অশ্রুমালা পর্ব ২১+২২

#অশ্রুমালা
part–21(বোনাস)
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

বাস এসে থামল তার গন্তব্যে। এতো লং জার্নি করে আবেগ বেশ ক্লান্ত। ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে। হবেই বা না কেন? রোদেলা যে সারা রাস্তা তার কাধে মাথা রেখে পার করে দিল। এদিকে আবেগ শটাং হয়ে এক জায়গায় স্ট্যাচুর মতো বসে ছিল ভুলেও নড়াচড়া করে নি। যদি রোদেলার ঘুম ভেঙে যায়। এর মাঝে দুই বার সে সমুদ্র কে ফিডার খাইয়ে দিয়েছে। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে সমুদ্র কে খাইয়ে দিয়েছে। ঘুম পাড়িয়েও দিয়েছে৷

বাস থামতেই আবেগ রোদেলাকে ডেকে তুলল। এবং বলল, পৌছে গেছি আমরা। উঠো। নামব।

রোদেলা চোখ কচলে জানালার দিকে তাকালো। সত্যি বড় বড় অক্ষরে কুড়িগ্রাম বাস স্ট্যান্ড লেখা। এখান থেকে বিশ মিনিটের রাস্তা রোদেলাদের বাসা। রোদেলা উঠে দাড়ালো। মাথাটা এখনো ভারী হয়ে আছে। ভোরের আলো চারপাশের পরিবেশ কে আরো স্নিগ্ধ করে তুলেছে।

বাস থেকে নেমে আবেগ বোতল বের করে কুলি করে নিল৷ মুখ ধুয়ে বোতলটা রোদেলার দিকে এগিয়ে দেয়।

আবেগের দেখাদেখি রোদেলা ও চোখে মুখে পানি দেয়৷ চোখ-মুখে পানি দেওয়ার পর কিছুটা সতেজ লাগতে শুরু করে তার৷

এদিকে বেশ শীত পড়ে গেছে। ভোরের কুয়াশায় চারপাশে ছেয়ে গেছে। আবগের ঠান্ডা লাগতে শুরু করল।

রোদেলা মুগ্ধ হয়েই বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে চারপাশে দেখতে লাগলো।

কি দেখছে রোদেলা জানে না আবেগ। এমন কিছু আহামরি নাই যে দুচোখ ভরে দেখতে হবে। পুরাতন একটা কক্ষ। পাশে চা ঘর তাও এখন বন্ধ আছে। আর একটা ল্যাম্পপোস্ট। রোদেলা ল্যাম্পপোস্টের সামনে গিয়ে দাড়ালো।

ল্যাম্পপোস্ট টা এখনো জ্বলছে। এতো ভোরে কেউ আর বন্ধ করে নি। হয়তোবা সকালে বন্ধ করে দিবে৷

ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় রোদেলা কে অন্য জগতের রহস্যময়ী নারী মনে হতে লাগলো আবেগের।

আবেগ চোখ ছোট ছোট করে রোদেলাকে দেখতে লাগলো। রোদেলা শাড়ি পড়ে আছে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। শাড়ির পাড়ে সাদা সুতার কাজ। চুল গুলো হাত খোপা করে একটা ঝুনঝুনি দেওয়া স্টিক দিয়ে আটকানো। নাক ফুল টা ল্যাম্পপোস্ট টা ঝিলিক মেরে উঠছে। হাতে একটা চিকন চুড়ি।

রোদেলা যে শাড়ি পড়ে আছে সেটা মাত্র খেয়াল করল আবেগ। এতোক্ষনে একবারো আমলে নেয় নি সে ব্যাপার টা। শাড়ি পড়ায় রোদেলার মধ্যে একটা গুরুগম্ভীর ভাব চলে এসেছে।

আবেগ অদ্ভুত নয়নে চেয়ে আছে রোদেলার দিকে।

চারপাশে কিচিরমিচির পাখির ডাকে এক অমায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সেই সাথে শীতকালের একটা গন্ধ পাচ্ছে আবেগ৷

শীতের ঋতুতে সকাল আর ভর সন্ধ্যায় আবেগ একটা কাঠপোড়া গন্ধ পায়। তার কাছে এই গন্ধ পাওয়া মানেই শীত পড়ে গেছে মনে হয়। এই গন্ধ অন্য কেউ পায় কিনা জানে না আবেগ। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় নি।

তার এখন রোদেলা কে খুব করে জিজ্ঞেস করতে মন চাচ্ছে, রোদেলা? তুমি কি শীত কালে কাঠপোড়া গন্ধ পাও?

