আমার আকাশ জুড়ে তুমি পর্ব ১৩+১৪

#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(১৩)
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আতিয়া ব্যাগ গুছিয়ে নিল। যাক থাকার জায়গা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। আতিয়া সা’দের সাথে ওর বাড়িতে থাকবে ভাবতেই কেমন অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। নাহিল আতিয়ার কাছে এসে বলল,
“-যাওয়া যাক?’
“-হুম।’
গাড়িতে নাহিল ওর প্ল্যান আতিয়া আর সা’দকে ভালো করে বুঝিয়ে দিল। সা’দ ড্রাইভিং সীটে তার পাশে আতিয়া আর পেছনে নাহিল। ড্রাইভ করতে করতে নাহিলের কথা শুনে মাথা নাড়ছে। ওখানে গিয়ে আতিয়াকে কী কী করতে হবে তা জেনে নিচ্ছে।
“-শোন, আমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমার অন্য কোনো কাজ নেই। তোমার একটাই কাজ থাকবে। দাদাজানের মন জয় করা। বুড়ো যা যা করতে বলবে চোখ বন্ধ করে করবে। বুড়োর যদি একবার সন্দেহ হয়ে যায় তোমরা সত্যিকারের স্বামী স্ত্রী না,তাহলে সবার কপালে দুঃখ আছে। তোমাকে সহ বুড়ো আমাদের দুই ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিব।’
“-ওসব নিয়ে তুমি টেনশন নিও না। আমার অ্যাক্টিং ধরতে পারবে এমন বাপের ব্যাটা এখনও জন্মায়নি। তুমি শুধু দেখে যেও। আমি দাদাজানকে কিভাবে বশ করি। উনি উঠতে বসতে আমার নাম জপবেন। উনার দিন শুরু হবে আতিয়াকে দিয়ে। আবার দিন শেষও হবে আতিয়াকে দিয়ে।’
নাহিল ওর কথা শুনে হেসে ফেলল।
“-তুমি একদম আমার কোয়ালিটির। এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে? আরও আগে দেখা হলে, এতদিনে দু’জনে মিলে অন্য রকম ইতিহাস তৈরি করে ফেলতাম।’
সা’দ হা করে দু’জনের কথা শুনছে। গাড়িতে ওঠার একটু পর থেকেই আতিয়াও নাহিলকে তুমি করে বলছে। দু’জনে চুটিয়ে গল্প করছে। সা’দ একবার আফসোস করল। সে কেন নাহিলের মত হলো না?
“-নাহিল,একটা কথা ভেবে দেখেছ। তোমার দাদার সামনে আমাকে নিয়ে গেলে উনি কিন্তু আমাদের বিয়ে করাতে চাইবে।’
“-হুম।’
“-হুম কি? উনার বিয়ে কিন্তু নকল হবে না। কাজী ডেকে সত্যি সত্যিই বিয়ে করিয়ে নিবে।’ আতিয়া সা’দের দিকে দেখে বলল,
“-আপনি কিছু বলছেন না কেন? আমরা কি সত্যি সত্যি বিয়ে করব?’
“-আরে ওসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি অত কাঁচা খেলোয়াড় না। কাল রাতেই আমি সব ভেবে রেখেছি।’
আতিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
“-কাল রাতে! তার মানে… ‘
নাহিল জিভ কেটে কান ধরে বলল,
“-আমি জানতাম তুমি না করবে না। তাই রাতেই প্ল্যান বানিয়ে নিয়েছিলাম। শোন এখন আসল প্ল্যান বলি। দাদাজানকে বলব তোমরা বিয়ে করে নিয়েছে? ‘
সা’দ এবার বলে উঠল,
“-কি!’
“-হ্যাঁ। এটাই বলতে হবে। নইলে বুড়ো নিজে সাক্ষী থেকে চোখের সামনে তোমাদের বিয়ে করাবে। তুমি বলবে আগেই তুমি ওকে বিয়ে করেছ। তাই এতদিন ভয়ে দাদাজানকে কিছু বলোনি। যদি দাদাজান সব শুনে রেগে যান।’
“-অসম্ভব। এতে দাদাজান কতটা কষ্ট পাবে ভাবতে পারছো তুমি? ‘
“-বেশি না। একটু তো পাবেই। এছাড়া কিন্তু তোমার কাছে আর কোন উপায় নেই।’
“-না থাকলেও আমি দাদাজানকে কষ্ট দিতে পারব না।’
“-ওকে তাহলে। আমার প্ল্যান বাদ। তোমার কী প্ল্যান আছে বলো শুনি। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই সামনে আগাবো।’
সামনের দিকে তাকিয়ে সা’দ বলল,
“-আমার কোনো প্ল্যান নেই।’
আতিয়া ওদের ঝগড়া দেখে বলল,
“-নাহিল তুমি কী বলছিলে বলো তো। উনার কথায় কান দিও না। নিজে এতো পারলে তো দাদাজান জোর করে বিয়ে করাতেন না।’
সা’দ বাঁকা চোখে তাকালে আতিয়া বলল,
“-কী? ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার প্ল্যানের থেকে নাহিলের প্ল্যান অনেক ভালো। ওকে কেউ জোর করতে পারবে?’
