আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব -০৬+৭

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৬
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

পিনপতন নীরবতা কেটে আবারও গুঞ্জন শুরু হতেই প্রফেসর মোর্শেদ উদ্দীন পোর্টফলিও ম্যানেজমেন্টের বইটি বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে সবার দিকে তাকালেন।

হাউ স্টুপিড! আবারও তোমরা আমার সাথে মশকরা শুরু করেছ?

গালে হাত দিয়ে মেহুল বিড়বিড়িয়ে বলল

ধুরর টাকলা ভ্যা ভ্যা করিস না তো ভাই। টেনশনে মরে যাচ্ছি।

শান্তা বলল

আমাদের স্কুলের বাচ্চা পেয়েছে এই টাকলা। এইসব কূটনামি করেই তো মাথার সব চুল গেল।

প্রফেসর মোর্শেদ সময় ফুরিয়ে আসতেই নোট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন দরজার বাইরে এক পা দু পা করে পায়চারি করছেন সদ্য জয়ন হওয়া প্রভাষক।

মোর্শেদ উদ্দীন কপালের একপাশে চুলকে বললেন

ও আরেকটা কথা। আজকে ফাইনানন্সিয়াল এনালাইসিস এন্ড কনট্রোল নতুন স্যার পড়াবেন। ফারদিন সাহেব আসুন আসুন। আমি আজকে ওদের একটু বেশি পড়িয়ে দিচ্ছি। ভীষণ অসভ্য এরা। নতুন স্যারের সাথে যেন ভন্ডামি না করে।

অভিক ভেতরে প্রবেশ করে হাসলো মৃদু।

সবাই তখন দাঁড়ানো। সুজানা মেহুল আর শান্তা একেবারে লাস্টে। প্রথম দুই বেঞ্চ ছাড়া যাদের দেখা যেত না তারা একদম শেষে ব্যাপারটা অনেকের কাছে আশ্চর্যের।

মেহুল কনুইয়ের গুঁতো মেরে বলল

আমি তোকে বলেছিলাম এই ক্লাসটা করব না। শুনলি না তো।

সুজানা বলল

বেরোনোর সুযোগ পেলাম কোথায়? আর উনি কি বাঘ নাকি? দেখ আজ না হোক কাল তোর সাথে ওনার দেখা হবেই। প্লিজ একদম মাথা খারাপ করিস না।

শান্তা বলল

হাহ ভার্সটিতে সব হ্যানসাম হ্যানসাম স্যার আসিতেছে কেন? এই বেটা তো এখন বেশ অর্ধেকের ক্রাশ হইয়্যা যাইবো সবাই ক্রাশ খাইয়্যা কিছুদিন পর ফাঁসও খাইবো।

মেহুল হেসে উঠলো। সুজানা বলল

এবার চুপ যাহ।

প্রফেসর মোর্শেদ উদ্দিন অভিককে দেখিয়ে সবার উদ্দেশ্য বললেন

এভরিওয়ান! তোমাদের নতুন স্যার কিন্তু ভারী মিষ্টি। তোমরা যদি উনার কাছেও কালার হয়ে যাও তাহলে বলতেই হবে আমার টাকলা হওয়ার একমাত্র কারণ তোমাদের মতোই স্টুডেন্ট।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। অভিক ও হাসলো।

উনি অভিকের সাথে হাত মিলালেন। অন্য হাতে কাঁধ চাপড়ে বললেন..

আসি হ্যা? অল দ্য বেস্ট ফারদিন।

থ্যাংকিউ স্যার।

ইয়াহ আরেকটা কথা ওদের একদম লাই দেবেন না। নিখিল নিহাত হাত তোলো ?

তৃতীয় সারি আর প্রথম সারির প্রথম বেঞ্চের দুজন স্টুডেন্ট হাত তুললো।

মোর্শেদ উদ্দিন হাসলেন। বললেন

এরা হচ্ছে এই ব্যাচের টপার। খুবই ভালো। আরও কয়েকজন আছে যেমন নিখিলের পাশের জন। আহির আর ওর পেছনের দুজন। মেয়েদের এদিকে ওই ডান পাশের গুলো। আরও কয়েকজন আছে। আপনি বুঝে যাবেন অবশ্য।
আর বাকি সবাই ভীষণ ফাঁকিবাজ। একটু এদিকসেদিক হলেই ক্লাস থেকে আউট করে দেবেন। একদম বাইরে।

অভিক হেসে উঠলো।

আরেহ হাসির কথা নয় ফারদিন সাহেব। কয়েকদিন ক্লাস নেন। নিজেই বুঝে যাবেন এরা কেমন। আসি। সাবধান কিন্তু। হ্যা?

