অস্তিত্বে চাই তোমার ছোঁয়া পর্ব -১৩+১৪+১৫

#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৩_১৪

২০.
তৃষ্ণার্ত চোখের দৃষ্টি মিটাতে চলে আসে যাবিয়াজ ইফদিয়ার বাসার সামনে। গাড়িটা আড়ালে বরই গাছের নিচে দাঁড় করায়। গাছটা বিশাল বড় না হলেও যাবিয়াজের গাড়ি দৃষ্টি অগোচর করতে সক্ষম।
গাড়ির প্রধান বাতি বন্ধ করে ফেলে। কেননা রাস্তায় নিভু নিভু ডিম বাতি জ্বলছে। বুঝা যাচ্ছে বাতিটা ফিউজ হওয়ার পথে। নিভু বাতির ঝলকটা লক্ষ করছে ইফদিয়ার। নিজের অজানা মনে যাবিয়াজ এর নেশাত্ব কাছাকাছি মনে হচ্ছে তার। কিন্তু জানে এই যে তার মনের ভ্রম মাত্র। যাবিয়াজ এনজিও ক্যানভাসে আটঁকা পড়েছে। দেখাও মেলবে সেই এক সপ্তাহ বাদে। বাম হাতে মুখ চেপে হামি দেওয়া বন্ধ করে ফেলে। সে রাতটা আকাশী মনোভাবে বিলাস করতে চাই। আজ আকাশে চাঁদের চৌপাশে ঘন তীর্যক তারা ঝিকিমিকি রুপে আলোর বর্ষণ ফেলছে। তারাগুলির মধ্যে সে লাভ স্টারস খুঁজছে। অথাৎ অগণিত তারার ছড়াছড়ির মাঝে দুটি তারার মিলনান্দ্রের আপনত্বময় তারা খুঁজছে। যে দুটি তারা সবসময় একসঙ্গে আঁটকা পড়বে। থেমে যাবে তাদের বিচ্ছেদের গতি। আজীবন আবদ্ধ রইবে সংস্পর্শের সাগরে।
কিন্তু ব্যর্থ দৃষ্টিকোণে পড়ল না পরম মায়াময়ী তারার মিলনান্দ্র ভালোবাসা। যাবিয়াজ নিরিবিলি গাছের নিচে গাড়ি থেকে বের হয়। তার সরু ঘোরলাগা দৃষ্টি পিচ্চি মেয়েটির উপর। না জানে কি পায় এ মেয়ের মাঝে সে! যার ফলে ঘুমকে উজার করে রাত বিরাতে চোখের তৃষ্ণা মিটাতে চলে এলো। আনমনে নিজের মনের গহীনকে প্রশ্ন করে যাবিয়াজ।

‘আমি কি কোনোভাবে পিচ্চি মেয়ের মায়ায় পড়লাম! নাকি এক ধরনের আকর্ষণশক্তি। যা মেয়েটি আমায় প্রতিবার ওতপ্রোতভাবে বুঝিয়ে দেয়। হায় আল্লাহ! শেষে কি সর্বনাশের কবলিত কবি হয়ে প্রেমরোগের বর্শীভূত হলাম।’

ঠোঁটের কোণায় ঝিলক প্রাপ্তিময় হাসি ফুটে তার। তবুও সে প্রকাশ করবে না। কেনো করবে পিচ্চি মেয়ে সে। বয়সের তফাৎ তাও খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। মনের একরাশ ভাবনার ছেদ ঘটে চুলকানির কারণে। বিরক্ততে ‘ব’ উচ্চারণ করতে গিয়েও করল না। নরম ঢিলেঢালা কালশিরা রঙের টি-শার্ট আর গাড় নীল রঙের নরম ঢিলা প্যান্ট পরেছে। যা পায়ের টাখনুর উপর পর্যন্ত বিরাজমান। গাড় নীলরঙটি আঁধারে গাড় কালো রঙের ন্যায় দৃশ্যমান হচ্ছে। যার ফলে মশার অজস্র কামড় সহ্য করতে হচ্ছে তার। তার চেয়ে বড় কথা হলো মশারা রক্তের ঘ্রাণ যেখানে সেখানে পেয়েই যায়। তাই তো রক্তের ঘ্রাণে স্বাদ মিটাতে চলে আসে। সেও দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। যেখানে মশা-মাছির চৌদ্দ গৌষ্ঠি ভনভন করে ঘুরে বেড়ায়। অতঃপর মশারা সুযোগ নিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে উঠে পড়ে লেগেছে।
যাবিয়াজ অসহায় দৃষ্টিতে এক পলক ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘শেষমেষ মেয়েটির জন্যে রাতের আঁধারে মশার সঙ্গে বাসর করতে হচ্ছে শাহ। শাস্তি বিয়ের পর দেবো। যত কামড় মশা দিছে না। এর চেয়ে বেশি যদি তোমায় না দেই। তাহলে আমার নাম যাবিয়াজ মেশরাফ না।’

মশাকে হাত দিয়ে তাড়িয়ে গাড়ির ভেতর বসে। সারারাত থাকতে পারবে না তবুও রাতের মধ্যভাগ তো পারবে। এনজিও তে সকাল ৭টা থেকে কেন্দ্র প্রশিক্ষণ শুরু হবে। এখনো হোটেল এ সকলে দারুণ বিশ্রামে মতঁ। গাড়ির কাঁচ হালকা করে নামিয়ে নিজস্ব দৃষ্টি ইফদিয়ার অক্ষিপল্লবে রাখে।
মেয়েটির বিস্ময় দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করে যাবিয়াজ আসমানের দিকে ঘনপলক রাখে।
আঁধার রাত্রিতে অগণিত তারার মাঝে আলোর ফুলকি ছুটে যাচ্ছে। আনমনে গাড়ি থেকে পুনঃপুনঃ হয়ে বের হলো। গাছের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্য উপভোগ করতে লাগে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ইফদিয়ার বিস্ময়ময়ী দৃষ্টিতে ভাবে।

‘এ কি তারা ছুটল কেনো!’

