আরশি পর্ব ১০+১১

#আরশি
#Part_10
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

মামার বাসায় এসেছি আজ দু’দিন হতে চললো। মামা তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। তো তারই একরুমে আমার আর অহনার জায়গা হয়। অহনা প্রথম দিকে মন খারাপ করলেও পরে ঠিক হতে যায় আর মামার সাথে ভাবও জমিয়ে নেয়। মামাও প্রায় বেশির ভাগ ওর সাথেই এখন সময় কাটায়। এইখানে আসার পর মামা আমার আর অহনার জন্য কিছু নতুন জামা কিনে নিয়ে আসে। সাথে অহনার জন্য কিছু খেলনা আর চকলেট। সেসব দেখে অহনার খুশি আর দেখে কে? অহনার মুখে তখন হাসি দেখে নিজেও প্রশান্তির নিশ্বাস নেই। মামার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু মামা সেইসব আমলে নেয় না।
মামার পুরো নাম মেহেদী হাসান নীরব। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার নিজস্ব একটি বুটিক হাউজ আছে। সেটা মোটামুটি ভালোই চলে। যে টাকা আসে তাতে ফ্ল্যাট ও অন্যান্য ভাড়া-টাড়া দিয়ে তার বেশ চলে যায়। একা মানুষের খরচ তো আর বেশি নয়। আগে নানু তার সাথে থাকতো। নানা তার যৌবন কালেই মারা গিয়েছিল। সেই থেকে নানুই তার সঙ্গী ছিল। কয়েকবছর হলো নানু মারা গিয়েছে এরপর থেকে মামা পুরাই একা। একাকিত্ব নিয়েই কাটছে তার জীবন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। আকাশ আজ ধূসর রঙে রাঙ্গা। আবছা আবছা লাগছে সব। মৃদু মৃদু বায়ু বইছে। বায়ুর সাথে তাল মিলিয়ে স্বল্প পরিমাণে দোল খাচ্ছে গাছে কচি পাতাগুলো। জানালার কার্নিশে এসে চুপটি করে বসে আছে এক জোড়া শালিক। বেশ অদ্ভুত যেন তাদের চাহনি। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে তাদের দেখছি। তাদের চাহনি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছি। হুট করে চারদিকে আসরের আজানের ধ্বনি প্রতিফলিত হতে শুরু। আজানের ধ্বনি শুনতেই জোড়া শালিকটি উড়াল দেয়। সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট ছোট চোখে তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রই। অতঃপর দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে মাথায় ওড়না টেনে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাই। অহনা ঠোঁট উল্টিয়ে এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি অহনার একটু সামনে গিয়ে ওকে ঠিক করে শুয়ে দেই। কপালে ছোট এক চুমু একে দিয়ে উঠে দাঁড়াই। ওযু করে এসে আসরের নামাজটা আদায় করে নেই। নামাজ পড়া শেষে হিজাবটা খুলতে যাব তখন বেল বেজে উঠে। বেল বাজার শব্দ কানে আসতেই আমি দরজার দিকে চলে যাই। দরজা খুলতেই মামার হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠে। মসজিদ হতে নামাজ আদায় করে আসলো সে। আমি তাকে সালাম দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াই। মামা সালামের জবাব দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েন। হাতে তার ঝুলন্ত ব্যাগ। আমিও দরজা দিয়ে তার পিছু নেই। মামা ডাইনিং টেবিলে ব্যাগটি রেখে নিজের মাথার টুপিটা খুলে ফেলেন। টুপিটা নিজের পকেটে ভরতে ভরতে বললেন,

— মসজিদের বাইরে ভালো মানের ফজলি আম পেলাম। তাই নিয়ে এলাম। তোর তো আবার আম অনেক প্রিয়।

— তোমার মনে আছে? সে তো অনেক আগের কথা।

— অভিভাবকরা কখনোই নিজের সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ ভুলতে পারে না। হোক সেটা পুরোনো আর নতুন। এখন যদি তোর পছন্দ পরিবর্তন হয় সেটা অন্য বিষয়।

শেষের কথাটা অভিমানী সুরেই বললেন। আমি তার কথা শুনে মুচকি হেসে বলি,

— মানুষটি যখন সেই একই আছে তাহলে পছন্দও সেই একই থাকবে, তাই না?