অভিক মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে

ইয়েস স্যার।

মোর্শেদ উদ্দিন যেতেই অভিক সামনের হান্টার ডেস্কে দু হাতের ভর দিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলো। নিহাত আর নিখিলকে উদ্দেশ্য করে বলল

বসুন। স্যারকে নিশ্চয়ই ভীষণ ক্ষেপান আপনারা।

সবার ঠোঁট হাসি। যার মানে হ্যা।

এনিওয়ে আমি আজ ব্যাসিক কিছু থিওরি পড়াবো। আপনারা এলইডি স্ক্রীনে তাকান।

শান্তা ফিসফিস করে বলল

মাগোমা ইনি তো আসা মাত্রই পড়া পড়া শুরু করে দিয়েছে। একটু পরিচিত তো হবে। হাহ ডিউটির মারে বাপ।

সুজানা বলল

চুপ কর। এদিকে না আসলেই ভালো।

এখন তো বলছিলি যে কেন ভয় পেতে হবে উনাকে। এখন অন্য কথা বলিস।

সুজানা মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলল

এদিকে আসলে যে ভয় পাব এমন না। একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে শান্ত। আচ্ছা এবার চুপ থাক।

শান্তা চুপ করলো। নিহাত নামের মেয়েটি বলল

স্যার সবাই আপনার সাথে পরিচিত হতে চায়।

অভিক ঘাড় ঘুরিয়ে বলল

ওহ ইয়েস। আমার ক্লাস অনেক পাবেন আপনারা। পরিচিত হওয়া যাবে। পে এটেনশন ইন ক্লাস।

নিহাত বসেই বলল

ওকে স্যার।

মেহুল সুজানাকে ডেকে বলল

জানু আমার ভয়ে কেমন হাত পা কাঁপছে। উনি যদি জানতে পারেন আমি মেহুল তাহলে কেমন রিয়েকশন হবে?

কিছু বলবেন না। চুপ যা হতো ভাই। তোদের কথামতো পেছনে এসে বসাটাই ভুল হয়েছে।

আচ্ছা আচ্ছা বাদ দিলাম।

অভিক এলইডি রাইটিং বোর্ডে আঙুল চালিয়ে পড়ার গভীরে নিয়ে যেতেই মনোযোগী হলো প্রতিটিা ছাত্রছাত্রী। সুনিপুণ ভাবে প্রতিটা টপিক, প্রতিটা রুলসের, প্রতিটা থিওরির স্পষ্ট ব্যাখ্যায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও পিনপতন নীরবতা নেমে এল পুরো ক্লাসরুম জুড়ে।
এমন শিক্ষকের ভূয়সী প্রশংসায় মনে মনে পঞ্চমুখ হলো ছাত্রছাত্রীরা।
পড়া শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অভিক সবার উদ্দেশ্য বলল

By the way, let me introduce myself, I am Abhik Fardin. I have joined the Finance Department as a lecturer. See you again very soon.

সবাই তখন দাঁড়িয়ে। ধপাস করে বসে পড়ার আগেই অভিক ফিরে তাকালো পুনরায় । সবাই হকচকিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

পেছনের তিনজন বেশি কথা বলেছেন। নেক্সট টাইম আপনারা সামনে এসে বসবেন।

বলেই অভিক বেরিয়ে গেল। সবাই সুজানাদের দিকে ফিরে তাকালো। তিনজন ধপাস করে বসে একে অপরের গায়ের উপর ঢলে পড়লো।

_______________

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠলো কাটাপাহাড়ের রাস্তা। ভিড় জমে উঠলো ঝুপড়িগুলোয়। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত চবি’র পুরো আঙিনা যেন অপরূপ এক লীলাখেলা । দৃষ্টিজুড়ে নান্দনিক, অপ্সরী। এ যেন নান্দনিক সৌন্দর্যের পুরোধা।
সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে পরম আকর্ষণীয়, ভ্রমণের পিপাসা মেটানো চিরসবুজ-শ্যামল সোনালি ক্যাম্পাসে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকা বন্ধুমহল ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ালো ঝকঝক করে এসে থামা শাটল ট্রেনের কাছে।

রঙবেরঙের এই শাটল ট্রেন তাদের কাছেই পরম আপনের। নিত্যদিনের সঙ্গী। একের পর বগি দখল হলো।

সবাই জায়গা দখল করে বসে পড়লো। কেউ ঘর্মাক্ত গায়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। এই ক্লান্ত দুপুরেও চবির ক্ষুদে শিল্পীদের পুরোনো তারছেঁড়া গিটারে সুর উঠলো। গেয়ে উঠলো সবাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সেই বিখ্যাত গান।

ও হালা চান গলার মালা
পেট ফুরেদ্দে তোয়াল্লায়।
কইলজা জ্জলের তুয়ারলাই।

মাইট্টা গুদাম টইনুর
ছানি ঝরঝরাইয়া পরের পাণি
মাইট্টা গুদাম টইনুর
ছানি ঝরঝরাইয়া পরের পাণি
আই ভিজিলে যেমন তেমন তুই
ভিজিলে পরান ফাঢী যায়
ও কালাচান গলার মালা
পেট পুরেদ্দে তুয়ারলাই
পেট পুরেদ্দে তুয়ারলাই
কইলজা জ্জলের তুয়ারলাই

হাতের তালি আর মাথা দুলিয়ে সুর মিলিয়ে সবাই গেয়ে যেতে লাগলো।

গিটারে আঙুল চালাতে চালাতে হাতের কব্জি দিয়ে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে ঘাম মুছে পাশে তাকাতেই নিখিলের চোখে পড়লো ক্লাসের টপারের দিকে। তার সাথেই অঘোষিত শান্তিযুদ্ধ চলতে থাকা সেই মানবীর দিকে। চোখ সরু করে তাকাতেই নিহাত চোখ সরিয়ে খোলা জানালার বাইরে চোখ নিবদ্ধ করলো। তার উড়ো চুল কাউকে বিরক্ত করছে তা দেখার সময় তার নেই। তার পাশে বসেছে কেন?

