অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৩

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৩
#সুলতানা_পারভীন

-তোমার সাহস হয় কি করে নিহার আমার বোনের কাছে ওই ফ্রড ছেলেটার হয়ে ওকালতি করার? আমার বোনের খুশির সওদা করে কি পাবে ওই ফ্রডের কাছ থেকে? সাহস হয় কি করে তোমার আমার একমাত্র বোনের জীবন নিয়ে খেলা করার? দেখছ তো নীলা চাইছে না ওকে বিয়ে করতে। তবু কেন তুমি ওকে বাধ্য করছ? ও না তোমাকে ভাবিমা বলে ডাকে? মা শব্দটার এই মূল্য দিচ্ছ তুমি? এতোগুলো বছর নিজের সন্তানের মতো মানুষ করে একটা চরিত্রহীন, প্রতারকের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিতে একবারও বুক কাঁপলো না তোমার নিহার?

নিহার নীলার চোখ বেয়ে পড়া কান্নার জলগুলো মুছে দিতে দিতে নিচু গলায় জিহানের কথাগুলো বলছিল নীলাকে। হুট করে আবরার কোথা থেকে নিহারের হাতটা টেনে নীলার মাথার কাছ থেকে সরিয়ে সজোরে একটা চড় বসিয়েছে নিহারের গালে। নিহার রুমের কাঠের আলমারিটা ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে ফ্যালফ্যাল চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো। অজান্তেই গলা দিয়ে ফোঁপানোর শব্দ বেরিয়ে গেল মেয়েটার। নীলা চোখ বুজে ছিল এতোক্ষণ। আবরারের রাগী চিৎকারটা শুনে চোখ মেলে আবরারের গায়ে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসালো। নিহারও ফুঁপিয়ে উঠতে দেখে নীলার রাগ উঠে গেল।

-কি সমস্যা কি তোর ভাইয়া? তুই আমার ভাবিকে মেরেছিস? তোর সাহস হয় কি করে ভাবির গায়ে হাত তোলার?

-চুপ একদম নীলা। একটাও কথা বলবি না তুই। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। যেই অমানুষটার জন্য আজ তোর এই অবস্থা এই মেয়ে তার হয়েই সাফাই গাইছে তোর কাছে? আবার ওই প্রতারকের কাছে পাঠাতে চায়? ও কি চায় আমাকে বলতে বল। সব দিয়ে দিবো। কিন্তু আমার বোনের গায়ে একটা ফুলের আঁচড়ও এলাউ করবো না আমি। কিছুতেই না।

-আমি তোর বোন তাই এতো দরদ। আমার কষ্ট দেখতে পারছিস না তুই, তাহলে ভাবি? ভাবি কারো মেয়ে, কারো বোন এটা তুই ভুলে যাস কি করে?

-নীলা? আমি কিচ্ছু ভুলি নি। আজ পর্যন্ত তোর ভাবির গায়ে কখনো হাত তুলেছি কিনা ওকে জিজ্ঞেস কর। কখনো বাজে বিহেভ করেছি? না। কিন্তু আমার বোনের ক্ষতি চাইলে কাউকে ছাড়বো না আমি। সে আমার স্ত্রী হলে তাকেও না।

-দাঁড়া ভাইয়া। একদম পালাবি না এখান থেকে। তুই ভাবির চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো কখনো খারাপ বিহেভ করিস নি ওর সাথে? কখনো না?

-না। কখনো করি নি।

-তাই নাকি? ছয় সাত বছর আগে তোদের বিয়ে হয়েছে ভাইয়া। মনে আছে তোর কোন পরিস্থিতিতে বিয়েটা করেছিস তুই? এর পর থেকে এতোগুলো বছরে ভাবির সাথে হেসে দুটো কথা বলেছিস কখনো? মনে করে বলতে পারবি কখনো এনিভার্সারিতে বা ভাবির বার্থডেতে উইশ করে একটা গোলাপও হাতে দিয়েছিস কিনা?