মামা মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যান। বেশকিছুক্ষণ আমি আম কেটে প্লেটে সাজিয়ে তার রুমে এসে হাজির হই। মামা ইজি চেয়ারে বসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লিখা “দূরবিন” উপন্যাসটি পড়ছে। আমি মুচকি হেসে প্লেটটা বিছানায় রেখে একটা ছোট মোরা নিয়ে তার সামনে রাখি। অতঃপর প্লেটটা হাতে নিয়ে সেটাতে বসে পড়ি আর প্লেটটা কোলে নিয়ে নেই। মামা আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইটা বন্ধ করে নিজের কোলে রেখে দিলেন। চোখে থাকা কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা হাত দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিলেন। চেহেরায় বয়সের ছাপ পড়েছে। চাপা রঙের চামড়ায় খানিকটা কুচকে এসেছে। মামা ভাজ পড়া গালে স্মিত হাসি উপহার দিতেই আমিও মিষ্টি হেসে তার দিকে প্লেটটা উঁচু করে ধরি। মামা এক টুকরো আম নিয়ে মুখে পুরে নেন। অতঃপর বলেন,

— কি রে কিছু বলবি? দেখে তো মনে হয় কিছু বলতে চাচ্ছিস। তা বলে ফেল।

আমি মামার কথা শুনে শুকনো গলায় ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নেই। অতঃপর চঞ্চল চোখে এইদিক সেদিক তাকাই। দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে বলি,

— আমি জব করতে চাই মামা।

আমার এই কথা শুনার পরও মামার মধ্যে আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। সে আগের ন্যায় শান্ত শিষ্টই আছে। সে আরেক টুকরো আম মুখে পুরে দিতে দিতে বলেন,

— কাউরো ঘাড়ে বোঝা হতে চাস না বলে কি জব করতে চাস নাকি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য জব করতে চাস? কোনটা?

মামার কথার ধাঁচ শুনে বুঝে যাই মামা কি বুঝাতে চাচ্ছে৷ আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— আগের ডিসিশনটা রাগ ও জীদের বসে নিয়েছিলাম। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বলে জব খুঁজতে যাই নি। বরং বোঝা নামক শব্দটি থেকে মুক্তি পেতে জব করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বলে জব করতে চাই। স্বাধীন হতে চাই। নিজের নাম গড়তে চাই না শুধু একটা কর্মরত জীবন পরিচালনা করতে চাই।

— তাহলে তো হলোই। আমি দেখছি ব্যাপারটা।

— আমি কিন্তু তোমার দোকানে জব চাই না। অন্য কোথাও চাই তাও নিজের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে।

