আমি ফাইসা গেছি পর্ব -২২+২৩

#আমি_ফাইসা_গেছি(২২)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

“ও মা গো,কি হলো আমার?আমি হাঁটতে পারতিছি না কেনো?এই বলে জোরে জোরে চিল্লাতে লাগলো কুশান।কুশানের কন্ঠ শুনে সবার আগে কামিনী দৌঁড়ে গেলো রুমে।আর জিজ্ঞেস করলো,
বাবা কি হয়েছে তোর?এতো জোরে চিৎকার করলি কেনো?
ধীরে ধীরে সবাই এগিয়ে আসলো।
জারিফ চৌধুরীও এসে বললো, কি হয়েছে বাবা?সোনিয়া,সুমন ও বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলো ভাইয়া কি হয়েছে?
কুশান সবাইকে এমন বিচলিত দেখে বললো কিছুই হয় নি আমার।এমনিতেই চিৎকার দিয়ে দেখলাম আমাকে কে কত টা বেশি ভালোবাসে?আম্মু যে সবচাইতে আমাকে বেশি ভালোবাসে তা আমি আগে থেকেই জানতাম।কিন্তু আজ দিয়ে আরো বেশি ক্লিয়ার হয়ে গেলাম।এই বলে কুশান তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো।

আসলে কুশান দেখতে চাইছিলো তার আম্মু সত্যি সত্যি অভিনয় করছিলো কিনা?যদি কামিনীর পায়ে ব্যাথা থাকতোই তাহলে তো সে এভাবে দৌঁড়ে আসতে পারতো না।

ইরা এবার কুশানের কাছে গিয়ে বললো, ভাই তুই হলি আমাদের সবার আদরের।তোকে সবাই অনেক ভালোবাসে ভাই।এইভাবে কখনো মজা করবি না।
মিরা আর লিরাও সেম কথা বললো।
কুশান সবার কথা শুনে বললো আমি আসলে অনেক লাকি এরকম একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করে।যে পরিবারে আমাকে সবাই পাগলের মতো ভালোবাসে।

কামিনী তখন কুশান কে বললো এরকম ফান আর কখনোই করবি না বাবা।তোর চিৎকার শুনে তো আমি হার্ট অ্যাটাক করতে ধরেছিলাম।আমার কলিজা সোনা টা।
কুশান তখন বললো আসলে আমাদের পরিবার টা সবার জন্য একটা আদর্শ পরিবার।এইরকম পরিবার যেনো সবার হয়।বাট,,,,বলেই থেমে গেলো কুশান।

–বাট?কি বলতে ধরে থেমে গেলি বাবা?

কামিনীর এমন প্রশ্ন শুনে কুশান বললো,আমি আবার বলছি, এইরকম পরিবার যেনো সবার হয়,বিশেষ করে এই রকম আম্মু যেনো সবার ঘরে ঘরে থাকে, আর এই রকম বোন ও প্রতিটা ভাই এর যেনো হয় বাট এরকম একটা পরিবার যেনো কোনো মেয়ের শশুড়বাড়ি না হয়,এরকম যেনো শাশুড়ী কারো না হয়,আর এমন ননদ যেনো কোনো মেয়ের সংসারে না থাকে।

কুশানের মুখে এরকম কথা শুনে সবাই ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলো।বিশেষ করে কামিনী আর তার মেয়েরা। ইরা,মিরা,লিরা শোনামাত্র একসাথে এগিয়ে এসে বললো,
ভাই,তোর মাথা কি ঠিক আছে?এইমাত্র প্রশংসা করলি আবার এই মাত্র নিন্দা করছিস।ব্যাপার টা ঠিক বুঝলাম না।
কুশান তখন বললো এখানে না বোঝার কি হলো আপু?তোরা যে সবাই আমাকে কত টা ভালোবাসিস সেটা তো অস্বীকার করছি না আমি।সেজন্যই তো বললাম এরকম বোন প্রতিটা ভাই এর যেনো হয়।কিন্তু তোরা কি কেউ আমার বউ কে ভালোবাসিস?সেও তো এখন এই পরিবারেরই একজন সদস্য। তবুও কেনো তাকে হিংসার চোখে দেখিস তোরা?আমি তো আর অন্ধ না।দেখি তো নিজের চোখ দিয়ে।তোড়ার মতো একজন রাগী আর জেদি মেয়ে নিজের রাগ কে কন্ট্রোল করে তোদের সাথে ভালো আচরণ করে মন জয় করার চেষ্টা করছে।তারপরেও ওকে তোরা নানা ধরনের কথা শোনাস।কেনো?উত্তর দে?

ইরা,মিরা,লিরা তিনজনই চুপ হয়ে গেলো।কারো মুখে কোনো কথা নেই।তবে তারা যে নিজের দোষ টা দেখতেই পারছে না।বরং উলটো মনে মনে ভাবছে তাদের ভাই সত্যি চেঞ্জ হইছে।বউ এর হয়ে আমাদের কে অপমান করছে।

কামিনী এবার এগিয়ে এসে বললো, হঠাৎ এরকম প্রশ্ন কেনো করছিস কুশান।আমি নিশ্চিত এসব তোর মনের কথা নয়।তোকে নিশ্চয় কেউ কানপড়া দিয়েছে।তা না হলে তুই তো এভাবে আমাদের অপমান করার সাহস পেতি না।

–কানপড়া?কিসের কানপড়া?আম্মু তুমি কি এখন সবার সামনে সত্য টা বলতে বলছো আমাকে?আমি যদি বলা শুরু করি তখন কিন্তু আর থামবো না।প্লিজ আম্মু ভালো হয়ে যাও।তোড়াকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসো।দেখবে সে তোমাদের আরো বেশি ভালোবাসবে,আরো বেশি আদর যত্ন করবে।

কামিনী কুশানের কথা শুনে একদম নিশ্চুপ হয়ে রইলো।

কুশান তখন কামিনী কে আবার জড়িয়ে ধরলো আর বললো,আম্মু,আমি বলি না কিছু তোমাদের সবার মন খারাপ হবে দেখে।তাছাড়া আমি চাইতাম না তোড়ার সামনে তোমাদের ছোটো করতে।আমি যে তোমাদের সবাইকে যথেষ্ট রেসপেক্ট করি।এজন্য সবার উদ্দেশ্যে ওয়ার্নিং দিলাম,তোড়া যেহেতু এ বাড়ির একজন সদস্য আর আমার বউ সেহেতু ওর সাথে সবাই ভালো আচরণ করবে।শুধু তোড়া না,ওর ফ্যামিলির লোকজনের সাথেও তোমাদের ভালো ব্যবহার করা উচিত।তোমরা আমাকে যেভাবে ভালোবাসো,তোড়া আর তার ফ্যামিলির লোকজনকেও সেভাবে ভালো বাসতে হবে।আমি সংসারে কোনো অশান্তি চাই না।আমি শান্তি চাই, শান্তি।

