অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব -২০

#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ20

রাত 11:15

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর টা নিয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে আশু। নিচে ডিনার করার জন‍্যে গিয়েছিল। কিন্তু মুখে এক লোকমা খাবার দিয়ে তারপর আর দিতে পারেনি। গলা দিয়ে খাবার নামেনি ওর। কান্নারা বারবার ওর গলায় এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। না চাইতেও চোখের পাপড়ি গুলো বারবার ভিজে যাচ্ছে। কালকে কি হবে সেটা জানে না আশু। তবে যাই হবে তাতে ওর উপর দিয়ে যে বড় সড় একটা ঝড় যাবে সেটা ‘ও’ ভালোই উপলব্দি করতে পারছে।

কড়িডোর দিয়ে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার সময় মোহনা সিক‍দার ওনার রুমের দরজায় দাড়িয়ে আশুকে ডাক দিলেন। আশু দূর্বল চোখে পিছনে ঘুরে ওর মায়ের দিকে একবার তাকাল। তারপর বিনা-বাক‍্যে ধীর পাঁয়ে এগিয়ে গেল মোহনা সিকদারের রুমের দিকে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম আশুর দৃষ্টি গেল বেডের দিকে। বেডের উপর অনেকগুলো জুয়েলারি বক্স রাখা। যার মধ‍্যে বিভিন্ন ডিজাইনের সব গোল্ড জুয়েলারি রাখা রয়েছে। আশু জুয়েলারি গুলোর দিকে এক নজর তাকিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকাল। মোহনা সিকদার বেশ খোশমেজাজে বললেন,

–“দেখো ত আশু, জুয়েলারি গুলো তোমার পছন্দ হয় কিনা। এইগুলো আমি সব নিজে পছন্দ করে তোমার জন‍্যে কিনেছি।”

আশু কপাল কুঞ্চিত করে বলল,
–“আমার জন‍্যে কিনেছো মানে? আমি এইগুলো দিয়ে কি করব?”

মোহনা সিকদার বললেন,
–“কি আবার করবে? বিয়ের পর হৃদানদের বাড়িতে গিয়ে একেক দিন একেকটা করে পড়বে। ওদেরকে দেখাবে তোমার বাবা-মা তোমাকে স্বর্ন দিয়ে মুড়িয়ে তারপর তোমাকে তোমার শশুর বাড়িতে পাঠিয়েছেন।”

মোহনা সিকদারের কথায় আশু তাচ্ছিল‍্য হাঁসল। ওর চোখে মুখে বিদ্রুপের ছাপ ফুটে উঠল। ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল‍্য হাঁসিটুকু বজায় রেখেই আশু বলে উঠল,

–“তুমি বোধহয় বারবার একটা কথা ভুলে যাও আম্মু, আমার বাবা আমাকে ছোট বেলায়-ই ছেড়ে চলে গেছে।”

মেয়ের কথায় মোহনা সিকদার ক্ষিপ্ত হলেন। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষ্ট করে বললেন,
–“আমি ইমদাদের কথা বলেছি আশু। তুমি ভুলে যেও না, উনি কিন্তু তোমার পাপা।”

মোহনা সিকদারের কথা শেষ হতেই আশু অগ্নিশর্মা হয়ে ওনার দিয়ে তাকাল। রাগে ফোশফোশ করতে করতে খানিকটা উচ্চ স্বরে বলল,

–“ওনাকে আমি পাপা বলে ডাকি, কিন্তু উনি আমার বাবা নন। তুমি কেন বারবার ওনাকে আমার বাবা বলো? তুমি কেন জোর করে আমাকে ওনার মেয়ে বানাতে চাও?”

মোহনা সিকদার এগিয়ে এসে এক হাত দিয়ে আশুর হাতের বাহু চেপে ধরে রাগি কণ্ঠে বলল,
–“কারন এটাই সত‍্যি!”