কিন্তু করল না। সব প্রশ্ন সবাই কে জিজ্ঞেস করা যায় না। কিছু প্রশ্ন নিজের মধ্যে পু্ষে রাখতে হয়৷

রোদেলা হালকা হেসে বলে, জানো এই স্ট্যান্ডে না এক ধরনের লজেন্স পাওয়া যায়৷হলুদ রঙের। খুব মজা খেতে। আর একটা ক্রিম ওয়ালা বিস্কুট পাওয়া যেত আগে৷ ওইটাও খুব মজা। এই দুইটা খাবার আমার ফেভারিট। জানি না এখনো পাওয়া যায় কিনা? তবে এই দুইটা খাবার আমি ঢাকায় কোথাও পাইনি। আগে যখন ই দাদাবাড়ী আসতাম বাবা দিত। আসার সময় একবক্স আর ঢাকা ফেরার পথে একবক্স।

বলে মৃদ্যু হেসে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগ ও বিনিময়ে একটা হাসি দিল। এই প্রথম আবেগ এতো সুন্দর করে হাসল তার কোন কথায়। অন্য দিনে তো বেশির ভাগ সময় তার কথায় বিরক্তি পোষন করে।

আবেগ আশেপাশে তাকিয়ে বলে, এবার চল আগাই। রওনা দিই। ঠান্ডা লাগছে তো।

–হু। চল।

আবেগ একটু সামনে এসে রাস্তার কাছে দাড়ালো। সমুদ্র তার কোলে। রোদেলা একটু পেছনে দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখছে৷

আবেগ রোদেলা কে জিজ্ঞেস করে, এখান থেকে বাড়ি কত দূর?

–বেশ দূরে তো।

আবেগ সমুদ্র কে শক্ত করে ধরে আছে। যেন তার শরীরের উষ্ণতা সমুদ্রের গায়ে মাখে আর শীত কম লাগে তার।

–তাহলে তো রিকশা নিতে হবে।

–হুম।

আবেগ আশেপাশে তাকালো। এতো ভোরে কোথায় রিকশা পাবে? আবেগ একটা জিনিস বুঝে পাচ্ছে না এই গহীন গ্রামে রোদেলা কিভাবে একা একা আসার সাহস পায়? আজকে যদি সে না আসত তবে রোদেলা একা কিভাবে হ্যান্ডেল করত? এই বাস স্ট্যান্ডে এসে কি করত? এখন কোন টেনশন ছাড়াই আশপাশে দেখতে ব্যস্ত। আর সে না যদি আসত তবে কি হত তাই ভাবছে আবেগ?

সাহস হয় কিভাবে রোদেলার একা একটা বাচ্চা নিয়ে বের হওয়ার?

মেয়েরা স্বামীর সাথে ঝগড়া করলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বোধহয়।

কোন রিকশা তো পেল না তবে একটা ভ্যান পেল। ভ্যান ওয়ালাকে বলতেই উনি রাজী হয়ে যায়৷

শহর থেকে এসেছে শুনে উনি খুশি মনেই আবেগকে উঠতে বলে তার ভ্যানে।

রোদেলাকে উঠে বসালো আবেগ। তার ব্যাগ-পত্র নিয়ে নিজে বসে পড়ে। মুখোমুখি বসেছে তারা।

ভ্যান চলছে আপন গতিতে। চারপাশে হালকা কুয়াশা। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটাকে উপভোগ করছে দুজনই।

রাস্তার দুইধারেই গাছ আর গাছ। সবুজ এ ভরপুর। মাঝে -সাঝে ছোট ছোট পুকুর । পানি কমে গেছে পুকুর গুলোয়। হাটুর নিচে ঠেকবে পুকুরের গভীরতা। বেশ খানিকটা পর খেজুর গাছ দেখতে পেল তারা৷

বড় বড় উচু উচু গাছ। গাছের কান্ড, বাকলে হাড়ি। এদিকটায় দুই-এক জন মানুষ দেখা যাচ্ছে।