কারো মুখে কোনো কথা নাই।সবাই শুধু কুশানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।কুশানের এতো পরিবর্তন হয়েছে।সত্যি আজ যে কেউ কুশানকে চিনতেই পারছে না।

কুশান তখন বললো,একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর মুহুর্ত হলো তখন,যখন দেখে তার স্বামীর সামনে তার শশুড় বাড়ির লোকজন তাকে অপমান করে তবুও তার স্বামী তার হয়ে কোনো প্রতিবাদ করে না।আমি যে তোমাদের সবাইকে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসি।সেজন্য কারো মনে আঘাত দিয়ে কোনো প্রতিবাদ করি নি।
বিয়ের পর থেকে তোড়ার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে তা তো আমি বুঝতে পারছি।আর নিজের চোখে দেখছিও।আমি এতোদিন শুধু দেখছিলাম সবকিছু,ভেবেছিলাম সব একদিন এমনি ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ব্যাপার টা ততো জটিল হয়ে যাচ্ছে।
আর তোমরা তো কেউ এই মর্ম টা বুঝবে না।কারণ তোমরা কেউ ই যে এই সিচুয়েশনে পড়ো নি?আম্মুও কোনোদিন তার শশুড়বাড়ি গিয়ে এক রাত কাটায় নি, আর আমার বোনেরাও না।সেজন্য তোমরা আরেকজন মেয়ের কষ্ট বুঝতে পারো না।নিজেরা যদি শশুড় বাড়ি গিয়ে সংসার করতে তখন বুঝতে সবার মন মানিয়ে চলা একজন বউ এর জন্য কতটা কষ্টের আর ধৈর্যের কাজ?

ইরা তখন বললো ভাই তুই কিন্তু আমাদের খোটা দিচ্ছিস?যা আর থাকবোই না এ বাড়িতে।আজকেই চলে যাবো।
মিরা তখন বললো তুই কিন্তু এর আগেও বলেছিলি এই কথাটা,ভেবেছিলাম না বুঝে বলেছিলি।

কুশানের কথা শুনে তিন বোনই রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।কুশানও তাদের আজ আটকালো না।কারন সে ভালো করেই জানে এরা কখনোই ভালো হবে না।আর যতদিন থাকবে এই বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকবে।

কুশানকে এরকম উচ্চস্বরে কথা বলা দেখে সবার মাথা একদম চক্কর দিয়ে উঠলো।এ কোন কুশানকে দেখছে তারা?যে কুশান কামিনী আর তার মেয়েদের সাথে মিউমিউ করে কথা বলতো আজ সে তাদের সাথে এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস দেখালো?

কামিনী নিজেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো।সে বুঝতে পারলো কুশান তাহলে এতোদিন সবকিছু জেনে বুঝেও চুপ করে ছিলো।আর আজকের ঘটনাও কি সে জানে?সে যে শরীর ব্যাথার মিথ্যা অভিনয় করলো সেটাও তাহলে কুশান বুঝতে পেরেছে।কামিনী কুশানের সাথে আর কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে গেলো রুম থেকে।

অন্যদিকে ইরা,মিরা, লিরা রাগ করে তাদের ব্যাগ গোছাতে লাগলো।আর জোরে করে বলতে লাগলো যে বাড়িতে কুশানকে সবাই মাথায় তুলে রেখেছে সে বাড়িতে তারা কিছুতেই থাকবে না।কুশান তাদের কোন সাহসে এরকম কথা বলে?ওকে এতো বড় পাওয়ার কে দিয়েছে?

কামিনী তাড়াতাড়ি করে ইরার রুমে প্রবেশ করলো।আর মিরা,লিরাকেও ইরার রুমে আসতে বললো।মিরা আর লিরা যখন আসতে চাইছিলো না তখন কামিনী জোর করেই টেনে এনে বললো,
এই রাগ তোরা কার উপর দেখাচ্ছিস?আর কার উপর রাগ করে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?এটা আমার বাড়ি।আমি কাকে রাখবো আর কাকে রাখবো না সেটা আমার ব্যাপার।কুশান বললো আর হলো নাকি?এটা আমার বাড়ি।আর আমার বাড়িতে সবার আগে আমার মেয়েদের থাকার অধিকার আছে।

ইরা সেই কথা শুনে বললো, আম্মু আমি বুঝতে পারছি না একটা জিনিস?তোমার বাড়িতে থেকেও কুশান আমাদের এভাবে অপমান করতে পারলো।আচ্ছা আমাদের না হয় করলো তার সাথে তো তোমাকেও যা নয় তাই বললো।তবুও তুমি কুশানকে এতো ভালোবাসো কেনো?

কামিনী সেই কথা শুনে বললো তোরা এভাবে বলছিস কেনো?কুশান তোদের ভাই হয়।আমার একমাত্র আদরের সন্তান সে।ও না বুঝে বলেছে এসব?আসলে কুশান তোড়াকে ছাড়া কিছু বুঝছে না।সেজন্য তোড়ার উপর কেউ কড়া কথা বলায় ওর মাথা গরম হয়ে গেছে।সেজন্য আজ থেকে কেউ তোড়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না।তাহলে দেখিস কুশানও আর ক্ষুব্ধ হবে না।

মিরা তখন বললো আম্মু তুমি কি ভয় পাচ্ছো কুশানকে?না মানে এই বাড়ি তোমার।ব্যবসা বানিজ্য সব তোমার?যেখানে কুশান তোমাকে মান্য করে চলবে সেখানে তুমি কুশানের কথা মতো তার বউকে সম্মান দিতে বলছো?আমরা এটা মানতে পারবো না।
কারণ ওই মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে না।

লিরা তখন বললো আম্মু আপু কিন্তু ঠিকই বলেছে।কুশানকে আমরা ভালোবাসি ঠিক আছে।তাই বলে ওর এসব কড়া কথা হজম করতে পারবো না। ও কি এমন হয়েছে যে ওর কথামতো চলতে হবে আমাদের?তার সাথে আবার ওই তোড়া আর টোরাকেও মেনে চলতে হবে?