আশু ঝাড়া মেরে মোহনা সিকদারের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর ছিটকে ওনার থেকে এক হাত দূরে গিয়ে বলল,

–“না, এটা সত‍্যি না।সবচেয়ে বড় স‍ত‍্যি হল, ইমদাদ সিকদারের একটাই মেয়ে। যার নাম রুশানি সিকদার। তুমি হাজার চেষ্টা করলেও এই সত‍্যি টা কখনো বদলাতে পারবে না। আর না কখনো আমাকে রুশানির জায়গায় বসাতে পারবে।”

মোহনা সিকদার বিদ্রুপের হাসি হেঁসে বলল,
–“আমার তোমাকে রুশানির জায়গায় বসানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ইমদাদ অনেক আগেই তোমাকে রুশানির জায়গাটা দিয়ে দিয়েছে। ‘ও’ তোমাকে রুশানির থেকেও বেশি ভালোবাসে।”

আশু শব্দ করে হাঁসল। কটাক্ষের স্বরে বলল,
–“এত বছর সংসার করার পরেও তুমি পাপাকে বিন্দুমাত্রও চিনতে পারোনি আম্মু। তুমি জানোই না, রুশানি পাপার প্রান-ভোমরা। পাপা আমাকে যতটা না ভালোবাসে, তারথেকে হাজার গুন বেশি উনি রুশানি কে ভালোবাসে। রুশানি ওনার ঠিক কতোটা আদরের সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তাই অহেতুক আমাকে রুশানির জায়গায় বসানোর লেইম ট্রিক্স টা বন্ধ করো।”

মোহনা সিকদার তৈলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। উনি ভালো করেই জানেন আশুর একটা কথাও ভুল না। কিন্তু এসব কথা ত রুশানিকে জানতে দেওয়া যাবে না। আর না ইমদাদ সিকদারের কঠিন মনটা রুশানির প্রতি সদয় হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে। মোহনা সিকদার এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আশুর দিকে তাকালেন। তারপর ক্রোধ নিয়ে চাপা স্বরে আশুকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললেন,

–“খবরদার আশু, একদম উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবে না। ওই রুশানি ইমদাদের কেউ না। ওই মেয়ের, এই বাড়ির উপর, এই বাড়ির মানুষদের উপর, কোনো অধিকার নেই। তুমি এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সত‍্যি। যত তাড়াতাড়ি এই সত‍্যিটা তুমি মেনে নিবে, ততই তোমার জন‍্যে ভালো হবে।”

মোহনা সিকদারের শাসানোতে কেন যেন আশু আজকে বিন্দুমাত্রও ভয় পেল না। ‘ও’ নির্দিধায় মোহনা সিকদারের চোখে চোখ রেখে বলল,

–“রুশানি এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে। ইমদাদ সিকদারের প্রোপার্টি আর ইমদাদ সিকদারের স্নেহ-ভালোবাসার একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছে রুশানি সিকদার। তুমি যত চেষ্টাই করো না কেন, এই সত‍্যিটা কোনোদিন তুমি চেইঞ্জ করতে পারবে না। আর এই সমস্ত সম্পত্তি তোমার একা ভোগ করার যেই সাধ, সেই সাধ তোমার জীবনেও পূরন হবে না।”

মোহনা সিকদার জ্বলন্ত চোখে আশুর দিকে তাকাল। আশু সেসবে তোয়াক্কা না করে বলল,

–“আর এই যে তুমি কাড়ি কাড়ি গয়না বানিয়েছো, এইগুলো তুমি তোমার কাছেই রেখে দেও। আমার এসবে কোনো লোভ নেই। আমার এসব চাইও না। যাকে মন থেকে চাইলাম তাকে ত তুমি পেতে দিলে না। তোমার মেয়ের খুশী ত তোমার সহ‍্য হল না। বিয়ের দুইদিন পর তোমার মেয়ের লাশটা যখন এই বাড়িতে আসবে, তখন নাহয় তুমি এই সব গয়না গুলো পড়ে নিজের জিত সেলিব্রেশন কোরো।”

কথাটা বলে আশু চলে যেতে নিল। মোহনা সিকদার দ্রুত এসে আশুর হাত ধরে টেনে ওকে নিজের সামনে দাড় করাল। তারপর ওর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

