অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব -০৮

#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#প্রথম_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ8

ব‍্যালকনীর রকিং চেয়ারে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা উপন‍্যাস টা পড়ছে রুশা। মনে মনে ভাবছে, জীবনের কাহিনি গুলো উপন‍্যাসের মতো লেখা যায় না কেন? যদি মানুষের জীবনের প্রত‍্যেকটা কাহিনী লেখার ক্ষমতা আল্লাহ প্রত‍্যেকটা মানুষের হাতে দিত। তাহলে হয়ত সবার জীবনের উপন‍্যাস গুলো বইয়ের উপন‍্যাসের চেয়ে বেশি সাজানো গোছানো হত। হয়ত সেই উপন‍্যাসে কোনো মানুষের হৃদয়কে কষ্ট’রা-হতাশা’রা স্পর্শ করতে পারত না। হয়ত সবার জীবনে প্রিয় জিনিস না পাওয়ার যে এত এত আক্ষেপ, বিষাদ সেগুলো তাদের থাকত না। হয়ত কাঙ্খিত জিনিসটা হারিয়ে ফেলার বিরহে রাত জেগে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে তাদের হাহাকার করতে হত না।

ভাইব্রেশন মুডে রাখা ফোনটার বিদঘুটে আওয়াজ কর্নগোচর হতেই বই থেকে মাথা উঠিয়ে রেলিংয়ের দিকে তাকাল রুশা। চোখের চশমাটা ঠিক করে হাত বাড়িয়ে রেলিংয়ের উপর থেকে ফোন’টা হাতের মুঠোর মধ‍্যে নিল। ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা আননন নম্বর সেখানে জ্বলজ্বল করছে। অবশ‍্য নতুন ফোন আর নতুন সিম কার্ড নেওয়ার পর থেকে এখন সব পরিচিতদের নম্বরই রুশার ফোনে অপরিচিত হয়ে গেছে। তাই রুশা আর বিলম্ব না করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল। ওপাশ থেকে খুব পরিচিত ভারি পুরুষালি কণ্ঠে কেউ একজন বলে উঠল,

–“আর ইউ রুশানি শিকদার?”

রুশা নম্র স্বরে বলল,
–“ইয়েস।”

রুশার সম্মতি সূচক অ‍্যান্সার শুনে ওপাশের ব‍্যাক্তিটি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যেটা রুশা ফোনের এপাশ থেকেও বেশ ভালো মতোই বুঝতে পারল। লোকটা ব‍্যাতিব‍্যস্ত গলায় বলল,

–“রুশা লিসেন, আমি তোমার রুবেল স‍্যার। এত রাতে কল করার জন‍্যে আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি বেটা। আই নো ইউ আর ইনজুরড। বাট আমি অনেকটা হেল্পলেস হয়েই এই সময়ে তোমাকে কল দিতে বাধ‍্য হয়েছি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্……”

লোকটাকে পুরো কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রুশা বিনয়ি স্বরে বলল,
–“স‍্যার এতটা ফরমাল হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার যা বলার আপনি আমাকে বিনা সংকচে বলতে পারেন। আমি জানি, আপনি আমাকে যা বলবেন ভেবে চিন্তেই বলবেন।”

রুশার কথা শুনে মিঃ রুবেল নিঃশব্দে হাসলেন। ওনার পুরো ক‍্যারিয়ারে রুশার মতো এরকম অ‍সাধারন স্টুডেন্ট উনি আর একটাও দেখেন নি। মেয়েটা পড়া লেখায় যেমন ব্রিলিয়ান্ট ছিল। তেমনই প্রফেসরদের সাথে কথা বলার মাধূর্যতাও ছিল চমৎকার। মেডিকেল কলেজের এত এত স্টুডেন্টদের মধ‍্যে এই একটা মেয়ে ছিল যাকে সমস্ত প্রফেসরেরা ভিষন রকম স্নেহ করতেন। ইনফ‍্যাক্ট মেডিকেল কলেজের প্রায় ইভেন্টেই রুশাকে উপস্থাপিকার দ্বায়ীত্বটা দেওয়া হত। ওর ইংলিশের স্পিচ গুলো এতটাই দুর্দান্ত আর শ্রুতিমধুর হত যে সবাই ওর বলা প্রত‍্যেকটা শব্দ মনোমুগ্ধ হয়ে শুনত। মিঃ রুবেল ওনার ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে রুশাকে বললেন,