বন্ধুরা সবাই ফিসফিস করলো

দোস্ত টপার প্লাস টপার একুয়াল কি হয়?

নিখিল দাঁতে দাঁত চেপে বলল

ডাফার হয়।

সবাই আবারও হো হো হাসিতে মেতে উঠলো।

সুজানা আর মেহুল আসার সময় ট্রেন মিস করায় নিউমার্কেট থেকে বাসে করে চলে এসেছিল। কিন্তু যাওয়ায় সময় তো আর মিস করা যায় না। ৫২ মিনিটের এই পথটা তাদের কখন যে ফুরিয়ে গেল ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেল না তারা। ঝকঝক করে সেই শাটল থেমে যায় শহরের বটতলী রেলওয়ে স্টেশনে এসে।

দলে দলে নেমে পড়লো সবাই। আর মিলিয়ে গেল ভিন্ন ভিন্ন পথে।

কাল সকালে তাদের আবারও দেখা হবে ঠিক এই স্টেশনে। তারা যে এক শহরের মানুষ।

______________

রোদ ছাতাটা বন্ধ করে ষোলশহরের ২ নম্বর গেইটের সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়িটির গেইট ঠেলে ভেতরে পা রাখলো সুজানা। ওই নীল গগনে শেষ বিকেলে ক্লান্ত,কর্মঠ কাকপক্ষীগুলো যখন নীড়ে ফিরছে সুজানা তখন পড়াতে এসেছে নবকুঠিরে। সূর্য্যিমামাও তখন ভারী পরিশ্রান্ত। বেলা করে পড়াতে এসেছে সুজানা। ভার্সিটি থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে যেই শুয়েছিল চোখটা লেগে গিয়েছিল। কি এক জ্বালা। এই টিউশনিটা বেশিদিন কন্টিনিউ করতে পারবে মনে হয় না তার।

বাড়ির দক্ষিণ পাশে কাজ করছে বাগানের মালী। সুজানা হাসলো মালীর সাথে। তারপর বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই দেখলো শার্ট কোর্ট পড়া কয়েকজন লোক বসে আছে।

সুজানাকে দেখে কেমন কৌতূহলী চোখে চাইলো। আজাদ সাহেব কিছু একটা বলতেই উনারা মাথা দুলিয়ে নিজেদের কাজে মনোযোগ দিলেন। দোতলায় যাওয়ার পথে অভিকের সাথে দেখা হতেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে উঠলো তার। আজ ক্লাসে নিশ্চয়ই উনি সুজানাকে লক্ষ্য করেছিলেন। আর ফিসফিস করাতে বিরক্ত হয়েছিলেন।

অভিক নেমে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলো

কেমন আছেন সুজানা?

সুজানা মাথা নেড়ে ভালো আছি বলার আগেই অভিক নিচে গিয়ে লোকগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠলো।

সুজানা দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। অনা আর আবিদ টেবিলের উপর বসে বসে কার্টুন দেখছে।

সুজানা বলল

একি? ওখানে কেন? আবার?

দুজনেই সমস্বরে সালাম দিল।

আসসালামু আলাইকুম টিচার।

ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি ব্যাপার?

অনা বলল

সুজান সুজান আছকেও আমরা ইখানে পড়বো।

সুজানা চেয়ারে গিয়ে বসলো। গাল টেনে দিয়ে বলল

কে বসিয়ে দিয়েছে এখানে?

অভি অভি।

ওহহ।

আবিদ সুজানার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালো। বলল

সুজান দিরি কচচো কেন? কান ধরো।

সুজানা বড় বড় চোখ করে চাইলো। বলল

হাহ আমি?

হ্যা অভি বুলেচে টিচার দিরি কললে পানিশ দিতে।

সুজানা হেসে বলল

কানে না ধরলে কি করবেন?

অভিকে বুলে দিবো।

আচ্ছা? উনি কি করবেন?

আবি আর অনার মোতো আদর কববে না।

সুজানা কপাল চাপড়ে বলল

মাফ করেন আমায়। আর দেরী করব না ভাই।

মর্জিনা এসে ট্রে রেখে গেল। সুজানা দেখলো চায়ের বদলে কফি। আর দু রকমের নাশতা। সুজানা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মর্জিনা বলল

ছোড বাবু বলছে তোমারে চায়ের বদলে কফি দিতে। তাই বড় বউ কফি দিছে। খাইয়্যা লও।
সুজানা খেল কোনো উপায়ান্তর না দেখে। তবে আগের মতো অত খারাপ লাগলো না।

_____________

সুজানা পড়ানো শেষ করে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো নতুন শাড়ি পড়া কয়েকটা ভদ্র মহিলা। নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছেন উনারা। পুরুষমানুষ কাউকে দেখা গেল না অভিক আর আহনাফ ছাড়া। আহনাফ সুজানাকে দেখে জানতে চাইলো

কেমন আছেন সুজানা? ওরা ঠিকঠাক পড়ছে তো?

