অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ১৫

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_১৫
#সুলতানা_পারভীন

-মামী প্লিজ স্টপ ইট। অন্য ফ্যামেলি থেকে আসা মেয়েটা তোমাদের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না, কাজ পারে না, সারাদিন শুয়ে বসে থাকে, এসব বলাটা বন্ধ করো প্লিজ। আর ট্রিপিক্যাল শাশুড়িদের মতো আচরণটা করো না মামী প্লিজ। নিজের মেয়ে আর বউয়ের মধ্যে এই যে পার্থক্যটা করছো সেটাই আজকালকার সংসারগুলোর ভাঙার মেইন কারণ। নইলে তুমিই বলো তো মামি? নীলা আসার আগে কি বাড়িতে কাজগুলো সময়মতো কমপ্লিট হয়নি? নাকি নীলা আসার আগে বা পরে এই একমাসের মধ্যে মুগ্ধা কখনো রান্নাঘরের ধারেকাছে ঘেঁষেছে? তাহলে মুগ্ধার বেলাতে কেন এই কথাগুলো বলো না কখনো? ও যে কলেজের নামে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, বাসায় থাকলেও সারাদিন হয় মোবাইল নিয়ে পড়ে আছে, নয়তো টিভিতে। কই কখনো ওর নামে তো কমপ্লেইন করতে শুনি না তোমাকে? তাহলে নীলা এসেছে আজ ত্রিশ দিনও হলো না এখনই তোমার মনে হচ্ছে এই মেয়ে সংসারের কোনো কাজ পারে না, ওকে দিয়ে সংসার হবে না এটসেকট্রা এটসেকট্রা? হোয়াই? যে কাজটা ও পারছে না শিখে নিবে, এ আর এমন কি? খন্দকারদের বাড়িতে নীলা নিজের হাতে এক গ্লাস পানি নিয়েও খেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। তাহলে এটা কেন আশা করছ যে এই বাড়ির বউ হয়েছে বলেই বিয়ের পরেরদিনই ওকে রান্নাঘরের দায়িত্ব দিয়ে তুমি ছুটি নিবে?

দেখতে দেখতেই মাসখানেক কেটে গেছে। এই এক মাসে জিহান নীলার সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি না হলেও একটা অদৃশ্য বন্ধন ঠিকই তৈরি হয়েছে দুজনের মাঝে। জিহানের টেন্ডার নিয়ে সারাদিন অফিসের ধকল সেরে বাড়ি ফেরার পর নীলা ওর মুখটা দেখে কিছু না বললেও ঠিকই গরম ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি রুমে রেখে দিয়ে যায়। রান্নাঘরের হাজার ব্যস্ততার ভিড়েও এই কাজটা করতে ভোলে না নীলা। আর জিহানও সারাদিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া নীলাকে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারাতে সাহায্য করে। এটা যেন ওদের প্রতিদিনকার অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম নীলা রাগে সরে আসলেও এখন আর বাধা না দিয়ে চুপটি করে জিহানের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। হয়তো ক্লান্তিতে, অথবা সময়ের সাথে সাথে আবেগ, রাগ, দুঃখ অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে এসেছে মেয়েটার। অবশ্য চৌধূরী ভিলার চার দেয়ালের মধ্যে নীলার দিনগুলো কি করে কাটছে সেটা হয়তো জিহানের কল্পনারও বাইরে।

আর পাঁচটা দিনের মতোই আজও সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হলো জিহানের বাড়িতে ফিরতে। আর বাড়িতে ফিরে রুমে যাওয়ার আগেই মামী অভিযোগের খাতা খুলে বসলেন নীলার নামে। মেয়েটা সাধারণ একটা রান্নাও পারে না, ঘরের কাজ তো দূর এতোদিনের তোলা ডিনার সেটের দুটো প্লেটও ভেঙে ফেলেছে ধুয়ে রাখতে বলায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মেয়েকে দিয়ে সংসারের একটা কাজও হয় না। সারাদিন মোবাইল, নাহয় ঘুম, ইত্যাদি ইত্যাদি। যে টেন্ডার নিয়ে এতোদিন ঘুম খাওয়া এক করে লেগে ছিল, সেটাই হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় এমনিতেই জিহানের মাথা খারাপ অবস্থা। তার উপরে জিহানের মামী দিলারা জামানের কথাগুলো বলার ফাঁকে ড্রইংরুমের টিভি থেকে ফুল ভলিউমে হিন্দি পার্টি সং বাজার শব্দে নিজের ধৈর্য্যের বাঁধটা সত্যি সত্যিই ভেঙ্গে গেছে জিহানের। নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখেই কথাগুলো বলে দোতলার দিকে পা বাড়াবে এমন সময় দিলারা জামানের কান্নার শব্দে থেমে গেল জিহান। দিলারা জামান রীতিমতো বিলাপ শুরু করেছেন বলা যায়।