— আচ্ছা তাই হবে। তুই চিন্তা করিস না। কিন্তু তোকে কিছু কথা বলার ছিল।

— হুম বলো।

মামা এক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,

— তোকে কিন্তু শক্ত হতে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। পাল্টা উত্তর যদি তুই দিতে না পারিস তাহলে মনে রাখবি তুই এই সমাজে টিকতে পারবি না। লোকনিন্দা তোকে টিকতে দিবে না। জবাব তোকে দিতেই হবে।
একটা কথা জানিস কি? ১৯৭৪ সালে যে বাংলাদেশে দূর্দশা দেখা গিয়েছিল তা এখন পর্যন্ত স্থায়ী। পরিস্থিতির দিক দিয়ে নয় মানসিক দিক দিয়ে। ১৯৭৪ সালের দূর্দশা ছিল সকলের চোখের স্পষ্ট। কিন্তু এখনকার দূর্দশা চোখের স্পষ্ট না। অনুভবে স্পর্শনীয়।
সময়ের সাথে সাথে যেমন সভ্যতায় আধুনিকতা এসেছে ঠিক তেমনেই দূর্দশায়ও আধুনিকতা এসেছে। বলতে গেলে আপডেট হয়েছে। আগের ন্যায় এখনকার তৎকালীন সমাজে পার্থক্য শুধু এতটুকুই এসেছে যে, আগের দূর্দশাগুলো মানুষের মধ্যে হাহাকার তৈরি করতো কিন্তু এখনকার দূর্দশাগুলো মানুষের মধ্যে নিম্নতম অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে না। বরং পরিস্থিতিটা এখন সকলের অবহেলার স্তূপের নিচে পড়ে গিয়েছে। এই যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে পথচারী শিশু, বাসস্থান ছাড়া থাকছে মানুষ, নারী ও পুরুষেরা হচ্ছে অপমানিত-লজ্জিত, ধর্ষিত হচ্ছে নারী, পুরুষরা করছে সমাজে টিকে থাকার যুদ্ধ, শক্ত হতে গিয়ে অনুভূতিহীন হচ্ছে পুরুষ, নিম্ন কর্মরত মানুষ হচ্ছে লাঞ্চিত, আগুনে পুড়ছে ঘর-বাড়ি, না খেয়ে মরছে হাজারো মানুষ। কিন্তু কই মানুষ তো একবারের জন্যও কষ্ট অনুভব করছে না। আর না এদের নিয়ে ভাবছে, না এদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারছিস তো কেন? সকলের মন-মানসিকতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যেখানে সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে অস্পষ্ট তার কাছে। সকল মানবই এখন এই দূর্দশায় ভুগছে। প্রত্যক্ষ ভাবে না পরোক্ষভাবে।

তাই স্বার্থের জন্য হোক বাঁচার জন্য হোক আওয়াজ উঁচু তোকে করতেই হবে। উত্তর তোকে দিতেই হবে৷ তুই যত চুপ থাকবি ততো তোকে তারা ঘিরে ধরবে বুঝলি।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আরেক টুকরো আম মুখে পুরে নিলেন। আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— তুমি তো বুঝদার কম নও। তাহলে নিজের ভালোটা কেন বুঝলে না? বিয়েটা কেন করলে না তুমি?

আমার কথাটা শুনার সাথে সাথে মামা চমকে উঠেন। সর্তক চোখে আমার দিকে তাকান। অতঃপর গলা ঝেড়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— কখনো নিজের স্বার্থের চেয়ে প্রতিশ্রুতি বড় হয়ে যায়। তখন চেয়েও সেটা ভাঙ্গা যায় না। পৃথিবীতে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি আছে যা চিরতরের জন্য অমর। জীবন্ত! তুই যখনই নিজের কথা ভাবতে যাবি তখনই সেই প্রতিশ্রুতি তোর চোখে সামনে ভেসে উঠবে আর তোকে দিশেহারা করে তুলবে। তখন তুই চেয়েও তা ভঙ্গ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবি না।

— উপন্যাস পড়ে পড়ে তোমার মধ্যেও রহস্য আর প্যাঁচ ঢুকে গিয়েছে।

— কথা ঘুরানো বেশ ভালোই শিখেছিস। তা যা রুমে যা। একটু পর মাগরিবের আজান দিবে। আর শুন! আজ আমায় আর ডাকিস না। একা থাকতে চাচ্ছি।

— সরি মামা! আমি আসলে তোমাকে…

— ধুর পাগলি। তুই যা ভাবছিস তা না। শুধু একটু একা থাকতে চাইছি আর কিছুই না। জানিস এই তো মাঝে মাঝে নিজেকেও সময় দেওয়া দরকার।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসি। জানি কিছু বলকেও কাজ হবে না। বরং ক্ষত বাড়বে। এর চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো। মামার রুম থেকে বের হয়ে আমি দরজা দিয়ে দেই। হঠাৎ চারদিকে আজানের মিষ্টি ধ্বনি এসে কানে বারি খায়।

____________________________________________

দেখতেই দেখতে প্রায় ১ সপ্তাহ কেটে গেল। দিন গুলো কিভাবে যে এত দ্রুত চলে গেল বুঝাই গেল না। সকালে আমি, অহনা ও মামা নাস্তা করছি। নাস্তা যখন প্রায় শেষের দিকে তখন মামা বলে,

— আরশি শুন!