–“রুশানি, আমার একজন পেশেন্ট আছে। যার বয়স মোটামুটি 50+ হবে। উনি হুট করেই সন্ধ‍্যা বেলা ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। এর আগেও দু-দুইবার ওনার ছোটোখাটো স্ট্রোক হয়েছে। হয়ত এইবারের টা একটু বেশিই গুরুতর। ইমিডিয়েট ওনার ট্রিটমেন্ট করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি আউট অফ টাউন আছি। যেখানে আছি সেখান থেকে চাইলেও এখন হসপিটালে এসে পৌছাতে পারব না। আর অন‍্য কোনো নিউরোলজিস্ট কে কেসটা হ‍্যান্ডওভার করার সাহস পাচ্ছি না। যদি কাইন্ডলি তুমি পেশেন্ট টা অ‍্যাটেন্ট করতে, তাহলে আমি একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম।”

রুশা ওনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
–“ওকে স‍্যার চিন্তা করবেন না, আমি দশ মিনিটের মধ‍্যেই হসপিটালে পৌছাচ্ছি। পেশেন্ট কি এখন হসপিটালে আছে?”

–“হ‍্যাঁ। পেশেন্ট কে আই.সি.ইউ. তে রাখা হয়েছে। তুমি রিসিভশনে গিয়ে আমার কথা বলো। তাহলেই ওরা তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবে। আমি ফোন করে ওদেরকে সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছি।”

রুশা ‘ওকে’ বলে ফোনটা কেটে দিল। বইটা রকিং চেয়ারের উপর রেখে ধীরে ধীরে হেঁটে ব‍্যালকনি থেকে রুমের মধ‍্যে আসলো। খোলা চুল গুলোকে পেচিয়ে খোপার মতো করে ভালো করে ক্লিপ দিয়ে আটকে নিল। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে মিরোরে নিজের প্রতিবিম্বটার দিকে তাকিয়ে ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সাদা চ‍্যাপ্টা গজ দিয়ে কপালের পুরো অংশটা ঘুরিয়ে ব‍্যান্ডেজ করা, গলার ডান পাশে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ডান হাতের কনুইয়েও সাদা গজ দিয়ে ব‍্যান্ডেজ করা, যেটার উপর হালকা ব্লাডের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যাচ্ছে, ডান পায়ের হাঁটুতেও এরকম সেম একটা ব‍্যান্ডেজ করা আছে, যেটা আপাতত সেলোয়ারের নিচে ঢাকা পড়েছে। আসলে শান যখন রুশাকে ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিল। তখন রুশার ডান সাইড রোডের উপরে পড়েছিল। যার কারনে ডান সাইডের অংশ গুলোতে বাম সাইডের তুলনায় বেশি আঘাত লেগেছে। যদিও এই এক মাসে আঘাতের ক্ষত গুলো অনেকটা ঘুচে গেছে। কিন্তু পুরোপুরি ভাবে ঠিক হয়নি।

নিজের এমন করূন অবস্থা দেখে বিরক্ত হল রুশা। মিরোরের সামনে থেকে গটগট করে হেঁটে রেডি হতে চলে গেল। শরীরের এই ক্ষত গুলো দেখলে ওর শানের প্রতি ঘৃনাটা কেমন বেড়ে যায়। ইচ্ছে করে ওই মানুষটাকেও এভাবে আঘাত দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে। কিন্তু ‘ও’ তো সেটা কখনো করতে পারবে না। কারন একজন ডাক্তারের ধর্ম মানুষের আঘাত-ক্ষত সারিয়ে তোলা। নিজের সমস্ত বিদ‍্যা উজাড় করে দিয়ে মানুষের প্রান বাঁচানো। তাই রুশার ইচ্ছে থাকলেও ‘ও’ কখনো শানের মতো পাষাণ হতে পারবে না।
_________________________