হ্যা পড়ছে ভাইয়া। দুষ্টুমি তো করবেই। এখনো ছোট তাই।

বলতে না বলতেই অনা আর আবিদ ছুটে এসে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। আহনাফ বলল

এইতো চলে এসেছে। অভিক সুজানাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়।

অভিক মাথা তুলে সুজানার দিকে তাকালো। সুজানা বলল

না না। আমি চলে যেতে পারব ভাইয়া। সমস্যা হবে না। আমাকে ম্যাডাম কেন ডেকেছিলেন?

অভিক চোখ নামিয়ে ফোনে মনোযোগ দিল। আনিকা ছুটে এসে বলল সুজানা আসুন না। আরেহ আমার আম্মা আর চাচী আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন।

বলেই হাত ধরে নিয়ে গেল আনিকা। সুজানা বলল

কিন্তু আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম।

গাড়িতে করে যেতে পারবেন। এমনিতেই দেরী হয়েছে। আসুন আমার আর চাচী অনেকদিন পর এসেছেন।

সুজানাকে রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেল আনিকা। সুজানাকে দেখেই সবাই নড়েচড়ে বসলো। সুজানা সালাম দিতেই আনোয়ার বেগম উত্তর দিলেন। বললেন

বসো। কি নাম তোমার?

সুজানা নিজের নাম বলে আবারও আনিকার দিকে চাইলো। আনিকা বলল

এমা আমার আম্মা উনি। এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে?

সালমা বেগম আঁড়চোখে তাকিয়ে বললেন

শোনো মেয়ে। একটা উপদেশ দিই তোমাকে। মেয়ে বড় হয়েছ কেউ যখন কথা বলতে ডাকবে তখন একদম চুপচাপ থাকবে। আর যেটা জিজ্ঞেস করবে সেটা উত্তর দেবে। মনে থাকবে?

সুজানা মাথা নামিয়ে বলল…

জ্বি।

আনোয়ারা বেগম হেসে বলল

বেয়াইন ছোটমানুষ তাই লজ্জা পাচ্ছে হয়ত। আচ্ছা মা তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? কোথায় থাকো?

আমি মা আর ভাই। সরিষা বাড়ির পথে যে বিল্ডিংটা দেখা যায় ওখানে তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকি আমি। আমার গ্রামের বাড়ি পটিয়া।

ওহহ আচ্ছা আচ্ছা। তোমার বাবা কি করেন?

সুজানা কিছু বলতে যাবে তখনি আবিদের ডাক ভেসে এল।

সুজান সুজান অভি এখুন যেতে বলে। এখুন ডাকে। এখুন এখুন।

আনিকা বলল

আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছে বাপু।

আবিদ চলে গেল। কিছুক্ষণ পর অনা এল।

সুজান সুজান অভি এখুন ডাকে। নইলে মার দিবে।
এখুন আসো। আসো তাত্তারি আসো। আসো না?

সালমা বেগম বললেন

অ্যাই বজ্জাত তুই আমার ছেলের নাম ধরে ডাকবি কেন?

অনা চিল্লিয়ে বলল

ভোবব। অভি আমার ছিলে। মাই সান।

সবাই হেসে উঠলো তার কথায়। সালমা বেগম খুন্তি দেখিয়ে বললেন

সুজানা যাবে না। যাবে না মানে যাবে না।

অনা মাথা দুলিয়ে বলল…

তাওলে অভি কুলে করে নিয়ে যাবে।

সালমা বেগম চোখ বড় বড় করে তাকালেন।
সুজানার ইচ্ছে হলো মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়তে।

অনা বেরিয়ে যেতে যেতে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল

অভি অভি তাত্তারি আসো । টিচারকে কুলে করি নিয়ে যাও।

চলবে…….

পাঠক অনুভূতি জানাবেন। ভালোবাসা সকলকে❤️❤️❤️❤️ আমার জন্য দোয়া করবেন।#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৭
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

সালমা বেগম চেঁচাতে চেঁচাতে ড্রয়িংরুমে এলেন। অভিককে ফোনের ভেতর মুখ গুঁজে বসে থাকতে দেখে বললেন

আহা আমার ছেলেটার বোধবুদ্ধি কখন হবে? হ্যা? দেখছিস তো ওখানে মেয়েটার সাথে মুরব্বির সাথে কথা বলছে। তারমধ্যেই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিস?

অভিক মাথা না তুলেই জিজ্ঞেস করলো

আমি কখন ডাকলাম মা?

তুই তো ডাকিস নি। কিন্তু বজ্জাত দুটোকে পাঠিয়েছিস। ওই মেয়েটাকে সেখানে দাঁড়াতে দিচ্ছে?

