আমি পদ্মজা পর্ব ৬৯+৭০

আমি পদ্মজা – ৬৯
___________
অনেক্ষণ হলো তবুও মৃদুল আসছে না। পূর্ণা বিরক্ত হয়ে নিকাব মাথার উপর তুললো। ব্যাগ থেকে টর্চ বের করলো। টর্চটির আলাদা বিশেষত্ব, এটি তিন রঙের আলো দেয়। তাই মৃদুল এটি প্রান্তের জন্য কিনেছে । পূর্ণা টর্চের সুইচে চাপ দেয় কিন্তু কাজ হয় না। সে ভ্রুযুগল কুঁচকে আরো দুইবার চাপ দিল। তাও হলো না। সুইচে আঙুল রেখে টর্চের মুখটা সে নিজের দিকে তাক করলো। মনে প্রশ্ন আসে,দোকানদার নষ্ট টর্চ দিয়ে ঠকালো নাকি?
তখনই টর্চের আলো জ্বলে উঠে। তীব্র তিন রঙের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ণার চোখেমুখে। সাথে সাথে পূর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ওদিকে আমির হাতের সিগারেট নদীর জলে ফেলে পিছনে ফিরে তাকালো। রাফেদ কী করছে দেখার জন্য! রাফেদের বদলে পূর্ণার মুখটা ভেসে উঠে। তিন রঙের আলোয় পূর্ণার মুখটা স্পষ্ট। আমিরের চোখের দৃষ্টি থমকে যায়। রাফেদ,মন্তু পূর্ণার একদম কাছাকাছি চলে গিয়েছে। আমির তাৎক্ষণিক কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। কিন্তু রাফেদ,মন্তুকে আটকাতে তো হবেই। আমির ছাদ থেকে জোরে চেঁচিয়ে ডাকলো,’রাফেদ।’

আমিরের কণ্ঠস্বর শুনে রাফেদ,মন্তু পিছনে তাকায়। পূর্ণাও তাকালো। সে আমিরের কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়েছে। মৃদুল মাত্র ঘাটে প্রবেশ করেছে। তার কানেও আমিরের গলা এসেছে। চারটি চোখ হা করে আমিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমির দ্রুত ট্রলার থেকে নেমে আসে। পূর্ণা অস্পষ্ট স্বরে ডাকলো,’ভাইয়া!’

আমির রাফেদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় চাপাস্বরে বললো,’ট্রলারে যাও।’
তারপর পূর্ণার দিকে এগিয়ে আসলো। বললো,’পূর্ণা এখানে কী করছো?’
মৃদুল আমিরের পিছনে এসে দাঁড়াল। পূর্ণার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমির পিছনে তাকালো। মৃদুলকে দেখতে পেল। আমির অবাক হয়ে উচ্চারণ করলো,’মৃদুল?’
তারপর আবার পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণার দৃষ্টি নত। আমির দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’দুজনে একসাথে এসেছিস?’
মৃদুল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,’জি, ভাই। মেলায় আইছিলাম।’

আমির দুই পা পিছিয়ে গেল। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে পূর্ণা আর মৃদুলকে দেখলো। পূর্ণা আতঙ্কে বার বার মৃদুলের দিকে তাকাচ্ছে। মৃদুল ইশারায় তাকে ভরসা করতে বলছে। আমিরের কেন জানি হাসি পাচ্ছে। কিন্তু চোখেমুখে গাম্ভীর্য রেখে বললো,’একদম ঠিক করোনি পূর্ণা। এভাবে রাতের বেলা এত দূরে চলে এসেছো। আবার অজানা,অচেনা একজন ছেলের সাথে।’
আমিরের কথা শুনে মৃদুল আহত হয়। পূর্ণার বুক ধুকপুক, ধুকপুক করছে। আমির যেহেতু জেনেছে পদ্মজাও জানবে। আর তারপর কী হবে, পূর্ণা ভাবতে পারছে না। মৃদুল পূর্ণার অবস্থা বুঝতে পেরে আমিরকে বললো,’ ভাই,ও আসতে চায় নাই। আমি জোর করছিলাম…’
আমির মৃদুলকে বাঁধা দিয়ে বললো,”পূর্ণাকে তোর চেয়ে আমি বেশি ভালো চিনি। নিজের ইচ্ছায় এসেছে নাকি কারো কথায় সেটা বুঝতে পারছি।’

ভয়ে,লজ্জায় পূর্ণার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। আমির গাম্ভীর্যতার সাথে রাগ মিশিয়ে বললো,’এর একটা বিহিত করতেই হবে। নালিশ বসাব আমি।’
‘ভাই…’
‘তুই থাম মৃদুল! পূর্ণা আমার বোন। আমার বোন নিয়ে আমি কী করব সেটা আমার ব্যপার।’

আমিরের প্রতিটি কথায় পূর্ণা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে ভয়ে ভ্যাঁ,ভ্যাঁ করে কান্না করে দিল। মৃদুলের সাথে আমিরও থতমত খেয়ে গেল। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি আর আসবো না ভাইয়া।’

