আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ৩+৪

##আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ০৩

আফিমের সাথে নাফিয়াও তার পেছন পেছন আফিমের অফিসে প্রবেশ করে।অফিসে আফিমের পা পড়তেই একে একে সকল কর্মীরা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিচ্ছে।আফিম সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে নিজ ক্যাবিনে প্রবেশ করে।এ কক্ষটি বেশ বড়সড়।কক্ষের বাম দিকে কোনো দেওয়াল নেই।পুরোটা গ্লাস দিয়ে আটকানো।বাইরের সবকিছু এখান থেকে স্বচ্ছ দৃশ্যমান।পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে নাফিয়ার মন মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ।কক্ষের সব কিছু সাদা ও সোনালী রঙের।নাফিয়ার বুঝতে বাকি রইলো না যে আফিমের পছন্দের রং সাদা।
নাফিয়ার মুগ্ধ নয়ন কক্ষের প্রতিটি জিনিস দেখতে ব্যস্ত কিন্তু অন্য একজন অবাক চোখে তাকেই দেখে চলছে।বিষয়টি নাফিয়া লক্ষ্য না করলেও আফিমের চোখ এড়ায় না।সে রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-রিয়াদ,গতকাল তোমায় একটা ল্যাহেঙ্গা ডিজাইন দিয়েছিলাম।তার কাজ কত দূর?
আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসতেই তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি নাফিয়ার থেকে সরিয়ে আফিমের দিকে আবদ্ধ করে রিয়াদ।নিজেকে সামলে নিয়ে ভীতু স্বরে বলে ওঠে,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার,কাজ একটু বাকি আছে।
আফিম গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
-দুপুরের মাঝে কমপ্লিট চাই।
রিয়াদ মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
-ওকে স্যার।
কথাটি বলে রিয়াদ আফিমের কক্ষে পাতানো সাদা সোফাটিতে ল্যাপটপ নিয়ে বসতে যাবে ঠিক তখনই আফিম বলে ওঠে,
-রিয়াদ,এখন থেকে তুমি আমার পাশের ক্যাবিনে বসে কাজ করবে।
-কিন্তু স্যার?
রিয়াদকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই আফিম বলে ওঠে,
-আজ থেকে অফিসে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় সব কাজ করবে মিস.শেখ।তাই তোমার এখন থেকে আমার কক্ষে থাকার প্রয়োজন নেই।তুমি অফিসের কাজ গুলোয় মনোযোগী হও।
রিয়াদ অসহায় চোখে তাকিয়ে আফিমের কথা গুলো শুনে নিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো নাফিয়ার দিকে।এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে এসে তার আর তার কলিজার স্যারের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করছে ব্যাপার টা মানতে পারছে না রিয়াদ।এতো বছর ধরে সব সময় সে আফিমের সাথে সাথে থেকেছে।এখন কিনা তার বদলে এই মেয়ে থাকবে তার স্যারের সাথে!রাগ-দুঃখ নিজের মাঝে চেপে নিয়ে আফিমের কক্ষ ত্যাগ করলো রিয়াদ।
বিয়াদ কক্ষ ত্যাগ করার পর এতোক্ষণে নাফিয়ার মুখে কথা ফুটলো।সে বলে উঠলো,
-আপনার ক্যাবিন টা ভীষণ সুন্দর।
উত্তরে আফিম গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
-তোমাকে এখানে সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নিয়ে আসা হয়নি মিস.শেখ।
কথাটি বলে নিজের হাতের ঘড়িটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আফিম।সময় দেখে নিয়ে সে বলে ওঠে,
-Now it’s time to drink my green tea. [এখন আমার গ্রীন টি পান করার সময়]
উত্তরে কিছু না বললেও মনে মনে আফিমকে একশো একটা গালি দিতে দিতে কক্ষের বাম দিকে এগিয়ে যায় নাফিয়া।একটি ছোট্ট সাদা রঙের টেবিল পাতানো আছে সেদিকে।টেবিলের উপরেই কারেন্টে পানি গরম করার জগ,গ্রীন টি প্যাকেট এবং কাপ রাখা।প্রয়োজনীয় সব কিছু পেয়ে যাওয়ায় কাজটা সহজেই করে ফেললো সে।
গ্রীন টি বানিয়ে নাফিয়া তা আফিমের দিকে এগিয়ে দিতেই আফিম চোখের ইশারায় তা টেবিলের উপর রাখতে বলে।ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কিছু করছে।নাফিয়ার ইচ্ছে হচ্ছে দেখতে যে আফিম তার ল্যাপটপে কি করছে!কিন্তু আফিমের কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তার।এসব ভাবনার মাঝেই আফিম তাকে বলে ওঠে,
-Miss. Sheikh, my shoulder hurts. Can you massage? [মিস.শেখ,আমার কাঁধে ব্যাথা করছে।ম্যাসাজ করতে পারবে?]
নাফিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে আফিমের কাছে চলে যায়।ছেলেটার বাম দিকে দাঁড়িয়ে কাঁধে নিজের নরম হাতে মালিশ করতে করতে ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টিপাত করে নাফিয়া।তাকিয়ে দেখতেই মুগ্ধতায় আপনা-আপনিই সে মনে মনে বলে ওঠে,
“অসম্ভব সুন্দর”
আফিম ল্যাপটপে একটি ব্রাইডাল লেহেঙ্গা ডিজাইন করছে।এখনো কমপ্লিটও হয়নি অথচ এখনই তা থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না,এতোটাই সুন্দর।এভাবেই মালিশ করতে করতে অনেকটা সময় পাড় হয়ে গিয়েছে।কিন্তু নাফিয়া মুগ্ধ চোখে আফিমের কাজ দেখায় এতোটাই ব্যস্ত যে তার সময়ের দিকে খেয়ালই নেই।হুট করেই আফিম কাজ বন্ধ করে নাফিয়ার পেটে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়ে।চোখ বুজে ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠে,
-I am having headache too.
হটাৎ আফিমের এমন কাজে মৃদু কেপে ওঠে নাফিয়া।আফিমের মাথার ছোট ছোট চুলগুলো বিঁধছে তার পেটে।এতে কেমন জানি একটা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করছে সে।একটু সুরসুরিও লাগছে তার।কিন্তু সব অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রেখে সে আফিমের কপালে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করে দেওয়ায় মনোনিবেশ করে।অনেক্ক্ষণ যাবৎ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই হয়তো ছেলেটার এখন মাথা ব্যাথা করছে।
ল্যাপটপের দিকে বেশিক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকলেই চোখসহ মাথায় ব্যাথা হতে আরম্ভ করে আফিমের।এতোদিন ধরে এই অসহ্য যন্ত্রণা চুপচাপ সহ্য করেই কাজ করে গিয়েছে সে।কিন্তু এখন হয়তো সে দিন শেষ।এতো বছরে এই আজই এক জাদুকরী হাতের স্পর্শের সন্ধান পেলো সে।যে স্পর্শে প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছে আফিম।তার মাথায় হওয়া অসহ্য যন্ত্রণা এই স্পর্শ পেয়ে খুব কম সময়েই বিদায় নিয়েছে।কিন্তু ব্যাথা কমলেও এই হাতের স্পর্শ পেয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আফিমের।তাই সে চুপটি করে নাফিয়ার গায়ে হেলান দিয়েই কপালে নাফিয়ার মালিশ অনুভব করছে।
জীবনে প্রথম হয়তো এভাবে কোনো পুরুষ এতোটা কাছে নাফিয়ার।নাফিয়া সবসময়ই ছেলেদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা মেয়ে।কখন ভুলেও কোনো ছেলের স্পর্শ লাগতে দেয়নি নিজের শরীরে কিন্তু আফিমের বেলায় কেনো যেনো বাজে অনুভব হচ্ছে না তার।আফিমের এভাবে কাছে আসা খারাপ লাগছে না তার বরং মায়া হচ্ছে আফিমের ক্লান্ত মুখখানা দেখে।জ্বর থেকে নিস্তার পাওয়ার পর থেকেই দূর থেকে যতবার সে আফিমকে দেখেছে ততবারই ছেলেটা নিজের ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত।এখন বুঝতে পারছে যে আফিম আসলে নিজের কাজের প্রতি ভীষণ নিষ্ঠাবান।প্রচুর পরিশ্রম করে ছেলেটা।এসব ভাবতেই আফিমের প্রতি আরো বেশি মায়া কাজ করছে নাফিয়ার।প্রায় ২ ঘন্টা যাবৎ সে আফিমের ম্যাসাজ করে দেওয়াতে ব্যস্ত।হাতদুটো ব্যাথা হয়ে আর চলতে চাইছে না। কিন্তু মেয়েটা নিজের ব্যথা পাত্তা না দিয়ে আফিমের সেবা করে চলছে।