রাত 11:15

আই.সি.ইউ’র. সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফোনে ডাক্তার রবিনের সাথে কথা বলছে শান। টেনশনে ওর হাত-পায়ের রক্ত চলাচল করা বন্ধ করে দিয়েছে। চেহারায় রাগ আর আতঙ্কের ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অপাশ থেকে ডাক্তার রবিন বিভিন্ন কথা বলে শানকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এমন ক্রিটিক‍্যাল মুহূর্তে ওনার এসব শান্তনা শোনার ধৈর্য শানের একদমই নেই। তাই শান আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিল। তারপর ব‍্যস্ত ভঙ্গিতে ফোনের নম্বরের লিস্ট ঘেটে অন‍্য নিউরোলজিস্টদের নম্বর খোজায় মন দিল। এরমধ‍্যেই ওর সাইড কাটিয়ে গায়ে এপ্রোন আর মুখে সার্জিক্যাল মাক্স লাগানো একটা মেয়ে দ্রুত গতিতে আই.সি.ইউ’র. মধ‍্যে ঢুকে পড়ল। তার পিছনে পিছনে দুজন নার্সও ভিতরে ঢুকে গেল। শান বুঝল ইনি-ই সেই ডাক্তার যার কথা মিঃ রবিন বলেছিলেন। কিন্তু এতেও যেন শান নিজেকে শান্ত করতে পারল না। চিন্তিত ভঙ্গিতে কড়িডোরের এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে লাগল।

ঘন্টা খানেক আগে শান অফিসের কাজ কর্ম শেষ করে গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরছিল। তখনই ওর বাবার অ‍্যাসিটেন্ট ওকে কল করে জানাল, ওর বাবা নাকি হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবরটা শুনে শান দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে ওর বাবার অফিসের দিকে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ওর বাবাকে চেক বুঝতে পারে ওনার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। তাই শান দেড়ি না করে ওনাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হসপিটালের উদ্দ‍্যেশে রওনা দেয়। পথে ডাক্তার রবিনকে কল করলে উনি জানায় উনি আপাতত আউট অফ টাউন আছেন। এই মুহূর্তে ওনার হসপিটালে আসা কোনো ভাবেই সম্ভব না। তবে ওনার পরিচিত ভালো একজন নিউরোলজিস্ট আছে যিনি এই কেসটা হ‍্যান্ডেল করতে পারবেন। এইটুকু বলে ডাক্তার রবিন ফোন কেটে দেন। আর শান ওর বাবাকে নিয়ে হসপিটালে এসে ওনাকে আই.সি.ইউতে. ভর্তি করে।

ডাক্তার ভিতরে গেছে প্রায় আধ ঘন্টার মতো হয়ে গেছে। এখন পযর্ন্ত ভালো-মন্দ কোনো খবর-ই ভিতর থেকে কেউ দেয়নি। শান টেনশনে এক হাত দিয়ে আরেক হাতের তালু ঘশে যাচ্ছে। আর ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে টাইম দেখে নিচ্ছে। প্রায় মিনিট পনেরো পর সৃজা আর শানের মা এসে ওখানে পৌছাল। ওদের সাথে শানের ফুপি মোহনা সিকদার, ওনার হাসবেন্ট ইমদাদ সিকদার আর ওনাদের মেয়ে আশু’ও এসেছে। ওরা এসে শানের কাছে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ওদের এর প্রশ্ন শুনে শান বিরক্ত হয়ে বলল,

–“দশ’টা মিনিট শান্তিতে একটু বোসো। তারপর আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে।”

শানের কথায় সবাই একটু দমে গেল। এরমধ‍্যেই আই.সি.ইউ’র. দরজা খুলে কেউ একজন বাইরে বের হতে হতে বলে উঠল,

–“আজকে রাত’টা আমি আমার চেম্বারেই থাকব। এখানে কোনো কমপ্লিকেশন দেখলে আমাকে ডাকবে। খবরদার নিজেদের দ্বায়ীত্বে একদম খাফেলতি করবে না। বুঝতে পেরেছো?”