আমি খাওয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে মামার দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকালাম। মামা আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে,

— তোর জবের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।
#আরশি
#Part_11
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— তোর জবের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। নিভু নিভু আলো জ্বলে উঠে মনের দুয়ারে। আমি আশাবাদী দৃষ্টিতে মামার দিকে তাকাই। মামা গলা ঝেড়ে বলেন,

— এ আর কোম্পানির এমডি মি. শরিফ আমার চেনা জানা। তাকে বলেছিলাম যে যদি কোন চাকরির খোঁজ সে পায় তাহলে জানাতে। গত পরশুদিন রাতেই সে ফোন করে জানালো যে তার কোম্পানিতে একজন এমপ্লয়ি লাগবে। ফিন্যান্স সেক্টরে। আর তুই তো ফিন্যান্স সাবজেক্টটা নিয়েই পড়েছিস। এখন তুই যদি রাজি থাকিস তাহলে শনিবার সকাল দশটার দিকে নিজের সব কাগজপত্র নিয়ে সেই অফিসে তার সাথে দেখা করতে যাবি। যদি তার মনে হয় তুই জবের জন্য উপযুক্ত তাহলে তোকে হায়ার করা হবে অথবা না।

— সেটা তো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি।এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া চাকরি দিবে?

— আমার সাথে কানেকশন আছে বলে বিবেচনা করবে হয়তো বা। যেহেতু তুই নিজের যোগ্যতায় জব পেতে চাচ্ছিস সেহেতু আমি এখনো সুপারিশ করি নি৷ অবশ্য আমি নিজেও সুপারিশ করতে ইচ্ছুক নই।

আমি মামার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাতেই মামা খাওয়ায় মন দেয়। সে বরাবরই আমার এমন চাহনি উপেক্ষা করে। কেন করে তার উত্তর সঠিক আমার জানা নেই। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে খাওয়ায় মন দেই। তখন মামা পুনরায় বলে উঠে,

— কম্পিউটার চালানো মনে আছে তো? ইন্টার শেষে তো কোর্স করেছিলি।

— হাল্কা পাতলা মনে আছে। কিন্তু পুরো পুরি ভাবে না।

— তাহলে এই কয়েকদিনে আমার কাছ থেকে শিখে নিস। জব যদি হয়ে যায় তাহলে কিন্তু তোকে বেশির ভাগ কাজ কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপেই করতে হবে।

— তোমার ল্যাপটপ আছে?

— থাকবে না কেন আজব?

— না মানে তুমি চালানো কবে শিখলে? আগে তো আমার সাথেই শিখতে বলেছিলাম শিখলে না তো তখন।

— সময়ের সাথে নিজেকে বদলাতে হয়। তারই সাথে বেশ কিছু জিনিস আয়েত্তেও আনতে হয়। আমার বুটিক হাউজের কিছু প্রডাক্ট দেশের বাইরে যায়। বেশির ভাগ কাজই তখন অনলাইনে করতে হয়। তো সেই জন্যই ল্যাপটপ চালানো শিখতে হয়েছিল। তখনই আরকি কিনা হয়ে যায়।

