অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৯

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৯
#সুলতানা_পারভীন

-কত বেলা হয়ে গেল, অথচ মেয়েটার ওঠার নাম গন্ধও নেই? এই নিহারররররর? আর কতো ঘুমাবে আজকে কে জানে? এই নিহার? দেখো দশটা বেজে গেছে। নিহাররররররররররর।

কানের কাছে আবরারের জোর গলায় নাম ধরে ডাকার শব্দে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো নিহার। আবরার ভ্রু কুঁচকে নিহারের সদ্য ভাঙা ঘুমজড়ানো চোখ মুখের দিলে তাকিয়ে আছে দেখে নিহার একটু বিব্রতই হলো। এতো ঘুম পাচ্ছে যে চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না বেচারি। প্রচন্ড ঘুমে চোখ বুজে আসছে এমন সময় আবরারের হাতের স্পর্শে কেঁপে চোখ মেলে তাকালো নিহার। আবরার বিছানায় শুয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে নিহারের ঘাড়টা টেনে নিজের বুকের উপরে নিহারের মাথাটা টেনে নিয়েছে। নিহার থতমত খেয়ে আবরারের বুকে থুতনি ঠেকিয় ঢলুমলু চোখে ঘুম কাটানোর জন্য চোখ ডলছে। ঘুম তো কাটছেই না, উল্টো আবরারের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ আর উষ্ণতায় আরো ঘুমঘুম পাচ্ছে মেয়েটার।

-এই যে মিসেস খন্দকার? এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমালে হবে? দশটা বাজতে চললো। আজ কারো ব্রেকফাস্ট করা লাগবে না নাকি ম্যাডাম? কাল রাতে না নীলা কি করছে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলে? আজ দেখে বিছানা ছেড়ে উঠতেই চাইছ না? ব্যাপারটা কি ম্যাডাম?

-কি! দশটা বাজে! হায় আল্লাহ! কি বলছ! এতো বেলা পর্যন্ত শুয়ে আছি! ছি ছি ছি! তুমি আরেকটু আগে ডাকবে না? ধ্যাত! সবাই কি ভাববে এবার? হায় আল্লাহ!

-আরে বাবা! আমি তো সেই কখন থেকে ডাকছি, তুমিই তো উঠছ না? এখন আমার দোষ দিচ্ছ? এসব কি ঠিক বলো তো?

-তোমার দোষ দিচ্ছি না। সরি–আসলে এতো বেলা হয়ে গেছে তাই—-। আমি ফ্রেশ হয়ে ৫ মিনিটের মধ্যেই নিচে যাচ্ছি—-। ইশ! সবাই কি ভাববে?

-আরে আস্তে! এতো তাড়াহুড়ো করছ কেন? ঠিক আছে তো? একদিন দেরি হতেই পারে। আর বাবা তো ডেইলি এক কাপ চা খেয়েই চলে যায়। কাজের লোকেরা সেটার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। তুমি এতো হুটোপুটি করো না তো। টেনশন করতে গিয়ে নিজেই ব্যথা ট্যথা পাবা পরে।

-না না। আমি ঠিক আছি। তুমিও তো অফিস যাবে? আমি ফ্রেশ হয়ে নিই। তারপর তুমি যেও—-। অলরেডি অনেক বেলা হয়ে গেছে—-। দশটার বেশিই বোধহয় বাজে! ওয়েট—–। দশটা কোথায়? সাড়ে সাতটা বাজে! আবরার! তোমাকে আমি?