হঠাৎ জারিফ চৌধুরী প্রবেশ করলেন ইরার রুমে।তিনি নিজেও এসে মেয়েদের বোঝাতে লাগলেন।কিন্তু তার মেয়েদের একটাই কথা তারা তোড়ার সাথে কিছুতেই ভালো আচরণ করতে পারবে না।

জারিফ চৌধুরী তখন কামিনী কে বললো,কামিনী! এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যাও।আর মেয়েদের ও ভালো পথে আনো।তা না হলে কুশানকে কিন্তু তোমরা সারাজীবনের জন্য হারাবে।যে ছেলেকে নিয়ে তোমার এতো অহংকার?এতো ভালোবাসা?সবকিছু কিন্তু ধুলিসাৎ হয়ে যাবে।সো মাইন্ড ইট কামিনী। আর কুশান হাত ছাড়া হওয়া মানে,,, বুঝতেই পারছো?এই বলে জারিফ চৌধুরী চলে গেলো।

কামিনী জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে রাগে নিজের চুল নিজেই ছিড়তে লাগলো।কারণ যে সত্য টা এতোদিন ধরে সে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে সেই সত্য টা জারিফ কেনো আবার মনে করে দিলো?আর এই সত্য টা যাতে কুশানের কানে কোনোদিন না যায় সেজন্য তার কুশানকে হাতে রাখা উচিত।কুশানের চোখে তার খারাপ হওয়া চলবে না।কিন্তু তোড়া?এই তোড়াকে যে সে নিজেও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।এই তোড়ার জন্যই আজ কুশান তাকে এভাবে অপমান করলো?কি করে সে তোড়াকে কুশানের জীবন থেকে সরাতে পারবে সেটাই ভাবতে লাগলো কামিনী।

ইরা,মিরা আর লিরা এবার কামিনীর কাছে এগিয়ে এসে বললো, আম্মু,আব্বু এভাবে কি বললো তোমাকে?তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো আমাদের থেকে?

কামিনী তার রাগ কে কন্ট্রোল করে বললো,না কই কি লুকাচ্ছি?
–তাহলে আব্বু ফিসফিস করে কি বললো তোমাকে?
কামিনী তখন বললো তোদের আব্বুও কুশানের মতোই সেম কথা বললো। তোড়ার সাথে আমাদের কে ভালো ব্যবহার করতে বললো।
🖤
তোড়া চলে যাওয়ায় কুশানের মন টা আজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। তার উপর আম্মু আর বোনদের কড়া কথা বলে আরো বেশি মন খারাপ হলো কুশানের।কুশান মনে মনে শুধু ভাবছে তার আম্মুরা কেনো তোড়াকে মেনে নিতে পারছে না, যেখানে তারা নিজেরাই তাকে চুজ করে এনেছে।
কুশানের মন খারাপ থাকা সত্ত্বেও সে তোড়াকে কল করতে ভোলে নি।তোড়া তার গ্রামে না পৌঁছতেই এর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচবারের বেশি কল দিয়েছে কুশান।তোড়া না পৌঁছানো পর্যন্ত যেনো কুশানের মনে স্বস্তি ফিরে আসছিলো না।কুশান আবার কল দিয়ে বললো, পৌঁছেছো তোড়া?

তোড়া কুশানের এমন অস্থিরতা দেখে বললো,
তুমি এতো বেশি টেনশন কেনো করছো কুশান?আমি সময়মতো পৌঁছে যাবো।আর বললাম তো বাসায় গিয়ে জানাবো।

কুশান তখন বললো কেনো জানি শান্তি পাচ্ছি না।তাছাড়া রাস্তাঘাটের যে অবস্থা,কেনো জানি ভয় লাগছে আমার।
তোড়া কুশানের এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বললো,তুমি কখনো কি চেঞ্জ হবে না কুশান?বললাম তো অযথা চিন্তা করো না।
–ওকে।আর করবো না চিন্তা। এই বলে কুশান কল কেটে দিলো।

তোড়া তখন নিজের থেকে আবার কল দিয়ে বললো, রাগ করতেছো কেনো?আমি তো এমনি বললাম।আচ্ছা আমার কথা বাদ দাও।আম্মুর কি অবস্থা এখন?ব্যাথা কি ভালো হইছে?
কুশান তখন বললো তুমি কি ফান করছো আমার সাথে তোড়া?
–ফান?ফান করবো কেনো?সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করছি।আসলে আমি ধারণা করে বলেছিলাম যে আম্মু অভিনয় করছে।সেই ধারণা তো মিথ্যেও হতে পারে।
কুশান তখন হঠাৎ করে বললো, সরি তোড়া।
তখন ওভাবে তর্ক করা উচিত হয় নি আমার।আসলে কোনো জিনিস যাচাই করে তবেই সেই বিষয় নিয়ে তর্ক করা উচিত।

–তার মানে আম্মু সত্যি সত্যি অভিনয় করছে?

কুশান তখন বললো আমি আবার কখন সেটা বললাম?তুমি যেমন বললে তোমার ধারণা তো মিথ্যেও হতে পারে।ঠিক আমিও বলছি আমার ধারণাও তো মিথ্যে হতে পারে।

–ওকে। ঠিক আছে কুশান।আমাদের দুইজনের ধারনায় মিথ্যা।তুমি এখন রাখো কল টা।আর ফিসফিসিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।আমার পাশে স্বর্ণা আছে কিন্তু।যখন বলবে ফোন টা আমাকেও একটু দে, দুলাভাই এর সাথে আমিও কথা বলি তখন বলবে কথা?
–না,না।রাখলাম এখন।এই বলে কুশান কেটে দিলো কল।

আজ আর কুশান দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না।তার চোখেমুখে একটুও ঘুম নেই।সে শুধু ভাবতেছে কখন রাত টা শেষ হয়ে যাবে?আজ যেনো সময় আর যাচ্ছেই না।এই কিছুক্ষন আগেই তোড়ার সাথে সে কথা বললো।ঘুমাবে বলে তোড়াকে গুড নাইট ও বললো।কিন্তু এখন আর ঘুম আসছে না কুশানের।কুশান তখন শুয়ে থেকে ফোনটা হাতে নিলো।তবুও তার ভালো লাগছে না।সেজন্য সে তার মনের আবেগ দিয়ে তোড়াকে কে একটা ভালোবাসার মেসেজ পাঠালো।

