অভিমান পর্ব ৪

#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪
‘খোঁজ পেয়েছিস?’

‘কার দোস্ত?’

‘মাথামোটা। নিয়ন এর খোঁজ পেয়েছিস? ফোনে পাওয়া গেছে?’

প্রাপ্তি অসন্তুষ্ট গলায় বলে,

‘নাহ দোস্ত। পাই নি। কোনো ফোন করছেও না ধরছেও না। কি করি বল তো?’

কথাটা শুনে ঝুমকো নিবীড়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। হঠাৎ ই বুকে কান্নারা উতলে উঠে। চোখ দুটি কেমন ঝিমঝিম করে। নিঃশব্দে কান থেকে ফোন টা নামিয়ে দু চোখের পাতা আলগুছে বন্ধ করে। আস্তে গলায় বলে,

‘আমার জীবন থেকে কেনো বারবার সবাই হারিয়ে যায়? আপন মানুষরা কেনো আপন থাকে না? তারা কি আমায় আপন ভাবতে পারে না? আমি কি এতোটাই খারাপ?’

বন্ধ চোখের পাতা ঘেষে নির্বিকারে জল গড়িয়ে পরে গেলো কানের নিচ দিয়ে। ঝুমকো চোখ বন্ধ করে কতকিছু ভাবে!

সে ভাবে, কত সুন্দর ছিলো মুহুর্ত গুলো! তার আর নিয়নের বন্ধুত্বপূর্ণ সময় গুলো খুব আশ্চর্যরকম সুন্দর ছিলো। কিন্তু সেই সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো তখন যখন ঝুমকো খারাপ মেয়েদের দলে নাম লিখালো। কিন্তু তবুও… তবুও তো নিয়ন তার সাথে ছিলো তার পাশে ছিলো সবসময়। তাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলো এই ধ্বংশের পথ থেকে। কিন্তু ঝুমকোর জেদের কাছে হার মেনে গেছে। কত হাসি মজা শান্তি আনন্দ ছিলো তাদের বন্ধুত্বের মাঝে। কোথায় গেলো এসব? কোথায় গেলো নিয়ন?

আজ তিনদিন থেকে নিয়ন নিখোঁজ। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝা যায়, সে স্ব ইচ্ছায় নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেনো? ঝুমকোকে এই নরকের পথ থেকে ফেরাতে পারে নি এই দুঃখেই কি নিয়ন হারিয়ে গেলো? ঝুমকোর একমাত্র কাছের বন্ধু তার একান্ত আপন হাসি আনন্দ টাও বুঝি এবার হারিয়ে গেলো। কিন্তু কেনো? এখন ই কেনো এই ছেলেটাকে হারাতে হলো? ঝুমকোর জীবনে যখন কঠিন অতীতের উদয় হলো ঠিক তখনই কেনো নিয়ন অস্ত গেলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হলেও নিয়ন কে দরকার। খুব দরকার…।

ঝুমকোর গলা কাঁপে। বুকের ভেতর যেই কষ্টগুলো জ্বলছে তা আসলে কিসের জন্য? প্রিয়তম বন্ধুর হঠাৎ কোনো বার্তা ছাড়াই হারিয়ে যাওয়ার জন্য না কি সেই বিষাদ কঠিনতম অতীতের মানুষটা আবার চোখের সামনে আসার জন্য? কেনো ঝুমকোর এতো কষ্ট হয়? ঝুমকো তো চায় সবকিছু ছেড়ে ছোড়ে থাকতে। সবকিছু থেকে আলাদা থাকতে। নিজের অন্য এক ধ্বংসের জগত নিয়ে থাকতে। এই ধরণীভৃত্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায় সে। নিজের এই বিষাদ ময় জীবনটাকে বড্ড বেশি ঘৃণা করে।

ঝুমকো বিরবির করে বলল,

‘আই হেইট ইউ রাহান। আই হেইট ইউ মোর দেন মাই লাইফ।’

ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঝুমকোর ঠোঁট জোড়া থেমে গেলো। চোখ বাঁকা করে তাকিয়ে দেখলো ছিপছিপে গড়নের হ্যাংলা পাতলা শ্যামলা মুখের টলটলে চাহনি নিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। শরীর অনেকটা ঝুলে পড়েছে। একটু বাঁকা হয়ে চলতে হয় বৈ কি। কিন্তু এখনও তিনি প্রায় সব কাজ করেন। এ বাড়ির যাবতীয় সকল দিক-নির্দেশনা তিনি দেন। সবার দেখভালও তিনি করেন। এতো খাটাখাটুনি.. তবুও তাকে দেখতে বেশ জোয়ান জোয়ান বলে মনে হয়। মনে হয় এই সবে মাত্র পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। কিন্তু বয়স তার ষাটোর্ধ। তার পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক ভদ্র লোক। সুঠাম দেহের পুরুষ। বয়স তার চল্লিশ হবে। ফর্সা শরীরে বেশ আধুনিকতার ছাপ। মুখ গাম্ভীর্য পূর্ণ।

ঝুমকো চোখের জল আড়ালে মুছে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে যেই বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার নাম কামিনী বেগম। ঝুমকো তার দু’কাধে ধরে এগিয়ে নিয়ে এসে বিছানায় বসায়। এরপর হাসি হাসি মুখ করে বলে,

‘কি খবর মাই সিন্ড্রেলা? ‘

কামিনী বেগম নাতনীর মুখ ধরে চুমু খান। তার ঠোঁটের চারপাশ টা পান খেয়ে লাল টকটকে হয়ে আছে। তিনি হেসে হেসে বলেন,

‘বারবি ডল টা যদি সারাক্ষন মুখ গোমড়া করে থাকে তাহলে সিন্ড্রেলার খবর কেমন করে ভালো হবে তুমি বলো তো নানুমনি?’

ঝুমকোর মুখের হাসিটা একটু দমে যায়। পরক্ষনেই আবার মুখটাকে হাসি হাসি করে সেই সুন্দর ভদ্র লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘কেমন আছো মামা? তোমাকে তো আজকাল দেখাই যায় না। ‘

আদিম উদ্দিন স্মিত হাসেন। ঝুমকোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

‘পাঁচদিনের জন্য একটু দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। কাজ ছিলো মামুনি। তোমার কি অবস্থা? কি করছো এখন?’

ঝুমকো বেশ তাচ্ছিল্য ভাবেই বলে,

‘আমার আর কি অবস্থা হবে। যেমন দেখে গিয়েছিলে তেমনই। বড়লোক নানুর নাতনী। বড়লোক মামার ভাগনি। আমার মাও তো বড়লোক ছিলো তাই না? শুধু বাবা গরিব না হলেও তেমন স্বচ্ছোল ছিলো না। যদিও বাবার মুখটা আমার মনে পরে না। আচ্ছা নানুমনি বাবা আর মা অনেক ভালোবাসতো দুজন দুজনকে তাই না?’

কামিনী বেগম মাথাটা একটু নিচু করেন। লুকিয়ে চোখের পানি মুছেন। আদিম উদ্দিন ও অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। এই মুহুর্তে ভাগনীর চোখের দিকে তাকাতে তার লজ্জা করলো হালকা।

ঝুমকোর বেশ মজা লাগে। সে সবসময় ইচ্ছে করেই সবাইকে এমন অপদস্ত করে। ঝুমকো জানে, এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ তাকে মন থেকে ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসা দিয়ে ঝুমকোর কি হবে? সব কেড়েকুড়ে নিয়ে এই আলগা ভালোবাসার কি সত্যি কোনো দরকার আছে ঝুমকোর জীবনে? এটাকে বলে অনেকটা ওই প্রবাদ বাক্যের মতো, “জুতো মেরে গরু দান করা।”