পূর্ণার মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে আমির সশব্দে হেসে উঠলো। পেট চেপে ধরে হাসতে থাকলো। কতদিন পর এভাবে মন খুলে হেসেছে কে জানে! আমিরের হাসি দেখে পূর্ণার কান্না থেমে যায়। মৃদুল শুধু অবাক হয়ে দেখছেই। প্রথম পূর্ণা হুট করে কান্না শুরু করে দিল,এখন আমির হুট করে পাগলের মতো হাসছে! হাসতে হাসতে আমিরের চোখে জল চলে আসে। সে অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললো,’কাঁদতে হবে না। আমি কিছুই করব না। প্রেম করা যায় আর ধরা পড়লেই কাঁপাকাঁপি?’
পূর্ণা আড়চোখে মৃদুলকে দেখে মিনমিনিয়ে বললো,’আমাদের মধ্যে প্রেমট্রেম নেই ভাইয়া।’
আমিরের মুখটা হা হয়ে গেল। সে বিস্ময় নিয়ে বললো,’সেকী! কী যুগ আসলো! প্রেম,ভালোবাসা ছাড়াই ছেলেমেয়ে একসাথে রাতের বেলা মেলায় চলে এসেছে।’
মৃদুল বললো,’বন্ধু…বন্ধু হই।’
আমির ভ্রু উঁচিয়ে বললো,’তাই না? তোরা বন্ধু? আচ্ছা,হতেই পারে বন্ধুত্ব। শোন, পদ্মজা পূর্ণার বিয়ে ঠিক করেছে। মৃদুল,তুই কিন্তু পূর্ণার বিয়েতে আমার সাথে নাচবি।’
মৃদুলের চোখ দুটি সজল হয়ে উঠে। পূর্ণা চকিতে তাকাল। গুরুতর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,’ কবে? কোথায় ঠিক করেছে?’
‘সে আমি কী বলব? তোমার বোন জানে।’
পূর্ণার কান্না পাচ্ছে। সে মৃদুলকে এক নজর দেখে আমিরকে প্রশ্ন করলো,’তোমরা ঢাকা থেকে কবে আসছো?’
আমির প্রশ্নটা শুনে তখনই জবাব দিল না। ভাবলো,পূর্ণা বোধহয় পদ্মজার খোঁজে তাদের বাড়িতে গিয়েছিল। আর তখন বাড়ির কেউ হয়তো বলেছে ঢাকার কথা। আমির হেসে জবাব দিল,’বিকেলে। কাল যেও বাড়িতে। বোনের সাথে দেখা করে আসবে।’

পূর্ণা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমির খেয়াল করলো,মৃদুল,পূর্ণা দুজনের মুখে কালো ছায়া নেমে এসেছে। তাই সে মিথ্যের পর্দা সরিয়ে বললো,’বিয়ে ঠিক করেনি। মজা করেছি। তারপর মেলা থেকে কী কী কেনা হয়েছে?’
আমিরের কথা শুনে মৃদুল-পূর্ণার বুকে এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসে। বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়। পূর্ণা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,’অনেক কিছু কেনা হয়েছে। সব উনি কিনে দিয়েছেন।’
‘তাই নাকি! আমি কিছু কিনে দেব না? মৃদুল,মেলা ভেঙে গেছে?’
‘না ভাই,ভেঙে যাবে।’
‘তাহলে চল,যাই।’
পূর্ণা আটকাল,’না ভাইয়া,আর কিছু লাগবে না। অনেক কিছু হয়ে গেছে।’
‘এসব তো বন্ধু দিয়েছে। ভাইয়ের উপহার আলাদা। নাকি এখন শুধু পূর্ণা বন্ধুর উপহারই নিবে। বাকি সব বাদ!’
আমিরের মশকরা বুঝতে পেরে পূর্ণা বললো,’ধুর,ভাইয়া।’
আমির হাসলো। বললো,’কোনো কথা না। আমরা এখন মেলায় যাব। মৃদুল তোর সাইকেলটা ওইযে ছোট ট্রলারটা ওখানে রেখে আয়। পূর্ণার হাতের ব্যাগটাও নিয়ে যা। যাওয়ার সময় ট্রলার দিয়ে চলে যাবি। রাতের বেলা হাওড়ের ক্ষেত দিয়ে না যাওয়াই ভালো। সাথে যখন পূর্ণা আছে।’
‘তুমি ফিরবে না ভাইয়া?’ বললো পূর্ণা।
আমির বললো,’একটু দেরি হবে। একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। মৃদুল যা।’

মৃদুল সাইকেল আর ব্যাগ রেখে আসে। তারপর তিন জন একসাথে মেলায় প্রবেশ করে। পূর্ণার শাড়ি বেশি পছন্দ। তাই আমির শাড়ি কিনলো বেশি। একটা শাড়িতে তার চোখ আটকে যায়। কালো রঙের রেশমি সুতার শাড়িটা চোখে পড়তেই পদ্মজার মুখটা ভেসে উঠে। পদ্মজার কালো রঙ ভীষণ পছন্দের। ফর্সা,ছিমছাম আদুরে শরীরে যখন কালো রঙের শাড়ি লেপ্টে থাকে কী অপূর্বই না দেখায়! আমিরের তো মাঝে মাঝে মনে হয়,কালো রঙের সৃষ্টি হয়েছে শুধুমাত্র পদ্মজার রূপের ঝলকানি বুঝাতে! চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পদ্মজার ঠোঁটের নিচের সূক্ষ্ম স্থির কালো তিলটা। হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। তিলটা থেকেও যেন অদ্ভুত কোনো আলো বের হচ্ছে! আমির মুচকি হেসে শাড়িটা কিনে নিল। আর কিছু কিনলো না। পদ্মজা গয়নাগাটি পছন্দ করে না। তারপর চলে এলো ঘাটে। পূর্ণা খুশিতে আটখানা। এত কিছু পেয়েছে আজ! ট্রলারে করে চলে গেল মৃদুল-পূর্ণা। সাথে গেল মন্তু। মন্তু পূর্ণাকে বাড়িতে অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে। আমির তার আগের জায়গায় এসে বসে। মৃদুল-পূর্ণার ব্যাপারটা অদ্ভুত শান্তি নিয়ে এসেছে বুকে! কত সুন্দর তাদের জীবন। কোনো জটিলতা নেই,কোনো দূরত্ব নেই!

