আরশি পর্ব ১২+১৩

#আরশি
#Part_12
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— তুমি মিস মুকুর না?

কথাটা শুনার সাথে সাথে ফুঁসে উঠি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই সাদমানের দিকে। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলি,

— ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু কল মি এট দিস নেম। আমি কোন মুকুর টুকুর না। আমি আরশি!

সাদমান চোখ বড়বড় করে তাকায়। অতঃপর দাঁত কেলিয়ে বলে,

— মানতে হবে আমার দৃষ্টি শক্তি খুব প্রখর। বাজের চেয়েও সুক্ষ্ম। এক দেখাই চিনে ফেললাম তোমায়। উফফ! সাদ আ’ম প্রাউড অফ ইউ।

আমি সাদমানের উদ্ভট কথা শুনে আড়চোখে তাকাই। সাদমান মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বলে,

— তা মিস মুকুর থুরি আরশি এতদিন পর কোথ থেকে? ডিইউ এর ফিন্যান্স সেক্টরের মনিটার আজ আমার জুনিয়র আদৌ ভাবা যায়?

আমি ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— তোমার আমাকে মনে আছে? বাট হাও? আমি তো ডিইউতে শুধু মাত্র এক বছর পড়েছিলাম।

— বন্ধুকেও ভুলা যায় বাট দুশমনকে না। আর তুমি তো আমার প্রাণ প্রিয় দুশমন ছিলে সেই কালে। তোমাকে কিভাবে ভুলি বলো?

— না ভুললে নাই। দ্যাট ইজ নোট মাই প্রবলেম।

সাদমান থুতনিতে হাত রেখে বলে,

— ডোন্ট ওয়ারি মিস মুকুর। এখন প্রবলেম না হলেও পরে হবে।

এই বলে দাঁত কেলায় সে। সাথে সাথে আমি পুনরায় ফুঁসে উঠি। কড়া গলায় বলি,

— বলেছি না আমাকে মুকুর ডাকবে না। আই জাস্ট হেট দিস নেম।

— ওকে ওকে কুল৷ ডাকবো না মুকুর। তা এর আপডেট ভার্সনটা ডাকি। তো কেমন আছেন মিস দর্পণ?

আমি দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রই। এই ব্যক্তিকে এখন অসহ্য লাগছে। সাদমান তা দেখে বলে,

— অহ কথা বলবেন না? ওকে দ্যান! তো এখন চলো তোমায় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তারপর তোমাকে আবার কাজ বুঝাতে হবে। উফফ!! কত কাজ। চলো!চলো!

এই বলে সাদমান আগে আগে চলে যায়। আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে নিজেকে বকতে শুরু করি,

— কোন দুঃখে যে আজ নিকাবটা পড়লাম না? নিকাবটা পড়লে এটলিস্ট আজ এই পাগলের হাত থেকে বেঁচে যেতাম। এখন না জানি এই পাগল কি করে।

মনে মনে এইসব বলতে বলতে সাদমানের পিছন পিছন চলে যাই। সিড়ি বেয়ে উপরের ফ্লোরে এসে পড়ি আমরা। উপরে আসতেই দেখি বিশাল বড় এক ফ্লোর। সকলের জন্য আলাদা আলাদা ডেস্ক বসানো। ভিতরের দিকে দুইটা কেবিন। বা পাশের দিকে প্রিন্টআউট মেশিন আর ফটোকপি মেশিন। এর থেকে খানিকটা দূরে কফি মেশিন আর পানির ফিল্টার রাখা। বেশ পরিপাটি সব কিছু। আমি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সাদমানের পিছে গিয়ে দাঁড়াই৷ সাদমান গলা ঝেড়ে বলে,

— এটেনশান গাইস!

সবাই সাদমানের দিকে তাকাই সাদমান স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

— উই হ্যাভ এ নিউ মেম্বার ইন আওয়ার সেকশন। মিট হার! হার নেম ইজ আরশি।

সাদমানের কথা শুনে আমার দিকে তাকায়। সকলের নজর আমার উপর এসে স্থির হতেই আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। আমি অস্ফুটে সুরে বলে উঠি,

— আসসালামু আলাইকুম!