-এজন্যই বলে রক্ত কথা বলে জিহান। এতোগুলো দিন ওকে নিজের ছেলের মতো করে আগলে রাখার এই প্রতিদান দিলি? আজ কথাগুলো আমি না বলে তোর মা বললেও কি এভাবে অপমান করতে পারতি তোর মাকে? না পারতি না। আমি তো তোর মা নই, মামী। সত্যিই তো, তোর বউকে কিছু বলার অধিকার আছে নাকি আমার? এজন্যই বলে বিয়ের পরে ছেলেরা আর নিজের থাকে না, বউয়ের কথায় উঠে আর বসে।

-মামী প্লিজ? কথাগুলো তুমি বলো বা আমার মাই বলুক, আনসারটা সেইমই হতো। কে বলছে সেটা ডিপেন্ড করে না, ডিপেন্ড করে কে সঠিক আর কে ভুল।

-হায় আল্লাহ! এই কথা শোনানোর জন্যই এতোদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলে? এর চেয়ে আমি মরে গেলাম না কেন? আমাকে উঠিয়ে নাও আল্লাহ! উঠিয়ে নাও।

দিলারা জামান এবারে বুক চাপড়ে এমন মরা কান্না জুড়ে দিয়েছেন যে বাড়ির সব কজন কাজের লোক ছুটে চলে এসেছে। জিহান একবার কাজের লোকেদের দিকে তাকিয়ে চলে যাওয়ার ইশারা করতেই সবাই চলে গেল। জিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিলারা জামানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে সাগর না বানালেও মোটামুটি সাইজের একটা কূয়ো বানিয়ে দিবেন এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই জিহানের। আর উনার এমন ওভার রিএকশনটা এই প্রথমবার নয়। তাই জিহান মোটেও বিব্রত হলো না।

-কথাগুলো নীলার ক্ষেত্রে না হয়ে মুগ্ধার ক্ষেত্রে বললেও আমার জবাবটা একই থাকতো মামী। তাই এসব কান্নাকাটি বন্ধ করো প্লিজ। তোমার ওকে কাজ শিখানোর তো মায়ের মতো করে শেখাও। শুধু নীলাকে কেন? আমি তো বলবো মুগ্ধা আর নীলা দুজনকেই হাতে ধরে রান্না, ঘরের টুকটাক কাজ শেখাও তুমি। ওরা না পারলে কাজ করার লোকের তো অভাব নেই বাড়িতে। তবু প্লিজ এসব উল্টোপাল্টা কথা বলো না। জাজ করতে হলে মেয়ে আর বউ দুজনকেই সমান পাল্লায় মাপো। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।

-সেটাই তো! তোর বউকে কিছু বলার অধিকার আছে নাকি আমাদের? তোর মা হলে তার সাধ হতো না ছেলের বউয়ের সেবা নেয়ার? ওকে নিজ হাতে সব শেখানোর? তোকে বলে লাভ কি? তুই তো এখন এসব বলবিই। বিয়ে করে আগে শুনতাম মেয়ে পর হয়ে যায়, আর এখন বিয়ে দিলে ছেলে পর হয়ে যায়। হায় আমার কপাল! থাক বাবা। তোর বউকে কোনো কাজ করতে হবে না। ওকে বলে দিস কিচ্ছু করতে হবে না। আমরা আশ্রিত হয়ে আছি তো। এসব কাজের লোকদের কাজগুলো আমিই সামলে নিবো। তবু তোরা সুখে থাক বাবা, সুখে থাক।

-মামী! আরে? কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ কথা? আমি—–।

জিহানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দিলারা জামান চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। জিহান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে রুমের দিকেই পা বাড়ালো। রুমে নীলাকে গুটিশুটি হয়ে বিছানাা শুয়ে থাকতে দেখে কোনো শব্দ না করে নিজের সুটকেসটা কাবার্ডে ঢুকিয়ে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই নীলাকে কফির মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ম্লান হাসলো জিহান। নীলার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে টাওয়ালটা নীলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নীলাকে টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিহান কফির মগে চুমুক বসালো।

-আরে বাবা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? চুলগুলো মুছে দাও না প্লিজ? মাথাটা প্রচন্ড প্রচন্ড ব্যথা করছে।

নীলা এগিয়ে এসে বিছানায় বসে জিহানের ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হাতে মুছিয়ে দিতে দিতেই জিহান লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে আবার কফিতে আরেকবার চুমুক দিলো।

-আপনি কি কিছু নিয়ে টেনশন করছেন?

-কই না তো! আমার আবার কিসের টেনশন! খাচ্ছি ধাচ্ছি অফিস যাচ্ছি। মাস্ত লাইফ। টেনশনের কি আছে?

-তাহলে কোনো কিছু নিয়ে কি ডিস্টার্বড? আপনার তো এমনি এমনি মাথা ধরে না। কি হয়েছে বললে আপনারই ভালো। না বলতে চাইলে আর কি করা!

-বলার বা না বলার মতো কিছুই ঘটে নি নীলপাখি। আসলে টেন্ডারটা নিয়ে একটু বেশিই জল্পনা কল্পনা করে ফেলেছিলাম, তাই আজ টেন্ডারের ফাইনাল ডে তে এসে বাদ পড়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেছে।

-বিকেলবেলা তো ভাবি এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। কই কিছু তো বললো না?