আমিরের মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়, সে তো কথায় কথায় পূর্ণাকে আগামীকাল তাদের বাড়িতে যেতে বলেছে! কিন্তু পদ্মজা তো সেখানে নেই! তাছাড়া বেশ কিছুক্ষণ আগেও সে পদ্মজার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল। একটু ওদিকে যাওয়া দরকার। আমির রাফেদকে ডেকে বললো,’আমি ফিরছি। মন্তু এখুনি চলে আসবে। যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল মনে রাখবে। দুজন চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করবে। চাচাও আসবে বোধহয়। একটু দেরি হলেও, আমি আসবই।’
‘জি,স্যার।’

___________
পদ্মজা ভেবেছিল আরভিদ তার উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু করেনি। পদ্মজা বিওয়ান(B1) ঘরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দরজায় তালা দেয়া। ভেতরেও কোনো সাড়াশব্দ নেই! মেয়েগুলো বেঁচে আছে তো? যে ঘরে পাচার করার উদ্দেশ্যে কতগুলো মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে সে ঘরের দরজাটা আবার খোলা। দরজার উপর লেখা বিথ্রি(B3)। পদ্মজা বিথ্রির সামনে সন্ধ্যা অবধি ঘুরঘুর করেছে। প্রবেশ করার সাহস হয়নি। তার হাত বন্দি,আবার আরভিদ সবসময় তার উপর চোখ রাখছে। কখন না ইজ্জতে হাত দিয়ে দেয়। সে ভয়ে পদ্মজা এগোয়নি। সন্ধ্যায় রিদওয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল। সে বের হচ্ছিল। পদ্মজাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে, সে অবাক হয়েছিল। আরভিদকে জিজ্ঞাসা করে,’কী ব্যপার?’
আরভিদ বললো,’স্যার যা বলেছেন,তাই হচ্ছে।’
রিদওয়ান পদ্মজার দিকে চোখ রেখে বললো,’আমির এই মেয়ের রূপে ডুবে আছে। কবে যে ঘোর কাটবে! দেখে রেখো। কখন কী করে বসে!’
রিদওয়ান দরজা খুলতে চেষ্টা করলো। খুলল না। আরভিদ বললো,’ চাবি স্যারের কাছে।’
রিদওয়ানের খুব বিরক্তি নিয়ে বললো,’ধ্যাত!’

তারপর চলে এলো বিটুতে। শরীরে অনেক ক্লান্তি। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।।ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ আগেই খাবার খেয়েছে। আজকের রাতটা এক ঘুমে কাটাতে পারলে শরীরটা প্রায় সুস্থ হয়ে যেত। রিদওয়ান অনেক ভেবেচিন্তে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেল। তারপর শুয়ে পড়লো। বেশিক্ষণ লাগেনি ঘুমাতে। পদ্মজা রিদওয়ানকে দূর থেকে দেখেছে। কথা বলতে আসেনি। সন্ধ্যার পর হতাশ হয়ে নিজ ঘরে চলে আসে। ঘরে অনেকক্ষণ পায়চারি করে। শুয়ে থাকে। এশারের দিকে আবার বেরিয়ে আসে। ভালো লাগছে না কিছু। স্বাগতম ও ধ-রক্ত দরজার মধ্যখানে থাকা সোফায় আরভিদ ঘুমাচ্ছে! আরভিদকে ঘুমাতে দেখে পদ্মজা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। পা টিপে,টিপে সাবধানে ধ-রক্তে প্রবেশ করে। তারপর দ্রুত হেঁটে বিথ্রিতে চলে আসে। মেঝেতে পড়ে আছে অনেকগুলো মেয়ে। তাদের হাত,পা,মুখ বাঁধা। দুই-তিন জন ঘুমাচ্ছে। বাকিরা পদ্মজার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে গেল। চাপা স্বরে বললো,’আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। ভয় পেও না।’

সবার সামনে একটা স্বাস্থ্যবান মেয়ে বসেছিল। পদ্মজা মেয়েটির পিছনে গিয়ে বসলো। মেয়েটির মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। পদ্মজার হাত পিছন থেকে হ্যান্ডকাপ পরানো। তাই সে কাপড়ের গিট্টুটি নিজের দাঁত দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো। খুব দ্রুতই সে সফল হয়। প্রতিটি মেয়ে অবাক হয়ে পদ্মজাকে দেখছে। অসম্ভব সুন্দর পদ্মজার উপর থেকে তারা চোখ সরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে,বিধাতা কোনো দূত পাঠিয়েছেন। আসার পথে গালে ব্যথা পেয়েছে! স্বাস্থ্যবান মেয়েটির মুখ মুক্ত হতেই পদ্মজাকে বললো,’আপনি কেলা?’
পদ্মজা ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকালো। তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,’আমি পদ্মজা। চিনবে না আমাকে। আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই।’

মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। পদ্মজা স্বাস্থ্যবান মেয়েটির হাতের বাধঁন খোলার জন্য তার পিছনে গিয়ে পিঠ করে বসলো। হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো,পারলো না। হ্যান্ডকাপের মাঝের দূরত্ব খুব কম। পদ্মজা শুধু আঙুল নাড়াতে পারছে। তাই দাঁত দিয়ে দঁড়ির গিট্টু খোলার জন্য সে শুয়ে পড়লো। গালের ক্ষতস্থানে ঠান্ডা মেঝে লাগতেই শিরশির করে উঠে। যে দঁড়ি দিয়ে মেয়েটির হাত বাঁধা হয়েছে সে দঁড়িতে অনেক ময়লা ছিল। পদ্মজার মুখের ভেতর ময়লা প্রবেশ করে। পদ্মজার কষ্ট হয় তবুও সে থামেনি। ঠিক নয় মিনিট পর মেয়েটি হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়। খুশিতে মেয়েটির বুকে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। নিজের হাত দিয়ে পায়ের বাঁধন খুলে। পদ্মজা অনুরোধ স্বরে বলে,’এবার তুমি বাকিদের মুক্ত করো।’

মেয়েটি তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। আরো দুটো মেয়েকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে। তারপর তিনজন মিলে বাকিদের সাহায্য করে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। পদ্মজা সবাইকে কথা বলতে নিষেধ করেছে। সে মনে মনে প্রার্থনা করছে, কেউ যেন না আসে। আর তারা সবাই যেন বেরিয়ে যেতে পারে। আমিরের বোকামি,সে পদ্মজাকে ছেড়ে গিয়েছে। এই বোকামি আর কখনো আমির করবে না। আজ কাজে না লাগাতে পারলে সব শেষ! মেয়েগুলোর মধ্যে কেউ কেউ উত্তেজনায় কাঁপছে। পদ্মজা সবার উদ্দেশ্যে বললো,’সামনে একজন লোক বসে আছে। সে ঘুমে আছে। যদি সজাগ হয়ে যায়, সবাই আক্রমণ করবে। ভয় পাবে না।।নিজেদের ইজ্জতের উপরে কিছু নেই। ইজ্জত রক্ষার জন্য কাউকে আঘাত করার সাহস বুকে রাখতে হয়। একদম ভয় পাবে না। লড়াই করবে। এইযে তুমি আর তুমি আমার সাথে একটু আসো। বাকিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।’

দুটো মেয়ে পদ্মজার সাথে সাথে যায়। পদ্মজা বিফাইভে চলে আসে। বিকেলে যখন এদিকে হাঁটছিল এই ঘরের এক কোণে সে লাঠি আর পাথর দেখেছিল। মেয়ে দুজনকে বললো,’লাঠিগুলো নাও,আর পাথর তিনটাই নিয়ে নাও।’

তিনজন আবার বিথ্রিতে চলে আসে। পদ্মজা সবার উদ্দেশ্যে বললো,’ কাদের সাহস বেশি? কাউকে আঘাত করার মতো সাহস কার কার আছে?’
ছয়টা মেয়ে হাত তুলে। তারা হাতে লাঠি আর পাথর তুলে নেয়। পদ্মজা বলে,’যখনই আক্রমণ করতে বলবো,আক্রমণ করবে। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে যেভাবে পারো আঘাত করবে। যদি তোমরা না পারো,তবে বিদেশ পাচার হয়ে যাবে। সেখানে তোমাদের অনেক খারাপ কাজ করতে হবে। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা দাঁত আর নখ কাজে লাগাবে।’

মেয়েগুলো বাধ্যর মতো মাথা নাড়ায়। তারা ঘোরের মধ্যে আছে। প্রাণের মায়া চলে গিয়েছিল। পদ্মজার হঠাৎ আগমনে মনে বাঁচার আশা জেগেছে। সবাই সাবধানে বিথ্রি থেকে বেরিয়ে আসে। সামনে পদ্মজা। ধ-রক্ত দরজা পেরোবার সময় মেয়েগুলো ধাক্কাধাক্কি করে। ধাক্কা খেয়ে একটা মেয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। আর্তনাদ করে উঠে। আরভিদ চোখ খুলে সামনে এতগুলো মেয়েকে দেখে হকচকিয়ে যায়। সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না! পদ্মজা উঁচুকণ্ঠে চিৎকার করে উঠে,’সবাই এই লোকটাকে আক্রমণ করো।’

স্বাস্থ্যবান মেয়েটি সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠি দিয়ে আরভিদের পিঠে আঘাত করে। আরভিদ পড়ে যায়। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরভিদ মেয়েগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পনেরোটা যুবতী মেয়ে তো কম কথা নয়! সে কিছুতেই পেরে উঠেনি। মার খেতে খেতে উঁবু হয়ে যায়। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা লাথি দিতে থাকে অনবরত। একটা মেয়ে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা তাকে উৎসাহ দিতে জোরে বললো,’লোকটার মাথায় আঘাত করো। দ্রুত করো। চাইলে সব পারা যায়। তুমি ভয় পেও না।’