সা’দ আর কিছু বলল না। নাহিল বলতে শুরু করল,
“-আমি পেপার রেডি করে রেখেছি। তোমরা দু’জন সাইন করে দিলেই হবে। দাদাজানকে ওটা দেখালে, দাদাজান আর সন্দেহ করবে না। রাগ করলেও ভাববে কোট-এ তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।’

দাদাজান বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন। তার চোখের সামনে তিন আসামি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিল আড়চোখে সা’দ আতিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। আতিয়ার চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। সা’দকে সবার বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। গমগমে গলায় দাদাজান বললেন,
“-কী চাও তোমরা? না, আজ আমাকে বলো তোমরা দুই ভাই ঠিক কী চাও? আমি তো মেনে নিয়েছিলাম, নাকি? তারপরও কেন তোমরা আমার সাথে এমন করলে? আমার নাতির বিয়ে নিয়ে আমার কি কোনো শখ আহ্লাদ ছিল না? আমার কোনো স্বপ্ন ছিল না?’
বুড়ো আজ সিরিয়াস রাগ করেছে। ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। ওদের দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আতিয়া এগিয়ে এলো। নিচু গলায় আস্তে করে বলল,
“-দাদাজান, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন না? আপনি তো আমাদের দাদা, নাতি নাতনিরা ভুল করলে দাদা কি তাদের ভুল ক্ষমা করে দেয় না?’
দাদাজান স্থির চোখে আতিয়ার দিকে তাকালেন। মেয়েটা মিষ্টি আছে। সুন্দর করে গুছিয়ে কথাও বলতে পারে। দেখতেও মাশাআল্লাহ। সা’দের মত শান্ত ছেলেকে এই মেয়ের পছন্দ হলো কী করে? এই মেয়ের তো নাহিলের মত চঞ্চল মিশুক স্বভাবের কাউকে পছন্দ করা উচিত ছিল। এবার সাহস করে নাহিল বলে উঠল,
“-তাছাড়া দাদাজান এই আইডিয়া ভাইকে আমি দিয়েছিলাম। সেদিক থেকে বলতে গেলে সব দোষ আমারই।’
নাহিলকে বাঁচাতে আতিয়া বলল,
“-দোষ নাহিলেরও না দাদাজান। আপনি যদি কারো দোষ ধরতেই যান, তাহলে আমার দোষ ধরুন। আমার উপর আমার পরিবার থেকে চাপ আসছিল। ওকে হারাবার ভয়ে আমিও ওর উপর চাপ দেই। নইলে দাদাজান আমার বাবা মা আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিত।’
নাহিল রীতিমত আতিয়ার ফ্যান হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে কত সুন্দর করে চোখে মুখে মিথ্যা বলছে! নাহিলের মত এই মেয়েও মিথ্যা বলার উপর পিএইচডি করে এসেছে। সা’দ জীবনে কয়টা মিথ্যা বলেছে তা সে গুনে রাখেনি। কিন্তু হলফ করে বলতে পারবে অকারণে কখনও এক সাথে এতগুলো মিথ্যে বলেনি সে। আতিয়ার কথা শুনে সে অবাক না হয়ে পারছে না। এই মেয়ে তো তার ভাইকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।
দাদাজান সা’দের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“-সব কি ওরাই বলবে? নিজের তরফদারি করে তুমি কিছু বলবে না? আমি তোমার থেকে কখনও এসব আশা করিনি। যে নাতিকে নিয়ে আমার সবচে বেশি স্বপ্ন ছিল, সে নাতিই আমার সবথেকে বড় স্বপ্নটা ভেঙে দিল। ধুমধাম করে পুরো শহরকে জানিয়ে তোমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি। নাহিলকে নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। আমি জানতাম ওই ছেলে বৌ নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে বলবে ‘দাদাজান আমি বিয়ে করে ফেলেছি। এই হলো তোমার নাতবৌ’। এখন তো আফসোস হচ্ছে। নাহিলই আমার সোনার টুকরো নাতি।’
দাদাজানের মুখে প্রশংসা শুনে নাহিল খুশিতে বাকবাকুম করে আকাশে উড়ছে।
“-সত্যিই দাদাজান, আমি আপনার সোনার টুকরো নাতি। ‘
“-তামা তুমি। তামাও না লোহা তুমি। সা’দকে এসব করার বুদ্ধি তুমিই জুগিয়েছ। নাহলে আমার ভোলাবালা নাতি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করতো না। ওর মাথা তুমি নষ্ট করেছ। তোমাকে তো আমি পরে দেখে নিব।’
নাহিল বিরবির করে বলল,
“-লে হালুয়া! যত দোষ নন্দঘোস।’
দাদাজান তেমনই মুখ গম্ভীর করে বললেন,
“-শুধুমাত্র আমার নাত বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এবারের মত তোমাদের দু’জনকে ক্ষমা করলাম। কিন্তু মনে রেখ, এই বাড়ি আমার। আমার কথা মত না চললে আমি যেকোনো সময় তোমাদের দুই ভাইকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।’
দাদাজানের কথা শুনে আতিয়া ফিক করে হেসে দিল। দাদাজান হাসির শব্দ শুনে ওর দিকে তাকালে তাড়াহুড়ো করে দুই হাতে মুখ চেপে ধরলো। এটা দেখে দাদাজানও আর গম্ভীর হয়ে থাকতে পারলেন না। মৃদু হেসে উনি বললেন,
“-নতুন বউয়ের সামনে আর অপমান করছি না। যাও, যাও। বৌ নিয়ে ঘরে যাও। অনেকক্ষণ ধরে নতুন বউকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ওকে ঘরে নিয়ে যাও।’