–“কি প্লান ঘুরছে তোমার মাথায়? বাই এ‍্যানি চান্স তুমি কি বিয়ের পর সুইসাইড করার প্লান করছো না-কি আশু? খবরদার এই কাজ……”

মোহনা সিকদার পুরো কথাটা শেষ করতে পারলেন না। আশুর অশ্রুসিক্ত অদ্ভুত চাহনির দিকে তাকিয়ে উনি থেমে গেলেন। আশু মোহনা সিকদারের দিকে ঘৃনাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলে উঠল,

–“বাঁচলে আশিষের বউয়ের পরিচয়েই বাঁচব। আর নাহলে হৃদানের বাড়ির এক দরজা দিয়ে ওরা আমাকে ভিতরে ঢোকাবে, আর অন‍্য দরজা দিয়ে আমার লা’শ বাইরে বের করবে।”

আশুর কথায় মোহনা সিকদার থম মেরে দাড়িয়ে রইলেন। আশু দৌড়ে ওই রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।

হৃদানের সাথে আশুর বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছিল তখনই আশু ওর মাকে আশিষের ব‍্যাপারে সবটা জানিয়েছিল। সব শুনে মোহনা সিকদার আশুকে শাসিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, আশিষের ব‍্যাপারে আশু যদি কাউকে জানায়, তাহলে উনি আশুকে মে’রে ফেলবেন। ওনার এসব কথা শুনে আশু মোটেও ভয় পায়নি। ‘ও’ তাও সবাইকে সবটা জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু মোহনা সিকদার অবস্থা বেগতিক দেখে, আশুকে ওনার মৃত‍্যুর ভয় দেখান। বলেন, আশু আশিষ কে যদি ভুলে না যায়, আর হৃদানকে যদি বিয়ে না করে, তাহলে উনি বি’ষ খাবেন। মায়ের ব্লাকমেইলে আশু ভয় পেয়ে যায়। তাও হৃদানকে সবটা বুঝিয়ে বলে আশু শেষ বারের মতো বিয়েটা ভাঙার একটা ট্রাই করেছিল। কিন্তু হৃদানও ওর মায়ের মতোই স্বার্থপর-লোভি টাইপ মানুষ। যে নিজের বিজনেস আর প্রোফিট ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।

আশু কয়েকবার আশিষের ব‍্যাপারে শানকে জানাতে গিয়েছিল। কিন্তু কিচ্ছু জানাতে পারেনি। ঠিক সময়ে এসে মোহনা সিকদার ওকে আটকে দিয়েছে। ইনফ‍্যাক্ট সবার অগোচরে ওর গায়েও কয়েকবার হাত তুলেছে। মায়ের এমন ব‍্যাবহারে আশু মোটেও আশ্চর্য হয়নি। ‘ও’ ভালো করেই জানে, ওর মা নিজের কার্যসিদ্ধি হাসিল করার জন‍্যে যা খুশী তাই করতে পারে। এই যেমন, আশু ছোট বেলায় ইমদাদ সিকদারকে আংকেল বলে ডাকত। কিন্তু মোহনা সিকদার সব সময় ওকে পাপা ডাকতে বলত। আংকেলকে পাপা ডাকাটা নরমাল বিষয়, সেটা আশু জানত। কিন্তু কাউকে এত দিন ধরে একটা নামে ডাকার পর, হুট করেই তাকে অন‍্য নামে ডাকাটা আশুর জন‍্যে বেশ মুশকিল ছিল। তাই ‘ও’ ইমদাদ সিকদারকে আংকেল ডাকাটাই শ্রেয় মনে করল। কিন্তু এই সামান‍্য বিষয়টা নিয়েও মোহনা সিকদার অ‍্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছিলেন। একদিন রুম আটকে আশুকে ইচ্ছে মতো মেরেছিলেন। আর ইমদাদ সিকদারকে আংকেল যাতে না ডাকে সেইজন‍্যে আশুকে শাসিয়েও ছিলেন। তারপর থেকে আশু ভয়ে বাধ‍্য হয়ে ইমদাদ সিকদারকে পাপা ডাকা শুরু করেছিল। এতে ইমদাদ সিকাদারের কোনো প্রবলেম না থাকলেও ওনার বোনেরা বেশ ক্ষিপ্ত হয়েছিল। সবাই আশুকে বলেছিল, ‘এই মেয়েটা প্রথমে এই বাড়িতে এসে রুশাকে বাড়ি ছাড়া করেছে, আর এখন ইমদাদকে পাপা ডেকে রুশার জায়গাটা দখল করতে চাইছে।’