— ভালো তো।

— তুই কিন্তু নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করে দে।

— হুম।

____________________________________________

বিকেলের দিকে ল্যাপটপ চালানোটা আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা করছি৷ বেশ কিছু জিনিসই ভুলে গিয়েছি। অবশ্যই ভুলে যাওয়ার এই কথা। এসব কর্মকাণ্ড অনুশীলনে না থাকলে মনে রাখাটা দায় হয়ে যায়। সেখানে আমি কতটা বছর ধরে এইসবের ধারের কাছেও নেই। ভার্সিটি লেভেলে থাকতে বিভিন্ন এসাইনমেন্ট করার জন্য ল্যাপটপের প্রয়োজন হতো। তখন ফাহাদের কাছ থেকে ওর ল্যাপটপটা ধার নিতাম। ও সহজতর আমায় ওর ল্যাপটপ ধরতে দিত না। অনেক কষ্টে তাকে মানাতে হতো। সবসময় রাজীও হতো না। তখন ফ্রেন্ডকে দিয়েই নিজের এসাইনমেন্টগুলো করাতাম। সময়ের সাথে অবশ্য সেই ফ্রেন্ডগুলিও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।ঘন্টা খানিক আগেই মামা অহনাকে নিয়ে পার্কের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। অবশ্য এইটা রোজকার রুটিন। বিকেলে তার পার্কে গিয়ে খেলা চাই এই চাই। অভ্যাসটা অবশ্য মামা নিজেই করেছে৷
আমি মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ চালাচ্ছি এমন সময় জামায় টান পরে। আমি পাশে তাকাতেই দেখি অহনা ছোট ছোট চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে ও বোচা নাকের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ফর্সা গাল দুইটি টকটকে লাল হয়ে আছে। সুরু ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলছে। আমিও মিষ্টি হাসি দিয়ে ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে ওকে কোলে তুলে নেই। ওড়নাটা টেনে সামনে নিয়ে এসে অহনার কপালের ঘামটুকু মুছে দেই। স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— কি আমার মামনির খেলা হয়েছে বুঝি? নানুকে আজ বেশি জ্বালাও নেই তো?

— উঁহু! আমি কি কাউকে জ্বালাতে পারি? আমি না তোমার ভালো বেবি?

— হ্যাঁ তাই তো।

— আম্মি জানো আজ কি হয়েছে?

— তুমি না বললে আম্মি কিভাবে জানবে সোনা।

অহনা থুতনিতে হাত রেখে ভাবার অভিনয় করে বলে,

— তাও তো ঠিক। আচ্ছা তাহলে শুনো আমি এই বলছি। আজ না আমি চকলেট আঙ্কেলকে দেখেছি।

আমি অহনার কথাটা বুঝতে না পেরে বলি,

— কাকে দেখেছ?

— চকলেট আঙ্কেলকে।

আমি অহনার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাই। মনে করার চেষ্টা করি এই চকলেট আঙ্কেলটা কে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি না। আমি অস্ফুটে স্বরে জিজ্ঞেস করি,

— কার কথা বলছো তুমি মামনী?

— ওই যে পার্কে আমার পায়ে যে কাপড় বেঁধে দিয়েছিল।

অতঃপর আমার সেইদিনের কথা মনে পড়ে। কেউ একজন অহনার পায়ের ক্ষতস্থানে রুমাল বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সে কে ছিল তা আমার জানা হয় নি। তাই তার কথাটাও মাথা থেকে বেড়িয়ে যায়। আমি অহনার দিকে তাকিয়ে বলি,

— তারপর? তুমি কি গিয়ে কথা বলেছিলে?

— না আম্মি। আমি ডাক দেওয়ার আগেই সে চলে যায়। আর খুঁজে পাই নি আমি।

কথাটা বলে সে মন খারাপ করে বসে। আমি ওর কপালে চুমু একে বলি,

— তোমার কি তার সাথে কোন দরকার ছিল?

— হু!

আমি আর এই বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অহনাকে বলি,

— থাক পরের বার দেখা হলে কথা বলে নিও। আর তুমি তো দেখছি পুরো ঘেমে গিয়েছ। চল তোমায় চেঞ্জ করিয়ে ফ্রেশ করে দেই।

— তারপর আইস্ক্রিম খাব। পিলিজ!

