#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৪
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
মাত্রই এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে টিভি ছেড়েছিলো হেমসিনী তবে খাবার আর গলা নিয়ে নামলো না। তার আগেই ভিষম খেলো সে। চটজলদি পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।
” এমপিপুত্র আনদ্রে মাহাতিব আবারো নিজের কাজের মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি একজন ক্ষ’তিগ্রস্থ হওয়া পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায় বিচার পাইয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন পূর্বে সেই পরিবারের ছোট মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি প্রাইভেট কার তাকে আ’ঘা’ত করে। গাড়ির মালিক প্রথমে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে চাপের মুখের পড়ে কিছু অর্থ দিতে রাজি হলে পরিবারের মানুষরা তার শা’স্তিও চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকটি উচ্চপদস্থ হওয়ার কারণে কেউ তাদের সাহায্য করতে চাইছিলেন না। তবে সব ভয়ডর উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছেন আনদ্রে মাহাতিব। অবশেষে অনেক অভিযান চালানোর পর কাল রাতে আচমকা এবং গোপনীয়ভাবে তাকে আটক করা হয়েছে। পরবর্তী খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের চ্যানেলে।”
সংবাদ পাঠিকার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো হেমসিনী। সে দ্রুত ফোন বের করে ওই নিউজটা আবারো দেখলো।
” সবসময় এরকম মানুষকে সাহায্য করবে? নাকি ভোট সামনে তাই এসব করছে? উনার বাবা তো ভালো না জানি উনি কতটা মানুষকে সাহায্য করতে পারেন।”
ফোনটা রেখে খাবারে মন দিলো হেমসিনী। খেতে খেতে আচমকা সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো, পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো।
” না হেমসিনী তোমাকে মাহাতিব থেকে দূরে থাকতে হবে। উনি এখনো আবেগের মধ্যে আছেন, বাস্তবতা বড় কঠিন। ওনার আবেগকে মোটেও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবেনা৷ ওনার যা ইচ্ছে উনি করুক। ওনার অনুভূতি, ওনার হৃদয় আমার কিছু যাই আসেনা। আমার নিজেকে আটকাতে হবে।”
.
.
পার্টি অফিসে বসে একই খবর দেখেছে মাহাতিব। প্রতিটি চ্যানেলে একই খবর দেখে বড্ড বিরক্ত সে।
” ভাই দেখুন আপনাকে কত সুন্দর লাগছে। মেয়েরা তো একেবারে ফিদা হয়ে যাবে। আর আমাকে দেখুন কিরকম সাদামাটা লাগছে।” আফসোসের স্বরে বললো মুকিত।
এমনিতেই মাহাতিব বিরক্ত বোধ করছিলো তারউপর মুকিতের কথা শুনে তা আরো বৃদ্ধি পেলো।
” বাজে কথা বন্ধ কর মুকিত। আমাকে এটা বলো এই খবরের লোকেরা কিভাবে এই বিষয়ে জানতে পারলো? আমরা তো একদম গোপনভাবে কাজটা করেছিলাম। চাইলে সকালেও আমরা কাজটা করতে পারতাম কিন্তু আমি সবার আড়ালে থেকে কাজটা করতে চেয়েছিলাম বলেই রাতের আঁধারে সব করেছি। তাহলে তাও কিভাবে সাংবাদিকরা খবর পেলো? তোমরা ভালো মতোই জানো এসব আমার মোটেও ভালো লাগেনা।”
” ভাই আমরা তো কাউকে কিছু বলিনি। আর আমরা কেনই বা বাইরের কাউকে বলে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনবো? আর ভাই আপনি তো জানেনই সাংবাদিকদের কিছু বলতে হয়না। তারা একেকটা ঈগল, তারা তাদের ঈগল পাখির মতো চোখ দিয়ে আমাদের মতো মানুষের উপর নজর রাখে। সুযোগ পেলেই খপ করে খবর তুলে টেলিকাস্ট করে দেই।”
” কবে যে এরা আমার পিছু ছাড়বে৷ শান্তিতে কোন কাজও করতে দেবেনা। এদের জন্য গোপনে কোন কাজও করতে পারিনা। না জানি কবে হেমসিনী কথাও জেনে যাই। তখন দেখা যাবে খবরের কাগজে ছেপেছে ‘ এক মেয়ের পেছনে ঘুরছে আনদ্রে মাহাতিব ‘।” শেষের কথাগুলো নিচুস্বরে বলেছে মাহাতিব। যা সে নিজেও স্পষ্টভাবে শুনতে পাইনি। মুকিত আড়ি পেতে শোনার বহু চেষ্টা করেও বিফলে গিয়েছে।
.
.
একজন রোগীকে ইনজেকশন দিয়ে বিশ্রামের জন্য নার্সদের জন্য বরাদ্দ রুমের দিকে যাচ্ছিলেন প্রীতি আহমেদ। সেইসময় তিনি কারো ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ শুনতে পেলেন।
” দিদি আপনি এখানে কি করছেন?”