সরি মা।

আজীম সাহেব এসে সোফায় বসলেন।

মা ছেলে কি নিয়ে কথা হচ্ছে?

আহনাফ হেসে উঠে বলল

কাকি অনা আর আবিদের রাগ অভির উপর ঝাড়ছে কাকাই।

আহ সালমা তুমি না ছেলেকে বিয়ে করাতে যাচ্ছ? এবার একটু মিষ্টি করে কথা বলতে তো শেখো। সবাই আমাদের আনিকার মতো হবে? ও তো বিয়ের আগে থেকে জানতো চিনতো সবাইকে তাই মানিয়ে নিতে পেরেছে । কিন্তু হুট করে একজন নতুন মেয়ে এসব সহজভাবে নিতে পারবে?

সালমা বেগম ক্ষিপ্ত চোখে তাকালেন। আজীম সাহেব বললেন

আচ্ছা বাবা তুমি তোমার কাজে যাও। আমরা কিছু কথা বলি। অভিক তোমার হাতে সময় থাকলে বিজনেস ডিলটার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই।

সালমা বেগম তেড়ে এলেন।

এই এই শোনো তোমরা বাপ জেঠা তো সারাক্ষণ অফিস আর অফিস। ব্যবসা আর ব্যবসা। ওসবে আমার ছেলেকে একদম জড়াবেনা বলে দিলাম। ও কতদিকে মাথা দেবে বলতে পারো? ও পড়ায় বুঝলে? পড়াতে কত মেধা খাটাতে হয় জানো? কত বড় বড় ছেলেপেলেদের পড়ায় সেটা জানো? খোঁজ রাখো? আহনাফ তোকে বলে দিচ্ছি বাবা এই লোকের কথা একদম কানে তুলবি না। অতিরিক্ত কাজ করার কোনো দরকার নেই। না তুই, না অভি।

অভিক মায়ের মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো। উনি ছেলেকে অমন করে তাকাতে কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

তোর বাপের কথা একদম শুনবি না অভি। আমি তোর বউয়ের সাথে কখনো খিটখিটে মেজাজে কথা বলব তোর মনে হয়? আমি তোর সাথে ওভাবে কথা বলি?

অভিক হাসলো।

এমা ছেলে হাসে। হাসিস কেন? আমি হাসার কথা বললাম? তোর বাপকে কিছু বল।

অভিক আবারও হাসলো।

আজীম সাহেব এবার হেসে উঠলেন নিজেই। গা এলিয়ে বসে বললেন

আচ্ছা তুমি ভালো শ্বাশুড়ি হবে সালমা। এবার নিজের কাজে যাও।

সালমা বেগম যাবে যাবে করেও কিছুদূরে গিয়ে থেমে গেলেন । আবারও নিশ্চয়ই অফিসের কথা বলবে এই লোকটা।

আজীম সাহেব পায়ের উপর পা ছড়িয়ে ডাকলেন।

অভিক ফারদিন।

ইয়েস বাবা।

তোমার রুমে গিয়ে আইরন টেবলটা ওপেন দেখলাম। ফোল্ড করা ছিল না।

ওহ সরি। ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি ওখানে একটা ছবি রেখেছি। দেখে জানিও তোমার মাকে।

সালমা বেগম গালে হাত দিলেন। ছুটে এসে বললেন

হায় হায় তুমি আগে আমাকে বলবেনা। কেমন মানুষ গো তুমি? আমার অভির বউ আমি দেখব না?

তোমার পছন্দ হলো না, কিন্তু তোমার ছেলের পছন্দ হয়ে গেল তখন তুমি কি করবে সালমা?

সালমা বেগম চুপ করে ম্লানমুখে তাকালেন। যেন ভারী অসন্তুষ্ট হলেন তিনি।

আমার ছেলে ও। আমার আর ওর পছন্দের মিল থাকবে না?

অভিক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

মা আগে তুমি দেখো। ঠিক আছে?

সালমা বেগম খুশি হয়ে গেলেন পাঁচ আঙুলের মাথায় চুমু খেয়ে ছেলের মুখে ছোঁয়ালেন। বললেন

আমার সোহাগা ছেলে।

ওকে। এখন সুজানাকে ডেকে দাও। উনার দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আবারও সুজানা? ওই মেয়ে কথা বলছে বলছিলাম না।

তোমার মেয়েকে তুমি এতক্ষণ বাড়ির বাইরে রাখতে মা?