— আচ্ছা খাবে। কিন্তু অল্প, তোমার না কয়েকদিন আগেই ঠান্ডা লেগেছিল।

— আচ্ছা।

কথাটা বলেই অহনা আমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বসে। অহনার এহেন কান্ডে আমি হেসে দেই।

__________________________________________________

সমুদ্র নীল আকাশের বুকে আজ শুভ্রময় মেঘের ছড়াছড়ি। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির। ইলেক্ট্রিক পোলের তারের উপর আলসে ভঙ্গিতে বসে আছে এক জোড়া কাক। আকার-ভঙ্গি এমন যে তারা যেন কোন বিষয়ে নিয়ে বেশ বিরক্ত। নিজের বিরক্ত প্রকাশ করার জন্য সে ক্ষণেকের মাঝেই বার বার কর্কশ কন্ঠে ডেকে উঠছে। ধীরে ধীরে রৌদ্র মামার উত্তাপ বেড়েই চলেছে। বাতাসের সাথে আজ ধুলোবালি মিলে একাকার। রাস্তায় শা শা শব্দ করে গাড়ি ও বাইক ছুটে চলেছে নিজের গন্তব্যে। পিছে ফেলে যাচ্ছে প্রকৃতির জন্য কিছু বিষাক্ত গ্যাস। বড় রাস্তার মোড়ে লেগেছে সিগন্যালের জ্যাম। অহেতুক হর্ণের আওয়াজে পরিবেশ হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। সিগন্যালের জ্যাম ছাড়তেই সকলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দীর্ঘ জ্যাম পেড়িয়ে অবশেষে আমি এসে পৌঁছালাম এ আর কোম্পানির বিল্ডিংয়ের নিচে। দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভিতরে।

ওয়েটিং রুমে বসে আছি ঘন্টা খানিক হলো। এমডি এর আসার কথা আরও ৩০ মিনিট আগে। অথচ এখনো তার আসার নাম গন্ধ নেই৷ এই হচ্ছে বাঙ্গালী এক স্বভাব। তারা কখনোই সময় নির্ধারণ করে সেই সময়ে আসতে পারবে না। নিয়মানুবর্তিতা যেন এদের ধরে বেঁধেও শিখানো যাবে না। আরও পাঁচ-দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর খবর আসলো যে এমডি স্যার এসেছেন। আমাকে তার কেবিনে যাওয়ার জন্য বলছেন। আমি এইবার বুক ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে মনে সাহস জুগিয়ে নেই৷ অতঃপর পা বাড়াই এমডি স্যারের রুমের দিকে।

এ আর কোম্পানির এমডি মি. শরিফের সামনে বসে আছি। অপর পাশের চেয়ারেই মি. শরিফ বসে আছেন আর সুক্ষ্ম চোখে আমার কাগজপত্রের দিকে চোখ বুলাচ্ছেন। ক্ষণে ক্ষণে নাকের ডগায় থাকা চিকন ফ্রেমের চশমাটি তিনি বা হাত দিয়ে ঠেলে দিচ্ছেন। চোখে মুখে তার বয়সের ছাপ স্পষ্ট। গালের নিচের দিকে হাল্কা চামড়া ঝুলে পড়েছে। রোদে পুড়ে যাওয়া হাতের চামড়াটিও কুচকে এসেছে। কিন্তু তাও বান বেশ ভালোই আছে। আপাতত পরিবেশটা বেশ থমথমে। মনের মধ্যে আমার কোন এক আশঙ্কা বাসা বাঁধছে। নার্ভাস ফিল হচ্ছে। যার ফলে গলাটা প্রায় শুকিয়ে আসছে। কেন এমন হচ্ছে জানি না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ঠিক এমন সময় মি. শরিফ গলা ঝেড়ে উঠেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তা মিস. আরশি। জবটি আপনাকে দেওয়া হবে কি না তা জানানোর আগে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আশা করি তাতে আপনার কোন প্রবলেম নেই।

প্রশ্নের কথা শুনেই আমার মনের মধ্যে থাকা আশঙ্কাটি দৃঢ় হয়ে আসে। মনের মধ্যে কু ডাকতে শুরু করে। বার বার এমন বোধ হতে থাকে, ‘তিনিও সকলের মত আমার ডিভোর্সি হওয়া নিয়েই প্রশ্ন করবেন।’ এমন ভাবনা মাথায় আসতেই আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— জ্বী নেই।

— আপনি এই জবটি কেন করতে চাইছেন? স্পেসিফিক কোন কারণ আছে কি?