মায়ের নির্মমতায় আর চারপাশের মানুষের টিটকারি-খোচামূলক কথায় ভয়ে শিটিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় আশু প্রচন্ড ভিতু একটা মানুষে পরিনত হয়েছে। ‘ও’ এতটাই ভিতু হয়ে গেছে যে, কেউ ওকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে ‘ও’ এখন সেটার প্রতিবাদ অবদি করতে পারে না। বরং মাথা নিচু করে চুপচাপ সবটা মেনে নেয়।
_________________________

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই রুশা গিয়ে ব‍্যালকনিতে দাড়াল। বাইরের দিকে ওর দৃষ্টি যেতেই ‘ও’ খানিকটা অবাক হল। গার্ডেন এড়িয়ার পুরোটা জুড়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন‍্যে ডেকোরেটরেশন করা হয়েছে। রুশা গতকাল রাতে যখন ঘুমাতে যাচ্ছিল, তখন ‘ও’ ডেকোরেটরের লোকদের কাজ করতে দেখেছে। ওই সময় ‘ও’ ভেবেছিল ওরা সবাই বিয়ের স্টেজ আর বিয়েতে আসা লোকদের খাবার-দাবারের জন‍্যে ডেকোরেটরেশন গুলো করছে। কিন্তু এখন ত দেখছে এখানে বিয়ের স্টেজের কোনো নাম গন্ধও নেই। যতদূর চোখ যাচ্ছে তাতে সব জায়গায় শুধু কাচা ফুলের সাজ। যেটা সাধারণত গায়ে হলুদের থিমের সাথে মিলিয়ে করা হয়েছে। রুশা চিন্তায় পড়ে গেল। একবার ভাবল গায়ে হলুদ শেষ হওয়ার পর হয়ত এইগুলো খুলে নতুন করে ডেকোরেট করে বিয়ের জন‍্যে স্টেজ সাজানো হবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ওর মাথায় চিন্তা এলো যে গায়ে হলুদর পর যতটুকু সময় থাকবে, তাতে এত কম সময়ে এত বড় অ‍্যারেঞ্জমেন্ট করা কিছুতেই সম্ভব না। তাহলে বিয়ের অনুষ্ঠান টা হবে কোথায় বসে? আনমনে কথাটা ভাবতে ভাবতে রুশা রুমে চলে এলো।

দরজায় নক পড়ার শব্দে রুশার হুশ আসলো। ‘ও’ চেয়ারের উপরে ঝুলিয়ে রাখা ওড়নাটা হাতে নিয়ে নাইট গাউনের উপরেই ওড়নাটা গলার সাথে পেচিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই সৃজা তড়িঘড়ি করে রুমের মধ‍্যে ঢুকে রুশাকে সাইড করে দরজার লকটা আটকে দিল। রুশা ভ্রু কুচকে সৃজার দিকে তাকাল। সৃজা ব‍্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বেডের উপর আসন দিয়ে বসে পড়ল। রুশা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সৃজা হতাশ কণ্ঠে বলল,

–“সব শেষ আপু। ভাইয়া আমাদের প্লানের পুরো তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে ভাইয়া এভাবে আমাদের হাতে বাশ ধরিয়ে দিবে ভাবিনি।”

সৃজার কথায় রুশার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ‘ও’ কপাল কুচকে বলল,
–“কি হয়েছে?”