সালমা বেগম হকচকিয়ে গেলেন।

ওই মেয়ের বাবা মা ছেড়েছে কেন? আমি তো ছাড়তাম না।

মা এরকম বলতে নেই।

আচ্ছা বাপু আর বলব না। ডেকে দিচ্ছি।

সুজানা ছাড়া পেয়ে তার কিছুপরেই ছুটে এল। বাবারে বাবা যেন চাকরির ইন্টারভিউ নিচ্ছে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন।

সে আসতেই অভিক বলল

গাড়ি রাখা আছে। গিয়ে বসুন।

সুজানা বেরিয়ে গেল। সে রিকশা করে যাবে। সবসময় সাহায্য নিতে ভালো লাগেনা।

অভিক ফোন ঢুকিয়ে বেরুলো বাড়ি থেকে। সদর দরজা পার হতেই দেখলো সুজানা গেইটের কাছে। গলা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

অভিক গাড়িতে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল। সুজানা পিছু ফিরে সটান হয়ে দাঁড়ালো। অভিক গাড়ি তার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল

বসুন।

সুজানা পান্ডুরমুখে গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসলো।

অভিক গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল

আপনি সবসময় দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করবেন সুজানা। আপনি পড়েন কখন? এখান থেকে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনার ক্লান্ত লাগবে অন্য কাজও থাকতে পারে। তাহলে পড়বেন কখন?

সুজানা চুপ করে বসে রইলো। কিছু পরেই বলে উঠলো..

স্যার একটা রিকশা দেখেছি। ওটার সামনে দাঁড়ালে ভালো হতো।

অভিক গাড়ি দ্রুত টেনে নিয়ে রিকশাটি পার করে গেল । সরিষাবাড়ির সেই বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামালো। সুজানা গাড়ি থেকে নেমে ধন্যবাদ জানাতে যাবে তার আগেই অভিক গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল। সুজানা নিজের বোকামির জন্য নিজেকে বকলো কিছুক্ষণ। মাঝেমাঝে সে এমন কাজ করেনা। স্যার নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ভেবে নিয়েছে।

গেইট ঠেলে বাসার দিকে যেতে যেতেই দক্ষিণে বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে একজন মহিলা উঁকি দিল।

কি গো সুজানা আজকাল গাড়িতে চড়া চড়ি চলছে।

সুজানা হেসে এড়িয়ে গেল।

বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই সাজিয়া বেগম বললেন

গাড়ি দেখলাম। আজকেও ওদের বাড়ির করে গাড়ি করে এলি? ওদিকে রিকশা পাওয়া যায় না?

আম্মা এতসব দেখে তো টিউশনি পড়াতে পারব না। ঘরের ভেতর বসে থাকতে হবে।

সাজিয়া বেগম মেয়ের পিছু পিছু ছুটলেন। বললেন

রাগ করছিস কেন? মানুষের তো আমাদের কথা শোনাতে বাঁধেনা। তুই সাবালিকা তাই আমার চিন্তা হয়। টিউশনি বাদ দে এটা বলার ক্ষমতা থাকলে তখনই বলে দিতাম। তোর বাপ তো আমার হাতে দুটোকে দিয়ে চলে গেল। একা কতদিক সামলাবো?

সুজানা মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। উনি মেয়েকে পিছু করে দাঁড়িয়ে চোখের জল আড়াল করলেন। সুজানা মাকে পেছনে জড়িয়ে ধরলো। বলল

ও আম্মা তোমার মেয়ে এমন কোনো কাজ করবেনা যাতে তোমাকে কথা শোনা লাগে। উনারা খুব ভালো মানুষ জানো? আমাকে একা ছাড়তে চায় না। তারউপর আজ সন্ধ্যে নেমে গেল।

আচ্ছা ঠিক আছে।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব আম্মা। বকোনা কেমন?

বল।

আব্বা তোমাকে কত তাড়াতাড়ি একা করে চলে গেল না? তোমাকে কেউ আর বিয়ে করতে বলেনি?

সাজিয়া বেগম মেয়েকে সরিয়ে দিলেন। বললেন

তোমার বাপ আমাকে দুটো সম্পত্তি দিয়ে গেল না। ওগুলোর দেখাশোনা তো করতে হবে আমাকে। আবার বিয়ে। মুখ ধুঁয়ে চা খেতে আয়।

তোমাকে নানা বিয়ে দিতে চেয়েছিল না আম্মা। দাদুও চেয়েছিল। তাই তুমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে এখানে চলে এসেছ।

সাজিয়া বেগম কঠোর চোখে তাকালেন। সুজানা একটুও ভড়কালো না। বলল

আমি তোমাকে আর ভাইকে রেখে কখনো একা কোথাও যাব না আম্মা। যেখানে যাব সেখানে তোমাকে আর ভাইকে নিয়ে যাব।

আকাশকুসুম কল্পনা বাদ দে। জীবন এত সহজ নয়। ফাইনালের পরপরই তোকে বিয়ে দিয়ে দেব আমি। জায়গা বেঁচার কথা চলছে। তারপর বাকি জীবনটা তোর উপর। আমি শুধু আমার কর্তব্যটুকু শেষ করব। লেখাপড়া করানোর দরকার তাই করাচ্ছি। বিয়ে দেওয়াও কর্তব্য সেটাও করব।

আম্মা কেন এসব বলো?