শান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল এটা সেই মেয়েটা। যে একটু আগেই নার্সদের সাথে আই.সি.ইউ. তে ঢুকে ছিল। মেয়েটার কণ্ঠস্বরটা ওর কেমন চেনা চেনা লাগল। কিন্তু মুখের ম‍্যাক্সের জন‍্যে কথাগুলো একটু কেমন যেন শোনাল। তাই মেয়েটা কে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটা নার্সদের হাত থেকে একটা ফাইল হাতে নিয়ে সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে শানদের সামনে এসে দাড়াল। শান, সৃজা, আশু সহ বাকিরা সবাই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা কপালে ভাজ ফেলে ফাইলটা বন্ধ করে এক টান দিয়ে মুখের মাক্স টা খুলে ফেলল। সামনে রুশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে শান থম মেরে গেল। সৃজা ছাড়া বাকিরা সবাই ভুত দেখার মতো করে গোল গোল চোখে রুশার দিকে তাকাল। রুশা সেসবে বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে শানের দিকে তাকিয়ে বলল,

–“টেনশনের কিছু নেই, আপাতত উনি কিছুটা ঠিকঠাক আছেন। কালকে সকালে ওনার কিছু টেস্ট করাতে হবে। রিপোর্ট আসলে এরপর আমরা অন‍্যান‍্য ট্রিটমেন্ট গুলো শুরু করতে পারব। আশাকরি এরমধ‍্যে রবিন স‍্যারও চলে আসবেন।”

রুশার কথার প্রতিউত্তরে শান কিছু বলল না। শুধু নিঃস্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে রইল। সৃজা এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল,

–“ওহ আচ্ছা, তারমানে তুমি ডাক্তার? তাই ত তোমাকে দেখতে এতটা সুইট। কিন্তু তুমি সেদিন ওই গব্বার সিংয়ের বাসায় কি করছিলে?”

রুশা ভালো করেই বুঝতে পারছে সৃজা আয়াশকে গব্বার সিং বলছে। তাই ‘ও’ ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

–“আমি তোমার ওই গব্বার সিংয়ের পার্সনাল ডাক্তার। তাই ওনার ট্রিটমেন্ট করতে গিয়েছিলাম।”

রুশার কথা শুনে সৃজা ওর দিকে একটু এগিয়ে এসে ওর কানের কাছে ফিশফিশ করে বলল,
–“তোমার ট্রিটমেন্টে ওনার কিছুই হবে না আপু। তুমি বরং ওই পাগল লোকটাকে পাবনা মানষিক হসপিটালে পাঠিয়ে দেও। ওটাই ওনার জন‍্যে বেস্ট জায়গা। পারলে ওনার গফটাকেও পাঠিয়ে দিও। দুজন মিলে ওখানে গিয়ে নেচে, গান গেয়ে সবাইকে এন্টেটেইনমেন্ট করতে পারবে।”

সৃজার কথা শুনে রুশার পেট ফেটে হাসি আসলো। ‘ও’ কোনো রকম ঠোঁট চেপে নিজের হাসি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে লাগল। এরমধ‍্যেই ইমদাদ সিকদার এগিয়ে এসে রুশার ডান হাতের কনুই চেপে ধরে ওকে নিজের দিকে ঘোরাল। তারপর চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

–“এটাই তাহলে তোমার আর তোমার দাদুর ক‍্যালিফোর্নিয়া? এতগুলো বছর ধরে সবাইকে মিথ‍্যা বলে ঠকাতে লজ্জা করল না?”