যবে থেকে তোমায় বেসেছি ভালো,
তবে থেকে আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন শুধু তুমি।
আমার আকাশ,আমার বাতাস,আমার নদীজল,
আমার পৃথিবী,আমার নিঃশ্বাস,আমার বিশ্বাস,
শুধুই যে তুমি।
আমি তোমাতে থাকি, তোমাতেই হারাই,তোমার মাঝে নিজেকে যে খুঁজে বেড়াই।
বেঁচে আছি আজ তোমারই তরে,আরও বাঁচতে চাই তোমাকে ঘিরে।আমার জীবন,আমার মরণ সঁপে দিলাম তোমারই তরে।
যদি জেগে থাকো প্রিয়া,তাহলে একটা রিপ্লাই দিও।
কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না।

অপর পাশ থেকে উত্তর দিলো,দুলাভাই আপু তো ঘুমাচ্ছে।আমি স্বর্ণা।

কুশান স্বর্ণার মেসেজ দেখার সাথে সাথে অফলাইনে চলে গেলো।

স্বর্ণা হাসতে হাসতে একদম শেষ হয়ে গেলো।কিন্তু স্বর্ণা তো কুশানের মেসেজের রিপ্লাই দিলো এখন যদি তোড়া এই মেসেজ দেখে তাহলে তো ভীষণ রেগে যাবে।সেজন্য স্বর্ণা ডিলিট করে দিলো মেসেজটি।তবে কুশানের সেই ভালোবাসার মেসেজটি রাখলো সে।

আসলে স্বর্ণা তোড়ার মোবাইল টা হাতে নিয়ে সুমনের নাম্বার খুঁজছিলো।কিন্তু তোড়ার ফোনে যে সুমনের নাম্বার টি এখনো ব্লক লিস্টেই আছে।ওই যে সেদিন রাতে কুশান সুমনের ফোন থেকে কল দেওয়াই তোড়া ব্লক করে রেখেছিলো।সেই থেকে আর খোলে নি নাম্বার টা।
🖤
কুশান ভার্সিটিতে যাবে বলে রেডি হচ্ছিলো।এদিকে কামিনী আর ইরা,মিরা,লিরা কাল থেকে কুশানের সাথে কোনো কথা বলে নি।কুশান নিজেও রাগ করে কথা বলে নি কারো সাথে।কুশান রেডি হয়ে যখন নাস্তার টেবিলে চলে গেলো সে কাউকেই দেখতে পেলো না।শুধু টুনি কুশানকে দেখে এগিয়ে এসে বললো, কুশান ভাইয়া নাস্তা দিবো এখন?

কুশান তখন বললো আম্মু আর আপুরা খাইছে?

–না ভাইয়া। খায় নি।আমি সেই কখন নাস্তা রেডি করেছি।সোনিয়া,সুমন,খালু আর দুলাভাই রা খেয়েছে শুধু।খালামনি এখন পর্যন্ত খেতে আসে নি।আর আপুরা না খেয়েই চলে গিয়েছে অফিসে।

কুশান টুনির কথা শুনে সোজা কামিনীর রুমে চলে গেলো।রুমে গিয়ে দেখে কামিনী শুয়ে আছে।কুশানকে রুমে ঢোকা দেখে অন্য পাশ হলো কামিনী।কুশান তখন কামিনীর হাত ধরে বললো,সরি আম্মু।তোমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলা উচিত হয় নি আমার।শান্ত ভাবে বোঝানো উচিত ছিলো।কিন্তু কালকের রাগ আজকে করলে কি হবে?শুনলাম তোমরা নাকি কেউ খাও নি নাস্তা।চলো খেয়ে নেই।আমি ভার্সিটিতে যাবো এখন।

কামিনী তখন বললো বাবা তুই খেয়ে নে।আমরা পরে খেয়ে নিবো।

–পরে কেনো?আমার সাথে খেলে কি প্রবলেম?

কামিনী সেই কথা শুনে বললো কিসের আবার প্রবলেম?তুই খেয়ে ভার্সিটিতে যা।তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কুশান তখন জোর করেই তার আম্মুকে বিছানা থেকে টেনে তুললো।আর সোজা ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেলো।

কামিনী আর কোনো কথা বললো না।কিন্তু কামিনীর চোখে পানি দেখতে পেলো কুশান। কুশান তখন কামিনীর হাত ধরে বললো, কি হয়েছে আম্মু?কাঁদছো কেনো আবার?

–কিছু না।এই বলে কামিনী চোখের পানি মুছে নিলো।

কুশান তখন বললো আম্মু যা হয়েছে ভুলে যাও প্লিজ।আমার কিন্তু এসব কান্দাকাটি একদম ভালো লাগে না।জানোই তো আমি এসব অশান্তি পছন্দ করি না।আর তুমি যদি খাওয়া বাদ দিয়ে এভাবে কেঁদেই চলো তাহলে কিন্তু আমি না খেয়েই চলে যাবো।

কামিনী সেই কথা শুনে কান্না থামিয়ে দিলো।আর চুপচাপ খেতে লাগলো।কুশান নিজেও তাড়াতাড়ি করে খেয়ে দেয়ে ভার্সিটির দিকে রওনা দিলো।
🖤
কুশান ক্লাসেও মনোযোগ দিতে পারলো না।তবুও এক প্রকার বাধ্য হয়েই ক্লাস গুলো করতে হচ্ছে তাকে।ক্লাস শেষ হলে বন্ধুরা আবদার করে বসলো তারা তাদের ভাবিকে দেখবে।কত দিন হইলো বিয়ে হয়েছে কুশানের।এখন পর্যন্ত তারা কুশানের বউকে দেখলো না।এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
কুশান তখন সবাইকে বললো ও নাই বাসায়।বাবার বাড়ি গিয়েছে।এবার আমাদের বাড়ি আসলে ঠিক নিয়ে যাবো।
তখন বন্ধুরা বললো তাহলে অন্তত একটা ট্রিট তো দিতে পারিস।এই বলে তারা কুশানকে টেনে নিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে গেলো।সবাই সবার পছন্দমতো খেয়েদেয়ে প্রাইভেট পড়তে চলে গেলো।কিন্তু সেখানে গিয়ে শোনে তাদের স্যার আজ বাসায় নাই।এজন্য এক ঘন্টা সময় তাদের বসে থাকতে হবে।কিন্তু কুশানের আজ এতো বেশি ধৈর্য্য নাই।সেজন্য সে রাগ করে বাসায় চলে এলো।কারণ তার যে মনে বিন্দুমাত্র শান্তি নাই।তবে বাসায় গিয়ে কুশান তার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ফেললো।সে ঠিক করলো আজকেই সে একবার তোড়ার বাড়ি যাবে।তোড়াকে এক নজর না দেখলে সে কিছুতেই শান্তি পাবে না।কিন্তু বাসার সবাইকে কি জানিয়ে যাবে না লুকিয়ে যাবে এই নিয়ে ভাবতে লাগলো কুশান।