এভাবেই ২ মিনিটের মতো অতিবাহিত হতেই চোখ মেলে তাকায় আফিম।নাফিয়ার থেকে সরে এসে সে ল্যাপটপে সময় দেখতেই অবাক হয়ে যায়।প্রায় ২ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে! অবাক চোখে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-হাত ব্যাথা করছে না তোমার?
নাফিয়া হাসি হাসি মুখে বলে ওঠে,
-করছে।
এতোক্ষণ যাবৎ মালিশ করলে হাতের অবস্থা কি হয় তা আফিম বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।কিন্তু মেয়েটা যেভাবে বলছে যেনো বিষয়টা খুবই সামান্য।এইটুকু একটা মেয়ের কাছ থেকে এমন ধৈর্য্য মোটেও আশা করেনি আফিম।এতে মেয়েটিতে আরো একবার মুগ্ধ হয় সে।কিন্তু প্রকাশ করা তার ডিকশিনারিতে নেই।
নাফিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আফিম গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
-সোফায় গিয়ে বসো।
আফিমের কথায় নাফিয়ার ঠোঁটের হাসি গায়েব হয়ে গেলো।সে মনে মনে বলে উঠলো,
“কি খারুস!!একটা ধন্যবাদ ও দিলো না।একটা সুযোগ একটু পেয়ে নেই তখন মজা বুঝাবো এই ব্যাটারে,হুহ!”

!!
দুপুরের খাবারের বেলা হতেই একটি লোক এসে খাবার দিয়ে গিয়েছে আফিমের ক্যাবিনে।কক্ষে পাতানো সোফার সামনের টেবিলটায় খাবার গুলো রাখা।নাফিয়ার তো ভীষণ খিদে পেয়েছে কিন্তু আফিমের ভয়ে কিছু করার সাহস পাচ্ছে না।
নাফিয়াকে চুপচাপ লোলুপ দৃষ্টিতে খাবারের দিকে তাকিয়ে থেকে অসহায়ের মতো বসে থাকতে দেখে হাসি পাচ্ছে আফিমের।মেয়েটা ভালোই ভয় পায় তাকে তা বুঝতে পেরে বেশ ভালো লাগছে তার।
বেশ কিছুটা সময় পাড় হবার পর আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসে নাফিয়ার।
“মিস.শেখ,এভাবে তাকিয়ে থাকার জন্য খাবার টা দিয়ে যাওয়া হয়নি।প্লেটে খাবার সার্ভ করুন আমি আসছি।”
ল্যাপটপে দৃষ্টি স্থির রেখেই কথা গুলো বলে ওঠে আফিম।ছেলেটার এসব কথায় ভীষণ রাগ হচ্ছে নাফিয়ার।আফিমের দিক থেকে রাগী দৃষ্টি সরিয়ে আবারও খাবারের দিকে তাকায় সে।রাগ পরে আগে পেটে খাবার দিতে হবে।পেটের ডাকে সাড়া দিয়ে খাবার গুলো প্লেটে সার্ভ করছে নাফিয়া।হটাৎ তার চোখ যায় তরকারির সাথে রাখা বোম্বাই মরিচের দিকে।এমন আস্তো একটা বোম্বাই মরিচ এই তরকারিতে মেশালে তা কোনো মানুষ খেতে পারবে বলে মনে হয় না নাফিয়ার।সাথে সাথে মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসে তার।
আগে নিজের প্লেটে তরকারি উঠিয়ে নিয়ে আফিমের তরকারিতে বোম্বাই মরিচ ছিঁড়ে ছোট টুকরো করে তা ভালো মতো মিশিয়ে দেয় সে।উপর থেকে দেখলে বোম্বাই মরিচ চোখে পড়বে না।লুকিয়ে খুব সাবধানতার সাথে কাজটি করে নাফিয়া মনে মনে নিজেই নিজেকে বলে ওঠে,
“সাব্বাশ নাফিয়া!!”

