতাম খোলা থাকায় শুভ্রকে সুন্দর লাগছে অনেক। আচ্ছা সে যেভাবে শুভ্রকে দেখে থমকে যায়, ঐ মেয়েটাও কি?
ভাবতেই বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করে উঠলো। পরক্ষনেই মুখটা কালো হয়ে গেলো প্রভার। বেরিয়ে এলো সে। শুভ্র প্রভার এমন অদ্ভূত ব্যাবহারের মাঝে মাঝে কোনো কারণ পায় না। হটাৎ এমন স্ট্রেঞ্জ বেহেভ করছে কেনো কে জানে?

প্রভা সিড়ি বেয়ে নীচে নামলো, যতক্ষণ না সে ঐ মেয়েকে দেখছে তার শান্তি হবে না। শুভ্রের পাশের ঘরটা সে দেখেছে মেয়েটি নেই। রহিমা খালাকে জিজ্ঞেস করে আবার উপরে এলো প্রভা।
এতক্ষণে হিয়া ছাদ থেকে সবে মাত্র নামলো। প্রভাকে সামনে দেখেই সে থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে বুঝে না উঠায় পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই প্রভা সামনে এসে দাড়ালো। প্রভা ভঙ্গিতা না করে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলো,” তুমিই কি হিয়া?”

হিয়া প্রভার দিকে তাকিয়ে হা সূচক মাথা নাড়ল। প্রভার চোখ লাল হয়ে আছে। মেয়েটা অনেক কেঁদেছে হয়তো। এই কান্নার কারণ হিয়ার বুঝার বাকি রইলো না, এতটা বোকাও সে নয়।

প্রভা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। চলে যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে বললো,” শোনো শুভ্রকে আমি ভালোবাসি। তুমি চাইলেও ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। তাই ওর কাছে যাওয়ার একদম চেষ্টা করবে না।” কড়া গলায় বলে প্রভা জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। তারপর এক মুহুর্ত দেরী না করে চলে গেলো। অস্থিরতায় সে কি বলে ফেলেছে নিজেও জানে না। মেয়েটার উপড় যে উচু গলায় কথা বলেছে সেটা বাড়ী থেকে বের হয়েই বুঝতে পারলো প্রভা।

হিয়া অপলকে তাকিয়ে রইলো। খুব খারাপ লাগছে তার কারণ সবাই অকারনেই তাকে ভুল বুঝছে। সে কোনো নোংরা ট্রিকস খেলতেও আসেনি কিংবা কারোর প্রিয় কাউকে কেড়ে নিতে। মেয়েটাকে বলতে পারলে ভালো হতো যে, সে কোনোদিন শুভ্রকে কেড়ে নিবে না, কোনোদিন না। হয়তো কথাটা শুনলে মেয়েটা শান্তি পেতো কিন্তু সে সুযোগটা মেয়েটাই দিলো না।

হিয়া আনমনে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। নিজের রুমে পা ফেলার আগেই আবার সেই আওয়াজ কানে এলো হিয়ার।

” এই মেয়ে দাড়াও।”, শুভ্রের হটাৎ এমন ডাকে ভয়ে আতকে উঠলো হিয়া। আরেকটু হলেই আত্মাটা বেড়িয়ে আসছিল। হিয়া পরক্ষনেই চোখ বড় বড় করে রুমটা দেখে নিলো ভুল করে এই ছেলের রুমে পা ফেলেনি তো। না! না! ওনার রুম না, একটা সস্থির নিশ্বাস ফেলতে যাবে তখনই মনে হলো সে তো ঠিক রুমেই এসেছে তাহলে লোকটা ডাকছে কেনো তাকে? আবার কি অঘটন ঘটিয়েছে সে।

[ #চলবে ]
সবাই পাশে থাকবেন। 💕]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here