সকলেই হাসি মুখে আমার সালাম গ্রহণ করেন। অতঃপর কয়েকজন বলে উঠে,

— সাদ স্যার! এনি কি আমাদের জুনিয়র নাকি সিনিয়র?

সাদমান বলে,

— তোমাদের জুনিয়র সে৷ সো তোমরা সকলেই একে কাজে সাহায্য করবে কেমন। না করলে তোমাদের আমি ক্লাস নিব।

পাশ থেকে একজন বলে উঠে,

— ক্লাসে খাবার পাবো তো সাদ স্যার?

সাদমান সুরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

— হ্যাঁ পাবে তো। খাবার হিসাবে বেতের বারি।

— বাহ! বেশ মজার খাবার তো৷ ইয়াম!

কথা বলার পর পরই হাসির রোল পড়ে যায়। এদের আচরণ দেখে যতটুকু বুঝতে পারলাম এরা একে অপরের সাথে বেশ ফ্রি। সাদমান এইবার সকলকে থামিয়ে বলে,

— অনেক হলো। এইবার একেক করে সবাই এর সাথে পরিচয় হয়ে নাও। আমি কেবিনে আছি। ইলমি শুনো! পরিচয় পর্ব শেষ হলে একে আমার কেবিনে দিয়ে এসো।

ইমলি নামের মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে বলে,

— জ্বী আচ্ছা স্যার।

এরপর সাদমান আর এক মূহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়। অতঃপর একেক করে আমি সকলের সাথে পরিচয় হয়ে নেই। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই ইলমি নামের মেয়েটি আমায় সাদমানের কেবিনে নিয়ে যায়। আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে সে চলে যায়। সাদমান চেয়ারে বসে কাজ করছে। আমি ওর সামনে যেতেই সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়। অতঃপর বলে উঠে,

— মিস দর্পণ বসো।

আমি কিছু না বলে পড়ি। সাদমান এইবার বলতে শুরু করে,

— এইখানে কিছু রুলস এন্ড রেলুগেশন আছে। তোমাকে সেগুলো মানতে হবে। এর বাদে নরমাল যে বিষয়গুলো হচ্ছে তা আমরা এইখানে সকলে বেশ ফ্রি। সকলেই সকলের সাথে বন্ধুসলুভ আচরণ করি। অফিসে সবাই আমাকে সাদ স্যার বলে তো তুমিও তাই বলবে। আর অফিসেত বাইরে এত ফরমাল হতে হবে না। সাদ বললেই হবে।

আমি ছোট করে বলি,

— হুম।

— আর হ্যাঁ তখন এর কথা গুলো ধরতে হবে না। ওইগুলো এইভাবেই ফাজলামো করে বলেছিলাম তোমাকে ফ্রি করার জন্য। তুমি বেশ নার্ভাস লাগছিলে তাই এমন করা। ডোন্ট ওয়ারি।

সাদের কথা শুনে আমি এইবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।

— বাট বাট তোমার নাম মিস দর্পণই থাকবে। ইহা চেঞ্জ হবে না। শেয়ার বাজারে ধস নামতেও না।

আমি সাদমানের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেই। সাদমান এইবার বুঝে যে আমি টোটালি ফ্রি হয়ে গিয়েছি। তাই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে শুরু করে।