” আরে সবুজ ভাই আপনি। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। রোগী দেখে ঘুমাতে যাচ্ছিলাম, তবে মনে হলো কারো ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ শুনতে পেয়েছি।”
” আরে কি বলেন আপনি? মেইন গেট তো বন্ধ, রোগীর সাথে একজন মহিলা অভিভাবক ছাড়া তো আর বাইরের কেউ নেই। আর এই সময়ে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আপনি তাহলে ফিসফিস করার শব্দ শুনবেন কি করে? যান ঘুমিয়ে পড়ুন, ঘুমের কারণে উল্টোপাল্টা কিছু শুনতেছেন হয়তো।”
” হুম তাই হবে হয়তো। তবুও আপনি একটু চেক করে ঘুমাতে যাবেন।”
” আপনি নিশ্চিতে যান, আমি আছি তো।”
প্রীতি আহমেদ চলে তো গেলেন তবে মনে খটকা রয়েই গেলো।
.
.
সৃষ্টি আহমেদ এর দরজা কিছুটা খোলা ছিলো। ছোট অংশটা দিয়ে হেমসিনী ভিতরে উঁকি মেরে দেখলো। সৃষ্টি আহমেদ পেছনের দিকে ফিরে কিছু করছিলেন। হেমসিনী কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে দরজা নক করলো। ছোট জায়গাটা দিয়ে হেমসিনী খেয়াল করলো সৃষ্টি আহমেদ দ্রুত কিছু একটা সরিয়ে রেখেছেন। তবে সে কিছু বললোনা, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো।
” আরে হেম, এতোরাতে আমার ঘরে যে? ঘুমাওনি কেন? তুমি আর হিমাল রাতের খাবার খেয়েছো?”
” জ্বি চাচী আমরা দু’জন খেয়েছি। তুমি খেয়েছো?”
” না কিছুক্ষণ পর খাবো। তুমি কি কিছু বলবে?”
” না, দেখতে এসেছিলাম তোমাকে। আমি আসি, তুমি খেয়ে নিও।”
হেমসিনী চলে আসতে নিলেও থেমে গেলো। পেছন ফিরে সৃষ্টি আহমেদ এর ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত মুখশ্রীটা দেখলো। বয়সের তুলনায় বর্তমানে ওনাকে আরো বয়স্ক লাগছে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হেমসিনী। অজানা কারণে তার গায়ে কাঁটা উঠে গিয়েছে। সে দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে চলে গেলো।
.
.
আজ বেশ অনেকদিন পর নিজের পরিবারের সাথে রাতের খাবার খেতে বসেছে মাহাতিব। পরিবার বলতে তার মা-বাবা এবং বড় বোন আছে। বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে কিছুবছর আগে। বর্তমানে সে তার বাবা-মা নিজেই এই সুবিশাল বাড়িতে বসবাস করছে।
সুমাইয়া নাসরিন ছেলের প্লেটে মাছের পিসটা তুলে দিলেন। পাশে বসে তিনি মমতা নিয়ে ছেলের খাওয়া দেখছেন। আজ বহুদিন পর তিনি ছেলেকে একটু শান্তিতে বসে খেতে দেখছেন।
” কাজ কেমন চলছে মাহাতিব? ভোটের কিন্তু বেশি সময় বাকি নেই।”
” এখন পর্যন্ত সব ঠিক চলছে আব্বু। আশা করি সামনেও সব ঠিকঠাক থাকবে।”
” আমি আশা করছি আমার উপর জনগণ যে ভরসা রেখেছে, তোমার উপরও তারা ভরসা করতে পারবে। দরকার হলে নিজের জীবন বি’প’দে ফেলবে তাও অন্যায় পথে পা বাড়াবে না।”
স্বামীর কথা শুনে সুমাইয়া নাসরিনের হৃদয় ধ’ক করে উঠলো। তিনি দ্রুত টেবিলে শব্দ করে দু’জনের দৃষ্টি নিজের দিকে করলেন।
” তুমি এসব কি বলছো! দয়া করে এসব কথা বন্ধ করো। খাওয়ার সময় অন্তত আমার ছেলেটাকে একটু শান্তি দাও।” ইশারায় স্বামীকে বললেন সুমাইয়া বেগম। মাকে উত্তেজিত হতে দেখে মাহাতিব চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে দ্রুত মায়ের হাত ধরে উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
” মা তুমি প্লিজ উত্তেজিত হবেনা, শান্ত থাকো। আমরা আর এসব নিয়ে কোন কথা বলবোনা। তুমি প্লিজ গলায় একদম জোড় দেবেনা। শান্ত হও।”
ছেলের চিন্তিত মুখশ্রী দেখে সুমাইয়া নাসরিন নিজেকে শান্ত করলেন। মাকে স্বাভাবিক হতে দেখে মাহাতিব স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। পানি এগিয়ে দিলো ওনার দিকে। মায়ের জন্য মাহাতিবের অনেক খা’রা’প লাগে। মাহাতিবের মা সুমাইয়া নাসরিন কথা বলতে পারেন না। শত ডাক্তার দেখেইও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। একটু কথা বলার জন্য তিনি বহুত চেষ্টা করেছেন কিন্তু সবই বৃথা। উল্টো তিনি অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করলে গলায় প্রচন্ড রকমের ব্য’থা অনুভব করেন। তাই সবাই সর্বক্ষণ উনার প্রতি খেয়াল রাখে। মায়ের মুখ থেকে কথা শোনার জন্য মাহাতিব ছটফট করে, শেষ কবে মায়ের মুখ থেকে শব্দ শুনেছে তা তার মনে নেই। মায়ের মিষ্টি কন্ঠে আদর, আবদার, শা’ষণ শোনার জন্য অপেক্ষা করে মাহাতিব। কিন্তু সে জানেনা তার ইচ্ছে আধো পূর্ণ হবে নাকি অপূর্ণ রয়ে যাবে।
চলবে…….