-হা হা হা। সরাসরি না জিজ্ঞেস করে খুঁচিয়ে জানতে চাইছ তোমার বাবার কোম্পানি টেন্ডারটা পেয়েছে কিনা? হা হা হা।

-আমি হাসার কি বললাম? আপনারা দুই কোম্পানি তো টেন্ডারটা নিয়ে রীতিমতো রক্তারক্তি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। আপনাড কোম্পানি না পেলে তো বাবার আর ভাইয়ার টেন্ডারটা পাওয়ার কথা।

-আমরা কেউই পাই নি টেন্ডারটা। আনএক্সপেক্টেড ব্যাপার কি জানো? যত লো কস্টে ভালোভাবে কাজটা কমপ্লিট করা যায় সেই এমাউন্ট ডিক্লেয়ার করেছিল আমি। ইভেন তোমার ভাইয়াও সব প্রোডাক্টের কোয়ালিটি চেক কটে মিনিমাম এমাউন্ট বলেছে টেন্ডারে। বাট যে কোম্পানি টেন্ডার পেয়েছে ওরা জাস্ট আমাদের থেকে হাফ ওর মে বি ওয়ান পয়েন্ট কম বলেছে। এটাই বেশি গোলমেলে লাগছে আমার। কোনো ডিটেইলস দেয় নি ওনারের, না নাম না কিছু। অদ্ভুত!

-অদ্ভুতের কি হলো? ওরা যা পারবে তাই করে দেখিয়েছে আর কি। আপনাদের মতো সবার সামনে গলা না ফাটিয়ে কাজে করে দেখিয়েছে।

-ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড নীল। কিছু একটা তো ঘাপলা আছেই এই S S industry limited কোম্পানিটাতে। আমার গাট ফিলিংস বলছে বুঝলে। নইলে জাস্ট তিন চার বছর আগে হওয়া একটা কোম্পানি তোমার বাবা আর আমাদের এতো বছরের পুরোনো কোম্পানির সাথে টেক্কা দিতে আসে!

-নিজেদেরকে একটা কিছু ভাবেন যে তাই ওরাও আপনাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি এক্কেবারে খুশি হয়েছি। হুহ।

-আরে ধুর! তোমাকে কি বলছি তুমি ব্যাপারটা তো বুঝলেই না। এতো এক্স্যাক্ট এমাউন্ট বলা পসিবলই না যদিনা অফিসের কেউ টেন্ডারের এমাউন্টটা লিক না করে। বুঝলে কি না ব্যাপারটা? আমার কোম্পানি থেকে কেউ একজন খবর লিক করছিল, আমি সেটা জানি। এই টেন্ডারের সব ক’টা আমি নিজে করেছি। তাহলে? আর তোমার ভাইয়াও টেন্ডার নিজে রেডি করেছে এবছর। ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না।

-আমার এতো বুঝার দরকারও নেই। আপনারা যেমন এই বাড়িতে কি হচ্ছে ওই বাড়িতে নিউজ টেলিকাস্টের মতো করে জেনে যান, এবারও সেইম হয়েছে। পার্থক্য শুধু এবার আপনাদের দু পক্ষের নিউজই অন্য কারো বাড়িতে টেলিকাস্ট হয়েছে।

-মানে এই মেয়েটা কোথায় একটু সমবেদনা যাবে তা না! উল্টো আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয়ার মতো করে খোঁচা মারছে। বলছি এসব করা ছেড়ে দাও বুঝলে। এমনিতেই মাথা গরম।

-থ্রেট দেয়া হচ্ছে?

-নোপ। সর্তক করে দিচ্ছি আর কি।

-উফফ! আপনার মাথা ধরার গল্প শুনতে গিয়ে আমার মাথা ধরে গেছে। ডিনারের টাইম হয়ে গেছে। খেতে চলুন?

-তুমি যাও। মামীকে একটু হেল্প করো। আমি আসছি।

নীলা একটা রহস্য মাখা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেয়েটার এমন হুটহাট অদ্ভুত আচরণের মানেই আজকাল বুঝতে পারে না জিহান। এই যে হুটহাট একদম সহজ, সাবলীল কথাবার্তা, আবার হুটহাট এতো রেগে যায় মেয়েটা। বোঝা মুশকিল হয়ে যায় জিহানের কাছে। জিহান কাপের লাস্ট সিপটুকুতে চুমুক দিয়ে একটা টিশার্ট পড়ে নিয়ে রুমের দরজার দিকে পা বাড়াতেই জিহানের মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠলো। জিহান কাবার্ডের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে আননোন নাম্বার দেখে কলটা রিসিভ করতেই অপেরপ্রান্ত থেকে কারো হুড়মুড় করে বলা কথাগুলো শুনতে পেল জিহান।

-এই আপনি নীলাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন মিস্টার জিহান? আসলে আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। আসলে ভালোবেসে নয়, টর্চার করতেই মেয়েটাকে বিয়ে করার নাটকটা করেছেন আপনি। এই কাজটার জন্য আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবো না আমি। কখনোই না।

চলবে, ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here