ঘরে এসে আতিয়া ভালো করে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিল৷ সবকিছু বেশ সুন্দর করে সাজানো। ব্যাটার রুচি আছে বলতে হবে। মাথা থেকে ওড়না ফেলে ধপ করে বেডে বসে আতিয়া বলল,
“-উফফ! আপনার দাদা একটা চিজ।’
সা’দ তার দিকে তাকালে জিভে কামড় দিয়ে বলল,
“-না মানে… আপনার দাদা ভীষণ রাগী মানুষ।’
শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে সা’দ বলল,
“-দাদাজান আমার থেকে এ কাজ কখনোই আশা করেননি। আমি উনাকে কষ্ট দিয়েছি।’
ছেলে মানুষের এমন ন্যাকামি দেখে আতিয়ার গা জ্বলে গেল। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল,
“-আহারে! দাদাজানের ভালো বাচ্চাটাহ! আমি আমার বাপের মনে কষ্ট দিয়ে বাড়ি থেকে একবার না, একাধিক বার পালিয়ে আসতে পারি। আর উনি নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য দাদাজানের মনে কষ্ট দিতে পারবেন না। এতই দাদাজানের মনের চিন্তা করেন তাহলে আমাকে ধরে এনে নাটক না করিয়ে ফারিহা নামের ওই মেয়েকেই বিয়ে করে নিতেন। তাতে দাদাজানও খোশ আর আপনিও।’
মনের কথা মনে মনেই হজম করে নিল আতিয়া। প্রথম দিন এসেই এই লোকের সাথে ঝগড়া করতে চায় না সে। নাহিল কত ভালো। আর এই লোক এমন খিটখিটে মেজাজের কেন? আসলেই কি এরা দুই ভাই? ‘
সা’দ কিছুক্ষণ ধরে আতিয়াকে দেখছে। তাকে কিছু বলতে না দেখে নিজেই বলল,
“-এটা আমার ঘর। আপনি এখানেই থাকবেন। এ বাড়িতে কোনো কিছুর অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন। এখানে আপনার কোনো কাজ টাজ করতে হবে না। আপনি যেমন ভাবে থাকতে পছন্দ করেন ঠিক তেমন ভাবেই থাকবেন।’
“-হুম।’
সা’দ ওয়ারড্রোব থেকে টিশার্ট নিয়ে চেঞ্জ করতে চলে গেল। আতিয়া ততক্ষণে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরের সবকিছু দেখে নিল। ঘরটা তার বেশ ভালোই লেগেছে। তার নিজের বাসার রুম থেকে একটু বড়। তবুও কেমন একটা নিজের ঘর ঘর ফিলিংস আসছে।’
দুপুরে সবার সাথে বসে খেয়েছে আতিয়া। আজ কতদিন পর বাড়ির খাবারের মত তৃপ্তি করে খেল। খাবার ফাঁকে ফাঁকে নাহিল আর দাদাজানের সাথে গল্পও করেছে। সা’দ চুপচাপ ওদের কথা শুনেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই তবে উত্তর দিয়েছে। নয়তো চুপ করেই খেয়েছে। খাওয়া শেষ করে রুমে এসে আতিয়া লম্বা একটা ঘুম দিল। এক ঘুমেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সা’দের আজ কোনো কাজ না থাকায় বাসায় ছিল সে। দু’য়েক বার রুমে এসেও আতিয়াকে না জাগিয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় যখন আতিয়ার চোখ খুলেছে তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আতিয়া হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। চারদিকে তাকিয়ে কিছু মনে করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।
“-হায় হায়! প্রথম দিন শ্বশুরবাড়ি এসেই এমন ঘুম দিয়েছি! দাদাজান কী ভাববেন? এমনিতেই আমাকে উনার পছন্দ না। তার উপর নতুন বৌয়ের এই নবাবজাদী চাল দেখে তো বেহুঁশ হয়ে যাবে।’
আতিয়া ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে এলো। এক দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে দাদাজানের ঘরের সামনে চলে এলো। দাদাজান ভেতরে একা বসে আছেন। কারো সাথে কথা বলছেন নাকি? আতিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পেতে ভেতরে দাদাজান কী বলছে তা শোনার চেষ্টা করল।
“-দেখলে খাদিজা, আমার দুই নাতি কত বড় হয়ে গেছে! বড় নাতি সা’দ, ও আজ বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসেছে। কী ফুটফুটে মেয়েটা! ওর জন্য এতো সুন্দর একটা মেয়ের সামনে আমাকে রাগ দেখাতে হলো। মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়েছে। না জানি আমাকে বদমেজাজি, রাগী আরও কত কী ভাবছে। কিন্তু রাগ না দেখিয়ে কী করতাম বলো তো? সা’দ, আমার সেই ছোট সা’দ আমাকে না বলে বিয়ে করে ফেলেছে। কেন? আমাকে বললে আমি তার বিয়ে করাতাম না? আমি ওদের ভালো চাই না? ওদের ভালোবাসায় আমি বাঁধা হতাম নাকি? বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারেনি। আমি ওর উপর রাগ করিনি। কিন্তু ওর সামনে এই কথা বললে আরো মাথায় উঠতো। ওর ছোটটা, নাহিল। সে তো আরও বড় বাদর। ভাইয়ের দেখাদেখি সে-ও একই কাজ করত। তাই বকা দিয়েছি।’
আতিয়া এটুকু বুঝতে পারলো লোকটা নিজে নিজে কথা বলছে। ঘরে তো অন্য কেউ নেই। তাহলে এই খাদিজা কে? কার সাথে উনি কথা বলছেন? নাহিলকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে।
রাতে আতিয়া নাহিলের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে নাহিল বলল,
“-কে?’
