আমি কাউকে বলিনি সে নাম পর্ব ২

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ২
__________________________

—কইরে নবাবজাদী ঘুম ভাঙে নাই ! থালা বাটি মাজবো কেডায় , আঙিনাও ঝাড়ু দেয় নাই এখনও …

চাচীর চিৎকারে কাৎরাতে কাৎরাতে বিছানা থেকে উঠে আসে রূপা ৷ তার পায়জামা , জামায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে ৷ সেটা দেখে আলেয়া বেগম হায় হায় করতে শুরু করে ৷

—হায় হায় হায় হায় হায় ! কোন নির্লজ্জ বেহায়া মাইয়্যা আমার কপালে আইসা জুটছে রে খোদা ! ঐ , ঐ ছেড়ি সারা শইল্যে নাপাক রক্ত মাইখ্যা বইসা আছিস লজ্জা শরম কী নাই ! ঘরে আমার জোয়ান পোলা , ঘরে তোর চাচা , তাগো দেইখাও শরম করে না রে বেহায়া বেসেইস্তা !

—আমি মাখাই নাই চাচী ৷ কাইল রাইত থেইকা আমার সেই অসুখটা আবার হইছে ৷ চাচারে কও না চাচী আমারে একটু ডাক্তর দেখাইবো ৷ আমি মনে হয় মইরাই যামু !

—তুই মরবি না , তুই আমগোরে মারবিরে বেসাইস্তা ! ঐ ছেড়ি তোরে কইছি না তেনা লইতে !

—তেনা তো নাই ৷

—ক্যান গত মাসে দুখান তেনা দিলাম না তোরে !

—ঐগুলান ফালায়া দিছি

—নবাবজাদী ! ফালাইছিস ক্যান ! তেনা ধুইয়া তোরে ঘরের পিছে নাইড়া দিতে কইছি না ! খাড়া আবার দিতাছি , এইবার যদি তেনা ফালাইছোস তোরে বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিমু হারামজাদী ৷

রূপা বোঝে না তাকে এত গালাগাল কেন করছে তার চাচী ৷ কাপড়ের ময়লা টুকরোই তো ফেলেছে সে , এটা কী খুব অন্যায় হয়ে গেছে !

ঘর থেকে দুটা ছেঁড়া শাড়ির টুকরো নিয়ে এসে রূপার হাতে দেয় আলেয়া বেগম ৷ তারপর বলে “অক্ষন পুকুড়ে গিয়া ডুব দিয়া আয় , কেউ দেখনের আগে… এই কয়দিন ভোরে গিয়া ডুব দিবি , কারো নজরে যেন না পড়ে এমুন কইরা তেনা ধুইয়া মেলবি ৷ মনে যেন থাকে কতাখান ”

রূপা কথা না বাড়িয়ে গোসল করতে পুকুরে যায় ৷ পুকুর পাড়ে নিপা আপা বসে আছে ৷ নিপা আপা রূপার বড় চাচার মেয়ে ৷ ছোট চাচী আলেয়া বেগম যত মুখরাই হোক তাকে অন্তত ঘরে ঠাই দিয়েছে ৷ বড় চাচার উঠানেও পা দেওয়ার সাহস হয় না রূপার ৷ গালাগালি বা মারের ভয়ে না ৷ তার বড় চাচী সুফিয়া বেগম পাগল ৷ সারাক্ষন শিকলে বেঁধে রাখা হয় তাকে ৷ শিকলে বাঁধা থেকেও হুংকার দেয় , কুকুরের মতো গড়গড় করতে থাকে ৷ রূপার বড্ড ভয় করে , মনে হয় বড় চাচী সামনে পেলে তাকে খেয়ে ফেলবে ৷

নিপা আপার মন সবসময় খারাপ থাকে ৷ বিষন্ন মায়াবী একটা মুখ নিপা আপার ৷ বয়স বিশ বছর পার হয়ে গেছে বোধহয় ৷ কিন্তু মা পাগল জন্য তার বিয়ে হচ্ছে না ৷ অবশ্য মা পাগল হলেও নিপা আপার দুই ভাই নাদের , আর নাসিরের বউ পেতে সমস্যা হয়নি ৷ কিন্তু নিপা আপার বিয়ে হচ্ছেই না ৷ কী জানি , হয়তো বিয়ে হচ্ছে না জন্য নিপা আপার মন এমন বিষন্ন থাকে , অথবা অন্য কিছুও হতে পারে ৷

এই পুকুরটা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি ৷ দুই চাচার বাড়ির লোকজনই ব্যবহার করে ৷ সময় করা আছে সকাল থেকে বারোটা পর্যন্ত মেয়েরা গোসল করে আর বারোটার পর থেকে ছেলেরা ৷

নিপা রূপাকে রক্তে মাখামাখি দেখে জিজ্ঞেস করে “কী রে রূপা , তোর মাসিক হইছে ?”

রূপা নিজেকে সামলাতে না পেরে তার মনের যত না বলা কথা আর ভয় জোঁক সংক্রান্ত সব খুলে বলে নিপাকে কাঁদতে কাঁদতে ৷ নিপা খানিক হেসে রূপাকে কাছে বসিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে এটা আসলে কোন অসুখ না , এটা প্রকৃতির নিয়ম ৷ নারী হয়ে উঠার অংশ বিশেষ ৷

সব শুনে রূপা অবাক বিষ্ময়ে বলে “আপা এইটা তুমারও হয় ?” নিপা মাথা নেড়ে বলে “হ , হয় ” … রূপা আবারও আরো বিষ্ময়ে বলে “চাচীরও হয় ?” নিপা হাসতে হাসতে বলে “হ চাচীরও হয় , যা ডুব দিয়া আয় ৷” এরপর তাকে কিভাবে কাপড় ব্যবহার করলে জামাতে দাগ লাগবে না সেটাও শিখিয়ে দেয় ৷

রূপার বুক থেকে একটা পাথর নেমে যায় ৷ সে যে এখনি মারা যাচ্ছে না এটা ভেবেই আনন্দে তার মন ভরে উঠে ৷

গোসল করে বাড়ি ফিরে ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে বাসন মাজতে যায় রূপা ৷ তা দেখে আলেয়া বেগম মুখ কালো করে বলে ,” যা ঘরে গিয়া শুইয়া থাক ৷ কাম করন লাগবো না ৷ বেদনা কইমা গেলে আইস”

কৃতজ্ঞতায় রূপার মন ভরে যায় ৷ আজ তার ভালো দিন ৷ নিপা আপা জানালো সে কোন অসুখে ভুগছে না , চাচী তাকে শুয়ে থাকার অনুমতি দিলো …. আজ নিশ্চয় ভালো কিছু হবে ৷

দুপুরের পর রূপার পেট ব্যথা কমে যায় ৷ চাচী ডাকার আগেই নিজ থেকেই রূপা উঠে ঘরের কাজকর্ম করতে শুরু করে দেয় পরম উৎসাহের সাথে ৷ আজ তার কাজ করতেও ভালো লাগছে ৷

সন্ধ্যায় রূপার চাচা মানিক মিয়া সনপাপড়ি নিয়ে ফিরলেন ৷ সনপাপড়ি রূপার খুব পছন্দ ৷ পছন্দের সেই সনপাপড়ি থেকেও রূপা বেশ খানিকটা ভাগ পেলো …. আজ সত্যিই তার ভালো দিন ৷

রাতের খাবার পর রূপা গভীর আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে চলে গেলো ৷

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here