চলবে,#আমি_ফাইসা_গেছি(২৩)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

সন্ধ্যাবেলা চামেলি বেগম এঁচোড়ের ডালনা, নারকেল দিয়ে মোচার ঘন্ট, চিংড়িমাছের মালাইকারি রাঁধছেন।কারণ চামেলি বেগমের হাতের এসব খাবার তোড়া অনেক বেশি পছন্দ করে।যেহেতু তোড়া এখন তার বাবার বাড়িতে আছে সেজন্য চামেলি বেগম এখন মেয়ের পছন্দের খাবারদাবারই রান্না করেন।
অন্যদিকে তোড়া কুশানের সাথে কথা বলা শেষ করে মাত্র ফোন টা চার্জে লাগিয়ে দিয়ে স্বর্ণার সাথে গল্পে মেতে থাকলো।
কিন্তু হঠাৎ করে কারেন্ট চলে যাওয়ায় চামেলি বেগম তোড়া তোড়া বলে চিল্লাতে লাগলো।আর তাকে ঘর থেকে লাইট টা আনতে বললো।তোড়া তখন তার ফোনের লাইট জালিয়ে চামেলি বেগমের লাইট খুজে দিয়ে আসলো।এদিকে কারেন্ট না থাকায় ভ্যাপসা গরমে থাকা যাচ্ছিলো না বাড়ির মধ্যে।স্বর্ণা তখন বললো আপু চল না একটু বাহিরে যাই?এই গরমের মধ্যে কারেন্ট না থাকলে বাড়ির মধ্যে থাকা খুব কষ্টদায়ক হয়ে যায়।

তোড়া স্বর্ণার কথা শুনে বললো,এই সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির বাহিরে গেলে আম্মু রাগ করবে।আমি যেতে পারবো না এখন।

–দূর চল। কিছুই বলবে না।এখন তোর বিয়ে হইছে না?এখন কেউ কিছুই বলবে না।ফোন টা হাতে নে,আর চাচীকে বল আম্মু তোমার জামাই কল দিয়েছে সেজন্য বাড়ির মধ্যে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না একটু বাহিরে যাবো।

তোড়া স্বর্ণার মুখে এই কথা শুনে বললো তুই তো দেখি অনেক ব্রিলিয়ান্ট হয়ে গেছিস রে?এতো বুদ্ধি পাস কই তুই?

স্বর্ণা তখন মুচকি হেসে বললো,এসব বুদ্ধি আবার শিখতে হয় নাকি?মাথাতে অটোমেটিক ভাবে চলে আসে।এই বলে স্বর্ণা তোড়াকে টেনে নিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেলো।

বাড়ির বাহিরে যেতেই দেখে শুধু তারায় নয় গরমের ঠেলায় সবাই রুম থেকে বের হয়ে এসেছে।বিশেষ করে বাড়ির বাহিরে যে টঙ টা আছে সেখানে বসার মতো একটুও জায়গা নাই।বাড়ির বাহিরে গাছগাছালি থাকায় খুব সুন্দর মিটিমিটি বাতাস বইছে।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেই শরীর টা একদম শীতল হয়ে যায়।
তোড়া আর স্বর্ণা যে আশায় বের হয়ে আসলো সেই আশা আর তাদের পূরণ হলো না।তারা ভেবেছিলো টঙে বসে থেকে পা দুলিয়ে দুলিয়ে মনের সুখে গল্প করবে।

এদিকে সায়ক ও সেই টঙ এ বসে ছিলো।স্বর্ণাকে দেখামাত্র এগিয়ে এসে বললো,এই সন্ধ্যাবেলায় বাসা থেকে বের হইছিস কেনো?
স্বর্ণা তখন আমতা আমতা করে বললো তোড়া আপু ডেকে নিয়ে এসেছে।
সায়ক স্বর্ণার কথা শুনে তোড়ার দিকে এক নজর তাকিয়েই বাড়ির মধ্যে ঢুকলো।সে আর কিছু বললো না।

আসলে সায়ক মনে মনে তোড়াকে একটু একটু পছন্দ করতো।তার মনের কথা প্রকাশ করার আগেই তোড়ার বিয়ে হয়ে গেলো।সায়ক বাড়িতে থাকলে হয় তো কিছু একটা করতো সে।কিন্তু যেদিন কুশানরা তোড়াকে দেখতে আসে সেদিন সায়ক বাড়িতে ছিলো না।বন্ধুদের সাথে বনভোজনে গিয়েছিলো সে।
এইভাবে অপ্রকাশিত ভালোবাসাগুলো সারাজীবন আড়ালেই রয়ে যায়।কিন্তু এই ভালোবাসা গুলো ভীষণ কষ্টদায়ক।ভালোবাসা প্রকাশ করলে কিছুটা কষ্ট কমে যায় কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ না করে মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখলে সেই ভালোবাসা ভীষণভাবে কাঁদায় প্রতিটা মানুষ কে।সায়ক তার জ্বলন্ত উদাহরণ। না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সহ্য করতে।

তোড়া নিজেও বুঝতে পারে এখন।কারণ সায়ক তার দিকে যেভাবে তাকায় বোঝায় যায় সে তোড়াকে কত টা ভালোবাসে?সায়কের অনুভূতি বোঝার আগেই তোড়া কুশানের প্রেম কাহিনি শুরু হয়ে যায়,সেজন্য সায়কের ভালোবাসা তোড়ার চোখে পড়ে নি।

তোড়া আর স্বর্ণা টঙে বসতে না পেরে গেটের সামলেই দাঁড়িয়ে রইলো।তোড়াদের পাশের বাসার এক চাচী তোড়ার কন্ঠ শুনে বললো,কি রে তোড়া?কবে এসেছিস?
তোড়া তার চাচীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো তার কাছে আর বললো,এই তো চাচী কালকে।

–তা জামাই কই?জামাইকে দেখছি না যে?