সৃজা অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
–“বিয়েটা এই বাড়িতে হবে না আপু। পাশেই একটা কমিউনিটি সেন্টার আছে বিয়ের সব ব‍্যবস্থা সেখানে করা হয়েছে। গায়ে হলুদের পর আশু আপুকে এই বাড়ি থেকে সাজিয়ে সোজা সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।”

রুশা ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
–“তাহলে সেখানে বসেই নাহয় যা করার করব।”

–“নো চান্স আপু। ভাইয়া সেখানে কড়া সিকিউরিটির ব‍্যবস্থা করেছে। সামনে-পিছনে সব জায়গায় সিকিউরিটি গার্ডরা থাকবে। বাইরের লোক ওখানে কোনো ভাবেই এলাউ করা হবে না। ইনফ‍্যাক্ট যাদের ইনভাইট করা হয়েছে তাদেরকেও চেকিং করে ওখানে ঢোকানো হবে।”

সব শুনে রুশার কপালেও এবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ‘ও’ একটা চেয়ার টেনে সৃজার মুখোমুখি হয়ে চেয়ারটার উপরে বসে পড়ল। তারপর থমথমে মুখে বলল,

–“অদ্ভুত, বিয়েতে এমন চেকিং ফেকিংয়ের কি প্রয়োজন আছে, আমি ত সেটাই বুঝতে পারছি না। শান হঠাৎ-হঠাৎ করে কেন এরকম নিজের প্লান গুলো চেইঞ্জ করে ফেলছে?”

সৃজা বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলল,
–“এইগুলো ফুপ্পির কাজ। ফুপ্পি ত আশু আপু আর আশিষ ভাইয়ার রিলেশনের ব‍্যাপারে জানে। তাই ইচ্ছে করে শান ভাইয়াকে ভুজুম-ভাজুম বুঝিয়ে এসব করাচ্ছে। যাতে আশু আপু বা আশিষ ভাইয়া বিয়েতে কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট করতে না পারে। আর শান ভাইয়াও যাতে ওদের রিলেশনের ব‍্যাপারে কিছু জানতে না পারে। সেইজন‍্যে হঠাৎ-হঠাৎ সবকিছুর প্লান করে ভালোয় ভালোয় বিয়েটা সম্পূর্ণ করতে চাইছে।”

সৃজার কথা শুনে রুশা বেশ ভালো করেই আন্দাজ করতে পারছে আড়াল থেকে এইসব কিছুর কলকাঠি মোহনা সিকদার নাড়ছে। রুশা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মনে-মনে একে একে সবকিছুর ছক কষে ফেলল। তারপর লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে সৃজাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“তুমি এখানে বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সৃজা চিন্তিত মুখ করে রুশার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“কিন্তু আপু এই বিয়েটার কি হবে?”

রুশা সৃজাকে আশ্বস্ত করে বলল,
–“আমরা যেভাবে সবটা প্লান করেছিলাম। সবকিছু সেভাবেই হবে। একটু ধৈর্য ধরো শুধু।”

কথাটা বলে রুশা গলায় থাকা ওড়নাটা চেয়ারের উপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। সৃজা রুশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় মনোযোগী হল।
_________________________
রুশা ব্রাশ করতে করতে টেনশনে ওয়াশরুমে বসেই পায়চারি করছিল। হঠাৎ অসাবধানতা-বশত ফ্লোরে পড়ে থাকা পানিতে ওর পাঁ টা পিচলে যায়। আচমকা এমনটা হওয়ায় ‘ও’ পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন‍্যে শাওয়ার ট‍্যাপের অন-অফ সুইচ ধরে ফেলে। হাতের চাপ লেগে সাথে সাথে শাওয়ার ট‍্যাপ অন হয়ে রুশার গায়ে ঝড়ঝড় করে পানি পড়া শুরু করে। রুশা কোনোরকম ভাবে পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেলেও ওর শরীরের প্রায় 70% ভিজে গেছে। ‘ও’ দ্রুত ট‍্যাপটা অফ করে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রুশার বিরক্তির মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল। ‘ও’ রাগি দৃষ্টিতে সামনের বেডের উপরে পাঁ ঝুলিয়ে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকাল। সামনের ব‍্যাক্তিটি এক দৃষ্টিতে রুশার দিকেই তাকিয়ে আছে। রুশা এগিয়ে এসে চেয়ারের উপর থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়ে আবারও নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপর খিটখিটে মেজাজে সামনে থাকা ব‍্যাক্তিটিকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,

–“আপনার লজ্জা নেই, তাইনা? কালকে আমার রুমে ঢোকার জন‍্যে আমি আপনাকে এতকিছু বললাম। অথচ তারপরেও আপনি আজকে আবারও আমার পারমিশন ছাড়া আমার রুমে ঢুকেছেন?”