মেয়ে হয়েছ তাই শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে। আমি তোর মামা আর চাচাদের বলে রেখেছি। ভালো ছেলের খোঁজ পেলে যেন বলে। তোকে বিয়ে দিয়ে দিলে আমি আর সায়েমের দিন কোনোমতে চলে যাবে।

আমি চাকরি নেব আম্মা। জীবন এভাবে চলতে পারেনা।

বিয়ের পর সেটা তোমার আর তোমার বরের ব্যাপার। বিয়ের পর আমার কোনো কথা তোমার শ্বশুরবাড়িতে চলবেনা। অত আশা রেখোনা নিজের ভেতর। আবারও বলছি জীবন অতটা সহজ নয়।

আমি টিউশনি সেড়ে এসেছি আর তুমি আমাকে এসব কথা শোনাচ্ছ।

কথাটা তুই নিজেই তুলেছিস সুজানা। কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও এগুলোই সত্যি।

সুজানার চোখে নোনাজলের ডুবডুবানি।

আমি তাকেই বিয়ে করব যে আমাকে আমার মতো করে চলতে দেবে। একটা ছেলে তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারলে মেয়েটা কেন পারবেনা?

সাজিয়া বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে টেনে বুকে জড়ালেন।

মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললেন

অনেক বড় হ। তেঁতো কথা হয়ত বলি কিন্তু ওগুলোই সত্য মা। বেশি আশাবাদী হবিনা। কারো কাছে কোনো এক্সপেক্টেশন রাখবি না। আমিও কত আশা রেখেছিলাম তোর বাবার উপর।
তোর আব্বার ছাত্রী ছিলাম ছিলাম আমি । হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কতটা ভয়ে ছিলাম জানিস। খুব শান্তশিষ্ট ছিল এবং কম কথা বলতো তো। খুব ভয় পেতাম। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম তোর আব্বার মতো মানুষই হয় না। আমি মাস্টারমশাই ডাকলে তোর বাবা হেসে উঠতো। অনেকদিন ওই ডাক মুখ থেকে ফেলতে পারিনি। পরে উনি নিজেই ওই ডাকের মায়ায় পড়ে গিয়েছিলেন। কোনোদিন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারিনি। কত আগলে আগলে রাখতো আমায়। তোকে পেয়ে তো খুশির শেষ ছিল না উনার। তারপর বাবু এল। তারপর সব হঠাৎ করে কি যেন হয়ে গেল। আমি তো একটা অভিযোগ ও শোনাতে পারিনি উনাকে। সেই সুযোগটাও পেলাম না।

সুজানার গাল বেয়ে তরতরিয়ে জল গড়ালো। কেঁপে কেঁপে উঠলো সে। ডুকরে উঠে বলল…

এমন মাস্টারমশাই কারো জীবনে না আসুক আম্মা। আমি কখনো কাউকে তোমার মতো করে ভালোবাসব না। তুমি কিচ্ছু পাওনি আম্মা। কিচ্ছু না।

কিছু পাওয়ার আশায় কেউ কাউকে ভালোবাসেনা পাগল। ওটা এমনি এমনি আপনাআপনি হয়ে যায়। একদিন বুঝবি।

__________________

সোনা রঙা রোদের দেখা মিলেছে কিছু আগে। ফাঁকা রেলওয়ে স্টেশন কিছুক্ষণের ব্যবধানে রমরমা হয়ে উঠেছে। পিঠে ব্যাগ চেপে ঘুমঘুম ফোলা চোখমুখে অপেক্ষারত সবাইকে চমকে দিয়ে প্রতিবারের মতে ঝকাঝক শব্দ করে এসে থেমে গেল রঙিন শাটল। জনকোলাহল বেড়ে গেল আরও।

দলে দলে হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়লো ট্রেনে। সুজানা মেহুল আহির আর নিখিল ইতোমধ্যে বগি দখল করে বসেছে। শান্তা এখনো পৌঁছুইনি।

নির্দিষ্ট সময় হয়ে আসতেই শাটল ছেড়ে দেয়ার পূর্বাভাস জানান দিতেই সবাই হাতের ফোন চেপে শান্তার ফোনের পর ফোন দিতে দিতে শাটল ছেড়ে দিল ঝকাঝক শব্দসুর তুলে।
সুজানার ফোনে ফিরতি ফোনটা আসতেই সে তুলে কানে দিল।

কোথায় তুই?

আমাকে তোল। আরেহ আরেহ ছেড়ে দিল।

সবাই গলা বের করে উঁকি দিয়ে তাকে দেখে হৈচৈ করে উঠলো। আহির পিঠের ব্যাগ মেহুলের কোলে দিয়ে ট্রেন দরজার সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকলো

গাধী আরো তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি আয়।

শান্তা দৌড়াতে দৌড়াতে বলল

থামাতে বল না। আর দৌড়াতে পারছিনা।

আরও জোরে। আরেকটু আরেকটু। হাতটা ধর।

সবার চোখেমুখে উত্তেজনা। শান্তা প্রাণপণে ছুটলো ব্যাগটা এক হাতে বুকে চেপে ধরে।
হাতটা বাড়িয়ে দিতেই অকস্মাৎ নিজেকে হালকা মনে হলো হাতটা যেন শরীর থেকে আলাদা হয়ে এল। ঝিমঝিম করে উঠলো সারা দেহ।