দৃষ্টি সরিয়ে যেই জানালা বন্ধ করতে নিল। তখন অবাক হয়ে রাস্তার মধ্যে গাড়ি দেখে। যেটি যাবিয়াজের গাড়ি। আর চার-পাঁচ না ভেবে গায়ে উড়না জড়িয়ে দৌড় লাগায়। আস্তে ধীরে দরজা বন্ধ করে গাড়ির কাছে চলে এলো। যাবিয়াজ এখনো কারো অস্তিত্ব টের পেল কিনা ধারণা করা ব্যর্থ। একদৃষ্টিতে কালো আকাশের দিকে পল্লবিত মুগ্ধতায় চেয়ে আছে। হালকা কাশি দিয়ে ইফদিয়ার বলে,

‘কবে আসলে!’

‘দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।’

স্বাভাবিক পাত্তাহীন ভাব নিয়ে বলে যাবিয়াজ। ইফদিয়ার ঠোঁট ফুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘এ্যাহ ভাব দেখো মশাইয়ের। আমারি বাসার সামনে এসে চৌকিদারী করছে। আবার আমারি মুখের উপর কথা ! বুঝাচ্ছি খাড়া বেটা।’

‘তুমি আমার বাসার সামনে কি করছো!’

সরু চোখে যাবিয়াজের দিকে তাকায়। সে পলক ফেলে ইফদিয়ার মুখশ্রীতেও তাকাল না। বরঞ্চ পকেটে হাত গুজে একধ্যানে আকাশের দিকে চেয়ে থেকে বলে,

‘জানো তারার মত ছুটে যাওয়া জিনিসটি কি!’

‘কি আবার তারাই হবে।’

‘উহুম উল্কাপাত।’

‘মানে!’

‘আকাশে তারার মত ছুটন্ত বস্তু হলো উল্কাপাত। যদি এটি ভূপৃষ্ঠে পতিত হতো। তাহলে একে উল্কাপিন্ড বলা হতো। জানো কি ! এগুলো কেনো আসে।’

আগ্রহদীপ্ত হয়ে ইফদিয়ার শুনার আকাঙ্ক্ষায় চেয়ে আছে যাবিয়াজের পানে। মুচকি হাসে পুনরায় বলে,

‘মহাকাশে নানা রকম মহাজাগতিক বস্তু আছে। নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে ভেসে বেড়ানো জড়পিণ্ড। ছোট-বড় অসংখ্য জড়পিণ্ড মহাকাশে ভেসে বেড়ায়। এই জড়পিণ্ডগুলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং অভিকর্ষ শক্তির কারণে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে। এরপর তারা পৃথিবী বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর বায়ুর সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে জ্বলে ওঠে। বায়ুমণ্ডলে আসার পর মেসোস্ফেয়ার স্তরে থাকা অবস্থায় আকাশে উল্কা দেখা যায়। বেশিরভাগ উল্কাই বায়ুর সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে জ্বলে ছাই হয়ে যায়। যেগুলো ছাই হয় না। পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে সেগুলোই হচ্ছে উল্কাপিণ্ড।

ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ কিলোমিটার থেকে ১১৫ কিলোমিটারের মধ্যে খালি চোখে উল্কা দেখা যায়।
উল্কা নানা আকৃতির হয়ে থাকে। আকার অনুযায়ী তাদের ওজনও আলাদা। উল্কা নানা রঙের হলেও কালো রঙের উল্কার সংখ্যাই বেশি।’

যাবিয়াজ এটুকু বলে দম ছেড়ে দুই হাত বুকের উপর গুজে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে,

‘উল্কা নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। উল্কাপাতের সময়কে অনেকে ইচ্ছেপূরণের সময় বলে। তাদের ধারণা ‘তারা খসে পড়া বা তারা ছোটার’ সময়ে কোনো মনোস্কামনা বা প্রার্থনা করলে তা পূরণ হয়। কেউ কেউ ‘তারা ছোটা’ অর্থাৎ উল্কাপাতকে মনে করেন সৌভাগ্যের লক্ষণ। কুরআনের মতে কি তা বেশ ভালো মনে নেই।’

ইফদিয়ার কৌতুকপ্রদ দৃষ্টি রেখে মিহি গলায় বলে,

‘এমনভাবে প্রার্থনা তো খ্রিস্টান ধর্মালম্বী মানুষেরা করে।’

‘আই থিংক ইয়েস।’

‘আচ্ছা আমি কালকে হাফেজা আপু থেকে জিজ্ঞাসা করব।’

যাবিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কি কথা!’

‘এই যে উল্কাপাত নিয়ে কুরআনের কি ব্যাখ্যা।’

‘ভালো এতো রাতে এখানে আসার কারণ!’