তোড়া তখন শান্ত কন্ঠে নিচ মুখ হয়ে বললো,ও আসে নি।ওর সামনে এক্সাম তো তাই ভার্সিটিতে ক্লাস করতে হয়,আবার প্রাইভেট আছে।

চাচী তখন তোড়ার কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,তোদের গন্ডগোল কি ভালো হইছে?কি এক ঝামেলার কথা শুনলাম।

তোড়া তখন বললো, না তো চাচী।কোনো ঝামেলা তো হয় নি।সব তো ঠিকই আছে।

চাচী তখন বললো, স্বর্নার মায়ে বললো, তোর বিয়ে দেওয়া নাকি ভালো হয় নি।তোর জামাই নাকি কিছুই করে না,স্টুডেন্ট মানুষ। আবার তোর নাকি ওটা শশুড় বাড়িও নয়।তোর নানা শশুড়ের বাড়ি ওটা?

তোড়া সেই কথা শুনে বললো হ্যাঁ।সে আর বেশি কিছু না বলে বাড়ির ভিতর চলে গেলো।স্বর্ণা তখন চিল্লায়ে চিল্লায়ে বললো, এই তোড়া কই যাচ্ছিস?দাঁড়া।

তোড়া আর দাঁড়ালো না।তার ভীষণ রাগ উঠলো চাচীর কথা শুনে।আর ওনারই বা কি দোষ?ঘরের লোক যদি কুটনামি করে তাহলে তার সাথে আর পাওয়া যায় না।এসব কথা যে স্বর্ণার মা ই বলে বেড়াচ্ছে তা তোড়া ভালো করেই জানে।

এদিকে স্বর্না সেই চাচীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, চাচী এসব কথা তুমি কই পাইলে?
চাচী তখন বললো, কথা কি আর এক জায়গায় থাকে মা?এমনিতেই শোনা যায়।

স্বর্ণা তখন বললো যা শুনেছো ভুল শুনেছো।তোড়া আপুর যে বাড়িতে বিয়ে হয়েছে ওরা তো বিশাল বড়লোক।আমাদের গ্রামের অর্ধেক এর মতো জায়গা জুড়ে বিশাল বাড়ি আছে।আর তাদের নিজস্ব ব্যবসা বানিজ্য, ফ্যাক্টরি সব আছে বুঝেছেন?

চাচী তখন মুখ ভেংচিয়ে বললো,তোর মা ই তো বললো,বেশি একটা নাকি ভালো হয় নি বিয়ে দেওয়া।আমরা এসব কথা কই পামু?তোর মা সেদিন গল্প করলো তাই জিজ্ঞেস করনু তোড়ারে।

স্বর্ণা তার চাচীর সাথে গল্প করতেই হঠাৎ সেখানে সে কুশানের মতো কাউকে দেখলো।পিছনে একটা ভ্যান ও আসছে।
স্বর্ণা তখন এগিয়ে গিয়ে বললো, দুলাভাই,আপনি?স্বর্না বেশ আশ্চর্য হলো কুশানকে দেখে।

কুশান বললো হ্যাঁ আমি,চিনতে পেরেছো তাহলে?

যেহেতু এখন সন্ধ্যার সময়,আবছা আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে সবাইকে।
স্বর্ণার মুখে দুলাভাই ডাক শুনে টঙে থাকা মহিলা আর মেয়ে গুলো নেমে আসলো।কারণ অনেকেই এখনো তোড়ার হাজব্যান্ড কে দেখে নি।হঠাৎ করে বিয়ে হওয়াই আর বিয়ের পর থেকে নানা ঝামেলায় কুশানেরও শশুড় বাড়িতে সেভাবে আসা হয় নি।

–কি রে? এই ছেলেই কি তোড়ার জামাই?

–হ্যাঁ,এটাই আমাদের তোড়া আপুর জামাই।আমাদের একমাত্র দুলাভাই।

কুশান স্বর্ণার মুখে এই দুলাভাই ডাকটা শুনলেই কেমন যেনো লজ্জায় লাল হয়ে যায়।সে কিছুক্ষন নিচ মুখ হয়ে থাকলেও মহিলাগুলোকে দেখে সালাম দিলো।মহিলা গুলো সালামের উত্তর দিলো ঠিকই কিন্তু তাদের চোখ তো এখন ভ্যানের দিকে।

মহিলা গুলো মনে মনে ভাবতে লাগলো,এই রকম জামাই ই তো দরকার।ভ্যানভর্তি খরচপাতি করে এনেছে।

এক মহিলা তো হাসতে হাসতে বলেই ফেললো,তা বাবা শুধু কি নিজের শাশুড়ীকে মিষ্টি খাওয়ালেই হবে?আমাদের খাওয়াতে হবে না?
কুশান সেই কথা শুনে এক প্যাকেট মিষ্টি মহিলাটির হাতে দিয়ে বললো,এটা আপনাদের জন্য।

মহিলাগুলো মিষ্টির প্যাকেট পেয়ে তো সেই খুশি।

এদিকে স্বর্ণা চিল্লাতে লাগলো,বড় আম্মু? তোড়া আপু বাহিরে এসে দেখে যাও কে এসেছে?

এদিকে তোড়া তো মন খারাপ করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।আর চামেলি বেগমের রান্নাবান্না এখনো শেষ হয় নি।সেজন্য তিনি বাড়ির ভিতর থেকেই উত্তর দিলেন কে এসেছে রে?

স্বর্ণা তখন বললো বাহিরে এসে দেখে যাও।

এদিকে মহিলাগুলো কুশানের সাথে গল্প করতে লাগলো।একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো যার কারণে কুশান বাড়ির ভিতর যেতে পারলো না।

স্বর্ণার এমন চিল্লাচিল্লি শুনে স্বর্ণার আম্মু বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে বললো,তুই এভাবে ষাঁড়ের মতো চিল্লা চিল্লি করছিস কেনো?তোর যে এখনো বিয়ে হয় নি সে খেয়াল আছে তোর?যা বাড়ির মধ্যে যা।
স্বর্ণা তার মায়ের ধমকানি শুনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।সে আর থাকতে পারলো না।আসলে স্বর্নার আম্মু টা এমনই।

স্বর্নাদের বাড়ি তোড়াদের বাড়ির সাথেই।মানে পাশাপাশি দুই টা পরিবার থাকে।শুধু মাঝখানে একটা প্রাচীর দিয়ে দুই পরিবার আলাদা হয়ে গেছে।আগে তারা যৌথই ছিলো। কিন্তু স্বর্নার আম্মু প্রায়ই চামেলি বেগমের সাথে কাজ কাম নিয়ে ঝগড়া করায় তারা আলাদা খায়।তবে হেনা বেগম চামেলি বেগমের সাথেই থাকে।