বেশ মুগ্ধ হচ্ছে আবেগ। বহু আগে এসেছিল গ্রামে। আর আসা হয় নি। সম্ভবত দশ-বারো বছর আগে শেষ এসেছে। সে গ্রামে মাত্র একবার এসেছে আর এইবার নিয়ে দ্বিতীয়বার। মাঝে মধ্যে হুটহাট করে গ্রামে আসা দরকার। মন টা মূহুর্তের মধ্যে সতেজ আর পুলকিত হয়ে যায়৷

রোদেলার দৃষ্টি আবেগের দিকে। আবেগ বিষ্ময়কর নয়নে গ্রামের পরিবেশ দেখায় ব্যস্ত।

আবেগ ভ্যান ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এতো তাড়াতাড়ি খেজুরের রস পাওয়া যায়?

ভ্যান ওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে বলে, কি যে বলেন না! এখনি তো খেজুরের রসের আসল সময়। খান নি কোন দিন?

আবেগ আফসোসের সুরে বলে, না। গ্রামে খুব কম আসি। এক কি দু বার এসেছি।

–এইবার খায়েন।বহুত মিস্টি খেতে৷

–ও।

কিচিরমিচির শব্দে চারপাশে জমজমাট ভাব। আবেগের মনে হচ্ছে সে পাখিদের দুনিয়ায় চলে এসেছে। পাখিরা তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে। এতো এতো পাখি সে তার এতো লম্বা জীবনে দেখে নি৷ ভ্যান থেকে উপরের দিকে তাকাতেই চোখ গেল বিভিন্ন গাছ-গাছালির উপর! পাখিরা বসে গান গাচ্ছে। পাখি রা না বসন্তে গান গায়? এটা তো শীত কাল। তাও কেন ডাকছে —প্রশ্ন জাগে আবেগের মনে।

আকাশ ভর্তি পাখিদের মেলা। ছোট ছোট পাখিদের উড়তে দেখে আবেগের ও পাখিদের সাথে উড়তে মন চাচ্ছে!

ভ্যানওয়ালা ভ্যান থামিয়ে দিয়ে সিট থেকে নামল এবং বলল, আপনারা নিচে বসেন। এখান থেকে কাচা রাস্তা শুরু। একটু ঝাকুনি লাগবে। তাই সিটে না বসে নিচের ফাকা জায়গায় বসেন৷

রোদেলা আচ্ছা বলে ভ্যানের উপরিভাগ থেকে নেমে নিচে বসল। তাকে দেখে আবেগ ও নিচে বসে পড়ল।

ভ্যানওয়ালা কাচা মাটির রাস্তা দিয়ে সামনে আগাচ্ছে। তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

ভ্যানটাও কিঞ্চিৎ দুলে দুলে উঠছে।

★★★

শৌখিন সকাল সকাল উঠে সকালের জন্য নাস্তা বানালো। শুকনা রুটি আর চা। সে ঘড়ি দেখল। আজকে একটা ইন্টারভিউ আছে। যদি চাকরি টা পেয়ে যায় তবে সংসারের অভাবটা কমে।যাবে। যদিও বা এই সংসারে সে আর তার বোন ছাড়া কেউ নি। তার বোনটা বেশ মেধাবি জন্য সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তাও ঢাকা মেডিকেল। বাংলাদেশের বেস্ট মেডিকেল কলেজে।শৌখিন মাঝে মাঝে অবাক হয়। তার বোন পড়াশোনায় এসএসসি পর্যন্ত মোটামুটি লেভেলের ছিল। হুট করে এতো ভালো কিছু যে হবে শৌখিন ভাবতে ও পারেনি। শায়েরী যখন ইন্টারে তখন থেকেই শৌখিন একটু একটু করে নিজের হাত খরচ থেকে টাকা জমাচ্ছিল শায়েরীকে ভালো কোথায় পড়াবে জন্য। কিন্তু সেটা আর লাগে নি। শায়েরী খুব ভালো ফলাফল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়। শৌখিনের যেন বুক টা উচু হয়ে যায়। মেয়েটার সে ছাড়া আর কেউ নি। মেয়েটার বাবা ও সে আর মাও সে।