ভড়কে গেল ইফদিয়ার। এতক্ষণ মানুষটার সঙ্গে সময় কাটিয়ে ভালো লাগছিল তার। এখন হুট করে রাগান্বিত গলায় প্রশ্ন করায় ভীতু বনে গেল। আমতা আমতা করে বলে,

‘আসলাম বয়ফ্রেন্ড কে দেখছিলাম।’

‘রিয়ালি পড়াশুনা ছেড়ে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছো। খুব তো আমাকে ভালোবাসো বলো। এখন ঠিক মত পাল্টে গেল। রাস্তা ভালোই যাও। কিন্তু মুখটা আমাকে দেখাবে না। যতসব লো ক্লাস সেকেন্ড ইউজ হ্যান্ডেড গার্ল।’

যাবিয়াজের মেজাজ টুঙ্গে গেল কেন তার ধারণা নেই ইফদিয়ার। কিন্তু আপন মানুষের মুখে নিজস্ব নিদোর্ষ চরিত্রে বাজে কটু কথা কি কারো সহ্য হবে। হবে না তেমনি ইফদিয়ার রাগে শরীর রি রি করে কাঁপছে। মাথা নিচু করে যাবিয়াজের কথা শুনার পর উদাসীন কণ্ঠে বলে,

‘চরিত্র নিয়ে দারুণ ব্যাখা দিলা। তো শুনি কিসের ভিত্তিতে তুমি আমার চরিত্রে ইউজ হ্যান্ডেড এর তর্কমা লাগালে।’

‘ওহ প্লিজ নাটক করা কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক। দিন নাই দুপুর নাই অন্য নাগরের সঙ্গে রিক্সা, সিএনজি তে ঘেঁষাঘেঁষি করে বেড়াও। আর আমার সামনে এলে সতিসাবিত্রী রুপ ধারণ করে। বাহ তোমার প্রশংসা না করলেই নয়।’

‘তুমি কি জানো লোকটা কে!’

লোকটার সম্বন্ধে পাল্টা প্রশ্ন করায় যাবিয়াজ এর রক্ত গরম হয়ে টগবগিয়ে উঠে। অন্য ছেলের কথা সে তার প্রিয় অপ্সরীর মুখে নিতে পারছে না।
ঠাস….. কষিয়ে দিল এক চড়। ইফদিয়ার চড়ের আঘাতে পা পিছলে পড়ে গেল। ছলছল অশ্রু নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। হিঁচকি তুলে গলায় কান্না আঁটকে নিল। যাবিয়াজ অসহ্যের ন্যায় খিটখিটে গলায় শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘আহ নতুন নাগর জুটাতে তোমাদের মত মেয়েদের এক সেকেন্ডও লাগে না। এই এক তো ওই এক। আরো তোমরা ছেলেদের ব্লেম করো। যে আমরা পোশাকের মত মেয়ে বদলায়। তাহলে ইউ আর রং অলসো গার্ল। রং তামাশা করা তোমাদের ফিদরত। আমাদের নয় ডোন্ট সি মি ইউর ফেস এগেইন। রাদার আই উইল ডিসটোরই ইউ।’

যাবিয়াজ চরম আক্রোশে পিছে ফেরে চলে যেতে আরম্ভ করে। তখন ‘দাঁড়ো’ বলে ইফদিয়ার কাঁপান্বিত গলার আওয়াজ করে যা শুনে থমকে যায় যাবিয়াজ। মেয়েটি কাঁপা গলায় আফসোসের সুরে বলে,

‘যে বিশ্বাস করে তার কোনো ব্যাখার প্রয়োজন হয় না, যে বিশ্বাস করে না; তাকে হাজার ব্যাখা দিলেও বোঝানো অসম্ভব। কারণ এটি ভেঙ্গে যায় সহজে, হারানোও সহজ কিন্তু ফিরে পাওয়াটা জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি।’

ইফদিয়ার দাঁড়িয়ে থাকার কোনো পন্থা পেল না। দৌড়ে বাসায় চলে যায়। তার যাওয়ার পানে এক-দু পলক চেয়ে থাকে যাবিয়াজ। পিচ্চি মেয়ে হওয়ার সত্ত্বেও উক্তি দিয়েছি মহীয়সী কোনো নারীর মত। আর সে কি করল! ভ্রু বাঁকিয়ে বিরক্তিসূচক কণ্ঠে নিজেই বলে যাবিয়াজ।

‘বাহানা তোমাদের দ্বিতীয় পথ ছেলেদের বশ করার। আমি বিশ্বাসই করতে পারি না ভাবে মেয়েটা!’

আক্রোশপূর্ণ বেগে পা দিয়ে জোরে লাথি দিল গাড়ির টায়ারে যাবিয়াজ। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। আনমনে বলে উঠে।

‘এতই যদি ভালোবাসিস তাহলে কেন তুই অন্য ছেলের সঙ্গে সিএনজিতে উঠেছিলি। ভালোই তো বাসতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু এক নিমিশেষে আমার বিশ্বস্ত মনের কৌটায় নিজের নাম মুছিয়ে দিলি অপ্সরীমনি। কেনো বেশি সহ্য করতাম না বলে। কই পরিশেষে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তুই নিজ হাতে ভেঙ্গে দিলি হৃদপিন্ডে গড়া প্রেম। হ্যা তুই দোষী, ছলনাময়ী তুই।’

যাবিয়াজ এর চোখের কোণায় রাগ-অভিমানে জল চলে এলো। তবু নিচে গড়িয়ে পড়তে দিল না। গাড়িতে বসে ইঞ্চিন চালু করে ক্যানভাসের দিকে চলে গেল।

২১.