তোড়াদের বাড়িটা মোটামুটি বড়।গোলাপ আর চামেলি বেগমের একটা শোবার ঘর,তোড়ার একটা শোবার আর একটা পড়ার ঘর।আর একটা হেনা বেগমের ঘর,বড়গোছের একটা বসার ঘর—রান্নাঘরের পাশে আলাদা খাওয়ার ঘর আছে।পুরো বাড়ি জুড়ে দুই টা বাথরুম।একটা বাথরুম আঙিনা থেকে কিছুটা দূরে আর আরেকটা তোড়ার রুমে আছে।
🖤
কুশান এবার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।
কুশানকে দেখামাত্র চামেলি বেগম এতো বেশি আশ্চর্য হলো যে তার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিলো না।কুশান তার শাশুড়ী কে সালাম দেওয়ার পর মনে হয় হুশ ফিরে এলো চামেলি বেগমের।
চামেলি বেগম তখন বললো,
এই তোড়া না মস্ত এক বজ্জাত মাইয়া। তুমি যে আসবে সেটা কি একবার আমাকে বলা উচিত ছিলো না?

কুশান তখন বললো আম্মু ওকে বকে লাভ নাই।যা বকুনি দেওয়ার আমাকে দিন।কারণ আমি আসার সময় বলি নি তোড়াকে।ভাবলাম সারপ্রাইজ দিবো।কই ও?

–ঘরেই আছে।যাও বাবা ঘরে যাও।

এদিকে এখন পর্যন্ত কারেন্ট আসে নি।কুশান তখন তার মোবাইল টা বের করে আলো জ্বালিয়ে তোড়ার রুমে প্রবেশ করলো।কুশান আলো জালিয়ে দেখে তোড়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।সেজন্য সে আলো টা নিভিয়ে দিলো।
অন্যদিকে তোড়া ভেবেছে হয় তো স্বর্ণা এসেছে সেজন্য সে ঠিক আগের মতোই শুয়ে থাকলো।

কুশান ধীরে ধীরে তোড়ার পাশে যেতেই তোড়া একদম চমকে উঠলো।তার বুক টা একদম ধক করে উঠলো।কারণ এ যে কুশানের পারফিউম এর ঘ্রাণ।তোড়া তখন সাথে সাথে এক লাফে উঠে বসতেই কুশান তোড়াকে জড়িয়ে ধরলো।

তোড়া ভয়ে কথা বলতে পারছিলো না।সে তো বুঝতে পারছে এটা কুশান।তারপরেও ভয় লাগছে।কারণ কুশান এই সন্ধ্যাবেলা কই থেকে আসবে?এই কিছুক্ষন আগেই তো সে তার সাথে কথা বলেছে।কই কুশান তো আসার কথা কিছু বলে নি।আবার এটা তো স্বর্ণাও নয়।তোড়া যেই চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই কুশান তোড়ার মুখ টিপে ধরে বললো অযথা চিৎকার করে আমার মানসম্মান নষ্ট করিও না।আমি কুশান।তোমার স্বামী।

তোড়া সেই কথা শোনামাত্র কুশানকে এক ঝাটকায় সরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে বালিশের নিচ থেকে
তার মোবাইল টা হাতে নিয়ে লাইট অন করলো।লাইট অন করা মাত্র কুশানকে দেখে সে আর তার খুশিকে ধরে রাখতে পারছিলো না।সে সাথে সাথে কুশানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
তুমি?তা আমাকে বলবে না?আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কুশান তখন নিজেও দুই হাত দিয়ে তোড়াকে জড়িয়ে ধরে বললো, আগে থেকে যদি জানতে তাহলে তোমার এই আনন্দভরা মুখ খানা দেখার সৌভাগ্য হতো কি?
তোড়া সেই কথা শুনে বললো,
আমি মোটেও আনন্দিত হয় নি।কাল তোমার ভার্সিটি আছে না?তুমি কেনো এসেছো সেটা আগে বলো।
কুশান তখন বললো একা একা ভালো লাগছিলো না।সেজন্য নিতে আসলাম।

তোড়া তখন বললো মাত্র কাল আসলাম কুশান।আর আজকেই নিতে এসেছো তুমি?বলেছি না তিন চার দিন থাকবো আমি?

–তিন চার দিন?একদিনই থাকতে পারছি না।আর যদি তুমি তিন চার দিন থাকো তাহলে আমিও থাকবো এখানে।

–পাগল হইছো তুমি?

কুশান তখন তোড়াকে কিস করতে করতে বললো,হ্যাঁ পাগলই হইছি।আমাকে পাগল বলো আর কিছু বলো তোমাকে রেখে একা একা আর যাচ্ছি না।

তোড়া তখন বললো, বাসায় বলে এসেছো?

–হ্যাঁ।

–সত্যি বলছো তো?

–বললাম তো হ্যাঁ।মিথ্যা কেনো বলবো?

এদিকে হেনা বেগম চিল্লাতে চিল্লাতে বললো কই কুশান?কুশান নাকি আসছে?

কুশান দাদীর ডাক শোনামাত্র তাড়াতাড়ি করে তোড়াকে ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলো।আর হেনা বেগমকে সালাম দিয়ে বললো, দাদী কেমন আছো?
হেনা বেগম তা শুনে বললো, আমি তো ভালোই আছি।কিন্তু তুই হঠাৎ করে এই সন্ধ্যাবেলায়।বুঝলাম না ব্যাপার টা।

–ও তোমাকে বুঝতে হবে না দাদী।তোমাদের সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো বলে না বলেই এসেছি।

হেনা বেগম তখন বললো হ ভাই,সবই বুঝি।এরকম সময় আমরাও কিন্তু পার করে এসেছি।আমি তো ভাবছিলাম তোর দাদুই মনে হয় এরকম সারপ্রাইজ দিতো,এখন তো দেখি এই জেনারেশনের ছেলেরাও সারপ্রাইজ দিতে জানে।

কুশান তখন ফিসফিসিয়ে বললো,দাদী বলেছিলে না?মনে আছে?ওই জন্য আর কি আসা।এই বলে কুশান মুচকি একটা হাসি দিলো।

দাদী কুশানের এমন দুষ্ট কথা শুনে বললো তুই বেশ বজ্জাত আছিস ভাই।

তোড়া পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো।সে ভাবতেই পারছে না কুশান এতো টা নির্লজ্জ হয়েছে।সে তখন কুশানকে ডাকতে লাগলো।
কুশান তোড়ার কাছে এগিয়ে যেতেই সে রাগ দেখিয়ে বললো, এসব কি হচ্ছে কুশান?দাদী তোমার মুরব্বি হয় না।কি যা তা বলছো?