নিহার কথাটায় শেষ করতে পারলো না। এর আগেই আবরার একহাতে নিহারের কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে নিহারের মুখটা অল্প করে তুলে ধরে ঠোঁটে ঠোট ডুবিয় দিয়েছে। নিহার একবার কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিয়েছিল। আবরার ইচ্ছে করে ওকে বোকা বানিয়েছে কথাটা মাথায় আসতেই এবারে আবরারের ঠোঁটেও জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। আবরার বেচারা হঠাৎ করে নিহারের এমন কাজে থতমত খেয়েই সরে এসেছে। পরমূহুর্তেই নিহার বিছানা থেকে নেমে পালানোর।আগেই আবরারের দু হাতের উষ্ণ বাঁধনে আবার আটকা পড়তে হলো নিহারকে।

-এটা কি হলো নিহার? আমি কতো সফটলি তাকে আদর করছি, আর ম্যাডাম আমার আবেগে ছাই ঢেলে দিলেন, এটা কিছু হলো?

-মিথ্যে বলে আমাকে ভয় দেখানোর শাস্তি। হুহ। বলে কিনা দশটা বাজে! যতবার মিথ্যে বলবে ততবার শাস্তি পাবে এমন।

-ইশ! এতো আদুরে শাস্তি পেতে হলে তো প্রতিদিন ভোরে এমন দু চারটা মিথ্যে বলাই যায়, কি বলো জান?

-হুম বলো। আমার কি। এর পর থেকে শাস্তিটা এমন হবে যে কারো সামনে যেতেও পারবে না, এমন দশা করবো। তখন বুঝবে বউয়ের শাস্তিগুলো কেমন আদুরে হয়।

-তাই নাকি? তাহলে তো শাস্তির প্রতিদানে তোমার কিছু আদরও পাওনা তোমার। সেগুলোও শোধবোধ করে দিই কি বলো? যত গভীর শাস্তি, তত নিবিড় আদর। ডিল ডান? তাহলে আজকের আদরটা নিয়ে নাও?

-একদম ভালো হবে না আবরার। সরো? তুমি ঘুমাও। তোমার তো অফিসে যেতে দেরি আছে। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করে ডাকবো তোমাকে। ছাড়ো না?

-আজকে কাজের লোকেরা ব্রেকফাস্টটা রেডি করুক না বউ? তুমি আমার বুকেই থাকো। আমি লক্ষী ছেলের মতো ঘুমাবো। একদম জ্বালাবো না এখন আর, প্রমিস।

-ইশ রে! কি ভালো হাজবেন্ড আমার! এভাবে মিষ্টি করে বললে না করি কি করে বলো তো?

-না করবে কেন? তুমিও লক্ষী মেয়ের মতো আমার বুকে থাকো কেমন? এই নিহার? জানো আমার টিশার্টটায় তোমাকে কত্তো সুইট লাগছে দেখতে! ইশ! এতো মিষ্টি লাগছে কেন তোমাকে আজ বলো তো?

-এই? একদম দুষ্টুমি না বলে দিলাম। চুপচাপ ঘুমাও। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবো। তুমি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকো।

-এটা কি হলো? বললাম না আজকে তোমার ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে না।

-খালাকে কি নাস্তা বানাতে হবে না বললে উনি কি নাস্তা রেডি করবেন? আর নীলাকেও তো ওষুধ খাওয়াতে হবে নাকি? বাবাও তো চলে যাবে অফিসে। সো মিস্টার? আমি গেলাম।

-আরে নিহার! এটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। আমি রুমে ঘুমাবে আর তুমি থাকবে কিচেনে? নো ওয়ে। মানি না আমি।

-তাহলে তোমার আর ঘুমাতেও হবে না। আমি কিচেনে গেলাম। তুমিও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি কাজ করবো, আর তুমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখবে। সুযোগ পেলে হুটহাট এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাবে। বা হুট করে এসে আদর দিয়ে পালাবে।

-সিরিয়াসলি? আমি কিন্তু সত্যি জ্বালাবো ম্যাডাম।।বারণ করলেও শুনবো না এবারে।

-ধ্যাত। আমি তো এমনি বললাম। ঘুমাও তো তুমি।

নিহার কোনোমতে লজ্জায় লাল হয়ে আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আর আবরার হেসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে, এমন আরো কত না বলা আবদার জমা পড়ে আছে মেয়েটার কে জানে!