ইফদিয়ার বিছানার সঙ্গে ঠেসমেরে হাটুগেরে বসে আছে। চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রু নিশ্চুপে বয়ে যাচ্ছে। মুখে অভিমানী কথন না ফুটলেও মনের গহীনে শত অভিমান জোড়ো হয়ে কথা বলছে। চিৎকার করে কাঁদছে তারা। যার ফলস্বরুপ চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরে পড়ছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
কট কট দরজায় শব্দ হওয়ায় ইফদিয়ার নড়েচড়ে উঠে। বসা থেকে উঠে উড়না ঠিক করে নিল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে ঘুমের ভান করে দরজা খুলে। ইসমাইল ছটপট করছিল অজানা কারণে। দরজা খুলতেই সে ফট করে ইফদিয়ার দিকে দৃষ্টি মেলে তাকায়। ভাইকে দেখে কলিজা কেঁপে উঠল ইফদিয়ার। এই বুঝি জানতে পারলে না জানি কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে ভাইয়া!
ভাবতেও শিরা-উপশিরায় শীতল রক্ত বয়ে গেল।
ঘুমকে আঁকড়ে ধরার ভান করে আমতা আমতা কণ্ঠে ইফদিয়ার বলে,

‘ভাইয়া তুমি ঘুমাও নি।’

‘আব না মানে ফজরের আযান দিবে কিছুক্ষণ পর। ঘুম থেকে উঠে কেনো যেন তোর কথা খুব মনে পড়ছিল। বুকটা ধড়ফড় করছিল এই বুঝি তোর সঙ্গে কোনো খারাপ কিছু হলো না তো। তাই ছুটে এলাম বোন। কিছু মনে করিস না তোর ঘুম না হলে ঘুমা।’

‘আরে না ভাইয়া কি বলিস! কিছু হয় নি। মাত্রই জাগলাম। আমিও নামাজ পড়ে স্কুলে যাওয়ার জন্যে রেডি হবো।’

ইসমাইল শত চিন্তার থেকে মুক্তি পেল। তার বোন ভালো আছে দেখে আর শুনে চলে গেল নিজ রুমে। দরজা আঁটকে ওযু করে নিল ইফদিয়ার। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। দু-তিনেক সেকেন্ড পর ফজরের আযান শুরু হলো। সঙ্গে ইফদিয়ার চোখ থেকে পুনরাবৃত্তি অশ্রুসিক্ত হলো।
নামাজে মনোনিবেশ করে সে।

যাবিয়াজ কে আজ সকাল থেকে মনমরা গম্ভীর ভাবে দেখে এরফান-ফেরদৌস এর ভালো লাগছে না। তাদের দোস্তকে রসিকতার মুখশ্রীতে মানায়। এরফান গতকাল অজ্ঞান হওয়ার পর তাকে জ্ঞান ফিরিয়ে যে পরিমাণে পঁচিয়ে ছিল যাবিয়াজ। তা ভুলা মুশকিল এরফানের। তখন বেশ উৎফুল্ল মেজাজে হাসছিল যাবিয়াজ। আর একদিনের মধ্যে এমন কি হলো যার ফলাফল যাবিয়াজ এর মুখেই বিরাজমান। তা কি শুধু মুখে নাকি হৃদয়ের মাঝেও বিদ্যমান। জানা নেই এরফানের।
ফেরদৌস কিছু বলতে গিয়েও পারল না। ল্যাব থেকে একজন প্রশিক্ষক ডাক দিল তাকে। এরফান আর যাবিয়াজ রোগীদের পর্যবেক্ষণ করছে। গতকাল যে রোগীকে চেকআপ করেছিল। আজ তাকে রিলাইজ দিয়েছে। সুস্থ হওয়ার জন্যে বিনামূল্যে ওষুধ দিয়েছে। যা দিনে দুবার খাবারের পর গ্রাহ্য করেছে। রোগীর মারাত্মক রোগ নয় বরঞ্চ নিউমোনিয়া হয়েছে। বিধায় তার পরিবারের সদস্যগণ নিশ্চিত মনে রোগীকে নিয়ে গেল।
বাদ বাকি একজনকে চেকআপ করে ল্যাবে চলে যায় যাবিয়াজ। এরফান শুধু গাম্ভীর্য যাবিয়াজ কে প্রতিসরণে রেখেছে। সেও চলে যায় ল্যাবে।

_______

পরের দিন…

মিসেস জাবিয়ার শরীরের উন্নতি হচ্ছে ধীরগতিতে। নিষ্ঠুর সেই দিনটির পর আহসান সাহেবকে বাসার চৌপাশে পাওয়া যায় নি। এমনকি ইফদিয়ার নিজে গিয়ে ছিল সেই নোংরা আবর্জনাস্তূপে যেখানে আহসান সাহেবকে ফেলে দেওয়া হয়ে ছিল। পরন্তু সেখানে গিয়ে মানুষটির ছিটেফোঁটাও দেখল না। জায়গা নোংরা দুর্গন্ধময় হওয়ায় ইফদিয়ার বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল না। ফিরে গেল বাসার পথে।
স্কুলে মশিউর স্যার পদার্থবিজ্ঞানের তাপগতিবিদ্যার উপর টেস্ট নিচ্ছিলেন। তিয়ানা এখনো স্কুলে আসে নি। তার সুস্থ হতে দু-তিন মাস সময় লাগবে জানিয়ে ছিল রুহিয়া। সে স্কুলে আসে। ইফদিয়ার মনটাও ফুরফুরে থাকে। সে আর ভার্সিটির ধারেপ্রান্তে যায় নি। সেই কালো রাতের পর নিজেকে গুটিয়ে নিল সিমে।
রুহিয়া তার বিষন্ন মুখ দেখে বলে,

‘দোস্ত আর ইউ ওকে!’

‘আব ইয়াহ কেন!’