শৌখিন আপাতত একটা ভালো চাকরির আশায় আছে। কিন্তু চাকরি আর সোনার হরিণ তো একই কথা । তাই আতিপাতি হয়ে খুজেও ফলাফল শুন্যের কোঠায়৷ সে আবার সোশ্যাল ওয়ার্কার। সমাজের জন্য কাজ করতে তার ভালো লাগে। যেদিন সে কারো সাহায্য করতে সক্ষম হয় সে দিন রাতের ঘুমটা তার খুবই আরামদায়ক হয়।

নাস্তা সেরে সে ভালো দেখে একটা শার্ট গায়ে দিল। যদিও বা তার শার্ট আছেই তিনটা। একটা সাদা, একটা কালো আর হালকা নীল,। এই তিন রঙের তিনটা শার্ট। তার মধ্যে সাদাটা সবচেয়ে ভালো আছে। তাই আজকেও সাদাটাই পড়ল। তার হাতে টাকা আছে কিন্তু নিজের জন্য কিছু কিনছে না। কিছু দিন পর শায়েরীর জন্য একটা কংকাল কিনতে হবে। কংকালের নাকি অনেক দাম। সেকেন্ড হ্যান্ড গুলো বিশ হাজার ছুইছুই। কিন্তু সে চায় শায়েরীকে সব নতুন জিনিস দিবে। তার বোন কেন কারো ইউস করা জিনিস ব্যবহার করবে?

সে বেরিয়ে গেল। শৌখিন পড়াশোনায় ভালোই ছিল। কিন্তু ইন্টার থেকেই পাট টাইম জবের ভারে রেজাল্ট টা কোন কালেই ভালো করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি।

পেটের খিদার তুলনায় তো কাগজের ওই প্লাসের গ্রেন্ড কিছুই না!

জীবন যে একটা রণক্ষেত্র তা হারে হারে টের পায় শৌখিন। যার বাবা-মা তার কেউ নেই। কেউ নেই বলতে কেউ নেই। সম্পূর্ণ একা। ছায়াহীন, ঢালহীন, অস্তিত্বহীন আর অসহায়। বাবা-মা যে কি অমূল্য রতন ভালো করেই জানে শৌখিন।

★★★

হুট করে ভ্যানের চাকা মাটির খালের সাথে ঘষা খাওয়ায় একটা ধাক্কা সৃষ্টি হয়। সেই ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে রোদেলা আবেগের গায়ের উপর এসে পড়ে৷

আবেগ চমকে উঠে। রোদেলার ছোয়া পেতেই সে এক অন্য জগতে চলে যেতে ধরে। রোদেলার গা এখনো কিছুটা গরম আছে।

রোদেলা সরে আসতে গিয়ে দেখল তার চুলের কিছু অংশ আবেগের শার্টের বোতামের সাথে আটকে গেছে৷

রোদেলা আহ বলে উঠে।

আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, কি হলো?

–আমার চুলে টান পড়ছে।

–সর‍্যি? বুঝলাম না।

রোদেলা মনে মনে বলে৷ তোমাকে বুঝতেও হবে না।

সে হুট করে আবেগের শার্টের বোতামে হাত দেয়৷ ওমনি খপ করে আবগ রোদেলার হাত ধরে ফেলে এবং কর্কষ কন্ঠে বলে, এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি?

রোদেলা আবেগকে ব্যঙ্গ করে বলে, এমন ভাবে বলছো যেন আমি তোমার ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছি।

–আজব! এভাবে আমার শার্টের বোতাম ধরে টানাটানি কেন করবে?

–চোখ টা একটু কাজে লাগাও। আমার চুল তোমার শার্টের বোতামে লেগে গেছে। এখন ছাড়াতে হবে৷

–ছাড়ানোর কি দরকার? ছিড়ে ফেল তোমার চুল।

রোদেলা চোখ সরু করে বলে, আমার চুল কেন ছিড়ব?

আবেগ আবারো বিরক্ত হয়ে গেল এবং প্রতিউত্তরে বলে, তোমার মাথায় অনেক চুল আছে এক-দুই টা ছিড়লে কিছু হবে না।

রোদেলা আবারো চোখ ছোট করে বলে, তাহলে তোমার শার্টের বোতাম ছিড়ে ফেলি?