ইমদাদ সিকদারের কথা শুনে শান আর সৃজা দুজনেই অবাক হল। রুশা ঝাড়া মেরে ওনার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর কঠিন গলায় ইমদাদ সিকদারকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,

–“বিহেব ইউর সেলফ মিঃ সিকদার। এটা আপনার বাড়ি না, এটা হসপিটাল। আর আমি আপনার বেতন ভুক্ত কোনো কর্মচারী না যে আমার সাথে আপনি উঁচু গলায় কথা বলবেন। আমি এই হসপিটালের একজন রেপুটেড ডাক্তার। সো, যদি এখানের ডাক্তারদের রেসপেক্ট করতে না পারেন, তাহলে এখান থেকে চলে যেতে পারেন। গেট খোলাই আছে।”

নিজের মেয়ের মুখে এরকম কথা শুনে ইমদাদ সিকদার হতবাক হয়ে গেলেন। মোহনা সিকদার এগিয়ে এসে রুশাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললেন,

–“এটা তুমি কীভাবে কথা বলছো রুশা? আমাকে সম্মান করতে নাহয় নাই বা পারলে। অন্তত নিজের বাবার সাথে তো একটু ভালো ভাবে কথা বলতে পারো। না-কি সেটাও পারো না?”

রুশা মোহনা সিকদারের দিকে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে বলল,
–“যাস্ট শাটআপ ওকে? এই মুহূর্তে আমি আপনাদের কারো সাথেই কথা বলতে ইন্টারেস্টেড নই। আমি আমার ডিউটি করতে এসেছিলাম। কাজ শেষ এখন এখান থেকে চলে যাব। তাই গায়ে পড়ে আপনারা কেউ আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না প্লিজ। কারন আমি মুখ খুললে ব‍্যাপারটা আপনাদের জন‍্যে মোটেও শোভনীয় হবে না।”

কথাটা বলে রুশা ফাইলের মধ‍্যে থেকে একটা কাগজ বের করে শানের দিকে বাড়িয়ে দিল। আর বলল,

–“যেই মেডিসিন গুলোর নাম লেখা আছে, ওইগুলো ইমিডিয়েটলি নিয়ে এসে নার্সদের কাছে দিন। আমি চেম্বারেই আছি। কোনো প্রবলেম হলে আমাকে জানাবেন।”

শান কাগজটা ধরতেই রুশা হনহন করে হেঁটে ওখান থেকে চলে গেল। শান থ হয়ে দাড়িয়ে আছে। পরপর এতগুলো শকড খেয়ে ‘ও’ কোনো রকম রিয়‍্যাক্ট করাই ভুলে গেছে।
_________________________

রাত প্রায় একটার কাছাকাছি। রুশা নিজের চেম্বারে বসে বসে কফি খাচ্ছে। ভেবেছিল অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার করে বাসায় বসেই ডিনার করবে। কিন্তু ইমার্জেন্সি এখানে চলে আসায় সেটা আর হল না। তাই স্টাফ কে দিয়ে কফি আনিয়ে আপাতত এটা দিয়েই নিজের ক্ষিদে নিবারন করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রুশার চেম্বারের দরজায় নক পড়ল। রুশা দরজার দিকে না তাকিয়েই ওপাশের ব‍্যাক্তিটাকে ভিতরে আসতে বলল। ওর সম্মতি পেয়ে একটা অবয়ব ভিতরে ঢুকল। রুশা ভ্রু কুচকে সামনে তাকিয়ে দেখল শান দাড়িয়ে আছে। সব সময়ের মতোই চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব। রুশা ধারাল দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে বলল,

–“কিছু বলবেন? বলার থাকলে বলুন। নাহলে আসতে পারেন।”

শান গলা খ‍্যাকানি দিয়ে নিজের প‍্যান্টের পকেটে দু-হাত গুজে একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে রুশা সামনে দাড়াল। রুশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে রইল। শান রুশার মুখোমুখি থাকা টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বলল,

–“এত বড় একটা অ‍্যাক্সিডেন্টের পরেও বেঁচে আছেন দেখছি। আমি তো ভেবেছিলাম এতদিনে আপনার আত্মারা পৃথিবীর বাউন্ডারি ক্রস করে অন‍্য গ্রহে এলিয়েনদের সাথে দেখা করতে চলে গেছে।”

রুশা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“আমার আত্মারা অন‍্য গ্রহে চলে গেলে আপনি নিশ্চয়ই অনেক খুশী হতেন। কিন্তু আপসোস, আমি আপনাকে সেই খুশীটা দিতে পারলাম না।”