‘না লাগছে কিছু হয়েছে তোকে কখনো বিষন্নময়ী রুপে দেখেনি। আজ হঠাৎ দেখে খটকা লাগল।’

‘ওহ কিছু নয় আম্মু প্যারালাইসিস রোগী। চিন্তে হচ্ছিল আম্মুর।’

‘চিন্তে করিস না ইসমাইল ভাইয়া আছেন। আন্টিও ইন শা আল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন।’

ইফদিয়ার উত্তরে শুকনো হাসি দিল নেকাপের গুপ্তবেশে। মাথা নেড়ে নিচু গলায় ‘ইন শা আল্লাহ’ বলে।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৫

২২.
অতলস্পর্শীর বিরহে যাওয়ার নিপীড়ন কি সহজে ভুলা যায়। প্রতিটা মুহূর্তই দরুণ মনে জেরা করে উঠে। কপোতাক্ষ নদের তীরে অঢের জলের ঢেউ এর ধারপ্রান্তে পা ভিজিয়ে বসে আছে ইফদিয়ার। পায়ের টাখনু পর্যন্ত পা ভিজে গিয়েছে।
জুতাজোড়া বালির উপর রাখা। বোরকার নিচের অংশের পাড় হাটু অব্দি বেঁধে রেখেছে।
যশোরে মনকাতরতার চেয়ে মন উৎফুল্ল করার প্রধান মাধ্যম কপোতাক্ষ নদ।

বোর্ড পরীক্ষা শেষ হয়েছে একসপ্তাহ হলো। তিয়ানা ছাড়া নিঃসঙ্গতায় কাটলেও রুহিয়া ছিল একমাত্র মেয়ে। যে কিনা বান্ধবীর পরিবর্তে এলেও কখনো বুঝতে দিতো না বান্ধবী ছাড়া নিঃসঙ্গতার জড়তা। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তিয়ানার সঙ্গে কথাও হয় নি। কারণ তার ফোন অসুস্থতার সময় ধরা বারণ। চিকেন ফক্স এর মত রোগ থেকে এখনো সেরে উঠতে পারিনি।
পরীক্ষা দিয়েছে বহু কষ্টে। বাসা থেকে পরীক্ষা দিতে এলে তাকে আলাদা কক্ষে বসিয়ে দেওয়া হতো। যে কক্ষে কোনো ছাত্র-ছাত্রীর প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা। আলাদা কক্ষে নিঃসঙ্গ নিরবতায় তার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তাকে দূর থেকে দেখার সাধ্যতা পেয়ে ছিল ইফদিয়ার। তার কক্ষের বাহিরে গার্ড দেওয়ার জন্যে পিয়ন থাকত। তারা কড়া গাইড দিয়ে সকলকে তাড়িয়ে দিতো। ইফদিয়ার করুণ চাহনী দিনকে দিন তিয়ানার জন্যে জমাটবদ্ধ হয়ে উঠছিল।
শেষ পরীক্ষায় কাছে যেতে গেলেই তিয়ানা নিজ দায়িত্বে দূরে সরে গেল। তার অসুস্থময় চাহনীতে শুধু ছলছল চোখজোড়া লক্ষ করে ছিল ইফদিয়ার। এর মর্মই হলো যে অসুস্থতায় তিয়ানা ভোগছে সে অসুস্থতায় কোনোভাবেও নিজের বান্ধবীকে ভোগ করতে দিবে না। ফলাফল দুমুঠো চোখের জল ফেলে প্রস্থান করে।
অতএব বেশ চাপা কষ্ট মিটাতে না পেরে নদের পাড়ে চলে এলো ইফদিয়ার।
কিন্তু মস্তিষ্কের ইচ্ছার বিরুদ্ধ হলেও মনে চেয়ে ছিল একবার ভার্সিটির প্রবেশদ্বার দেখে আসতে। কিন্তু কোথাও না কোথাও মান-অভিমানের দুটানার আলিঙ্গন হৃদয় জুড়ে বিরাজমান ছিল। সময়টা এমন যে গৌধূলী বেলা আরম্ভ হয়েছে। আনমনে চেয়ে আছে গৌধূলীর লগ্নে। কপোতাক্ষ নদের মুগ্ধতর ঢেউয়ে মনে পড়ে যায় বিখ্যাত স্পর্শীময় কবিতা।

“সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপ্নে
শোনো মায়ামন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান ভ্রান্তির ছলনে।”

অসাধারণ কবিতাটি লিখতে গিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কপোতাক্ষ নদকে ঘিরে নিজের সুখীকাতরতার মর্ম বুঝিয়েছেন। উনার দেশপ্রেমিকতার বক্ত করার মত ভাষা নেই মুখে। তবুও সেই স্পর্শীময়ী কবিতায় তিনি নদকে ঘিরে স্মৃতিচারণ করিলেও ইফদিয়ার মনে প্রিয়ম মানুষটির স্মৃতি ফুরফুরে উঠে।
মানুষটি কে ভুলতে চেয়েও পারে না। কেমনে পারবে জীবনে তার কাছে মা-ভাইয়ের পর ঐ মানুষটিই ছিল একমাত্র শেষ অস্তিত্ব। যার হাত ধরে নদ-নদীর কিনারায় হাঁটতে চেয়েছিল। তিমির আঁধারে কুহু ডাকের পাখির কলকাকলিতে চন্দন মাখাতে চেয়ে ছিল একে অপরের গালে। শত স্বপ্ন আজ স্বপ্ন রয়ে গেল। পূর্ণ হবার আকাঙ্ক্ষা আজও জেরা করে বেড়ায়। হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘাবড়ে গেল ইফদিয়ার। ভাবনাটাও বিচ্ছেদের মত ফুড়ৎ করে উড়ে গেল মন হতে। পাশ ফিরে দৃষ্টি মেলে দেখে ক্লাসের সেই বোকা ছেলেটি। যাকে সে বোকা বানিয়ে ছিল সিটে বসতে না দেওয়ার জন্যে। বোকা ছেলেটিকে পলক ফেলতে সম্মুখে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। নেকাপ শুদ্ধভাবে টেনেটুনে বোরকা টান টান করে ফেলে। ছেলেটি এখনো ভ্রু কুঁচকে ইফদিয়ার কান্ড কারবার দেখছে। যখন দেখল মেয়েটি নড়চড় করছে না। তখন গলা খাকড়ি দিয়ে প্রশ্ন করে।

