#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১৬
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
বাইরে প্রচন্ড রোদের তেজ। সূর্যটা যেন আগুনের ফুলকি ছুড়ছে পৃথিবীলোকে। কোন মাস চলছে? পৃথিবীর আবহাওয়ার রূপ কী বদলে যাচ্ছে? এহসাস আগে তো সূর্যের এত তেজ দেখেনি। দেখবে কী করে? আজন্মকাল বিলাসিতায় কাটিয়েছে যে। খাঁড়ার ওপর মড়ার গা হয়েছে এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে। এই রুম মরুভূমির মতো উত্তপ্ত হয় দুপুর বেলা। পিঠ রাখা যায় না বিছানায়। এহসাসের পিঠ চুলকায়। খুব জ্বলে। আয়নায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়েছে। লাল লাল গুটি গুটি ঘামাচিতে ফর্সা পিঠ ভরে গেছে। পঁচিশ বছরের জীবনে ঘামাচির এই প্রথম প্রকাশ ওর দেহে। কী বিশ্রী! কী অসহনীয়! এ তো বাসা নয় নরক। এহসাস জেনেশুনে নরকে বসত করছে। কেন করছে?
দরজা খোলার শব্দে নাকের পাটা ফুলিয়ে বিছানায় বসে। গায়ে শার্ট জড়িয়ে নেয়। নিরুপমা আনত মুখে খাবারের থালা হাতে রুমে ঢুকলো। কপাল পর্যন্ত ঢাকা ওড়নায়। চাদরের মতো সমস্ত বুকে জড়ানো। খাবারটা বিছানার ওপর রেখে চলে যাচ্ছিল এহসাস ডাকল।
“কী মাস চলছে?”
নিরুপমা থামল না। ভুরু কুঁচকে বলে,
“ভাদ্র।”
“কোথাও বিয়ের দাওয়াত আছে? এত তাড়া কীসের? দাঁড়াও দু মিনিট।”
নিরুপমা দাঁড়ালো। সামনের দেওয়াল ঘড়ি দেখল। এহসাস সেটা লক্ষ্য করে চোয়াল শক্ত করে। সেদিনের পর থেকে নিরুপমা স্রেফ জবাব দেওয়া ছাড়া মুখ খোলে না। কোনো প্রতিবাদ না, কোনো বক্র কথা না। এহসাসের সামনে না আসতে পারলে বেঁচে যায় যেন। দোষ ধরার অজুহাতে কথা বলার অবসর দেয় না। তবুও এহসাস নির্লজ্জ হয়, কথা বলতে চায়। নিরুপমা বলতে চায় না। এখন যেন আরও দূরে দূরে থাকে। চোখ তুলে তাকায় না, ঘোমটা এক হাত টেনে সামনে আসে। ঘামাচির চেয়েও অসহ্য নিরুপমার এ সকল ব্যবহার ওর কাছে। এহসাস উঠে দাঁড়ায়। একটু এগিয়ে এলো।
“দু’মিনিট শেষ। কিন্তু তুমি এক পা সামনে যাবে না।গেলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো।”
এহসাস নিরুপমার হাতের দিকে তাকায়। এই মেয়েকে রাগানো অবসেশন হয়ে গেল কি? খারাপ কিন্তু লাগছে না। মনে মনে হাসল।
“গরমে আমার জান বেরিয়ে যাবার উপায়। আমাকে তাড়ানোর জন্য কোনোভাবে এই রুমের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দাওনি তো? কে জানে, হয়তো গরমে সিদ্ধ করে মারার প্লান করছ? মরলেও পিছু ছাড়ব না তোমার অমাবস্যা। ভূত হয়ে ফিরে আসব। শাস্তি দিবো। কী শাস্তি শুনবে? বশ করে তোমাকে বউ বানাব, প্রেমে পড়াব। সারাজীবন আমার হয়ে থাকবে। আর তারপর আমাদের ডজন ডজন বাচ্চা হবে৷ প্রথম জোড়ার নাম রাখব, নিম্বা ও এব্বা। সুন্দর না নাম দুটো? অবশ্যই সুন্দর। ওদের মুখের আদল আমাদের কম্বিনেশনে হবে। আহা! আমার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে কল্পনা করতে গিয়ে।”
নিরুপমা দাঁতে দাঁত কামড়ে চুপচাপ শুনছে। এই লোকের মধ্যে লজ্জা বলতে কিছু নেই। কত বড়ো স্পর্ধা সে বিয়ে বাচ্চা পর্যন্ত চলে গেছে। বাচ্চাদের নামের কী শ্রী! আগেরবার এরু, রুরু আর এখন বলছে নিম্বা, এব্বা? এহসাস হঠাৎ ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। রাগ রাগ গলায় বলে,
“কমিউনিকেশন বোঝো না? এত বকবক কেন করলাম? তোমার সাথে সহজ কথাবার্তার জন্য। অথচ, তোমাকে দেখো! মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো। সে সামথিং অর আ’ল শ্যুট ইউ।”
নিরুপমা চকিতে চোখ তোলে। কিছুক্ষণের জন্য এহসাস দ্বিধায় পড়ল, সূর্যের তেজ বেশি না নিরুপমার দৃষ্টির? যাই হোক না কেন, দুটোতেই তো জ্বলছে এহসাস।
“একটা মেয়েকে অসহায় পেয়ে যা ইচ্ছে তাই করবেন বা বলবেন? আপনি কী ভেবেছেন? আমি খুব ধৈর্যশীলা? সব সহ্য করে নেবো? ভুল ধারণা আপনার।”
“কী করবে? পুলিশ ডাকবে? না, কৌশলে মারবে?”