মেয়েটি পদ্মজার কথামতো বড়সড় পাথরটি দিয়ে আরভিদের মাথায় আঘাত করে। আরভিদের মরণ আর্তনাদ আর মেয়েগুলির ক্রোধ মেশানো নিঃশ্বাসে চারপাশ কেঁপে উঠে। পদ্মজার সত্তা বিজয়ের আগমনে হেসে উঠে। রক্তাক্ত আরভিদ নিস্তেজ হয়ে যায়। মেয়েগুলো থামে,হাঁপাতে থাকে। পদ্মজা দরজার সামনে এসে চাবি খুঁজতে থাকে। চাবি নেই! দ্রুত আরভিদের কাছে আসে। তার প্যান্ট আর শার্টের পকেটে চাবি খুঁজে। নেই! পদ্মজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আর এক ধাপের জন্য তারা আবার আটকে যাবে! পদ্মজা দুটো মেয়েকে নিয়ে পুরো পাতালঘর তন্ন,তন্ন করে চাবি খুঁজে। যেসব চাবি পেয়েছে একটাতেও দরজা খোলা যায়নি। মেয়েগুলোর মধ্যে যে আনন্দ এসেছিল তা হারিয়ে যায়। পদ্মজাও ভেঙে পড়ে। সে মেয়েগুলোকে আশ্বাস দেয়,’কিছু হবে না। আমরা পারব।’

দরজায় সবাই মিলে ধাক্কাধাক্কি করে,তাতেও কোনো ফল পাওয়া গেল না। এই দরজা কী ধাক্কা দিয়ে ভাঙার মতো! পদ্মজা বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,’শুনো সবাই,আমরা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকব। যখনই কেউ দরজা খুলবে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। এই লোকটার মতো অবস্থা করে সবাই পালাব। এখন যেভাবে সবাই একসাথে কাজ করেছো তখনও করবে। ঠিক আছে?’
মেয়েগুলো মাথা নাড়াল। তারা প্রস্তুত। দশ মিনিট…বিশ মিনিট…ত্রিশ মিনিট পর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। সবার হৃদস্পন্দন থেমে যায়। পদ্মজার সবার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আক্রমণ করতে বলে। দরজা খুলতেই সবগুলো মেয়ে হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খলিল দুই হাতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। আমির পিছনে ছিল। সে এসে দেখে বাইরে খলিল,মজিদ দাঁড়িয়ে আছে। চাবি তাদের কাছে নেই। আমির খলিলের হাতে চাবি দেয়। খলিল দরজা খুলতেই এতগুলো মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দৃশ্যটি দেখে আমিরের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে মজিদকে বললো,’আব্বা সামনের দরজা বন্ধ করো।’

মজিদ সামনের দরজা বন্ধ করতে চলে যান। আমির এগিয়ে আসে। দীর্ঘদেহী,তুষ্টপুষ্ট আমির দুই হাতে মেয়েগুলোকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। দুজন মেয়ে লাঠি দিয়ে আমিরকে আঘাত করতে চায়,আমির দুই হাতে দুটো লাঠি ধরে ফেলে। লাঠিসহ মেয়ে দুটোকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। বাকি মেয়েগুলোকে চোখের পলকে চড়-থাপ্পড় দিতে শুরু করে। তার চোখ দুটি থেকে রাগ,ক্রোধ-আক্রোশ ঝরছে। একটা মেয়ে আমিরের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। পাথরটি আমিরের ঘাড়ে পড়ে। রিদওয়ান ঘাড়ে আঘাত করার বোধহয় তিন সপ্তাহও কাটেনি। আবার পাথরের আঘাত পেয়ে ঘাড়ের কালো আস্তরণ সরে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। পদ্মজার জন্য কেনা শাড়িটা আমির গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। আসার পথে ট্রলারের ছাদে বসে শাড়িটা দেখছিল,শাড়ির ব্যাগ পাশে রেখেছিল। কখন যে ব্যাগটি উড়ে যায়,টের পায়নি আমির। যখন টের পেল কিছু করার ছিল না। তাই গলায় মাফলারের মতো পেঁচিয়ে রেখে দেয়। তার পদ্মবতীই তো পরবে! আমিরের রক্তে শাড়িটি ভিজে যায়। সে ঝড়ের গতিতে ঘূর্ণিপাকের মতো প্রতি মেয়েকে আঘাত করে দূর্বল করে দেয়। পদ্মজা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। আমির তার রক্তচক্ষু দিয়ে পদ্মজার দিকে তাকায়। পদ্মজার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে। সে কিছু বুঝে উঠার পূর্বে,আমির পদ্মজার দিকে তেড়ে আসে। শাড়িটি দিয়ে পদ্মজার গলা পেঁচিয়ে জোরে টেনে ধরে। তারপর কিড়মিড় করে বলে,’ছলনাময়ী!’

আমিরের নিঃশ্বাস থেকে যেন বিষ বের হচ্ছে। আজরাইলের রূপ ধারণ করেছে। পদ্মজার দুই হাত বন্দি। নিজেকে রক্ষার কোনো পথ নেই। সে ছটফট করতে থাকে। একবার আমিরের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার পূর্বেই চোখ দুটি উলটো হয়ে আসে। বুকে ব্যথা শুরু হয়। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নিঃশ্বাস আটকে যায়। মৃত্যু তার খুব কাছে। আর একটু সময়…পদ্মজা কালিমা পড়ার চেষ্টা করে। মৃত্যুর আগে সে কালিমা পড়ে যেতে চায়। অস্ফুটভাবে তার মুখে ‘ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ হয়। আমিরের কানে শব্দটি আসতেই তার হাত দুটি কেঁপে উঠে। ছেড়ে দেয় পদ্মজার গলা। পদ্মজা লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। চোখ আধবোজা! ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। হাঁপড়ের মতো বুক ওঠানামা করছে। কষ্টে পুরো শরীর মুচড়ে যাচ্ছে! গলা নীল হয়ে গেছে!
আমি পদ্মজা – ৭০
__________
পাতালপুরী নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বিথ্রিতে মেয়েগুলো বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। পদ্মজা এওয়ানের পালঙ্কে শুয়ে আছে। তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। ঘরের ছাদে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটি শুষ্ক। এক ফোঁটাও পানি নেই। নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে সে। বিটুর দরজার পাশে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে আমির। তার চাহনি এলোমেলো। মস্তিষ্ক অন্যমনস্ক। এক টুকরো ছোট পাথর কামড়াচ্ছে। পাথরটা দিয়ে নিজের দাঁতে আঘাত করছে। মজিদ তীক্ষ্ণ চোখে অনেকক্ষণ যাবৎ আমিরকে পরখ করছেন। তিনি আমিরের হাব-ভাব বুঝার চেষ্টা করছেন। আমিরের দুই হাত অনেকক্ষণ ধরে কাঁপছে। এমনকি তার শরীরও কাঁপছে। মজিদ বিস্মিত! আমির দুই হাতে মাথা চেপে ধরে সেজদার মতো উঁবু হয়। আর্তনাদের মতো শব্দ করে মুখে। দুই হাতে মেঝে খামচে ধরার চেষ্টা করে। খলিল কিছু বলতে চাইলে মজিদ আটকে বললেন,’এখন কোনো শব্দ করা ঠিক হবে না। ওর মাথা ঠিক নেই।’