_________________________________________________

রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি। বাসার কাছেই এক মোড়ে সাংঘাতিক জ্যাম লেগেছে। ঘন্টা দুই-এক এর আগে মেবি ছুটবেও না। তাই খামাখা সেখানে বসে থাকার মানেই হয় না। সকাল বেলা সূয্যিমামা যেই উত্তাপ নিয়ে হাজির হয়েছিল তা এখন আর নেই। বরং পুরো আকাশের কোথাও নেই। তার বদলে আছে ঘন কালো মেঘ। চারদিকে বইছে ঝিরিঝিরি বাতাস। বাতাসের বুকে ঘূর্ণিপাকের মত করে এক জোড়া চড়ুই ছুটাছুটি করছে। কোথ থেকে যেন বেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে এসে বারি খাচ্ছে নাকের ডগায়। আমি চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখি রাস্তার ধার ঘেষে একটি ভ্যান দাঁড় করানো আছে। সেই ভ্যানেই বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ রাখা। হয়তো তার মধ্যে একটা বেলিফুলের চারা আছে। আর তাতেই ফুটে উঠেছে সদ্যজাত কচি বেলিফুল। তারই ঘ্রাণে এখন চারদিকটা মেতে উঠেছে। আমি আকাশের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম হয়তো আজ বৃষ্টি হবে। অতঃপর মনে করার চেষ্টা করলাম। বাংলা মাসে এইটা যেন কোন মাস। বেশ কিছুক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করার পর মনে পড়লো এইটা আষাঢ় মাস। তাহলে কি এইটা আষাঢ় মাসের প্রথম বৃষ্টি।
বৃষ্টিটা সকলের প্রিয় না হলেও আষাঢ় মাসের প্রথম বৃষ্টিটা বেশিরভাগ সকলেরই প্রিয়। সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে সদ্য পা রাখা কিশোরীদের জন্য। তাদের কাছে এই বৃষ্টি মানেই ভালো লাগার ছোঁয়া। বৃষ্টি দেখলেই তাদের চঞ্চল মন খুশিতে নেচে উঠে। বদ্ধ ঘরে আর তাদের মন স্থির থাকে না। ছুটে চলে যায় বর্ষণের ধারার নিচে, মাখিয়ে নেয় নিজেকে তার রঙ্গে। আজ কেন যেন আমারও মন কেন যেন এই বর্ষণের ধারায় নিজেকে রাঙ্গাতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে জানি না। কিন্তু বড্ড ইচ্ছে করছে। ইশশ! এখন যদি বৃষ্টিটা নামতো।
কথাটা বলতেই বলতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় আর আমার পা স্থির। আমার আশেপাশে সকলেই ইতি মধ্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করে দিয়েছে। অনেকে আবার আমার মতই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশায় থাকা কিছু যাত্রী হুট উঠাচ্ছে তো কেউ নামাচ্ছে। পথচারী বাচ্চারা নেমেছে রাস্তায়। তাদের মুখে প্রাণবন্ত ঝুলন্ত হাসি। আমি চোখ বন্ধ করে আকাশের পানে চাই। বৃষ্টির ধারা আমার মুখমন্ডল ছুঁয়ে দিতেই আমি শিউরে উঠি। মনের মাঝে থাকা সুপ্ত কষ্ট গুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। ইতিমধ্যে চোখের কার্নিশ দিয়ে সেগুলো উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর স্বচ্ছজলের সাথে ধীরে ধীরে নোনাজলের সংমিশ্রণ হতে শুরু করে। তখনই মনের মাঝে চিৎকার করে বৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলে উঠি,

— এই বর্ষণ! তুই নাকি অনেক প্রভাবশালী রে? তুই নাকি সকলের কষ্ট-গ্লানি ধুয়ে দিতে পারিস।হাজারো মানুষের জীবনের কাব্য-রচনা রচে দিতে পারিস। তা আমারটাও দে না।
এই বর্ষণ! আমাকে ছুঁয়ে তোরই মত শীতল করে দিয়ে যা। তুই যেমন স্বচ্ছ আমাকেও তেমন স্বচ্ছ বানিয়ে দে। সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে নিয়ে যা। রাস্তার ময়লার মত আমার অতীতের সকল কালো ছাপ ভাসিয়ে নিয়ে যা। কাল বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবের মত কালো স্মৃতিগুলো লণ্ডভণ্ড করে দে। নতুন করে গড়ে দে আমায়। বর্ষণের শেষে সূর্যের প্রথম তেজ হতে দে আমায়। দিবি কি আমায়? বল না?
এই বর্ষণ! তুই কি শুনছিস আমার কথা? এই বর্ষণ!
#আরশি
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