ঝুমকো নিজের মনে মনে হাসে। মুহুর্তেই তার চোখ পানিতে ভরে উঠে। তার বাবা মা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। নানু-নানি এমনকি মামাও মেনে নেয় নি। কারন তার বাবা ভালো স্টুডেন্ট হলেও ছিলো গরিব, ছিলো পিতা মাতা হীন, ছিলো না তার দু’কূলের কেউ। আর আজকালকার দিনে বড়লোক চাচা মামা ছাড়া কোনো চাকরি হয় না কি? তেমনি ঝুমকোর বাবারও হলো না। এই শহরটাও বাবাকে আর টানলো না। বিয়ে করে যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে মেনে নিলো না তখন ঝুমকোর বাবা মা গ্রামে চলে গেলো। ঝুমকোর বাবা গ্রামের স্কুলে পড়াতো। অনেক কষ্ট করে দিন চলাতে। একসময় ঝুমকো আসলো ঝুমকোর মায়ের গর্ভে।

ঝুমকো ভূমিষ্ট হওয়ার সময় তৎক্ষণাৎ পর্যাপ্ত টাকা হাতে না থাকায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে ঝুমকোর মা মারা গেলো। ঝুমকোর বাবা সেদিন অবধি কারোর কাছে হাত পাতেন নি। স্ত্রীর মৃত্যুতে কঠিন মানুষটাও টলে গেলো। দিন রাত ভর স্ত্রীর ছবি নিয়ে পরে থাকতো। কিছুদিন পর অনুধাবন করলো, না তাকে সামনের দিকে এগোতে হবে। তার মেয়েকে নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। মেয়েকে যত্ন করে বড় করতে হবে।

একসময় ঝুমকোর মামা আর নানুমনি সব জানতে পেরে খোঁজ নিয়ে এলো তাদের জীর্ণশীর্ণ গ্রামের ছোট্ট কুটিরে। ঝুমকোর নানুভাই তখন মারা গিয়েছে। ঝুমকোর তখন সবে পাঁচ বছর। মামা নানুমনি কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাইলো। ঝুমকোর বাবা তখন অসুস্থ ছিলো। মেয়ের এখন একটা অবলম্বন আছে, মাথার ছাদ আছে মামা, মামী, নানু আছে আর কি লাগে মেয়ের ভালো থাকায়? দুদিন পর ই ঝুমকোর বাবা চিরকালের জন্য দু চোখ বন্ধ করলো। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ঝুমকো এই বাড়িতে।

ঝুমকোর চোখ ছাপিয়ে জল নামে। কিছু জলের ফোটা পরে কামিনী বেগমের কোলে। তিনি চমকে উঠেন। নাতনীর মুখ উপরে তুলে চুমু খান। তার অনেক আদরের নাতনী।

ঝুমকো নাক টেনে ভাঙা স্বরে বলে,

‘পৃথিবীতে যারা বেশি ভালোবাসে তাদেরই বোধ হয় আল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি তার কাছে নিয়ে যায় তাই না নানুমনি? যেমন, নানুভাই কে নিয়ে গেছে। নানুভাইও তো তোমায় খুব ভালোবাসতো। আচ্ছা নানুভাই তোমায় এতো ভালোবাসতো তবুও ভালোবাসার মর্ম কেনো বুঝে নি? আমার বাবা গরিব ছিলো তাই কি হয়েছিলো? বাবাকে একটা চাকরি দিয়ে কি যোগ্য করা যেতো না? তোমাদের তো অনেক বড় কোম্পানি। তাহলে আমার মা বাবা দুজনই আজ বেঁচে থাকতো। ‘

কামিনী বেগম নাতনীকে ঝাপটে ধরেন বুকের মাঝে। নাতনীর মুখটা দেখলেই তার বুকটা হুহু করে উঠে। আদিম উদ্দিন ভাগনীর থেকে চোখ সরিয়ে নেন। ভাগনীর কান্না তিনি কখনোই সহ্য করতে পারেন না। একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়েকে তিনি রীতিমতো চোখে হারান। নিজের ছেলের থেকেও বেশি আদর যত্ন দিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।

গলা পরিষ্কার করে আদিম উদ্দিন বললেন,

‘মাস্টার্স করবে না?’