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। তারপর হৈহৈ করে উঠলো সবাই মিলে। বয়ে গেল হাসির ফোয়ারা। এই একরকম ঘটনা কতবার যে ঘটেছে তাদের সাথে।

আহিরের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল শান্তা। পড়নে হাঁটুর নিচ অব্দি সবুজ রঙা কূর্তি আর মিশেল রঙা ওড়নাটা দিয়ে মুখে বাতাস করতে করতে হাঁপাচ্ছে সে। ঘেমে উঠেছে পুরো মুখটা। আহির হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে নিখিলের পাশ ঘেঁষে বসলো।

বলল

হাতটা শেষ আমার।

শান্তা ধপাস করে সিটে বসে পড়লো। বলল

তোর হাত বেডির মতো কেন? কিছু হলেই তোর হাত শেষ হয়ে যায়।

এর পরের বার থেকে তোকে আর তুলবো না। তোর নাম শান্তি দিছে কোন হারামি? তুই গোটা গোটা একটা অশান্তি।

শান্তা মুখ মোঁচড়ালো।

সুজানা হেসে বলল

ওকে আর তুলবি না কথাটা এর আগে অনেক বলেছ বন্ধু। তারপরও তো তুলতে যান আপনি।

সবার ঠোঁটে হাসি। শান্তা ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সবার মুখের দিকে তাকালো। আহির চোখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে রাখলো। শান্তা বলল

সবাই হাসছিস কেন?

মেহুল বলল

না এমনি এমনি।

এই আহিরের বাচ্চা ওরা হাসতেছে কেন?

আহির ভুরু কুঞ্চন করে তাকালো।

আমি কি জানি? লাতি দিয়া বের ফালায় দিমু এখন। একদম চুপ থাক। ফটরফটর করবি তো খবর আছে।

শান্তা নাক ফুলিয়ে তাকালো। আহির হাত ঝেড়ে আবারও জানালার বাইরে চোখ রাখলো। নিখিল ইশারায় হাতের তালু দেখিয়ে বুঝালো হাতে ব্যাথা পেয়েছে।

শান্তা ফিসফিস করলো

কি বলিস। বেশি?

নিখিল মাথা নেড়ে হাসলো।

আহিরের দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বসে রইলো শান্তা। মেহুল আর সুজানাকে বলল

এখন কি করব?

মলম লাগাতে হবে হয়ত। আগে ক্যাম্পাসে যাই।

_________________

শাটল থেমে গেল সেই চিরচেনা সবুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে এসে। ধুপধাপ হৈ হৈ করে নেমে পড়লো সবাই। সুজানা আর মেহুল যেতে যেতে থেমে গেল নিহাতকে দেখে।

আরেহ নিহাত কোথায় বসেছিলে? আজ দেখিনি তো।

গোমড়ামুখো মেয়েটা একটা জবাব দিল শুধু।

অন্য বগিতে।

তারপরেই চুপচাপ হেঁটে চলে গেল একা একা। মেহুল বলল

ভাব দেখালো নাকি?

সুজানা ঠোঁট উল্টে বলল

ও কম কথা বলে খুব।

পেছন থেকে নিখিল এসে বলল

কথা যখন বলেনা তখন যেচে কথা বলতে যাস কেন?

মেহুল বলল

তোর কারণে হয়ত। তোর তো ওর সাথে যুদ্ধ চলে। তুই আমাদের বন্ধু তাই আমাদের সাথে কথা বলতে চায় না।

তাতে কি যায় আসে? কেন কথা বলতে হচ্ছে? বুঝা আমাকে।

সুজানা বলল

আচ্ছা বাবা আর বলতে যাব না। টম জেরি গেল কই?

নিখিল আঙুল দিয়ে শান্তাকে দেখিয়ে দিল।

আহিরের পেছন ছুটতে ছুটতে শান্তা বলল

দোস্ত দাঁড়া। হাতটা দেখা। আমি সরি।

আহির যেতে যেতে বলল

কিছু হয়নি।

হাতটা দেখা না। বাসা থেকে বেরুতে দেরী হয়ে গেল। দেরী করে ঘুমিয়েছিলাম তো ঘুম ভাঙতে দেরী হলো বুঝলি। তাই এদিকে দেরী হয়ে গেল।
আমি সরি রে। হাতটা দেখা । ধুরর দেখা তো।

আহিরের হাতটা টেনে ধরলো সে। হাতের তালু মেলতেই দেখলে তালুতে লাল ছোপ ছোপ। শান্তা জিভ কামড়ালো। বলল

আল্লাহ! চাপ লেগেছে না?

আচ্ছা তোর এসাইনমেন্ট গুলা আমি করে দেব। ঠিক আছে?

আহির মৃদু হাসলো।

শান্তা তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল

দোস্ত আমি সত্যি সরি। তোর মা দেখলে তো আমার একটা চুলও আস্ত রাখবে না।

আহির থেমে গেল। ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল

একদম কথা বলতে আসবি না আমার সাথে। দূর হ।

চলবে.……….

ভীষণ ব্যস্ততা যাচ্ছে। রিচেক করা হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here