আমির সোজা হয়ে বসে। তার চোখ দুটি রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে। মেঝেতে শুয়ে, দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে। কিছু একটা ভাবছে সে। দেখে মনে হচ্ছে,সমুদ্রের অতলে সে হারিয়ে যাচ্ছে। পানি খেতে খেতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কোনদিকে সাঁতরালে কিনারা পাওয়া যাবে ঠাওর করতে পারছে না। মজিদ খলিলকে নিয়ে সরে যান। আমির উঠে দাঁড়ায়। ঘরে পায়চারি করে। ঘন,ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ে। ঘাড়ের রক্ত শুকিয়ে গেঞ্জির সাথে লেপ্টে আছে। আমির চেয়ারে বসে হেলান দিলো। চোখ বুজতেই ভেসে উঠে পুরনো মুহূর্ত। আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা। তার মাঝে ছিল একটা মাত্র চাঁদ। আকাশের নিচে পদ্ম নীড়ের ছাদে আমির পদ্মজাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মৃদু কোমল বাতাসকে স্বাক্ষী রেখে পদ্মজা বলেছিল,’পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ স্বামীটি আমার, তাই প্রতিটি মেয়ের আমাকে হিংসে করা উচিত।’

আমির দ্রুত চোখ খুলে ফেলে। তার শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে। অস্থির,অস্থির লাগছে। বোতল থেকে পানি বের করে খেল।
তারপর বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এক কোণে পরে থাকা শাড়িটা হাতে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। যতক্ষণ না পুরো শাড়িটা ছাই হয়েছে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। ঠোঁট অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। সে কী কাঁদতে চাইছে?

মজিদ হাওলাদার চেয়ারে বসে সিগারেট ধরালেন। খলিল বললো,’আমিরের হাব-ভাব তো ভালা না ভাই। আলমগীরের মতো না কাম কইরালায়।’
মজিদ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,’এরকম হবে না। আমির কখনো নিজের তৈরি করা সাম্রাজ্য ছাড়বে না। তুই বের হয়ে যা। মন্তুরা বসে আছে।’
‘তুমি এইহানে থাকবা?’
‘আর কেউ আছে এখানে? মেয়েগুলোকে তো বারেকের সাহায্য নিয়ে সামলাতে পেরেছি। এখন ওরে বাইরের পাহারা বাদ দিয়ে ভেতরে আসতে বলবো?’
‘রাগো কেন? আমি তাইলে যাইতাছি।’
‘কাঞ্চনপুরের চেয়ারম্যানরে বলে আসবি শুক্রবারের কথা। কোনো ভুল যাতে না হয়।’
‘আচ্ছা ভাই।’
খলিল বেরিয়ে যায়। মজিদ ধোঁয়া উড়ান। পুরো ঘরে সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে।

আমির এওয়ান দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। স্বাভাবিক হতে তার মাঝরাত অবধি সময় লেগে গেছে। দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো পদ্মজাকে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে সে। আমির দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো। পদ্মজা দরজা খোলার শব্দ শুনেও ফিরে তাকালো না। আমির কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলো,তার কথা আসছে না। গলা বসে গেছে। সে পদ্মজার পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। আমির পদ্মজার পায়ে হাত দিল,পদ্মজা পা সরিয়ে নেয়নি। আমির বেশখানিক মুহূর্ত বসে থাকে সেখানে। তারপর বললো,’সকালে আমরা অন্দরমহলে যাবো।’
পদ্মজা জবাব দিল না। আমিরের এখানে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যতক্ষণ এখানে থাকবে,পদ্মজা নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। তাই বেরিয়ে যেতে উঠে দাঁড়াল। দরজার বাইরে পা রাখতেই পদ্মজার শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,’এই শক্তি আর মেধা ভালো কাজে লাগালে এর চেয়েও বড় রাজত্ব পেতেন। বেহেশত পেতেন। পরিবার পেতেন।’

আমির শুনেও না শোনার ভান করে দরজা ছেড়ে, এওয়ানের বাইরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। সেখানে উপস্থিত হলেন মজিদ। আমিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’বাবু এদিকে আয়।’
আমির,মজিদ একসাথে সোফায় এসে বসে। আমির ক্লান্ত। ক্লান্তি তার চোখেমুখে। মজিদ বললেন,’দুইদিন পর শুক্রবার। মনে আছে তো?’