!!
কাজ শেষ করে একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নেয় আফিম।অতঃপর নাফিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পায় ক্ষুদার্থ মেয়েটি বহু কষ্টে খাবার সামনে নিয়ে তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আফিম।ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে সোফায় নাফিয়ার পাশে বসতেই মেয়েটির চুপসে যাওয়া মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
তা দেখে নিয়ে আফিম নিজের প্লেট হাতে তুলতে তুলতে নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-খাও।
অনুমতি পেয়ে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না নাফিয়া।তড়িৎ গতিতে খাওয়া শুরু করে সে।এটি দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আফিমের।কিন্তু এই হাসিটি দেখার বিন্দু পরিমাণ সময় নাফিয়ার নেই। সে তার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত।
নাফিয়ার খাওয়া দেখে নিয়ে আফিম ও খাওয়া শুরু করে।এক লোকমা মুখে তুলতেই বুঝতে পারে তরকারি ভীষণ ঝাল।কিন্তু এতো বছরে এমন ঝাল দেওয়া তরকারি কখনো খায়নি সে।আজ এমন কি হলো! বুঝতে না পেরে তরকারিটি একটু নাড়াচাড়া করতেই আফিম এতে বোম্বাই মরিচের ছোট ছোট টুকরো দেখতে পায়।এভাবে তো কোনো সেফই এতো ঝাল দিয়ে তরকারি রাঁধবে না আর যদি রাঁধেও তাহলেও এতো ঝাল নাফিয়ার খেতে পারার কথা না কিন্তু নাফিয়া তো খাচ্ছে।ব্যাস,যা বুঝার বুঝা হয়ে গিয়েছে আফিমের।মেয়েটা তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।কত সাহস এটুকু একটা মেয়ের! যাই হোক,যুদ্ধে আফিমের পরাজয় অসম্ভব।যেভাবেই হোক তাকে জিততে হবে।
এসব ভেবে নিয়ে খাওয়া শুরু করে আফিম।বিনা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সে খেয়েই চলছে।আর অবাক চোখে তাকে দেখে চলছে নাফিয়া। ছেলেটা কি করে এতো ঝাল এতো সহজে খাচ্ছে তা কোনো ভাবেই মাথায় আসছে না নাফিয়ার।
আফিম পুরো খাবার শেষ করে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে একটি বাঁকা হাসি টেনে নেয় ঠোঁটে।অতঃপর উঠে ওয়াশরুম ঢুকে পড়ে।
আফিমের এমন অদ্ভুত কান্ডের আগা-মাথা কিছুই বোধগম্য হলো না নাফিয়ার কিন্তু ভয়ে তার কলিজা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে।ছেলেটা বুঝে যায়নি তো যে এই কুকাম সেই করেছে!