ঝুমকো কামিনী বেগম থেকে সরে এসে নির্দ্বিধায় জবাব দেয়,

‘না। পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না।’

কামিনী বেগম একটু নরম সুরে নিচু গলায় বলেন,

‘একজনের জন্য এভাবে নিজের জীবন উচ্ছোন্নে নিয়ে যাওয়ার আদেও কি কোনো মানে হয় নানুমনি?’

ঝুমকো একটু শক্ত কন্ঠে বলে,

‘তোমরা এখন একটু যাও নানুমনি আমি বেরোবো। ‘

আদিম উদ্দিন অবাক হয়ে বলেন,

‘এই বিকালে কোথায় যাবে?’

ঝুমকো একটু হেসে বলে,

‘প্রতিদিন যেখানে যাই। বন্ধুদের সাথে আড্ডা টাড্ডা দিয়ে ক্লাবে যাবো। ‘

আদিম উদ্দিন একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে বলেন,

‘আজ বের হয়ো না।’

ঝুমকো নিজের কথা স্থিতি থেকে বলে,

‘না বের হওয়ার কোনো কারন নেই। আমি বের হবো।’

আদিম উদ্দিন কিছু কড়া কথা বলতে গিয়েও বললেন না। শুধু কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে গেলেন,

‘খুব শীঘ্রই তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো আমি। এসব ভন্ডামি ছাড়ানোর ব্যবস্থা! তৈরি থাকো তুমি।’

___________________________________

কাল রাতে বাবা মা আসার আগেই কোনোমতে ঠেলেঠুলে তেথি কে নিজের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো রাহান। কি আশ্চর্য মেয়ে! নিজের বাড়ি রেখে আগে রাহানের বাড়িতে এসে জুটেছে। ভাগ্যিস বাবা-মা ছিলো না তা না হলে রাতে একটা মেয়েকে বাড়িতে দেখে নিশ্চয়ই মায়ের ভ্রু দুটো কুচকে যেতো চোখ টা বেঁকে যেতো।

শুভ্র বিকেলের রমরমা পরিবেশের দিকে তাকিয়ে রাহান কত কিছুই না ভাবে! চোখ দুটো বন্ধ করলেই চোখের পাতায় বেমালুম ঘুরে বেড়ায় অতীতের স্মৃতি। ঝুমকো আর তার ভালোবাসাময় স্মৃতি! কত সুন্দর সেসব! যখন ঝুমকো একটু রাগ করলেই রাহান নিজের কান ধরে ওর রাগ ভাঙাতো। নিজের গলায় সুন্দর একটি গানের মাঝখানের কিছু লাইন গেয়ে শুনাতো,

❝থেমে গেলে নিঃশ্বাস,
হারাবে না বিশ্বাস।
তোর মনের আঙ্গিনায়,
করি প্রেমের আবাস।

তুমি আমার পরান পাখি…
তোমায় দিয়েছি এই মন।❞

ঝুমকো তখন মুগ্ধতার হাসি দিয়ে জড়িয়ে নিতো রাহানকে নিজের সাথে। দু’হাত দিয়ে প্রিয়তমাকে জড়িয়ে নিয়ে রাহান ফিসফিস করে লাজুক ঝুমকোর কানে সুরেলা কন্ঠে আবার বলতো,

“থেমে গেলে নিঃশ্বাস হারাবে না বিশ্বাস। ”

ঝুমকো আরো নিবীড় ভাবে নিবন্ধন করে নিতো রাহান কে। লাজুক হেসে ফিসফিস করে নিজেও বলতো,

“থেমে গেলে নিঃশ্বাস হারাবে না বিশ্বাস ”

চলবে❤️

যাদের বুঝতে অসুবিধা হলো তাদের জন্য, ‘নিয়ন হচ্ছে ঝুমকোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কিন্তু সে হঠাৎ করে উদাও হয়ে গেছে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here