‘তুমি ইদানিং চঞ্চলতার মাঝ থেকে হারিয়ে গেলে কেনো!’

ছেলেটির কথায় জবাব দিতে হিমশিম খাচ্ছে ইফদিয়ার। অস্বস্তিময়ী দৃষ্টিতে হাত মুচড়ামুচড়ি করে আমতা করে বলে,

‘দেখেন ঐদিনের জন্যে রিয়েলী সরি। সেসময়টা বাচ্চামো ভেবে মাফ করবেন। আল্লাহ হাফেজ আসি।’

কথা কাটিয়ে বুকের ঘাবড়ানো আঁটকে নদের পাড় থেকে চলে যায় ইফদিয়ার। ছেলেটি নিঃশব্দে জোরালো শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় শিরঃপীড়া বয়ে যাচ্ছে রমণী। তবুও তোমার সুরেলা কণ্ঠধ্বনিতে মিষ্টান্ন কথন আলাপ করার সুভাগ্য হলো না। এতটাই কি যোগ্য নয় আমি!’

আনমনা হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে ছেলেটি। উত্তর ভাবলেশনহীন হয়ে রইল। এর উত্তরটা যে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। ‘ওয়াসিব’ কোনো পুরুষেলী সূক্ষ্ম কণ্ঠের মধ্যে নিজের নাম শুনে দৃষ্টিপাত করে উক্ত মানুষটির উপরে।
মানুষটি এসে উদাসীন ওয়াসিবকে দেখে হতাশের সুর টেনে বলে,

‘ওয়াসিব চল এবার। যার কাছে তোর মূল্য ক্ষুণ্ণ তার কাছে ভিক্ষা চাওয়ার কোনো মানে হয় না।’

ওয়াসিব অসহায় দৃষ্টিলব্ধে পুরুষটির দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখে। সূক্ষ্ম কাতর গলায় সে বলে,

‘ওরাইব ভাই আমি কি নিতান্তই অযোগ্য ঐসে রমণীর।’

‘এমন না ভাই তুই আর সে তফাৎ আকাশ-পাতালের। জানি মেয়েটির জন্যে তোর মনে স্ফট ফিলিংস আছে। কিন্তু আমার মনে হয় না তার মনে এর অনূভুতির কণাও আছে কিনা! কারণ মেয়েটিকে দেখলে মনে হয় কোনো বিষাদের ছাঁয়া নিয়ে সে চলছে। একবার সেই ছাঁয়া মায়ায় রুপ নিলে বোধ হয় বিরহের তৃষ্ণা ভালোবাসার মিলনে বেঁধে যাবে।’

ওরাইব এর মুখে আহ্লাদী অনুভবী কথা শুনে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রুক্ষ মেজাজে ভরে উঠে ওয়াসিবের। কথাগুলো সহ্যহীন লাগছে তার কাছে। সে চাইছে কথাগুলো যেন ভবিষ্যৎ এ মিথ্যে প্রমাণ হোক। ওরাইবকে কতিপয় কথা বলতে বারণ করে আক্রোশে দ্রুত পা ফেলে নদের পাড় হতে চলে যায়। নিজ স্কুটির সামনে এসে হেলমেট মাথায় পড়ে নিল ওয়াসিব। তাকে রেগে চলে যেতে চিন্তার ভাঁজ কপালে ফুটে উঠে ওরাইবের। সেও ছুটে এলো ওয়াসিবের কাছে।
ওরাইবকে দেখেও অদেখার ভান করে তীক্ষ্ম গলায় বলে,

‘ওরাইব ব্রো আইম নট ইন্টারেস্টেড ফর লিসেন ইউর ব্লশীট টকিং।’

ওরাইব শুনে শুকনো ঢোক গিলে অপরাধী গলায় বলে,

‘আইম সরি ব্রো প্লিজ গিভ মি এ লিফ্ট।’

‘কাম ফাস্ট।’

গাম্ভীর্য কণ্ঠে বলার পরও ওয়াসিবের চুক্ষগোচরে মুচকি হাসে ওরাইব। সে জানে তার ভাইটা অত্যন্ত আবেগী মানুষ। সহজে কেঁদে ফেলে শক্ত মানুষী রুপ তার মাঝে নেই। কষ্ট পেলেও এত কাঁদে না যত না কষ্ট পাই প্রিয় মানুষের অবহেলায়। ওরাইব সাক্ষি তার ভাইকে সে দেখেছে কেমনে প্রতিটা রাত ওয়াসিব বিলাপ করেছে নিজের সঙ্গে। বলতে থাকতো যে কেনো সেই মাতাল করা রমণী তাকে সহ্য করে না। কেনো দূরে সরে থাকে! এমন আজগুবি কথা প্রায় ওয়াসিব রাতের আঁধারে আকাশপানে চেয়ে থেকে বলতো।

২৩.