ওয়াশরুমে ঢুকেই বারংবার কুলি করছে আফিম।ঝালে মুখ,জিহবা,ঠোঁট সব জ্বলছে।নাক,চোখ,ঠোঁট সব লাল বর্ণ ধারণ করেছে।কুলি করতে করতে আয়নায় চোখ পরতেই নিজের অবস্থা দেখে ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে নেয় আফিম।নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
“কার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছো তা এখনো টের পাওনি মিস.শেখ তবে শীগ্রই পাবে।”

চলবে।আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ০৪

ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসে নাফিয়ার।সেই সকাল ৫ঃ৩০ হতে রাত ১০ টা অব্দি খাটিয়েছে আফিম তাকে।দুপুরে আফিমকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে খাবারে সে ঝাল মিশিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু এর পর নিজেকেই জব্দ হতে হয়েছিলো তার।ঝাল খেয়ে আফিমের তো কিছু হয়ই নাই কিন্তু ধরা পরার ভয়ে তার নিজের আত্মা উড়ে গিয়েছিলো।কাজটা করার আগে ধরা পরে যাওয়ার কথা একবারও ভাবেনি নাফিয়া।সে তো শুধু সুযোগ খুঁজছিলো।আর সুযোগ পেতেই তা কাজে লাগিয়ে নিয়েছে।কিন্তু কাজ টা করার পর যখনই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসছে তখন থেকেই দোয়া-দরুদ সব পড়ে ফেলেছে সে।অতঃপর হয়তো আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নিয়েছিলো এজন্যেই আফিম এই ঝালের বিষয়টা নিয়ে কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।জানে বেঁচে যাওয়ার খুশিতে মনে মনে আল্লাহকে বেশ ক’বার ধন্যবাদ দিয়ে বাকিটা সময় নিশ্চিন্তে কাটিয়েছে সে অফিসে।অফিসের কাজ শেষে বাসায় আসবার পর আফিম তাকে ঘুমোতে যেতে বলে নিজের কক্ষে চলে গিয়েছিলো।আর নাফিয়াও নিশ্চিন্ত মনে এখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।

!!
মাঝ রাত!ঘড়ির কাটা ২ এর ঘর ছুঁই ছুঁই।এমন সময় হটাৎ করেই ঘুমের মাঝে নাফিয়ার নাকে কড়া পার্ফিউমের ঘ্রাণ এসে লাগছে।ভীষণ সুন্দর এই ঘ্রাণ টা।হুট করে ঘুমের মাঝে এমন সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগায় ঘুম ভেঙে যায় নাফিয়ার।আধো আধো চোখ মেলে তাকাতেই আফিমকে দেখতে পায় সে।হয়তো ভুল দেখছে, এমনটি ভেবে বড় বড় চোখ করে তাকিয়েও আফিমেরই দেখা পায় সে।এবার ভালো করে আশে-পাশে সব দিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পায় সে আফিমের কোলে এবং আফিম তাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।হটাৎ এসবের কিছুই বুঝতে না পেরে যেই নাফিয়া কিছু বলতে যাবে ওমন সময়েই আফিম তাকে ওয়াশরুমের ভেতর দাঁড় করিয়ে সাথে সাথে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।লাইট টাও অফ।সব অন্ধকার!ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে সে দরজাতেই পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় আফিম।কান খাঁড়া করে রয় নাফিয়ার ভয়ে চিৎকারের আওয়াজ শুনবার অপেক্ষায়।যুদ্ধ যখন মেয়েটা শুরু করেই দিয়েছে তাহলে সে পিছিয়ে থাকবে কেন!ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিতে জানে আফিম কিন্তু এই বাচ্চা মেয়ে তা সহ্য করতে পারবে না ভেবে সে এই সহজ পন্থায় জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আফিম জানে এসব বাচ্চামি!তার মতো বিজনেসম্যান একটা কিশোরী মেয়ের সাথে এমন বাচ্চাদের মতো যুদ্ধে জড়াবে তা মোটেও শোভনীয় নয়।কিন্তু তার ভালো লাগছে এসব করে।ইচ্ছে করে নাফিয়াকে জ্বালানো,ভয় দেখানো আর শেষমেষ এই “যুদ্ধ” নামক বাচ্চামিতে জড়ানো সবটাই উপভোগ করছে আফিম।তার জীবনের ২৮ টা বছরে সে শুধু পড়াশোনা, কাজ আর প্রয়োজনের পেছনে ছুটেছে। একটু অবসর দরকার তার।জীবন নামক বেরঙ জিনিস টাতে একটু রঙের ছোঁয়া দরকার।
প্রায় ১৫ মিনিট পাড় হয়ে গিয়েছে কিন্তু ওয়াশরুমের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ শোনা যাচ্ছে না।ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে আফিম দরজায় কান পাতে।তবুও কোনো ধরনের আওয়াজ শুনতে সক্ষম হয় না সে।মেয়েটা কি তবে অন্ধকার ভয় পায় না?নাকি অতিরিক্ত ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে?