“-আমি।’
“-ওহ ভাবি। এসো এসো৷ দেবরের ঘরে আসতে আবার পারমিশন লাগে নাকি? অধিকার আছে তোমার। চলে এসো।’
আতিয়া ঘরে এসে হাসলো। এ বাড়িতে আসার পর থেকে নাহিল একবারও তার নাম ধরে ডাকে নি। তখন থেকে ভাবিই ডেকে যাচ্ছে। ডাকটা আতিয়ার মন্দ লাগছে না।
“-নতুন শ্বশুড়বাড়িতে কেমন লাগছে? ‘
“-ভালোই। এ বাড়ির সবাই খুব ভালো।’
শেষের কথা বলে আতিয়া থেমে গেল। এই ছেলে নিশ্চয়ই এই কথার ত্যাড়া মানে বের করবে। হলোও তাই। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে নাহিল বলল,
“-সবাই…? নাকি একজন বিশেষ করে ভালো?’
আতিয়া কিছু বলল না। হাসলো শুধু। নাহিল আবার বলল,
“-দেখো, তোমাকে এ বাড়িতে আমি নিয়ে এসেছি। মানে ভাইয়ের বৌ হয়েই এসেছ। কিন্তু আমার কথাতেই তো আসতে রাজি হয়েছ। তাই তোমার ভালো খারাপ দেখার দায়িত্বও আমার। তোমার যেকোনো ধরনের সমস্যা আমাকে বলবে। লজ্জা পাবে না। যা খেতে মন চাইবে আমাকে বলবে। যেখানে যেতে মান চাইবে আমাকে বলবে। বুঝলে? ‘
“-হুম।’
“-আমার ভাইটা কোন কাজের না। অফিস টফিসের কাজের দিক দিয়ে পারফেক্ট হলেও। এসব মেয়ে আর মেয়েদের মন বোঝার ব্যাপারে একদম কাঁচা।’
শব্দ করে হেসে ফেলল আতিয়া। বলল,
“-তুমি তো দেখছি মেয়েদের মন বোঝার ব্যাপারে পিএইচডি করে রেখেছ।’
“-তা তো করেছিই। বহু বছরের এক্সপেরিয়েন্স।’
“-তাহলে বলা যায়, তোমার বৌয়ের ভাগ্য ভীষণ ভালো।’
“-তা বলতে পারো। বৌয়ের এতটুকু কষ্ট হতে দিব না। ভালোবাসায় কমতি রাখব না একফোঁটাও।’
নাহিলের কথা শুনতে শুনতে আতিয়া আনমনা হয়ে গেল৷ তার মাথায় এখন অন্য কারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তাকেও যদি কেউ এমন ভাবে ভালোবাসতো।
সা’দ দরজায় এসে দাঁড়াল। ঘরে গিয়ে আতিয়াকে না দেখে অস্থির হয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে। নাহিল ভাইকে দেখতে পেয়ে বলল,
“-আসেন, আসেন। জামাই সাহেব বউকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। আপনার বৌ পালিয়ে যায়নি। এ বাড়িতেই আছে। নিজের ঘরের পথও ভুলে নি। দেবরকে একটু দেখতে এসেছে। তাতেই আপনি অতটা উতলা হচ্ছেন।’
#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(১৪)
#জেরিন_আক্তার_নিপা

সা’দ ফিরে যেতে নিলে নাহিল মুহূর্তে দরজার কাছে লাফিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“-রাগ করছো কেন ভাই? আসো না নতুন ভাবির সাথে একটু আড্ডা দেই। গল্প গুজব করি।’
নাহিল টেনে সা’দকে ভেতরে নিয়ে এলো। আতিয়া দু’পা তুলে বিছানার উপর বসে আছে। সা’দ চেয়ার টেনে বসল। নাহিল আতিয়ার পাশে বসতে বসতে বলল,
“-আতিয়ার তো আবার ছোট বোন আছে। দেখি নিজের জন্য কিছু করতে পারি কি-না। তোমার তো যেমনই হোক মিছেমিছি হলেও বিয়ে হয়ে গেছে।’
আতিয়া মনে মনে আফসোস করে বলল,
-বেচারা নাহিল! আমার বোনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে বেচারা! ও কী জানবে, পুরো গুষ্ঠিতে আমি একটামাত্র মেয়ে।’
সা’দ বিরক্ত মুখে বলল,
“-তোমার তো অলরেডি দশ বারোটা গার্লফ্রেন্ড আছে। আর কয়টা লাগবে তোমার? ‘