আমির মনে করার চেষ্টা করলো। শীতে তারা শীতবস্ত্র বিতরণ করে। এ নিয়ে বড় সমাবেশ হয়। কত,কত গ্রাম থেকে মানুষ আসে। দুনিয়ার লোক দেখানো পাপ-পুণ্যের হিসাবের খাতায় হাওলাদার বাড়ির নাম পূণ্যের খাতায় সবার উপরে! আমির নির্বিকার স্বরে বললো,’মনে আছে।’
‘দেখিস,পদ্মজা যেন কোনো ভেজাল না করে।’
‘আর কী ভেজাল করবে? মেরেই ফেলেছিলাম আরেকটু হলে। মেরে ফেললে খুশি হবে?’ আমির আচমকা রেগে যায়। মজিদ মৃদু হেসে বললেন,’মারবি কেন? তোর বউ তোর কাছে রাখবি। শুধু একটু খেয়াল রাখতে বলেছি।’
‘কিছু করবে না ও। আমি দ্বিতীয়বার আর ভুল করব না।’ আমির বিরক্তি নিয়ে বললো।
‘না হলেই ভালো। কুয়েতে সময় চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছি।’
‘সময় দিবে না। আর এতো অনুরোধ করার কী আছে? সময়মত হয়ে যাবে। তুমি এখন সামনের কাজে মন দেও। আমি এই ব্যাপারটা দেখছি।’
মজিদ আমিরের পিঠ চাপড়ে বললেন,’বাঘের বাচ্চা!’
আমির পূর্বের স্বরেই বললো,’ যাওয়ার সময় বারেক ভাইকে বলো আসতে।’
‘বাইরে কে থাকবে? তুই এখন থাক এখানে।’
আমির কিছু বললো না।

___________
চারপাশ থমকে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আমির নিজের নিশ্বাস নিজে শুনতে পাচ্ছে। চুপ করে বসে আছে। ঘাড়ের ব্যথাটা বেড়েছে। জ্বালাপোড়া করছে। সে দুই তিন বার এওয়ানের দরজার দিকে তাকিয়েছে। হাজারবার নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়েছে। কেন এমন হচ্ছে সে জানে না! তার একপাশে যেন রক্ত,অন্যপাশে ফুলের বাগান। ফুলের সুবাস তাকে চম্বুকের মতো টানছে। অন্যদিকে রক্তের রঙ যে তার পেশা,রীতি, নেশা,দায়িত্ব। আমির ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দ্রুত পায়ে চলে আসে এওয়ানে। ঘরে আবছা আলো। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে। তার হাতে হ্যান্ডকাপ রয়ে গেছে। আমির জুতা খুলে হেঁটে আসে। নয়তো শব্দ শুনে উঠে যাবে পদ্মজা। সে টের পায় তার দুই পা কাঁপছে! প্রবল জড়তা কাজ করছে। তাদের আলাদা দুই পথ এক হতে চাইছে না। একজন মানুষ হয়ে দুই সত্তা নিয়ে বাঁচা যায় না। দুই সত্তা বড় যন্ত্রণার। আমির পদ্মজার পায়ের কাছে বসলো। ফর্সা দুটি পা স্থির হয়ে আছে। আমিরের লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ছুঁলো না। পদ্মজার মুখের দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। পৃথিবীর একমাত্র অদ্ভুত মানুষটি বুঝি সে। আমির বিছানায় উঠে বসে। পদ্মজার গলার দাগটা দেখার চেষ্টা করে। পদ্মজা জেগে উঠে। আমিরের মুখটা ঝুঁকে আছে তার উপর। সে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আমির পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। পদ্মজার বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। শুনতে পায়,পদ্মজার বুকের ধুকধুকানি। পদ্মজা চমকে যায়।

পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। পদ্মজা ঢোক গিলে বললো,’আপনার রাজত্বে এসে আপনার সাথে পেরে উঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এইটুকু তো বলতেই পারি,আপনার ছোঁয়া আমার কাছে সবচেয়ে নোংরা,অপবিত্র।’

আমির জবাবে কিছু বলল না। চুপচাপ সরে গেল। অন্যদিকে ফিরে শুয়ে রইলো। পদ্মজা আমিরের পিঠের দিকে তাকায়। বুকটা হাহাকার করে উঠে। এতক্ষণ তো সে শক্তই ছিল। আমিরের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আসেনি,মায়া আসেনি। এখন কেন এমন হচ্ছে! আমিরের সাথে সাথে নিজের প্রতিও ঘৃণা চলে আসে। হাজার মেয়ের জীবন নষ্ট করা মানুষটাকে সে এখনো ভালোবাসে! তার মন কাঁদে। পদ্মজা ছাদের মেঝেতে তাকিয়ে মনে মনে হেমলতাকে বললো,’ তোমার মেয়ে এতো খারাপ মানুষ কী করে হলো আম্মা? আমি পাপীকে ভালোবেসে পাপ করছি! ক্ষমা করে দিও আমাকে। ক্ষমা করতে না পারলে,অভিশাপে পুড়িয়ে ছাই করে দাও আমাকে।’