“মারব? আমি তো আপনার মতো মানুষ মারতে সিদ্ধহস্ত না। ওমন নিষ্ঠুরও না। কিন্তু নিজেকে মারতে বাধবে না। মৃত্যুই যদি হয় আপনার টর্চার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ তবে সেটাই বেছে নেবো।”
এহসাসের বুকে আবার বজ্রপাত হয়। এবার বিকট শব্দে। কণ্ঠস্বর অসাড় হয়ে গেল। নিরুপমার সজল তপ্ত চোখে অনিমেষ চেয়ে রইল। তারপর আরো এগিয়ে এলো। নিরুপমা নড়বে না নড়বে না করেও পিছিয়ে যায়।
“মুক্তি চাও?”
“হ্যাঁ, চাই।”
পুরুষের চোখে চোখ রাখে না নিরুপমা। এহসাসের রেখেছে। রাখতে বাধ্য হয়েছে। লাজে চোখের পল্লব নামতে চায়। ওর বুক ঢিপঢিপ করছে। নামিয়ে নেয় পলক। এহসাস চুপ করে দেখছে। যেন পড়ছে৷ নিরুপমা বই নয়, খোলা ডায়ারি নয়। এহসাসের জন্য তো নয়ই। পাশ কেটে যেতে আবার থামল।
“ঘৃণা করো আমায়?” এহসাস জানতে চায়।
ঘৃণা! অনেক বড়ো অনুভূতি। নিরুপমা কি ঘৃণা করে ওকে? জানে না। কিন্তু অপছন্দ করে এটা নিশ্চিত।
“আমার জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন?”
এহসাস ভাবে। কী করত? ভেবে উত্তর পায় আবার পায় না। নিরুপমা আরও দূরে যায়। এহসাস জড়তা কাটিয়ে বলেই ফেলল,
“ক্ষমা করো, নীড়। ক্ষমা করো সেদিনের আচরণের জন্য। ওমনটা আর কোনোদিন করব না। কোনোদিন আর ওই নীচ কাজ করব না। মৃত্যু চেয়ো না তুমি।”
ধীর পায়ে হেঁটে আবার ওর সামনে দাঁড়ায়। নিরুপমা বিস্মিত। থমকে যায়। চোখ টলমল রাগে। এহসাস ওকে অবাক করে এক হাঁটু ভেঙে পি*স্তলটা ওর পায়ের কাছে রাখল। নিরুপমা সরে দাঁড়ায়। করছে কী এই লোক?
“যে জিনিসে তোমার এত ভয় তাই তোমার পায়ে ফেললাম। ক্ষমা করো আমায়। প্লিজ ঘৃণা কোরো না। পৃথিবীর সব সয়ে নিতে পারব, কিন্তু তোমার ঘৃণা আমার সইবে না নীড়, একটুই সইবে না।”
নিরুপমা ভুরু কুঁচকে তাকায়। এ দৃশ্য তো কল্পনাও করেনি। করেছে কী?
এহসাসের অপরাধী চাহনি। এই অত্যাচারী, নিষ্ঠুরকে ক্ষমা করা যায় না। নিরুপমা করবেই না। আবার কোনো ছল করছে ও। কিন্তু কোথাও গন্ডগোল বাধল। নিরুপমা এই প্রথম ভালো করে দেখল সম্মুখে হাঁটু ভেঙে বসা যুবকটিকে। ঘাড়ে নুড়ে পড়া ঢেউ খেলানো কালো চুল, বড়ো বড়ো দুটো মায়া জড়ানো চোখ, উন্নত নাসিকা আর.. আর… নিরুপমা চোখ সরিয়ে নেয়। গলা শুকিয়ে এলো। বুক দুরুদুরু করছে। কোনো কথা না বলে এক দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। এহসাসের মুখে বিমর্ষতা নামে। শুনতে পায় নিরুপমার মা চেঁচাচ্ছেন,
“কী হইছে? ও নিরু? ওমন ভূত দেখার মতো দৌড়ে পাকের ঘরে গেলি ক্যান? তোর বান্ধবীর কিছু হইছে?”
“কিছু না, মা। কিছু হয়নি। চুপ থাকো, চুপ থাকো।”
চলবে,,,,
আজ ভেবেছিলাম লিখতে পারব না। ঘণ্টা খানেক আগে লিখতে বসলাম। আর এই যে এইটুকু।