-নীলা? চুপ কর। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না।

-জানি না। কিন্তু জানতে চাই। বাবা পছন্দ করে ভাবিকে তোর বউ করে এনেছে। তুই নিজে না চেয়েও শেষপর্যন্ত রাজি হয়েছিস। কিন্তু এতো সবের ভিতরে ভাবির দোষটা কি?

-ওর দোষ হলো ও আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করতে চাইছে। সাত বছর আগে না চাইলেও এখন চাইছে। এক প্রতারক জীবন থেকে বিদায় হয়েছিল বলে ও আমার জীবনে এসেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ও আমার জীবনটা কন্ট্রোল করার অধিকার পেয়ে গেছে। সবাইকে ক্ষমা করা যায় নীলা। কিন্তু বিশ্বাস নিয়ে যে খেলা করে তাকে কখনো ক্ষমা করা যায় না।

-ভাবি তোর কি বিশ্বাস নিয়ে খেলা করলো? ভাবি নিজের কথাটা আমাকে বলেছে তাই বলে——।

-কি বিশ্বাস ভেঙ্গেছে ওকেই জিজ্ঞেস কর না? ও জানতো না জাহিন ছেলেটার রক্তেই প্রতারণা আছে। ওর পুরো পরিবার একেকটা চিট, ধোঁকাবাজ, চরিত্রহীন। ওই ছেলে তোর পিছনে লেগেছে সেটা ও জানতো, জেনেও কাউকে কিচ্ছু বলে নি। তুই ওই ধোঁকাবাজের জালে ধীরে ধীরে জড়িয়ে যাচ্ছিস সেটাও তোর ভাবি জানতো। তবু তোকে একটাবারের জন্যও আটকায় নি। কেন কেন কেন? এখন তুই ওই প্রতারকের আসল রূপটা দেখে যখন নিজে পিছিয়ে আসছিস তাহলে কেন ও আবার তোকে ওই নর্দমার কীটের কাছেই পাঠাতে চাইছে? কেন কেন কেন? কেন নিহার? কেন?

-ভাইয়া? খবরদার ভাবিকে কিছু করবি না। ভাইয়া?

আবরার নীলাকে কথাগুলো বলতে বলতে নিহারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিহারের হাত দুটো চেপে ধরে নিজের সামনে দাঁড় করালো। আবরারের চাপা গলার প্রশ্নগুলো শুনে নিহার কেঁপে উঠতেই নীলাও ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো। নীলা যে বিছানায় বসে আবরারকে কিছু বলছে সেদিকে আবরারের খেয়ালই নেই। সে সোজা নিহারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আবরারের শক্ত হাতের চাপটা ধীরে ধীরে চেপে বসছে নিহারের বাহুতে।

-বলো নিহার? কেন? কেন আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করতে চাইছ তুমি? আমার উপরে রাগ তো তোমার? স্বামীর কোনো দায়িত্বই আমি পালন করি না, তোমার কাছে আসি না, প্রয়োজনের বাইরে কথাও বলি না। এই তো অভিযোগ তোমার? তারজন্য আমার বোনটাকে ওই অমানুষটার কাছে ঠেলে দিলে পারলে তুমি? নীলার ভালোবাসাটা তোমার রাগের কাছে হেরে গেল? এতো সহজে? নাকি ওকে কখনো ভালোই বাসো নি? তাই দায়িত্ব, কাঁধের বোঝা নামাতে চাইছ?

-প্লিজ চুপ করো আবরার। অনেক বলে ফেলেছ তুমি। আমি তোমার মতো চোখের দেখা আর কানের শোনা দিয়েই মানুষকে বিচার করি না। তাই সেদিনও বলেছিলাম তুমি ভুল ছিলে, আজও বলছি, আজও তুমি ভুল। জিহান ভাইয়াকে চিনতে তুমি ভুল করছ। যে মানুষগুলো জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে জানে তারা এমন অন্যায় করতেই পারে না। তুমি মানো আর না মানো কোনো ছলনা, প্রতারণা জিহান করে নি। যদিও কোনো প্রতারণা হয়েও থাকে তবে সেটা অন্য কেউ করেছে। জিহান বা কায়রা নয়।

-নিহার?