রুশার কথায় শানের কোনো ভাবান্তর হল না। ‘ও’ পলকহীন দৃষ্টিতে রুশার দিকেই তাকিয়ে রইল। শানকে এভাবে তাকাতে দেখে রুশা নিজের দিকে তাকাল। নাইট গাউনটা ভিজে ওর শরীরের সাথে একদম লেপ্টে আছে। গাউনের উপর থেকে যেই ওড়নাটা গায়ে জড়িয়েছিল, সেই ওড়নাটা জরজেট হওয়ায় গাউনের পানিতে ওড়নাটাও ভিজে একদম চুবচুবে হয়ে গেছে। গাউনের উপর থেকে ওর শরীরের প্রত‍্যেকটা ভাঁজ একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুশা শানের দিকে একবার তাকিয়ে অন‍্যদিকে ঘুরে নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। তারপর ওড়নাটা সামনের দিকে একটু টেনে নিজেকে কভার করার ব‍্যর্থ চেষ্টা করে শানকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে কম্পিত স্বরে বলল,
–“শান, প-প্লিজ গেট আউট ফ-ফ্রম মাই রুম।”

রুশার কথার প্রতিউত্তরে পিছন থেকে কোনো রেসপন্স আসছে না দেখে রুশা ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনে তাকাল। পিছনে তাকাতেই দেখল শান একদম ওর কাছেই দাড়িয়ে আছে। শানকে এতটা কাছে দেখে রুশা চমকে বেশ অনেকটা পিছিয়ে গেল। ওর পিঠ গিয়ে ঠেকল কাবার্ডের সাথে। ‘ও’ সেখান থেকে সরে যেতে যাবে তার আগেই শান এসে রুশার দু-পাশ দিয়ে কাবার্ডের উপরে হাত রাখল। রুশা আশেপাশে তাকিয়ে শানের থেকে পালানোর পথ খুঁজতে লাগল। শান একটু একটু করে নিজের ঠোঁট জোড়া রুশার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে রুশা একটু নিচু হয়ে শানের হাতের নিচের ফাঁকা অংশ দিয়ে বেড়িয়ে এলো। শান বিরক্ত হয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফোশ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। রুশা আশেপাশে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিল। শান হাত বাড়িয়ে রুশাকে ধরার চেষ্টা করতেই রুশার ওড়না খুলে ওর হাতে চলে আসলো। ‘ও’ ওড়নাটাকে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে দ্রুত পায়ে রুশার দিকে এগিয়ে গেল। রুশা ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে শান এসে ওর হাতের বাহু চেপে ধরে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বেডের উপরে ছুড়ে মারল। শানের এরূপ কান্ডে রুশা হকচকিয়ে উঠে বসে পড়ল। আবারও পালানোর জন‍্যে প্রস্তুত হয়ে বেড থেকে উঠে দাড়াল। রুশার এমন ছোটাছুটি দেখে শানের বিরক্তির মাত্রাটা বেড়ে গেল। ‘ও’ রেগে রুশার নাইট গাউনের উপরের পার্ট’টাতে কোমড়ের অংশে যেই ফিতে’টা বাধা থাকে সেই ফিতে’টাকে একটান দিয়ে খুলে ফেলল। শানের এমন কান্ডে রুশা হতবম্ভ হয়ে গেল। নিচের স্লিভলেস শর্ট গাউনটা বের হওয়ার আগেই রুশা নিজের দু-হাত দিয়ে উপরের লং গাউনের কোমড়ের অংশ আর বুকের অংশটা চেপে ধরল। শান এগিয়ে এসে রুশার কোমড়ে এক হাত রেখে ওকে টেনে নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিল। রুশা জ্বলন্ত চোখে শানের দিকে তাকাল। শান কঠিন গলায় বলল,