–এই না! পাগল নাকি তুমি। শার্টের বোতাম কেন ছিড়বে? (ব্যতিব্যস্ত হয়ে)

রোদেলা বলল, তাহলে প্লিজ বি কোয়াইট। আমি আস্তে করে কায়দা করে তোমার বোতাম থেকে চুল গুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছি।

রোদেলা অনেকক্ষন ধরে আবেগের বোতামটার সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে বোতামটা ছিড়ে ফেলে।

সে মন খারাপ করে আবেগের হাতে বোতাম তুলে দিয়ে বলে, সর‍্যি। তোমার অনেক বড় ক্ষতি করে দিলাম!

একথা শুনে আবেগ হোহো করে হেসে উঠে।
#অশ্রুমালা
part–22
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

অথৈ মাত্র ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলো। ইন্টারভিউটা বেশ ভালোই হয়েছে। মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সে। তাই সে মনে মনে অনেক খুশি। যাক এবার সে নিজের পা দাড়াতে পারবে যদি জবটা পায়। আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। অথৈ অফিসটার সামনে সিমেন্ট দিয়ে গাথা সিড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছুটা ঘেমে গেছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে ওড়নার পেছনের অংশ দিয়ে নাকের ডগার ঘাম মুছলো। ঘাম মোছার সময় তার মনে পড়ল গ্রামের মানুষরা বলে, যেই মেয়ের নাকের ডগায় ঘাম জমে তার স্বামী নাকি তাকে খুব ভালোবাসে!

অথৈ জানে না এই কুসংস্কার টা কতোটুকু সত্য। যেহুতু কুসংস্কার তাই সত্য হবে না –এটা অথৈ ও জানে। তবুও মনে ক্ষীণ আশা আছে যদি সত্যি খুব ভালোবাসা পায় সে স্বামীর কাছ থেকে?

অথৈয়ের বাবা খুব রাগীস্বভাবের আর অথৈ তার বাবাকে জমের মতো ভয় পায়। তার মায়ের সাথেও খুব একটা ভাব বা সখ্যতা নেই তার। বাবা-মায়ের সাথে কেমন যেন একটা দূরত্ব আছে তার। সেই টিনএজ থেকেই। ছোট বেলায় অবশ্য সে বাবা-মায়ের মাঝখানে ঘুমাত৷ কিন্তু দশ বছর বয়স থেকে হুটহাট বাবা-মায়ের সাথে একটা গ্যাপ চলে আসে। যেটা দিন দিন ক্রমশ বেড়ে চলছিল৷ মেঘের সাথে প্রেম হওয়ার পর বাবা-মায়ের সাথে আরো দূরত্ব চলে আসে। মায়ের সাথে তাও এক-দুইটা কথা হত। কিন্তু বাবা? ওনার সাথে তো কথাই হত না। অথৈ কেন যেন তার বাবার সাথে কথা বলতে পারে না। একটা সংকোচ কাজ করে তার মধ্যে। বাবার কাছে কোন আবদার করতে পারে না। কেন যে পারে না অন্য মেয়েদের মতো বাবার কাছে গিয়ে চুরি-ফিতার আবদারের মেলা পেশ করতে! অথৈয়ের মনে পড়ে না আদৌ সে নিজের মুখ ফুটে তার বাবার কাছে কিছু চেয়েছে? নাহ সত্যি তার মনে পড়ে না৷ তার বাবাও কি পারে না একবার তার রুমে এসে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই কিন্তু সব জড়তা চুকে যায়৷

অথৈ ছোট করে একটা শ্বাস নিল। ছোটবেলা থেকেই তার বাবা-মায়ের সাংসারিক সমস্যা দেখে আসছে অথৈ। ছোটবেলায় না বুঝলেও কিশোর বয়স থেকে ঠিক ই সব বুঝে অথৈ তাই তো বাবা-মায়ের সাথে এতোটা মনোমালিন্য তার। তাদের পরিবার ভাংতে গিয়েও ভাংগে নি। বাসায় সবসময়ই একটা গুমটে ভাব থাকবেই। একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। এজন্যই তো কখনোই কোন উৎসব অনুষ্ঠান পালন করা হয় নি বললেই চলে৷ না কোন দিন অথৈ কিংবা তার ভাইয়ের জন্মদিন সেলিব্রেশন হয়েছে আর না হয়েছে শুক্রবারে পোলাও-মাংসের একটা লাঞ্চ!