তপ্ত দুপুরের তীক্ষ্ণ রোদ্দুরে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে চারদিকে। গাছে গাছে ফুটে উঠেছে হরেক রকমের মুকুল। ফল বিশিষ্ট গাছে ছড়িয়ে পড়েছে ফলের বাহার। গাছের ফাঁক-ফুঁকুর দিয়ে উঁকি মারছে এক ফালি রোদ। কয়েক’শ ভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভূ-পৃষ্ঠের বুকে। ঘাসফুলের উপর রোদের টুকরো পড়তেই তারা
যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। দূর আকাশ থেকে কোন এক পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে কর্কশ কন্ঠে কাক পাখির ডাকটি। চারদিকে ভ্যাপ্সা গরমের উত্তাপ। উত্তাপ সইতে না পেরে কোন এক কুকুর রাস্তার ধারে করে উঠছে আর্তনাদ। ধীরে ধীরে পথচারীদের দেখা সাক্ষাৎ কমে আসছে। ফাঁকা হয়ে আসছে রাস্তা।
এই অসহ্য এক তপ্ত দুপুরেই ঘামযুক্ত শরীর নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদ। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দরজার তালাটা খুলার চেষ্টা করছে কিন্তু খুলতে পারছে না। যার জন্য মিনিট কয়েক এর মধ্যেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সজোরে লাথি বসিয়ে দেয় দরজায়। অতঃপর নিজেকে শান্ত করে আবার তালা খুলার জন্য প্রয়াস করতে থাকে। একসময় সে সফলও হয়ে যায়। তালা খুলে যেতেই সে গটগট করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ড্রয়িং রুমে এসেই আগে সে পূর্ণবেগবানে ফ্যানটি ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে জমে থাকা ধুলোবালি গুলো উড়ে এসে বারি খায় তার মুখে। কেশে উঠে সে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। জানালা খুলে দিয়ে চলে যায় সোফার দিকে। ধপ করে বসে পড়ে। মূহুর্তেই ইন করা শার্টটি ছেড়ে দেয় আর গলার ঠিক নিচে দুই-তিনটি বোতাম উন্মুক্ত করে দেয়। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয় সোফায়। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সে, মাথা তুলে বসে। চারদিকটা একবার সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। সকল আসবাবপত্র ধুলোবালির স্তুপ জমে গিয়েছে। গুমোট ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে। দেড়-দু মাস হবে সে এই বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় এসেছে। এর মাঝে একবারও এইখানে আসা হয়নি। এর প্রমাণ সেই তালাটা। নাড়াচাড়া না পড়ায় সে শক্ত হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তার আজও আশা হতো না যদি তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এইখানে থাকতো। সব নেওয়া হলেও সেই ফাইলগুলো আর নেওয়া হয় নি। এইখানেই রয়ে যায়। এখন সেগুলো লাগবে বলেই এইখানে আসা।

ফাহাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চলে যায় নিজের রুমের দিকে। রুমে আসতেই সে কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে যায়। বুকের বা পাশটা লাফিয়ে উঠে। মনের মাঝে দ্বিধাবোধটা ধপ করে জেগে উঠে। কোন এক শূন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু কিসের এই শূন্যতা তা তার জানা নেই। সে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়। বিছানার চাদরটা কুঁচকে আছে। তার উপর রাখা কাঁথাটাও এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। বিছানার পাশে থাকা সাইড টেবিলে সেই অর্ধেক খাওয়া পানির গ্লাস এখনো বিধ্যমান। তার মধ্যে কয়েকটা পোকা মৃত অবস্থায় ভাসছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা সাজসজ্জার জিনিস গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সবকিছুতেই ধুলোবালির স্তুপ পড়ে একাকার। মেঝেতে পড়ে আছে কিছু কাগজ আর দুই একটা মেয়েলী পোশাক। ফাহাদের আর বুঝতে দেরি নেই পোশাকটা কার। সে নাক ছিটকে বিরবির করে বলে,

— ইশশ! কি হাল রুমের। আরশি থাকলে কখনোই রুমের এই রকম বীভৎসকর অবস্থা হতো না।

কথা বলা মাত্রই সে চমকে উঠে। নিজেই নিজেকে বলে উঠে,

— হুট করে আরশির কথা কেন মনে পড়লো আমার? ওর কথা তো আমার মনে পড়ার নয়। তাহলে?

কথাটা শেষ হতেই বারান্দায় নজর যেতেই সে দেখে সেখানে থাকা সকল গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে একদন মারা গিয়েছে। তা দেখে ফাহাদ আপন মনে বলে উঠে,

— কত বার বলেছি এইসব জঙ্গলি-ফঙ্গলি বাসায় রাখতে না। তাও মেয়েটা শুনে না। অসহ্য!