“-গার্লফ্রেন্ড তো আছেই। কিন্তু একটাও বৌ হবার যোগ্য না।’ হাসি হাসি মুখ করে আতিয়াকে দেখল নাহিল। বলল,
“-আতিয়ার মত একটা গার্লফ্রেন্ড পেলে এতদিনে কবেই বিয়ে করে নিতাম। বিশ্বাস করো ভাই,আমার একটা গার্লফ্রেন্ডও আতিয়ার সামনে কিছুই না। আতিয়ার সামনে ওরা টিকতেই পারবে না। আতিয়ার সামনে আমার গার্লফ্রেন্ড লাইক গরুর মাংসের সামনে চেপার তরকারি। ‘
নাহিলের এমন কথা শুনে আতিয়া খিলখিল করে হেসে ফেলল। নাহিল তখনও বলেই যাচ্ছে,
“-দেখো,দেখো। জান নিয়ে নেওয়ার মত হাসি। আমি তো এই হাসি দেখাই ফিদ। তুমি কেন ভাইয়ের আগে আমার সাথে দেখা করলে না। তাহলে ফার্স্ট চান্সটা আমিই নিতাম।’
আতিয়া হাসতে হাসতেই বলল,
“-এখনও কিন্তু চান্স মিস হয়নি। আমি তোমার ভাইয়ের নকল বৌ। তুমি চাইলে এখনও ট্রাই করতে পারো। বান্দা ঠিকঠাক হলে আমারও কোন আপত্তি নেই।’
কথাটা বলার পর আতিয়ার হাসি দ্বিগুণ হয়ে গেল। নাহিলও ওর সাথে হেসে ফেলল। সা’দ চোয়াল শক্ত করে একবার আতিয়াকে, একবার নাহিলকে দেখছে। নাহিলকে আজ তার অসহ্য লাগছে। নিজের ভাইয়ের পছন্দ জানার পরও কেমন বদমাইশি করছে। মেয়েটা না জানুক। সে তো জানে তার ভাই এই মেয়েকে ভালোবাসে। নাহিল ভাইয়ের রাগান্বিত চেহারা দেখেও না দেখার ভান করছে। আতিয়ার কাঁধে হাত তুলে দিয়ে বলল,
“-তুমি ভীষণ মজার মানুষ। তোমার সাথে আমার ভালো জমবে। আমার তো রীতিমত তোমার এক্সের উপর রাগ হচ্ছে, শালা তোমাকে ঠকিয়েছে! তোমার মত একটা মিষ্টি মেয়েকে! অবশ্য এক দিক দিয়ে ওর প্রতি আমাদের থ্যাংকফুল থাকা দরকার। কারণ ওর জন্যেই তুমি এতদূর সিলেট এসেছ। ও তোমাকে ছেড়ে গেছে বলেই ভাইয়ের সাথে তোমার দেখা হয়েছে। আর আমিও ভাইয়ের উছিলায় তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে পেয়েছি।’
আতিয়া ভাবছে এরা দুই ভাই যেদিন আসল সত্য জানবে সেদিন আতিয়াকে কী করবে? নিশ্চয়ই ঘাড় ধরে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবে। মনে মনে বলল,
-না বাবা! এরা কিছু জেনে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার আগে আমি নিজেই চলে যাব।’
সা’দ উঠে দাঁড়াল। আতিয়ার হাত ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,
“-রুমে চলুন।’
এটুকু বলেই সা’দ আতিয়াকে একপ্রকার টেনে নিয়ে চলে গেল। নাহিল ভাইয়ের জেলাসি দেখে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়লো। আসলে ভাইকে টাইট দেয়ার জন্যই নাহিল ইচ্ছে করে এমন করেছে।
“-ভাই আমার, তুমি এতটা হিংসুটে! নিজের ভাইকেও সহ্য করতে পারলে না! তোমার জন্য আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। বেচারা ভাই!’
ঘরে এসে আতিয়ার হাত ছেড়ে দিল সা’দ। আতিয়া চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“-আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলেন কেন? ‘
কী উত্তর দিবে সা’দ ভেবে পেল না। তার এমন কাজে সে নিজেই লজ্জিত। তবুও এই মেয়েকে কিছু একটা তো বলতে হবে। আমতা আমতা করে সে বলল,
“-রাত হয়েছে। আপনি ঘুমাবেন না?’