শান সিরিয়াস ফেস করে বলল,
–“আরেহ কোনো ব‍্যাপার না। একটা চান্স মিস হয়েছে তো কি হয়েছে? পরের বার আমাকে খুশী করার সুযোগ আমি আপনাকে অবশ‍্যই দিব।”

শানের কথা শুনে রুশার গা জ্বলে উঠল। ‘ও’ শানের দিকে তাকিয়ে রাগে ফোস ফোস করতে লাগল। শান মনে মনে হাসল। রুশা বসা থেকে দাড়িয়ে দরজার দিকে হাত উঠিয়ে রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল,

–“আমার চোখের সামনে থেকে এক্ষুনি বের হয়ে যান প্লিজ। নাহলে আমি যে আপনাকে কি করব আমি সেটা নিজেও জানি না।”

রুশাকে এতটা রেগে যেতে দেখে শান বেশ মজা পেল। ‘ও’ রুশাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে রুশার হাত ধরে টেনে এনে ওকে একদম নিজের বুকের উপর ফেলল। তারপর রুশার কোমরে দু-হাত রেখে ওকে নিজের সাথে পেচিয়ে ধরে বলল,

–“চলে যেতে আসিনি ডাক্তার সাহেবা। আপনি আমার কি করবেন সেটা দেখতে এসেছি।”

রুশা শানের বুকে ওর দু-হাত ঠেকিয়ে শানকে থাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ‘ও’ যত শানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে, শান তত ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। রুশা এবার মাত্রাতিরিক্ত রেগে গিয়ে শানের জ‍্যাকেটের কলার চেপে ধরে বলল,

–“আমাকে যদি অন‍্যান‍্য মেয়েদের মতো দূর্বল ভেবে থাকেন তাহলে ভুল করবেন মিঃ রায়জাদা। আমি কিন্তু মোটেও দূর্বল প্রকৃতির মেয়ে না। ভালোয় ভালোয় আমাকে ছাড়ুন বলছি, নাহলে আপনার নাক ফাটাতে আমার বেশি সময় লাগবে না।”

রুশার কথা শেষ হতেই শান রুশার কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিল। রুশা ভাবল, শান ওর হুমকি শুনে ভয় পেয়ে হাতটা সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওকে সম্পূর্ন ভুল প্রমানিত করে শান নিজের দু-হাত দিয়ে খপ করে রুশার দু-হাত চেপে ধরল। তারপর রুশার হাত দুটোকে মুচড়ে ধরে ওর পিছনে নিয়ে পিঠের সাথে আলত করে চেপে ধরল। হাতে চাপ লাগায় রুশা ব‍্যাথায় চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। শান আবারও রুশাকে হেচকা টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,

–“অন‍্যদের মতো দূর্বল না বলেই তো আপনাকে শান রায়জাদা চুজ করেছে। কিন্তু তাই বলে আমাকে আপনার শক্তি দেখাতে আসবেন না। কজ আপনার মতো শুকনো ডালকে আমি মিনিটের মধ‍্যে মাথায় তুলে একশো টা আছাড় দিয়ে আবার মাটিতে ফেলে দিতে পারি। বুঝেছেন মিসেস রায়জাদা?”

শানের মুখে আবারও “মিসেস রায়জাদা” শব্দ টা শুনে রুশা চমকে উঠে শানের দিকে তাকাল। শানের ঠোঁটের কোনে ঝুলে আছে অদ্ভুত এক হাসি। যেই হাসির দিকে তাকিয়ে রুশা নিজের কয়েকটা হার্টবিট মিস করে ফেলল। মুহূর্তের মধ‍্যে ওর হাত-পা গুলোও জমে কেমন বরফের ন‍্যায় হয়ে গেল। শানের বলা এই একটা শব্দ শুনলেই রুশার মনের মধ‍্যে ভীতি কাজ করে। সেকেন্ডের ব‍্যাবধানে ওর মস্তিষ্ক ওকে আতঙ্কগ্রস্ত বানিয়ে দেয়।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here