এসব ভাবতেই দরজা খুলতে আর দেরি করাটা উচিৎ হবে বলে মনে হলো না আফিমের।সে তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভেতর প্রবেশ করে।ভেতর টা ভীষণ অন্ধকার।চিন্তিত চোখে সে নাফিয়ার খোঁজে ওয়াশরুমের ভেতরে চোখ বুলোতেই যাবে এরই মধ্যে তড়িৎ গতিতে কিছু একটা এসে আফিমের বুকে জায়গা করে নেয়।খুব জোরেশোরে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আফিমকে জড়িয়ে ধরে আছে নাফিয়া।নিঃশব্দে চোখ থেকে পানি পড়ছে তার।নাফিয়ার এমন কাজে প্রথমে চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে আলতো করে নাফিয়ার পিঠে হাত রাখে আফিম।
কান্না জড়ানো কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আমি অন্ধকার ভীষণ ভয় পাই।আপনি প্লিজ আমাকে এখানে একা ছেড়ে যেয়েন না আফিম।
নাফিয়ার কথা শেষ হতেই আফিম নাফিয়ার থেকে একটু সরে এসে আলতো করে নাফিয়ার গাল স্পর্শ করে।নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাফিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ওঠে,
-তোমার থেকে গুণে গুণে কত বছরের বড় আমি জানো?নিজের থেকে বড় মানুষের নাম ধরে ডাকা ব্যাড ম্যানার্স,শিখো নাই?
ব্রু নাচিয়ে শেষ প্রশ্নটি করে আফিম।নাফিয়া নাক টানতে টানতে বলে ওঠে,
-আর ৬ মাস পর আমার ১৮ তে পড়বে।তাই আমিও বড়।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আফিমের ঠোঁটে।মাত্র ১৬ সম্পূর্ণ হয়ে ১৭ চলছে এমন বয়সের মেয়ে নাকি বড়!
-হ্যাঁ বড় দেখেই তো অন্ধকারে মাত্র ১৫ মিনিট থেকে চোখের পানি,নাকের পানি এক করে চোখ-মুখ লাল বানিয়ে ফেলেছো!
এক ব্রু উঁচু করে বাঁকা হেসে কথাখানা বলে আফিম।আফিমের কথা গুলো কানে আসতেই সাথে সাথে চোখের পানি মুছে নেয় নাফিয়া।ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-দুপুরে খাবারে ঝাল আমি দিয়েছিলাম তা বুঝেছিলেন আপনি, তাই না?এখন সেটিরই প্রতিশোধ নিলেন।আর দুপুর থেকে যে নিরব ছিলেন তা ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো তাই না?
আফিম ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে আলতো করে নাফিয়ার নাক চেপে ধরে বলে ওঠে,
-বুদ্ধিমতি মেয়ে!
আফিমের কথায় রাগ হচ্ছে নাফিয়ার।রেগে সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিম বলে ওঠে,
-এর পর থেকে আফিম ইবনানের সাথে লাগতে আসার সাহস তোমার হবে বলে মনে হয় না।ভীতু মানুষের এতো সাহস আসবে কোত্থেকে!