নিজের বলা কথায় ফাহাদ পুনরায় চমকে উঠে। তার বুঝতে দেরি নেই তার মস্তিষ্ক আরশিকে নিয়ে খেলা করছে। আরশির প্রতি তার করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবহারগুলো সে পুনরাবৃত্তি করছে। তাই ফাহাদ এইসব তোয়াক্কা না করে আলমারির দিকে চলে যায়। চাবি দিয়ে আলমারি দ্বিতীয় পাল্লা খুলে সে ভিতরের ছোট ড্রয়ারটি খুলে। খুলার সাথে সাথে সে থমকে যায়। চোখগুলো আপনা-আপনি বড় হয়ে আসে। কেন না ভিতরে আরশির সব গহনা-গাটি পড়ে আছে। সাথেই কিছু ক্যাশ৷ ফাহাদ অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে,

— আজব মেয়ে তো! নিজের গহনা-গাটি কিছু নেই। আর না ক্যাশ নিয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম সব নিয়ে গিয়েছে।

কথাটা বলতেই বলতে পাশের দিকে থাকা একটা দুই ভাজের কাগজের দিকে নজর যায় তার। ফাহাদ সেটা হাতে তুলে নেয়। কাগজের ভাজ খুলতেই সে বুঝতে পারে এইটা আরশির চিঠি। চিঠি ঠিকই কিন্তু সাধারণ চিঠিপত্র এর মত দীর্ঘ না। তিন-চার লাইনে লেখা। ফাহাদ পড়তে শুরু করে,

” বিয়ের সময় বাবা এইগুলো আমাকে দেওয়ার জন্য বানায় নি। বরং তোমাদের দেওয়ার জন্য বানিয়েছিল। তাই এতে আমার অধিকার নি। যার অধিকার আছে তাকেই দিয়ে গেলাম। শুধু একটা চেইন নিয়ে গেলাম যেটা নাকি আমার মা আমার জন্য বানিয়েছিল। যেটা আমার আধিকার।”

কথাটা যেন ফাহাদের বুকে তীরের মত লাগলো। রাগে অপমানে সে ফুঁসে উঠে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও আরশি যে তাকে পরোক্ষভাবে অপমান করেছে তা আর তার বুঝতে দেরি নেই। ফাহাদ সেই কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে মারে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

— সাহস তো কম না। আমাকে! ফাহাদকে সে অপমান করে। সামনে পেলে পিটিয়ে ছাল উঠিয়া ফেলতাম। অসভ্য মেয়ে একটা।

কথা বলেই সে ধুম করে ড্রয়ার লাগিয়ে দেয়। রাগে উপরে ভাজ করা কিছু কাপড় টেনে মেঝেতে ফালিয়ে দেয়। তখনই সেখান থেকে কয়েকটা ছবি টুপ করে নিচে পড়ে যায়। ফাহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকাতেই দেখে ছোট অহনার কিছু ছবি। সাথেই সেখানে তার আর আরশির কিছু ছবিও রয়েছে। ফাহাদ সেইদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কি মনে যেন ছবিগুলো তুলে নেয়। হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। অহনার সদ্য নিজের পায়ের দাঁড়ানো এক ছবি। মাথায় ছোট ছোট ছাটা চুল। চোখে মায়া ভরা। সে তার ইদুরের মত ছোট ছোট দাঁত বের হাসছে। যার জন্য গালের দিকে গর্ত হয়ে আছে। ফাহাদ অবাক হয়ে বলে,

— অহনার গালে টোল পড়তো? কই আমি তো কখনো দেখলাম না। স্ট্রেঞ্জ!

ফাহাদ বাকি ছবিগুলোও দেখতে থাকে। অতঃপর শেষের ছবিটাতে তার নজর আটকে যায়। তার আর আরশির ছবি। বিয়ের কয়েকমাসের ব্যবধানেই ছবিটা তুলা হয়েছিল। কতটা প্রাণবন্ত লাগছে আরশিকে। কি মিষ্টি তার হাসি। এই হাসি যেন কাব্য-উপন্যাসের লেখা সর্বনাশী হাসি। যার এক ঝলক এই যথেষ্ট কাউরো সর্বনাশ ডেকে আনার। কোমড় অব্দি চুলগুলো তার বাতাসে ছুটাছুটি করছে। হরিণীটানা চোখে কালো কাজলের ছড়াছড়ি। সাথেই তাতে লুকিয়ে আছে একরাশ চঞ্চলতা। গালে কেমন লাল আভা ছড়িয়েআছে। একবার এই মুখপানে তাকালেই চোখ ফিরানো দায়। অথচ এখন আর সেই চঞ্চলতার কিছুই নেই। নেই মুখে সেই মিষ্টি হাসি। নেতিয়ে গেছে মুখ। ভেঙ্গেছে চেহেরার গঠন। ফাহাদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আনমনে ভাবছে,