অথৈ সামনে পা বাড়াবে এমন সময় ফোনে কল আসল। সে ফোন চোখের সামনে তুলে দেখে ফয়সাল কল করেছে৷ তার মনটা এমনি খারাপ ছিল এখন তো বিষ মাখা হয়ে গেল। এই লোকটার সাথে তার আর কিছু দিন পর বিয়ে। বাবাই কোথা থেকে যেন তুলে এনেছে ছেলেটাকে।

অথৈ ফোন ধরল না। সামনে পা বাড়ালো। আবারো ফোন বেজে উঠল। এবার বাধ্য হয়ে ফোন ধরে অথৈ।

ওপাশ থেকে ফয়সাল বলে উঠে, এতোবার কল দিচ্ছি ফোন কেন ধরো না?

–বাইরে আমি৷

–বাইরে কেন,? বাইরে কি কাজ?

,–জব ইন্টারভিউ দিতে এসেছি৷

–কেন? তুমি চাকরি করতে চাও নাকি?

–অবশ্যই। চাই। নাহলে তো দূর কষ্ট করে পড়তাম নাকি!

ফয়সাল তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, কই এতো দূর পড়লা? পড়ছো কি এক ন্যাশনাল ভর্সিটি থেকে।ওই ভার্সিটিতে ক্লাস হয় ঠিক মতোন? মেয়েরা তো বাচ্চা নিয়ে ক্লাস করতে আসে। বাদ দাও। তুমি যে চাকরি করবা একবারো আমাকে জানাবে না?

–প্রয়োজন মনে করি না।

ফয়সাল হুংকার দিয়ে বলে, আমি চাই না আমার হবু বউ চাকরি করুক। প্রতিদিন অন্য পুরুষদের নিজের রুপ দেখাক। বাড়ির বউ বাসায় থাকবে৷ আল্লাহ দিলে আমার বেতন ভালোই। তোমার সব চাহিদা আমি মেটাতে পারব। কোন দরকার নাই তোমাকে জব করার৷

অথৈ কঠিন কিছু বলতে গিয়েও পারল না। সে খট করে ফোন কেটে দিল এবং অসাবধানে রাস্তায় পা ফেলতে লাগে। চোখ ভরে আসছে। তার আর ভালো লাগে না কিছু। সব অসহ্য লাগে!

সে হনহন করে হেটেই চলেছে। কোন দিকেই খেয়াল নেই।

কানের হর্ণের শব্দ ভেসে আসছে কিন্তু তা আমলে নিল না অথৈ। আজকে যদি কোন বাস বা ট্রাক তাকে ধাক্কা দিয়েও চলে যায় আপত্তি নেই অথৈয়ের।

হর্ণের শব্দ আরো নিকটে আসতে লাগল। সে একবারও পেছনে কিংবা আশেপাশে তাকালো না।

হুট করে হাতের কনুই বরাবর হ্যাচকা টান অনুভূত হয় অথৈয়ের। সে তড়িৎগতিতে চোখ বন্ধ করে নেয়। তখনি দুই ফোটা গরম জল তার চোখ থেকে পড়ে গালের মাঝ বরাবর গিয়ে ঠেকল।

গালে আরো স্পর্শ পেতেই চোখ খুলে ফেলে অথৈ। অস্পষ্ট স্বরে বলে, মেঘ,,,,,,,,,,

★★★

রোদেলা উঠানের লম্বা পিলারে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সকাল দশটা বাজতে চলেছে। তাদের বাড়ি পৌছানোর। আবেগ এসেই ফ্রেস হয়ে দিয়েছে এক ঘুম। কিন্তু রোদেলার আর ঘুমানোর দরকার পড়ে নি। তার কেন যেন গ্রামের হাওয়া খেয়েই চাঙ্গা লাগছে। গায়ে জ্বর আছে কিন্তু তবুও মৃদ্যু শীতল বাতাস সে দাড়িয়ে দাড়িয়ে উপভোগ করছে৷ পরনে সালোয়ার কামিজের উপর একটা শাল৷ শালটা তার মায়ের। মায়ের শালটা গায়ে জড়াতেই রোদেলার নাকে মায়ের গন্ধ ভেসে উঠল।