কপাল কুঁচকে নাকের পাটা ফুলিয়ে আতিয়া বলল,
“-অ্যাঁ! এ’কথা বলার জন্য আপনি আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন? না। আমি কি ছোট বাচ্চা? আমাকে ধরে এনে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পারাতে হবে। আশ্চর্য লোক তো আপনি!’
“-না মানে দাদাজানকে নিয়ে কিছু কথা বলার ছিল।’
“-কী এমন কথা বলার ছিল, যার জন্য হঠাৎ করে এতটা উতলা হয়ে উঠলেন? যে কথা একটু পরে না বললেই হতো না। এখুনি বলতে হবে।’
সা’দ মনে মনে নিজেকে ধমকাচ্ছে।
-এটা কী করলি গরু? মেয়েটার সামনে নিজের ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিলি তো। আস্ত গাধা তুই।’
সা’দ আতিয়ার সামনে দমে না গিয়ে স্বাভাবিক গলা বজায় রেখে বলল,
“-দাদাজানের জন্য আপনাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তাই এখানে আপনার একমাত্র কাজ দাদাজানকে সময় দেয়া। উনার খুশি, অখুশি দেখা। আপনার চেষ্টা থাকবে কিভাবে দাদাজানের প্রিয়পাত্র হওয়া যায়।’
“-শুনুন মিস্টার, এসব কথা আমি খুব ভালো করেই জানি। নতুন করে আর বলতে হবে না। আমি এখানে আসার পর থেকেই আমার কাজ শুরু করে দিয়েছি। দাদাজানের কী ভালো লাগে, কী ভালো লাগে না। উনার পছন্দ, অপছন্দ সব নাহিলের থেকে জেনে নিয়েছি। কাল থেকে সেভাবেই সব করব।’
সা’দ মনে মনে নাহিলকে গালি দিয়ে বলল,
-সব জানিয়ে রেখেছে। এর সাথে নাহিলের এতো কথা কখন হলো?’ আতিয়া সা’দকে লক্ষ করছে দেখে সা’দ বলল,
“-ওহ। তাহলে তো ভালোই।’
“-হুম।’
সা’দ ভেতরে ভেতরে আতিয়ার কথার সামনে চুপসে গেছে। এই মেয়ে পাক্কা চালু। সা’দকে চুপ থাকতে দেখে মিনমিনিয়ে আতিয়া বলল,
“-সারাক্ষণ এমন ভাব করেন, যেন এ বাড়িতে উনিই এক মাত্র কাজের লোক। আর বাকি সবাই যেন মশা মারতে আছে। হুহ! ভাব কত ব্যাটার।’

আশরাফ চৌধুরীর শরীর ভালো যাচ্ছে না। তিনি মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। হামিদ চাচাও আতিয়ার কোনো খবর পায়নি এই কয়দিন। ভাইজানকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি মনে মনে ভাবছেন আতিয়ার কি কিছু হয়েছে? নাহলে মেয়েটা দু’দিন ধরে কোন যোগাযোগ করছে না কেন? উনি চাইলেও তো আতিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। নাসরিন ভাইয়ের পাশে বিছানায় বসে আছেন। থেকে থেকে কিছু বলতে যেয়েও বলছেন না। অবশেষে বলেই ফেললেন,
“-ভাইজান, আমি বলছিলাম কী,পেপারে যদি আতিয়ার ছবি ছাপাতে তাহলে তো মেয়েটার একটা খোঁজ পাওয়া যেত। পুলিশ তো অনেক চেষ্টাই করেছে।’
“-নাসরিন, আমার মেয়ে তোর ছেলেকে বিয়ে করবে না বলেই বাড়ি ছেড়েছে। আমি ওর…
ভাইজান কি বিয়ের জন্য না করে দিবে? এই আশঙ্কা মনে আসতেই নাসরিন বলে উঠলেন,
“-আতিয়া কি একা তোমার মেয়ে ভাইজান? ও কি আমার মেয়ে না? ভাবি মারা যাবার পর ওকে তো আমিই পেলেছি। মায়ের মত ভালোবাসা দিয়েছি ওকে। এখন নিজের ছেলের সাথে ওর বিয়ে দেওয়াটা তো একটা বাহানা, ওকে নিজের কাছে চিরজীবনের জন্য রেখে দেওয়ার। আমার ছেলেও আতিয়াকে কম ভালোবাসে না।’
হামিদ যদি এ বাড়ির কাজের লোক না হতেন, তাহলে আজ নাসরিনের মুখের উপর কিছু কথা বলে দিতেন। কিন্তু কাজের লোক মালিকের মুখের উপর কথা বলে না। এটা হামিদের স্বভাবে নেই। মনে মনে তিনি বললেন,
“-আমার মা আপনারে একদম ঠিক নাম দিছে, কালনাগিনী। ‘
আশরাফ চৌধুরী বোনের কথা শুনে চোখ বুজে চুপ করে পড়ে রইলেন। একটু পর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শুধু।

আতিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছে। এই বাড়িতে আজই তার শেষ দিন। আর একদিন থাকবে না সে এখানে। কেন থাকবে সে? কার জন্য থাকবে?