— আরশি কি আদৌ এত সুন্দর ছিল নাকি আজ হঠাৎ দেখছি বলে এমন লাগছে। কই আগে তো তার এই সৌন্দর্য চোখে পড়ে নি। কেন পড়ে নি?

অতঃপর ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,

— উত্তরটা তো আমার জানাই৷ আমি তো কখনো আরশিকে ভালো মত দেখি এই নি৷ না নিয়েছি যত্ন। জীদের বসে বিয়েটা করেছিলাম ঠিকই কিন্তু মেনে নিতে পারি নি। দায়িত্ব নিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু বোঝা মনে করে। আদৌ কি আমি ওকে ভালবেসেছিলাম? উঁহু! বাসি নি। যেখানে আমার ওকে সহ্যই হতো না সেখানে ভালবাসা নিছক স্বপ্ন। অধিকার খাটিয়েছি ঠিকই কিন্তু তাকে অধিকার দেই নি। আরশি হয়তো কখনো বুঝেই নি যে আমি ওকে কখনো স্ত্রীর অধিকার দেইনি।

এই বলে ফাহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। অতঃপর ভাবলো,

— আচ্ছা এই কয়েক মাসে তো একটি বারের জন্যও আরশির কথা মনে পড়েনি তাহলে আজ কেন এমন হচ্ছে? শুধুমাত্র এইখানে আরশির স্মৃতি আছে বলে কি? দেয়ালে দেয়ালে আরশির আর্তনাদ লুকিয়ে আছে বলে কি? আচ্ছা আমি কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছি ওর সাথে? আচ্ছা নিজের সন্তানও তো ছিল আমার। তাকেও তো অবজ্ঞা করেছিলাম আমি। সেটাও কি তাহলে অন্যায়?

পরক্ষণেই ফাহাদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

— না আমি কোন অন্যায় করি নি। আরশি নিজের কর্মেরই শাস্তি পেয়েছে। আমার বউ হওয়ার শাস্তি পেয়েছে সে। আর সেই শাস্তি এর ভাগিদারই হয়েছে তার মেয়ে। হ্যাঁ ঠিক তাই। আর এইভাবেও আমি এইসব নিয়ে ভাবছিই বা কেন? যে কাজে এসেছি তা করে জাস্ট এখন বেরুতে পারলেই বাঁচি। উফফ!!

এই বলে ফাহাদ ছবিগুলো দুই খন্ড করে ছুঁড়ে মারে। অতঃপর নিজের ফাইল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

______________________________________________

মিনিট দশেক ধরে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। কিন্তু বাস আসার নাম গন্ধ নেই। আকাশের আজও মেঘ জমেছে৷ দুপুর কি বিকেলের দিকে বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা বেশি। দামকা হাওয়া বইছে। আমি মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি ফাস্ট এট অফিস লেট হয় আমার। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর বাস আসে। সাথে সাথে শুরু হয় মানুষের ধাক্কাধাক্কি। অনেক কষ্টে বাসে উঠি। উঠে দেখি সব সিট বুক। কোথাও কোন খালি সিট নেই। বেশিরভাগ মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে পড়ে এখন অফিস টাইম। ভীড় হওয়া স্বাভাবিক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে উপরের হ্যান্ডাল ধরে দাঁড়িয়ে রই। বেশ কিছুক্ষণ পর অনুভব করি…..

#চলবে

গল্পটা কেমন হচ্ছে প্লিজ জানাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলে খুশি হবো৷
#চলবে

আরশি শব্দটির এই সমার্থক শব্দ হচ্ছে মুকুর। এমনকি আয়না,দর্পণও। অনেকেই হয়তো বিষয়টা জানেন না তাই জানিয়ে দেওয়া হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here