দেখতে দেখতে আরো পাঁচ ছয়টা দিন কেটে গেছে এভাবে। নীলার পায়ের কাটা মোটামুটি ভালো হয়ে এসেছে। ব্যথাও নেই বললেই চলে। প্রায় প্রতিদিনই রাতে জিহানের উপস্থিতি টের পেলেও সকালে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না নীলার কাছে। রুমটা প্রতিদিনই ভিতর থেকেই লক করা থাকে, তাহলে জিহান আসার ব্যাপারটা যে ওর কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় এটাই ভাবে নীলা। এতোগুলো দিন যে যোগাযোগ নেই সেটা আধো জিহানের খেয়াল আছে কিনা এসব ভেবেই নিজের রুমের কোণে বসে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই নীলার।

এতোগুলো দিন পর আজ দুপুরে সবাই একসাথে বসে লাঞ্চ করেছে নীলারা। অন্য সময় নিহার আর আবরার থাকলেও আজ বাবাও যোগ দেয়ায় দারুণ লাগছে নীলার। কিন্তু বাবার সাথে ওই পি. এ শিহাব নামের ছেলেটাও আছে দেখে একটু বিরক্তই লাগছে নীলার। অফিসের লোকেরা বাসায় কেন আসবে? আবার ফ্যামেলি টাইমে কেনইবা একসাথে লাঞ্চ বা ডিনারে এটেন্ড করবে? এতোই জরুরি কাজ হলে নীলা নাহয় পরেই খেতে আসতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নীলা কোনোমতে ভাতগুলো খাওয়া শেষ করেছে। খাওয়ার পরে সবার সাথে ড্রইংরুমে ছোটোখাটো মিটিংয়ের মতো একটা আয়োজন দেখে নীলা একটু অবাকই হলো। আফসান খন্দকার মেয়ের কৌতূহলী দৃষ্টি খেয়াল করেই একটা বড়, মোটা প্যাকেট এগিয় দিল নীলার দিকে। নীলা ভ্রু কুঁচকে প্যাকেটটা নিতে নিতে বাবার দিকে তাকালো।

-এটা কি পাপা? চকলেটস? সেরকম তো মনে হচ্ছে না। কি আছে পাপা?

-নিজেই প্যাকেটটা খুলে দেখো মা। আই হোপ ইউ উইল লাইক ইট।

-আই হোপ সো। আরে? এগুলো তো বিয়ের কার্ড! এতোগুলো ইনভিটেশন কার্ড! কার বিয়ের ইনভিটেশন কার্ড পাপা? রিলেটিভ কেউ আমাদের?

-নিজেই দেখে নাও।

-ওকে। বাট পাপা। আমি কারো বিয়েতে পারবো না।

-আগে তো পাত্র পাত্রীর নামগুলো চেক করো।

-ওকে ওকে। ওয়েট এ সেকেন্ড—-। হোয়াট!

সুন্দর ডিজাইন করা ইনভিটেশন কার্ডটা দারুণ পছন্দ হয়েছে নীলার। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে কার্ডের উপরের পালকিতে করে বউ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কেন জানি একদম হৃদয়ে গেঁথে গেছে নীলার। আফসান খন্দকারের কথায় বর আর কনের পরিচিতির অংশে চোখ পড়তেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দশা হলো নীলার। হাতে ধরা প্যাকেট ভর্তি সবগুলো কার্ডই মাটিতে পড়ে গেল নীলার হাত থেকে। ফ্লোরে পড়ে থাকা কার্ডগুলোর দিকে তাকিয়েই ধড়ফড় করে নিজের সোফা থেকে ছিটকে কয়েক পা দূরে সরে এলো নীলা। এটা কি করে সম্ভব! যা দেখছে তা কখনো সত্যি হতেই পারে না। কিছুতেই না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here