ব্যাগে কাপড় ঢুকাতে ঢুকাতে আতিয়া বলছে,
“-থাকব না আমি। চলে যাব নিজের বাড়িতে…
সা’দ ওর হাত ধরে বলল,
“-কোথায় যাবে তুমি? ‘
“-নিজের বাসায়।’
“-এটা তোমার নিজের বাসা না? ‘
“-না। এটা আপনার বাড়ি। আর আমি আপনার সত্যিকারের বৌ না। নাটক করতে নিয়ে এসেছেন আমাকে। ‘
সা’দ আতিয়ার হাত ধরে হেঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। নিজের সাথে আতিয়াকে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“-কোত্থাও যাবে না তুমি। কে বলেছে তুমি আমার সত্যিকারের বৌ না? সত্যি হোক মিথ্যা হোক, তুমি আমারই বৌ। আমি তোমাকে ভালোবাসি আতিয়া।’
ফ্যালফ্যাল করে তাকাল আতিয়া। বলল,
“-সত্যি! সত্যি আপনি আমাকে ভালোবাসেন?’
“-তা নয়তো কি? সত্যি না হলে তোমাকে কেন শুধু শুধু নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতাম? স্বামী স্ত্রীর নাটক করা ওটা তো নাহিলের প্ল্যান ছিল তোমাকে এ বাড়িতে আনার।’
“-সত্যি? ‘
“-হুম। ‘
“-আপনার মাথা ছুঁয়ে বলুন।’
হেসে ফেলল সা’দ। কোনো কথা না বলে, চোখ বন্ধ করে আতিয়ার ঠোঁটের দিকে নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিল। আতিয়া বুঝতে পারছে না লোকটা ঠিক কি চাইছে। সে কিছু বুঝতেও চায় না।
-নায়য়য়য়য়য়াহ… বলে এক চিৎকার দিয়ে দু’হাতে সা’দকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল আতিয়া।
ঠিক তার পরপরই ধপাস করে শব্দ হলো। আতিয়ার এক লাথি খেয়ে বিছানা থেকে ধড়াম করে নিচে পড়ে গেছে সা’দ। কোমরে হাত দিয়ে মা’কে ডাকতে ডাকতে উঠে বসল সা’দ।
“-ও মা! এই জঙ্গলি মেয়ে তোমার ছেলের কোমর ভেঙে দিয়েছে। উফ বাবা! ঘুমের মধ্যে ফুটবল খেলছে নাকি? এতো জোরে লাথি মারল।’
আতিয়া ঘুমের মধ্যেই বলছে,
“-দূরে যান, দূরে। বিয়ের আগে এসব… দূরে যান।’
সা’দ কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল। ডান হাতে কোমর
ডলতে ডলতে বলল,
“-এই মেয়ে! এই মেয়ে উঠুন। উঠুন বলছি।’
সা’দের ডাকে ঘুম ভেঙে হুড়মুড় করে উঠে বসল আতিয়া। আশেপাশে দেখে চোখ বড় বড় করে বলল,
“-আপনি! কি করেছি আমি? ‘
“-কী করেছেন? আমার কোমর ভেঙে ফেলেছেন। আপনি মেসির ফ্যান নাকি?’
চোখ ছোট ছোট করে আতিয়া পাল্টা প্রশ্ন করল,
“-কেন?’
“-কেন আবার কি! যা লাথি দেয়া শিখেছেন! ‘
আতিয়া সা’দের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু আগে দেখা স্বপ্নের কথা ভাবছে। আহ! কত সুইট একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নে ব্যাটা তাকে ভালোবাসি বলছিল। আরও কী অসভ্যতামি করতে আসছিল। তখন আতিয়া দিয়েছে এক ধাক্কা। সে কী জানত,স্বপ্নের ধাক্কা বাস্তবে লাথিতে রূপান্তরিত হবে। জানলে এতো জোরে ধাক্কা দিত না। ইশশ! বেচারার মুখের দিকে চাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই ব্যথা পেয়েছে। কাচুমাচু মুখে আতিয়া জিজ্ঞেস করল,
“-ব্যথা পেয়েছেন? ‘
সা’দ টানটান মুখ করে বলল,
“-না। ‘
বলেই বেরিয়ে গেল। আতিয়া গালে হাত দিয়ে বসে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। এই ব্যাটা স্বপ্ন ছাড়া বাস্তবে কখনও তাকে ভালোবাসি বলবে না। আর কিস! সে তো আজকের পর আতিয়ার স্বপ্নেও আর সম্ভব না। ফোঁস করে দম ছাড়ল আতিয়া। এই স্বপ্নটা সত্যি হলে ভালোই হতো।
“-কিন্তু আমি তো ব্যাটাকে ভয় পাইয়ে দিলাম। আর কখনও আমার আশেপাশে আসবে বলে তো মনে হচ্ছে না। এমনিতেই যা ভীতু লোক!’ নিজের উপর রাগ দেখিয়ে আতিয়া বলল,
“-আতিয়া, তোর এই খাটো খাটো ঠ্যাং দুইটা কাইট্টা ফেলামু আমি। অসভ্য, বাজে, বদ ঠ্যাং। ওই বেডারে তুই লাত্থি মারলি ক্যান?’