ইসমাইল চেম্বারে বসে ছিল। দিনটায় বেশ ধকল যাচ্ছে। রবিবার হওয়ায় এক এক রোগীর আনাগোনা চলতেই আসে। টেবিলে রাখা ফাইলে ওষুধের নাম লিখছে। যা ইতিমধ্যে ফার্মেসী থেকে আনতে অর্ডার করবে সে। কিছুক্ষণ পর মেইল নার্স এসে বলে,

‘গুড আফটারনুর ড.।’

‘গুড আফটারনুর ব্রো। এনি অফ পেশেন্ট ওয়েটিং নাউ!’

উক্ত প্রশ্নে মেইল নার্স দরজা খুলে একবার বাহিরে উঁকি দিল। চেম্বারের বাহিরে বসার সিটে কোনো রোগী অপেক্ষায় নেই। আপাতত খালি পড়ে আছে। অন্যান্য চেম্বারের সম্মুখে রাখা সিটে মানুষ বসে আছে। দরজা ভিজিয়ে ইসমাইল এর দিকে শান্ত দৃষ্টি ফেলে আশ্বস্ত গলায় বলে,

‘নো ড. আপনি রেস্ট করতে পারুন।’

ইসমাইল সুখপ্রাপ্তির জোড়ে শ্বাস নিয়ে তার সামনে বসা রোগীকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিল। মেইল নার্সটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘শুনো এই রোগীকে সঙ্গে করে ফার্মেসীতে যাও। প্রেসক্রিপশনে লিখা দুটি ওষুধই যেন তিনি পান।’

মেইল নার্স ‘ওকে’ বলে রোগী কে সঙ্গে আসতে ইশারা করে। রোগীটি বৃদ্ধ এক পলক ইসমাইল এর দিকে বিশ্বস্ত দৃষ্টিতে তাকায়। ইসমাইল মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। বৃদ্ধ রোগীকে আঁকড়ে ধরে মেইল নার্স ফার্মেসীর দিকে এগিয়ে গেল।
তৎক্ষণাৎ টেবিলে রাখা ল্যান্ডলাইনে কল আসে। ‘ঠুন ঠুন’ করে শব্দ করে কল আসছে তা জানান দিল ইসমাইলকে। ল্যান্ডলাইনের হ্যান্ডসেট পাঁচ আঙুলের ভাঁজে নিয়ে কানে ধরে। অপরপাশের ব্যক্তি সালাম দিল। কণ্ঠটি শুনে স্মিত হাসি ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠে তার। উৎসাহী কণ্ঠে বলে,

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ড. ইসমাইল স্পিকিং।’

‘কেমন আছো!’

‘আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল। আপনি কেমন আছেন!’

‘আলহামদুলিল্লাহ বাবা তোমার কাছে একটি আবদার করব। পালন করবে!’

‘জ্বী বলেন বাবার সমান বয়সী আপনি আঙ্কেল। নিদ্বিধায় বলতে পারেন।’

‘বাবা তোমার থেকে এনজিও ক্যানভাসে আসা স্টুডেন্টদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে আলোচনা করো। তাদের ধাপান্তর প্রতিটা চিকিৎসার ক্ষেত্রে কেমন তা একমাত্র তুমিই পারবে বুঝাতে।’

আঙ্কেলের কথা অমান্য করার সাধ্য ইসমাইল এর ছিল না। কারণ এই আঙ্কেলটা ছিল মায়ের পর দ্বিতীয় উদারচিত্ত ব্যক্তি। যিনি উৎসাহ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। মুচকি হেসে ‘ওকে আঙ্কেল’ বলে।

অপরপাশের ব্যক্তির কিছু মনে পড়তেই ‘ওয়েট বাবা শুনো শুনো’ বলে উঠলেন। ইসমাইল কল কেটে দিতো তখনি তিনি বলায় থেমে যায়। তিনি পুনরায় অনুরোধ কণ্ঠে বলেন,

‘বাবা মেডিক্যাল স্টুডেন্ট এর সঙ্গে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি উপবিভাগের ছাত্ররা এসেছে। তাদের বায়োজেনেটিক পদ্ধতিটা তোমার মাধ্যমে পর্যালোচনা করতে চাচ্ছি। আজ বিকালে ফ্রি থাকলে ঠিকানা দিবো চলে এসো। কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে বাবা।’

শেষের কথাগুলো খুবই নম্র আর সরলভাবে বললেন। ইসমাইল প্রতিটা কথা মানলেও শেষ কথাটি মানতে তার মন বাঁধা দিচ্ছে। একটুখানি ভেবে দেখল বাসায় তার বোন,মা আর কাকীমা আছে। তিন নারী মানুষ একা থাকলে কোনো না কোনো দুঘর্টনার শিকার হতে পারে।
দুশ্চিন্তাময় কণ্ঠে সে বলে,

‘সরি আঙ্কেল আমার পরিবারে তিনজনই মেয়ে মানুষ। ওদের ছেড়ে এতদূর যাওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না।’

অপরপাশের ব্যক্তি ভেবে বলেন,

‘শুনো আমি এনজিও ক্যানভাসের ঠিকানাসহ আমার বাসার ঠিকানা দিবো। সেখানে চলে যাও আজকের মধ্যে। রাতে পৌছেঁ যাবে আশা করি। বাসায় আমার স্ত্রী আর মেয়ে আছে। তারা তোমাদের আপ্যয়নে কমতি রাখবে না।’

‘থ্যাংকস আঙ্কেল চিন্তা করবেন না পৌঁছে কল দেবো আপনাকে। রাখি আল্লাহ হাফেজ। ‘

অপরপাশের ব্যক্তি স্মিত হেসে জবাবে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে কল কেটে দিলেন। ইসমাইল কল রেখে দেরি করল না। চেম্বার হতে বেরিয়ে গেল। এখন তার অফ ডিউটি হিসেবে দরজায় টোকান লাগিয়ে চলে যায়।

২৪.