নিহারের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আবরারের শক্ত হাতের আরেকটা থাপ্পড় এসে পড়লো নিহারের গালে। নিহার আরেকবার আলমারির উপরে ছিটকে পড়লো। এবারে নিজেকে সামলাতে না পেরে কপালের বেশ খানিকটা কেটে গেল মেয়েটার। এদিকে আবরার নিহারকে থাপ্পড় দিয়ে সরিয়ে দিতেই নীলা বিছানা থেকে হুড়মুড় করে ফ্লোরে পা দিতেই ওর পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ জোড়া টকটকে লাল রক্তে ভিজে গেল। ড্রেসিংটা ভেদ করে পায়ের তাজা ঘা দিয়ে আবার রক্ত বেরোনোয় অসহ্য যন্ত্রণাটা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা ফ্লোরেই ধপ করে পড়ে গেল। না চাইতেও গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে গেল নীলার। আর নীলার কান্না আর ছটফটানির শব্দে পিছনে ফিরেই আবরার আর নিহার দুজনেই ছুটে এসে নীলাকে বিছানায় তুলে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসলো। আবরার নীলার পায়ের ব্যান্ডেজটা বদলে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই নীলা রাগ করে নিজের পা দুটো বিছানার সাথে শক্ত করে চেপে ধরে নিজেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। কিন্তু আবরারকে পায়ের ব্যান্ডেজ বদলাতে দিবে না বলে নিজের ব্যথাটা ঠোঁট কামড়ে সহ্য করার বিফল চেষ্টা করলো মেয়েটা।

-ভাবি? এই লোকটাকে বলো আমার চোখের সামনে থেকে যেন চলে যায়। নইলে আমিই–আমিই এই রক্তাক্ত পা নিয়ে এই বাড়ি ছেড়েই চলে যাবো।

-নীলু? বাড়াবাড়ি করবি না একদম। পায়ের ড্রেসিংটা বদলাতে দে আমাকে। আর একটাও কথা বলবি না বলে দিলাম। আর পা সোজা কর? কত রক্ত বের হচ্ছে?

-ভাবিইইই? তুমি কাউকে যেতে বলবা? নাকি আমি চলে যাবো রুমটা থেকে?

-তোদের দুজনের যা মন চায় কর। বাট ওই ছেলেকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা যেন এই বাড়িতে না শুনি। তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কিন্তু আর কেউ হবে না নীলু। কথাটা মাথায় রাখিস।

আবরার রাগ করে বেড সাইট টেবিলটার উপরে থাকা গ্লাসটা তুলে সজোরে ফ্লোরে আছড়ে ফেলে নিজেই সেই ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলোকে জুতোর তলায় পিষে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিহারও ছুটে এসে নীলার মাথার কাছে বসে নীলার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে কেঁদে ফেললো। আর নীলা? মেয়েটা নিহারের কোলে মুখ লুকিয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজে নিল। শরীরটা যেন আর চলতে চাইছে না মেয়েটার। দিনশেষে নিজেকে ক্লান্ত, শ্রান্ত, পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে, বেশ গভীর রাত। চারদিকে নিস্তব্ধ গভীর অন্ধকার। এই ঘন কালো অন্ধকারে ধীর পায়ে খন্দকার বাড়ির ড্রইংরুম পার করে নীলার রুমের দিকে এগিয়ে গেল কেউ একজন। এই বাড়িটার প্রত্যেকটা রুম, প্রত্যেকটা নকশা তার পরিচিত। তাই এই অন্ধকারেও নীলার রুমটা খুঁজে পেতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি। রুমটার সামনে এসে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে হালকা হাতে দু টো টোকা দিল লোকটা। আর প্রায় সাথে সাথেই রুমের দরজাটা খুলে নিহার বেরিয়ে এলো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে নিহারের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির একটা হাসি ফুটে উঠলো।

-আমি জানতাম ভাই তুমি আসবে। মেয়েটার এই অবস্থা আর তুমি কি না এসে থাকতে পারো?

-আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাবি। আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। যদি ওকে কখনো নিজের করে পাই তাহলে আপনার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো।

-কৃতজ্ঞ হয়ে পরে থেকো। আগে মেয়েটার এই অবস্থা কি করে হলো সেটা বলো?

-আমার দোষেই আজ আমার নীলার এই অবস্থা। ওর কাছে দুটো দিন সময় চেয়ে নিলাম যাতে সবার সব ছলচাতুরির জবাব দিতে পারি। উল্টো ওরা সেটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আমার আর নীলার মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিল।

-কি হয়েছিল? আর নীলার পায়ের এই অবস্থা? মেয়েটা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কেঁদেছে। কিন্তু একবারও বলে নি কি হয়েছে আপনার ফার্মহাউজে।

-একটা মেয়ে আমার ফার্ম হাউজে ঢুকেছিল ইম্পরট্যান্ট একটা প্রোজেক্টের ফাইল চুরি করতে। পালানোর আগে অনেক কিছু স্বীকার করে মেয়েটা। এমন সময়ই নীলা চলে আসে। আর ও ভুল বুঝে আমাদেরকে—–।

-ও নাহয় ভুল বুঝেছিল। তুমি ওর ভুলটা ভাঙ্গালে না কেন? কেন মেয়েটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছ তোমরা? তোমাকে বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে। অথচ সারাদিন মেয়েটার চোখের কোণ দিয়ে কান্নার বন্যা বয়ে গেছে। জানো?

-জানবো না আবার? ওকে তো চিনি। কেমন পাগলি মেয়েটা। আর বিয়েটা ক্যানসেলের খবরও পেয়ে গেছি। আপনার শ্বশুরমশাই বাড়িতে গিয়ে মামা মামিকে মিষ্টি দিয়ে এসেছে, বিয়ে ক্যানসেল করে।

-মানে? কিসের মিষ্টি?

-তেমন কিছু না ভাবি। এসব বিজনেস স্ট্রাটেজি। আপনাকে আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ ভাবি। আমার বউটার খেয়াল রাখার জন্য।

-শুকনো ধন্যবাদ নিবো না ভাই। এমনিতে কত কিছু হয়ে গেল আপনার বউয়ের খেয়াল রাখতে গিয়ে।

-কেন? কি হয়েছে?

-কিছু না ভাই। এবার আপনার বউয়ের খেয়াল আপনিই রাখুন। আমার ডিউটি আবার ভোররাত থেকে নাহয় শুরু হবে। ততক্ষণ এঞ্জয় ইওর কোয়ালিটি টাইম উইথ ইওর ওয়াইফ।

-হা হা হা। ওকে ভাবি। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। আপনি একটা ঘুম সেরে আসুন। আবার নাহয় নিজের ননদিনীর খেয়াল রাখবেন।

-জি জি। কেমন বেশিক্ষণ থাকবেন না আমিও দেখবো। চলি। আর বিরক্ত করবো না আপনাদের।

নিহার একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই জিহান রুমের দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিয়ে নীলার পাশে এসে গা এলিয়ে দিল বিছানায়। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে টের পেয়ে জিহান নীলাকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিয়ে নীলার ঠোঁট জোড়ায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। গভীর ঘুমের মধ্যেও নীলা কেঁপে উঠেছে দেখে জিহান হেসে নীলার কপালে ছোট্ট করে একটা আদরের চিহ্ন এঁকে দিল।

-সারাটা দিন কেঁদেছ কি ভেবে মেয়ে? তোমাকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো এটা ভেবে? নাকি বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারটা ফিরিয়ে দিলাম, ছিড়ে ফেলতে বললাম এটা ভেবে? একবার তো কিসের পেপার দিয়েছি চেক করে দেখবে পাগলি। তা না কেঁদে কেটে নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছে, আমাকেও পাগল করে দিচ্ছে? পাগলি একটা বউ আমার।

চলবে

((সংসার গল্পের চেয়ে রেসপন্স কম অস্তিত্বে তুমি গল্পে। তাহলে কি গল্পটা ভাল হচ্ছে না?? বন্ধ করে দিবো??))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here