বাবা এই সকালেই হাটে গেছে। বড় মাছ কিনতে। কালকে রাতে হুট করে বলায় উনি কোন প্রস্তুতি নিতে পারেন নি৷

রোদেলার মা সমুদ্র কে খালি গা করে সরিষার তেল গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে আর সমুদ্রের সাথে খেলছে। নানীর সাথে ভালোই ভাব জমে গেছে সমুদ্রের। দুজনের অমূল্য হাসির পানে চেয়ে আছে রোদেলা।

রোদেলা উঠানে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে নানী-নাতির কাহিনি দেখছে তার প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। রোদেলার হাতে একটা স্টিলের বাটি। বাটিতে খই আর গুড় সাথে নারকেল কুচি কুচি করে কেটে দেওয়া হয়েছে। রোদেলা শীতের
উত্তাপ গায়ে মাখছে আর খই খাচ্ছে। মৃদ্যু হাওয়া বয়ে আসায় তার চুল গুলো হালকা নড়েচড়ে উঠে।

আবেগ ঘুম থেকে উঠে রুমে কাউকে দেখতে পেল না। আশেপাশে তাকিয়ে ও রোদেলা র খোজ না পাওয়ায় সে রুম ছেড়ে বের হয়। তাকে বাথরুমে যেতে হবে৷ অগত্যা সে রুম ছেড়ে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকল। কিন্তু ঝামেলা রয়েই গেল।

প্রথম যে বার সে যখন বাথরুমে গিয়েছিল তখন বালতি তে পানি ছিল। এবার বালতি সম্পূর্ণ খালি। বাথরুমের সাথে টিউবওয়েল লাগানো। কিন্তু আবেগ টিউবওয়েল চেপে পানি বের করতে পারে না। এখন কি করবে সে? পানি খুব দরকার তার এই মূহুর্তে!

উপায় না পেয়ে সে বের হলো বাথরুম না সেরেই। । রোদেলাকে খুজতে হবে। কিন্তু কোথায় ও?

আবেগ উশখুশ করতে করতে উঠানে গেল। উঠানে যেতেই সে এক দফা চমক খেল। রোদেলা চুল ছেড়ে দিয়ে কার সাথে যেন হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। পরনে ঘিয়া শাল। এই শালটা পড়ায় তাকে মায়াবিনী লাগছে। কথার ফাকে ফাকে রোদেলা বাটি থেকে কিছু একটা হাতে নিয়ে মুখে দিচ্ছে৷ খাবার টা হাতের মধ্যে নিয়ে কিছুটা ঝাকাচ্ছে তারপর মুখে দিচ্ছে৷

রোদেলাকে এই রুপে দেখে আবেগের হার্টবিট মিস হলো। সে ঘামতে লাগল। তার পিপাসা পেতে লাগল। মাথার মধ্যে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হলো। চারপাশের কিছু ই তার কানে যাচ্ছে না। কেবল রোদেলার রিনরিনে কন্ঠ। রোদেলা হুট করে খিলখিল করে হেসে উঠে৷

রোদেলার হাসিতে আবেগ ডুবে গেল। তলিয়ে যেতে থাকে কোন এক অজানা গভীরে। যেই গভীরতায় কোন অপবিত্রতা নেই। কেবল পবিত্রতা ছেয়ে আছে। কেমন যেন মোহ কিংবা মায়াজাল সৃষ্টি হতে লাগে আবেগের মনের গহীনে। সে বুঝতে পারছে রোদেলাতে কিছু একটা আছে যেটা অনেকয়া দুর্বল করে দেয় আবেগকে ৷ কুড়ে কুড়ে খাক করে দেয়। কি আছে? সেটা জানে না আবেগ কিন্তু কিছু একটা আছে সেটা নিশ্চিত।

রোদেলা হাসি থামিয়ে পেছনে তাকাতেই আবেগকে দেখে আরো চুপ বনে গেল। আবেগের ঘোর তখনো কাটে নি। সে রোদেলার দিকে চেয়ে আছে নিষ্পাপ চোখে।

এতে রোদেলা বেশ লজ্জা পায়। সে মাথা নিচু করে ফেলে।

আবেগ হুট করে রোদেলার হাত ধরে ফেলে এবং তাকে উঠান থেকে সরিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়।

রোদেলা হতভম্ব হয়ে যায়। উঠানে এক মাঝবয়েসী মহিলা তার সাথে গল্প করছিল। উনি কি ভাববেন? কি লজ্জার কাজ করে বসল আবেগ? এখন ওই মহিলার সামনে সে পরবর্তীতে কিভাবে যাবে?