–“ট্রাস্ট মি. তোমার সাথে রুড হওয়ার আমার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই। আমি ত তোমাকে ইমপ্রেস করতে চাই। কিন্তু তুমি বারবার আমাকে রুড হতে বাধ‍্য করো। এসেছিলাম তোমাকে হলুদের অনুষ্ঠানের জন‍্যে ড্রেস দিতে। কিন্তু তুমি আমাকে তোমার সাথে অসভ‍্যতা করতে বাধ‍্য করলে।”

রুশা অগ্নি দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“গতকাল আপনার ক‍্যারেক্টার নিয়ে উল্টাপাল্টা বলার পর আমার ভিষণ গিলটি ফিল হচ্ছিল। কিন্তু আজকে আমি বলতে বাধ‍্য হচ্ছি, আপনি আসলেই একটা ক‍্যারেক্টারলেস, ছ‍্যাচরা এবং অত‍্যন্ত অসভ‍্য টাইপ একটা ছেলে।”

শান চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
–“রিয়েলি?”

–“ইয়াহ, আপনার মতো খারাপ আর জঘন‍্য ব‍্যাক্তিত্বের মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি।”

রুশা কথাটা বলার সাথে সাথে শান রুশার ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দিয়ে ওকে রুডলি কিস করতে লাগল। রুশা ছটফটিয়ে শানের থেকে দূরে সরার চেষ্টা করল। কিন্তু শান ওকে শক্ত হাতে নিজের সাথে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পর শান রুশার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে রুশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রুশা চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। ওর হৃদস্পদন খুব দ্রুত উঠা-নামা করছে। শান শান্ত কিন্তু দাম্ভিক স্বরে রুশাকে উদ্দ‍েশ‍্য করে বলল,

–“কি যেন বলছিলে একটু আগে? আবার বলো।”

রুশা কিছু বলল না। শক্ত হয়ে আগের মতোই চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রইল। শান রুশাকে আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠল। ‘ও’ রুশাকে ছেড়ে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল। তারপর ওপাশের ব‍্যাক্তিটির কথা শুনে রাগি গলায় ইংলিশে বিশ্রি কিছু গালি দিয়ে ফোনটা কেটে দিল। শানের বলা গালিগুলো শুনে রুশার কানের মধ‍্যে ঝিম ধরে গেল। ‘ও’ কপাল কুচকে শানের দিকে তাকিয়ে রইল। শান ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেডের সাইডে রাখা একটা ব‍্যাগের দিকে ইশারা করে বলল,

–“ওই ব‍্যাগটার মধ‍্যে আম্মু তোমার জন‍্যে হলুদে পড়ার ড্রেস আর জুয়েলারি পাঠিয়েছে। যদি হলুদের অনুষ্ঠান এটেন্ড করতে চাও, তাহলে ওইগুলো পড়েই বাইরে এসো। আর যদি অন‍্য কোনো ড্রেস পড়ে বাইরে আসার কথা ভাবো, তাহলে আমি বলব তোমার এই রুম থেকে আজকে বের না হওয়াটাই শ্রেয়। কজ অন‍্য কোনো ড্রেস পড়ে বের হলে আজকে সেই ড্রেস-সহ আমি তোমার গায়ে আ’গু’ন লাগিয়ে দেব।”

কথাটা বলে শান দরজা খুলে গটগট করে বের হয়ে গেল। রুশা শানকে উল্টাপাল্টা কয়েকটা গালি দিয়ে মনে মনে সৃজাকেও কয়েকটা গালি দিল। মেয়েটা হুটহাট লাফাতে লাফাতে ওর রুমে চলে আসে। আর ওকে না বলেই রুমের দরজা খোলা রেখে লাফাতে লাফাতে আবার চলে যায়। রুশার মনে হল এই ভাই-বোন দুটোই আস্ত ম‍্যানারলেস আর বেয়াদব। এদের দুজনেরই কোনো ভদ্রতা নেই। একটা না বলে রুম থেকে চলে যায়। আরেকটা না বলে রুমের মধ‍্যে ঢুকে আসে।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here