কথাটি বলেই আবারও বাঁকা হাসে আফিম।ঠোঁটে বাঁকা হাসি ও চোখ নাফিয়ার দিকে স্থির রেখে ধীরে ধীরে কদম ফেলে পেছনের দিকে সরে যেতে আরম্ভ করে সে।নাফিয়াও আফিমের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে।চোখে রাগ তার স্পষ্ট দৃশ্যমান।কয়েক কদম এভাবেই পিছিয়ে গিয়ে নাফিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নাফিয়ার বিপরীত দিকে ফিরে সোজা কক্ষ ত্যাগ করে আফিম।দরজার কাছে এসে মনে মনে বলে ওঠে,
“এবার তো তুমি দুঃসাহস দেখাবাই মিস.শেখ।অপেক্ষায় আছি তার।”
আফিমের যাওয়ার আগ অব্দি তার যাওয়ার পানে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো নাফিয়া।ছেলেটি কক্ষ ত্যাগ করতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
“আমার সাহস আছে কিনা তা দেখার অপেক্ষায় থাকুন দ্যা গ্রেট রুড ম্যান অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”

!!
সকাল হতেই নাফিয়ার ডিউটি শুরু।৫ঃ৪৫ মিনিটে কফি নিয়ে হাজির হয় সে আফিমের কক্ষে।আফিম তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করছিলো।আয়নায় নাফিয়াকে দেখতে পেয়ে সে বলে ওঠে,
-Come in,Miss. Sheikh.
নাফিয়া কিছু না বলে চুপচাপ কক্ষে প্রবেশ করে। আফিমের কাছে গিয়ে তার দিকে কফির মগটি এগিয়ে দেয়।আফিম এক হাতে কফি নিয়ে অন্য হাতের চিরুনিটি নাফিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়।চিরুনির দিকে এক বার তাকিয়ে আফিমের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় নাফিয়া।আফিম বলে ওঠে,
-আমার সব কাজ তোমার করা উচিৎ মিস.শেখ।কথা তো এমনই হয়েছিলো,তাই না?তো নিজের কাজ করো।
কথাটি বলে চিরুনির দিকে ইশারা করে আফিম।ইশারা বুঝতে পেরে একরাশ অনিচ্ছা নিয়েই চিরুনিটি হাতে নেয় নাফিয়া।আফিম তার বেডে বসতেই নাফিয়া তার চুল আঁচড়ে দেওয়ায় মনোনিবেশ করে।আর আফিম নাফিয়ার বিরক্তিতে ভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মৃদু হেসে নিচ্ছে।
চুল আঁচড়ানো শেষ হতেই আফিম বলে ওঠে,
-মিস.শেখ,জগিং থেকে ফিরেই আমি শাওয়ার নিবো।সো,সব কিছু রেডি করে রাখবা।আর আজ আমাকে তুমি গোসলে হেল্প করবা।
-অ্যা?
-হ্যাঁ,Be prepared.
কথাটি বলে আর দাঁড়ায় না আফিম।সোজা নিজের কক্ষ ত্যাগ করে।
এদিকে সকাল সকাল নাফিয়ার মেজাজের ১২ টা বেজে গিয়েছে।রাগে গা জ্বলছে তার।এখন কিনা এই বুইড়া ছেলেরে তার গোসলে সাহায্য করতে হবে।কোন ধরণের ফাইজলামি এটা! এসব ভাবতে ভাবতেই নাফিয়া মনে মনে বলে ওঠে,
“না জানি কবে বলে বসে,মিস.শেখ আমার মল ত্যাগ করবার জন্যেও তোমার হেল্প লাগবে।”
মনে মনে এমনটি ভাব্বার সাথে সাথেই নাফিয়া নিজে কল্পনা করা শুরু করলো যদি সত্যি এমনটা হয়?
কল্পনা করা শুরু করলেও তা শেষ করতে পারলো না সে।তার আগেই মনে মনে বলে উঠলো,
“ছিঃ!এমন কিছু আমি একটুও করবো না।উফ,এই দামী ধন্যবাদ আমার উপরই এতো ভারী পড়বে তা জানলে জীবনেও এই ব্যাটারে ধন্যবাদ দিতে যাইতাম না”

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here