আতিয়া খাবার টেবিলে এসে দেখে নাহিল আগে থেকেই বসে আছে। ব্রেড-এ জ্যাম মাখাচ্ছে সে। আতিয়াকে আসতে দেখে এক গাল হেসে বলল,
“-এসো। ঘুম কেমন হয়েছে? ‘
আতিয়া চেয়ার টেনে পাশে বসতে বসতে বলল,
“-দারুণ।’ জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে আতিয়া বলল,
“-সাথে জোশ একটা স্বপ্ন দেখেছি।’ আশেপাশে তাকিয়ে কেউ আছে কি-না দেখে নিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে গোপন কথা বলার মত ফিসফিস করে আতিয়া বলল,
“-আর জানো কী হয়েছে? ওই স্বপ্নটা দেখে তোমার ভাইকে এক লাথি দিয়ে বেড থেকে নিচে ফেলে দিয়েছি। ‘
নাহিল জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে যাচ্ছিল। আতিয়ার কথা শুনে মুখ থেকে ছলকে জুস পড়ে গেল। নাহিল প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“-কিহ…!’
আতিয়া নাহিলের মুখ চেপে ধরে বলল,
“-আরে চিৎকার করছো কেন? ‘
হাত সরিয়ে নিলে নাহিল তেমনই আতিয়ার মত ফিসফিস করে বলল,
“-সোজা লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিলে? ‘
যেন তেমন কিছুই করেনি আতিয়া। এমন নির্বিকার ভাবে বলল,
“-হুম। বেচারা হয়তো বেশ ব্যথা পেয়েছে। আমার সামনে লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি।’
এতক্ষণে নাহিল নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল,
“-তা স্বপ্নটা কী দেখেছিলে? ‘
প্রশ্নটা শুনে আতিয়ার কান লাল হয়ে গেল। নাহিল বলে যাচ্ছে,
“-না, আমিও শুনতে চাই। কী এমন স্বপ্ন দেখে আমার ভাইয়ের উপর এতো বড় জুলুম করলে। নিস্পাপ বাচ্চাটার উপর এভাবে অত্যাচার করতে তোমার বুক কাপলো না! ‘
খিলখিল করে হেসে ফেলল আতিয়া। নাহিল সব সময় এমন মজার কথা বলে। ছেলেটাকে প্রথম থেকেই তার কাছে ভালো লেগেছে। মজার মানুষ একজন। খুব হাসাতে পারে সবাইকে।
দাদাজানকে আসতে দেখে আতিয়া চুপ হয়ে গেল। দাদাজান বসতে বসতে বললেন,
“-আমাকে দেখে হাসি বন্ধ হয়ে গেল কেন? কি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল শুনি? ‘
নাহিল বাচাল মুখ ফসকে বলেই দিচ্ছিল।
“-দাদাজান আপনার নাত বৌ…
আতিয়া মাঝ থেকে বলে উঠল,
“-দাদাজন মজার একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখেছি, নাহিল আমাকে মনে করে পেছন থেকে একটা মেয়ের গায়ে হাত রাখে আর মেয়েটা তাকে চটাশ করে এক থাপ্পড় দিয়ে দেয়। তখন আবার আমি মেয়েটার সাথে ঝগড়া করতে করতে চুল ধরে টানাটানির পর্যায়ে চলে যাই।’
দাদাজানও হাসলো। বলল,
“-ভালই তো। দেবর ভাবী স্বপ্নেও মারামারি করছে।’ পাশের চেয়ারে সা’দকে দেখতে না পেয়ে দাদাজান বললেন,
“-তা আমার বড় নাতি কই? সে-ও আবার স্বপ্নে কারো সাথে মারামারি করছে নাকি? ‘
পেছন থেকে সা’দ বলে উঠল,
“-না দাদাজান।’
সা’দ এসে আতিয়ার পাশের চেয়ারটা টেনে বসেছে। আতিয়া লজ্জায় বেচারার দিকে চোখ তুলতে পারছে না।
“-জানি তুমি মারামারি করো না।’
আতিয়া ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলল,
“-করে নাহ! সেদিন তো লোক তিনটাকে মারতে মারতে মেরে ফেলছিল প্রায়।’
খেতে খেতে আরও অনেক কথা বলল সবাই। সবাই না, সা’দ চুপ করে শুনছিল। দাদাজান আজ বেশি কথা বলেছে। বুড়োকে আজ অনেকদিন পর এমন খুশি খুশি লাগছে। সবই আতিয়ার আসাতে হয়েছে। বুড়ো মনেপ্রাণে একটা নাতবৌ চাইত। যা উনি এখন পেয়ে গেছেন।

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here