যাদের ভালোবাসাকে বাজি ধরতে হয়,ভালোবাসাকে রক্তারক্তির যুদ্ধে নামাতে হয়,বুকের ভেতর ভালোবাসাকে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা যায় না তারা বোধহয় সবচেয়ে বেশি অসহায়। পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে ভেজাকণ্ঠে বললো,’যেদিন আপনার মনে হবে,আপনার দ্বারা আর কারো ক্ষতি হবে না। পাপ হবে না। সেদিন আমাকে পদ্মবতী ডেকে জড়িয়ে ধরবেন।’
আমির নিশ্চুপ রইলো। কিছু বলার মতো ভাষা তার মস্তিষ্কে নেই। সে নির্বাক। পৃথিবীতে তিনটা মানুষকে সে ভালোবেসেছে। তার থেকে দুটো মানুষই তার পাপের জন্য তার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। আরেকজন চলে যাওয়ার পথে। তারপরও আমির পারে না সবকিছু ছেড়েছুড়ে দূরে হারিয়ে যেতে। তার ইচ্ছে করে না,সে ভাবতে পারে না। পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমার মা নেই,বাবা নেই। আমার স্বপ্ন,আশা,সবকিছুই তো আপনি ছিলেন। আপনাকে নিয়ে আমি বৃদ্ধ হতে চেয়েছি। সেই আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। শত,শত মেয়েকে পিটিয়ে জান ছিনিয়ে নেন। আল্লাহর দোহাই লাগে,আমার কষ্টটা অনুভব করুন। আমি হাশরের ময়দানে কী করে মুখ দেখাব? মৃত,অত্যাচারিত মেয়েগুলোর সামনে কী করে দাঁড়াব? হাশরের ময়দানে সবাই আমার দিকে ঘৃণ্য চোখে চেয়ে থাকবে। কলঙ্কিনী আমি। আপনার বউ হয়ে আমি কলঙ্কিনী হয়েছি। মেয়েগুলোর বাবা,মাকে আমি কী বলব? তাদের নারীছেঁড়া ধনকে ছিনিয়ে নেয়া পুরুষটিকে আমি ভালোবেসেছি এই কথা কী করে বলব? বলতে পারেন?’

আমির উঠে বসে। বেরিয়ে যায়। পদ্মজা কাঁদতে থাকলো। চোখের জল শুকায় না। আল্লাহ তায়ালা এ কোন পরীক্ষায় ফেলেছেন! আমির খুব দ্রুত ফিরে আসে। তার হাতে লম্বা একখানা বস্তু। সে সেই বস্তুটি বিছানার উপর রেখে প্যান্ট থেকে চাবি বের করলো। হ্যান্ডকাপ খুলে পদ্মজাকে বসিয়ে দিল। তারপর পদ্মজার সামনে বস্তুটি ধরে শান্তস্বরে বললো,’ আমি পারবো না সরে আসতে। এই তলোয়ার ব্যবহার করা হয়নি। খুব পছন্দ করে এনেছিলাম। তোমার হাতে তুলে দিলাম। যদি পারো,মুক্তি দিও আমাকে। কোনো কলঙ্ক রেখো না গায়ে। হাশরের ময়দানেও তুমি সবচেয়ে সুন্দর,সম্মানিত এবং দামী থাকবে। শুধু বেহেশতে দুজনের একসাথে রাজপ্রাসাদে থাকার স্বপ্নটা পূরণ হবে না।’

আমিরের বলা কথাগুলো শুনে পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। বুকে ব্যথা শুরু হয়। আমির পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল। তারপর বললো,’শেষবার ছুঁয়েছি আর ছুঁবো না। শপথ করছি, আর ছুঁবো না।’
তারপর ছুটে যায় বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পদ্মজা দম বন্ধ হয়ে আসে।
মিনিট দুয়েক পার হতেই চাদর খামচে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। আল্লাহ উপর প্রশ্ন তুললো,’আমার ভালোবাসায় কী কমতি ছিল আল্লাহ? কেন এমন জীবন দিলে আমায়! আমি কী করব? মৃত্যু দাও আমাকে।’

পদ্মজা চোখভর্তি জল নিয়ে তুষারের দিকে তাকালো। তুষার এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে,’মাই গড!’
তার শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে যায়। চোখে জল চিকচিক করছে। এমন অদ্ভুত ভালোবাসা সে দুটো দেখেনি। একজন খুন হতে চেয়েছে,আরেকজন খুন করে মুক্তি দিয়েছে। ফাহিমা কাঁদছে। পদ্মজা মিষ্টি করে হেসে বললো,’আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?’
‘আমির হাওলাদারের একটা সুন্দর জীবন হতে পারতো।’ আফসোসের স্বরে বললো ফাহিমা।
পদ্মজা ফিক করে হেসে ফেললো। বললো,’পুলিশ হয়ে ক্রাইম কিংয়ের জন্য কাঁদছেন!’

তুষারের বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কঠিন মনের তুষার ভেঙে পড়েছে! ভালোবাসার অনেক ব্যাখা সে শুনেছে। কিন্তু ভালোবাসা এমনও হতে পারে সে ভাবেনি। তুষার বললো,’তিনি অবশ্যই চেষ্টা করেছিলেন এই জগত থেকে বের হতে! কিন্তু পারেননি। তিনি আষ্ঠেপৃষ্টে পাপের রাজ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভালোবাসার কোনো আদালত থাকলে সেই আদালতে আমির হাওলাদারের সব খুন মাফ!’
পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে হাসে। অনেক কাহিনি, অনেক কান্না তো এখনও বাকি। এরা এইটুকুতে কেঁদে অস্থির! তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ভীষণ!

চলবে…
®ইলমা বেহারোজ
(এন্ডিং বেশি দেরি নেই।

1 COMMENT

  1. আমি মানতে পারতেছি নাহ আমির হাওলাদার এটা কি ভাবে করতে পারলো?? কেন করল??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here