আবেগ বাথরুমের সামনে গিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে, আমাকে কল চেপে দাও তো। বালতিতে পানি নেই৷

রোদেলা বুঝলো শহরের ছেলের অসুবিধা হচ্ছে৷ সে মুচকি হেসে চুল খোপা করে নিল৷ এবং টিউবওয়েলের সামনে গিয়ে পানি চেপে দিল৷

আবেগ আরেকদফা মুগ্ধ হলো রোদেলার প্রতি৷ কি একটা অবস্থা! বারবার একই ব্যক্তির উপর মুগ্ধ হওয়ার তো কোন কারন দেখে না আবেগ?

রোদেলার বালতি ভর্তি করে বাথরুমের বাইরে বের হয়ে এসে বলে, হয়েছে। যাও এবার৷

আবেগ এক মূহুর্তে দেরি না করে ছুট লাগায় বাথরুমে তা দেখে রোদেলা হেসে ফেলে। অনেক দিন পর তার মনটা আজকে খুব খুশি। সব কিছুতেই আনন্দ খুজে পাচ্ছে৷ কিশোরীর মতো খালি পায়ে ছুটে যেতে মন চাচ্ছে মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তায়!

রোদেলার বাবা তালুকদার সাহেব। বাজার থেকে ইলিশ আর রুই আনলেন। ঠিক করা হলো দুপুরে পোলাও আর ইলিশ মাছ রান্না করা হবে। তাও সরষে ইলিশ।

রোদেলার মা রান্নার আয়োজন শুরু করে দিলেন। গ্যাসের চুলা থাকা সত্ত্বেও রোদেলার
আবদারের খাতিরে খড়ির চুলায় রান্না বসালেন তিনি৷রোদেলার খড়ির চুলার রান্না খুব প্রিয়। খড়ির চুলার রান্নায় স্বাদ বহু গুন বেড়ে যায়।

কিছুক্ষন বাদে উনি উঠে গেলে রোদেলাই চুলার পাড়ে বসে রান্না করতে লাগলো।

আবেগ ও চুলার পাশে এসে দাড়ালো। সে মূলত রোদেলা কে দেখতে এসেছে। আজ-কাল কি যেন হয়েছে। ঘন ঘন পিপাসা লাগার সাথে সাথে রোদেলাকে দেখার বাসনা জন্মে!যেমনটা অনেক আগে একবার হয়েছিল! যখন রোদেলা ভার্সিটি যাওয়া শুরু করে তখনকার দিনগুলো তে যেমন অনুভব করত তেমনি আজ-কাল তার রোদেলার প্রতি অনুভূতি গুলো মাথা নাড়া দিয়ে উঠছে।

চুলার উত্তাপ গায়ে লাগায় বেশ ভালোই লাগছে আবেগের৷

আবেগ চুলার বিপরীতে বসে পড়ে৷

রোদেলা শিংটা দিয়ে চুলাউ ফুক দেওয়া শুরু করল।

আর এদিকে ধোয়া চোখে লাগায় আবেগ আউ বলে চোখ কচলাতে
লাগল।

রোদেলা প্রথমে খেয়াল করেনি আবেগ তার বিপরীতে বসে আছে। চুলার কালো ধোয়া আবেগের চোখে লেগেছে তাই চোখ জ্বালা করা শুরু করে দিয়েছে৷

রোদেলা দ্রুত আবেগের কাছে গিয়ে তার চোখে ফু দিতে লাগলো।

রোদেলার ছোয়া পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুলল আবেগ।

লাল রক্তিম চোখে রোদেলাকে দেখে পাগল হতে গিয়েও হলো না পাগল আবেগ!

রোদেলা মায়া ভরা দৃষ্টিতে আবেগের চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ফু দিচ্ছে আর আবেগ মুগ্ধ হয়ে রোদেলা কে দেখছে।

হুট করে আবেগ রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে৷

চলবে।
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here