রবিউল সাহেব লাঠি ভর করে হাতরিয়ে বাগানে হাঁটছেন। পকেটে ফোনের তীব্র ভাইব্রেশনের কারণে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি গিয়ে বসেন একটি দোলনার উপর। লাঠিটা পরম যত্নে পাশে রেখে কলটি কানে ধরেন।
অনেকদিন পর সেই অপেক্ষাতুর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছেন। এই যে পরম মন ভুলানো হৃদয়ের আবেগ। কাঁপা কণ্ঠে আহ্লাদীময়ী হয়ে বলেন,

‘কেমন অাছেন!’

পুনরাবৃত্তি কল কেটে গেল। মুচকি হেসে ফোন পকেটে গুজে ভাবতে লাগলেন।

‘আজ ছেলেকে যদি বলতে পারতাম। ছোট থেকে কেউ তোর অপেক্ষার প্রহর গুণছে। তাহলে তুই দেরি করতি না তাকে আপন করতে। কেননা সে ছিল তোর চোখের একমাত্র কণিকা। যার মায়াবী চেহারা দেখে তোর হৃদয়হরণ হতে বাধ্য হতো। কিন্তু অন্ধকার চোখের ন্যায় অতীতটাও ভাঙ্গন হয়ে মুছে গেল। তোর হয়ত মনেও নেই সেই কণিকার কথা।’

অন্তরাল হতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে। সবুজ ঘাসে ঘেরাও করা রয়েছে বাগানের চর্তুদিক।
ছেলে কে ছাড়া যেন উনার দিন-রাত ফিকে পড়ে আছে। যাবিয়াজ এনজিওতে গিয়েছে আজ একসপ্তাহ হলো। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষকদের অনুরোধে সময়টা বাড়ানো হলো। ফলস্বরুপ ছেলের স্পর্শ পাওয়ার ভাবনা ব্যর্থ রয়ে গেল উনার।

এনজিও ক্যানভাস….

যাবিয়াজ কম্পিউটিং ল্যাবে বসে অস্ট্রেলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যালে ফরম পূরণ করেছে নিজের বাবার জন্যে। নোটিশ পেয়েছে দুদিন হলো। নোটিশে ভিন্ন ধরনের নিয়মনীতি মেনে চলার আহবান করা হয়েছে। সে নোটিশগুলো বারংবার পড়ে সেখানে একজন ডক্টর কে নিজের বাবার ব্যক্তিগত চেকআপের জন্যে রিজার্ভ করে নিল।
ডক্টর লিওন এর নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিল যাবিয়াজ। অস্ট্রেলিয়ায় দিনের ৩.৪০মিনিট বাজে। কল দিল সে। লিওন চেম্বারের বেলকনিতে বসে কফি খাচ্ছিল। ল্যান্ডলাইনের তীব্র শব্দ আসায় মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখে। হ্যান্ডসেট নিয়ে কানে ধরে সৌজন্যে বলে উঠে।

‘হ্যালো হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ মিস্টার!’

‘আইম যাবিয়াজ মেশরাফ। মাই ফাদার অপারেশন উইল বি হিল্ড দেয়ার।’

‘ওহ মিস্টার মেশরাফ নাইচ টু মিট ইউ। ইয়েস ইউ ক্যান ক্যারি ইউর ফাদার ইন আওয়ার হসপিটাল নেক্সট ম্যানর্থ।’

যাবিয়াজ শুনে চুপ হয়ে গেল। আনমনে শুকনো ডোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে ভাবে।

‘পরবর্তী মাসে তার মানে বাবাকে নিয়ে পাসপোর্ট ভিসা বের করতে হবে। বেশি সময় নেই হাতে। এ যাত্রায় ড্যাডের চোখের রশ্নি ফিরে আসবে ইন শা আল্লাহ।’

তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে লিওনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ওকে ড. আই উইল কাম ভেরি সুন।’

‘ওকে ইয়াংম্যান বাই।’

‘বাই।’

সৌজন্যেতার কাতিরে হাসি দিয়ে কল কেটে দিল।
চট জলদি উঠে ল্যাব থেকে বেরিয়ে বন্ধুমহলের দিকে পা ফেলে। এরফান বসে কোক খাচ্ছিল। এখন দেশে গরমের উত্তাপ সীমিত হলেও পর্যাপ্ত মনে হয়। যেদিন বর্ষণের নামনিশানা থাকে না সেদিন তীব্র গরমের উত্তাপ ভীষণ কড়া দেয়। ফেরদৌস হামি দিয়ে সামনে যাবিয়াজকে হাসিখুশি আসতে দেখে এরফানকে গুতা দিয়ে বলে,

‘দেখ কতদিন পর এই হাস্যজ্জ্বল চেহারা দেখছি যাবিয়াজের।’

এরফান ফট করে তাকায়। সত্যি শুভদিন বলে মনে হলো তার। যাবিয়াজ এসে জড়িয়ে ধরে তাদের। তৎক্ষণাৎ অন্য একজন দৌড়ে এসে তাদের উচু করে জড়িয়ে ধরে। তিনজন যেন ভূত দেখার মত চমকে গেল। ফেরদৌস হা হয়ে যায়। যাবিয়াজ স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় দেখেও ফোন বের করে টিপতে থাকে।

চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here