— মুরুব্বি?হ্যাঁ তোমাদের দিক দিয়ে মুরুব্বিই বটে।কিন্তু দাদী আমাকে বলেছে আমি তার কাছে নিজের নাতির মতো।আমার নিজের দাদীকে তো দেখি নি এজন্য এই দাদীর সাথে মজা করি।এতে কি তোমার কোনো প্রবলেম আছে?

তোড়া কুশানের কথা শুনে বললো তোমার দাদীকে তুমি দেখো নি?

কুশান তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,শুধু দাদী না,আমি তো এখন পর্যন্ত জানি না আমার দাদুর বাড়ি টা কই?আব্বু এ সম্পর্কে কিছুই বলে নি।আর আম্মু তো জীবনেও বলবে না।
🖤
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কুশান তোড়ার শোবার ঘরে চলে গেলো।শাশুড়ীর হাতের রান্নার অপূর্ব স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে তার—এঁচোড়ের ডালনা, নারকেল দিয়ে মোচার ঘন্ট, চিংড়িমাছের মালাইকারি, এ যেনো এক স্বর্গীয় স্বাদের খাবার।কুশান অনেক বেশি উপভোগ করেছে খাবারগুলো।কুশান আসায় তার শাশুড়ী আরো অনেক পদ রান্না করেছে কিন্তু এই খাবারগুলো যেনো তার কাছে অমৃতের মতো মনে হলো।
এদিকে অনেক রাত হয়েছে—চারপাশের নিস্তব্ধতার ভেতর ঝোপ ঝাড়, গাছপালাতে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে।

তোড়া এখনো তার রুমে আসে নি।কুশান বুঝতে পারছে না কিছু।এত লেট করছে কেনো তোড়া?তারা সবাই একসাথেই খাবার খেয়েছে।খাবার খাওয়া শেষ হলে তোড়া কুশান কে তার রুমে যেতে বললো আর বললো আমি একটু পরে আসছি এই বলে সে দাদীর রুমে প্রবেশ করলো।সেই যে ঢুকলো ওই রুমে আর বের হলো না।

কুশানের এই মুহুর্তে ইচ্ছা করছিলো একটু সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দুই একটা টান দিতে।কিন্তু এটা তো আর তার নিজের বাড়ি নয়,যে লুকিয়ে দুই একটা টান দিতে পারবে।কখন কে দেখে ফেলে কে জানে এই ভয়ে আর সিগারেটের কথা মনেই আনলো না সে।কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ একা একা রুমে বসে থাকা যায়?ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো তার।অবশেষে কুশানের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো।প্রায় তিরিশ মিনিট পার হয়ে যাবার পরে তোড়া রুমে প্রবেশ করলো।

তোড়া ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলো।তারপর পায়ে পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।

কুশান তোড়াকে দেখে একদম হা হয়ে গেলো।সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তোড়ার দিকে দেখছিলো। অল্প একটু সেজেছে তোড়া—মাঝখানে সিথি করে একটা খোপা করেছে,চোখে কাজল দিয়েছে, হালকা গোলাপি লিপিস্টিক দিয়ে ঠোঁট ও রাঙিয়েছে। ফর্সা, সুন্দর মুখটা—এই সামান্য সাজটুকুর জন্যে আরও সুন্দর লাগছে।

কুশান এই প্রথমবার তোড়াকে নিজের ইচ্ছায় এমন করে পরিপাটি করে সাজতে দেখলো।তোড়াকে দেখামাত্র কুশান তীব্র ভালবাসা অনুভব হতে লাগলো।সোনালি কালারের পাড় আর নীল কালারের শাড়ি পড়ে আছে তোড়া—সোনালি পাড়ের সাথে ম্যাচিং করে সোনালি কালারের ব্লাউজ ও পড়েছে। আঁচলটা দু বার করে বুকের ওপর সাজানো।

কুশান তোড়ার এমন সৌন্দর্য এবং আকর্ষণীয় রুপ দু চোখ ভরে দেখছিলো।তোড়া যে ধীরে ধীরে কুশানের মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করছে তা সে বুঝতে পারছে।

এতোদিন তোড়া যেমন আচরণ ই করুক না কেনো তবুও কখনো কুশান তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি।সে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসার চেষ্টা করেছে।
আর কুশান এটা ভালো করেই জানে তোড়া কথায় কথায় রেগে গেলেও সে সবচেয়ে বেশি আবেগি মানুষ। কারন রাগি মানুষদের মন ভেতর থেকে ভীষণ নরম প্রকৃতির হয়। তোড়া হুটহাট রেগে গেলেও কিছুক্ষন পরে আবার সেই ঠান্ডা চুপচাপ হয়ে যায়।
তোড়া যখন রেগে যায় তখন মনের অজান্তেই অনেক কড়া কড়া কথা বলে ফেলে কিন্তু রাগ কমার পর কষ্টটা সেই বেশি পায়।

তবে কুশান আরেক টা জিনিস খেয়াল করেছে তোড়া যার তার উপর রেগে যায় না।শুধুমাত্র তার সাথেই এতো টা রাগ দেখায়।বাকি সবার সাথে কত নরমাল ভাবে কথা বলে মনেই হয় না এই মেয়েই তার সেই রাগী বউ।আসলে মেয়েরা সবচেয়ে যাকে বেশি ভালোবাসে তার উপরই রাগটা দেখায়। হুটহাট রেগে যাওয়া মানুষ গুলো আসলেই মন থেকে ভালো হয়।
এখন তোড়াকে একজন পারফেক্ট বউ ই মনে হচ্ছে কুশানের।

কুশান আর এভাবে খাটে বসে থাকতে পারলো না।খাট থেকে নেমে পড়ে তোড়াকে তার কাছে টেনে নিলো।তোড়ার নরম এবং পরিপূর্ণ রূপ লাবণ্যের শরীরটাকে নিজের বুকে শক্ত করে চেপে ধরে মৃদু এবং গভীর গলায় ডেকে বললো,তোড়া?ব্যাপার কি?আমাকে মেরে ফেলতে চাও নাকি?

তোড়া কুশানের মুখে এরকম আবেগঘন ডাক শুনে কুশানের দিকে মুখ তুলে তাকালো।তোড়ার এমন চাহনি দেখেই কুশানের সমস্ত ভালোবাসা যেনো আগ্নেয়গিরি থেকে ছুটে বেরোল লাভার মত—ও এখন আর একটুও অপেক্ষা করতে পারলো না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here