মি. শরিফের প্রশ্ন শুনে আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস নেই। আমি যে ধারণা করছিলাম তা হয় নি। আমি এইবার স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— সকল নারী এই চায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে। অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে কিছু করতে। আত্মনির্ভরশীল একজন ব্যক্তি হতে। আমার বেলায় যে এর ব্যতিক্রম কিছু তা কিন্তু নয়। এসব ব্যতীত এই সমাজে একা বাস করা সহজ না। তাও আবার সিঙ্গেল মাদার হয়ে। অনেক স্ট্রাগল করতে তাদের। নিজের জন্য, নিজের সন্তানের জন্য। আমি নিজের জন্য না হলেও আমার মেয়ের জন্য আত্মনির্ভরশীল হতে চাই। সে যাতে মাথা উঁচু করে বলতে পারে সে কার মেয়ে। ওর যাতে কখনো মনে না হয় ওর বাবা নেই বলে তার মা অসহায়। বরং সবসময় এই ভাবনা পোষণ করুক যে তার বাবা ছাড়াই তার মা একশ।

— ইম্প্রেসিভ! আপনার চিন্তা-ভাবনা সত্যি অসাধারণ। আই এপ্রিশিয়েট ইউ। একটু আগেও আমার ভাবনা ছিল আপনি এই জবটির জন্য কোয়ালিফাইড না। বাট আপনার মধ্যে কিছু করার একটা জোস আছে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে যা সকলের চোখ জলসে দিতে সক্ষম। এই আত্মবিশ্বাসের উপরই আপনাকে একটা সুযোগ দেওয়া হলো। আপনাকে ২ সপ্তাহ অব্জার্ভার করা হবে। আপনি ঠিক কতটুকু এক্টিভ তা দেখা হবে। সেটার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আপনি আদৌ জবটির জন্য কোয়ালিফাইড কিনা।

— থ্যাংকস আ লোট স্যার।

— হুম! তা আপনি মি. সাদমান এর আন্ডারে থাকবেন। তিনি আপনাকে কাজ গুলো বুঝিয়ে দিবে। ওয়েট আ মিনিট।

এরপর মি. শরিফ কাউকে যেন ফোন করে নিজের কেবিনে আসতে বলেন। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই কেউ এসে দরজায় কড়া দেয়৷ দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,

— মে আই কাম ইন স্যার?

— ইয়েস কাম ইন।

মি. শরিফ পার্মিশন দিতেই সে ভিতরে চলে আসে। ভিতরে এসে সে বলে উঠে,

— আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?

— হ্যাঁ! মি. সাদমান এনি হচ্ছে মিস. মিশকাতুল আরা আরশি। এখন থেকে সে আপনার আন্ডারে কাজ করবে। আর মিস. আরশি এনি হচ্ছেন আমাদের কোম্পানির ফিন্যান্স ডিরেক্টর মি. মাহবুব হোসেন সাদমান।

আমি চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পাই একজন ফর্মাল ড্রেসাপে থাকা যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যুবক বলা ভুল হবে কি না জানি না। যুবক হতে বয়স একটু বেশি কিন্তু চেহেরায় সেটা স্পষ্ট নয়। আমি তার চেহারার দিকে তাকাতেই কয়েক মূহুর্তের জন্য থমকে যাই। কেন না এই মুখটি যে আমার চেনা। সামনে থাকা ব্যক্তিটি আমায় চিনতে পেরেছে কিনা জানি কিন্তু সেও এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এর মাঝেই মি. শরিফ বলে উঠেন,

— মি. সাদমান এনাকে সকল কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। আর মিস. আরশি আপনার কোন কিছু বুঝতে সমস্যা হলে এনাকে জিজ্ঞেস করবেন। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?

আমি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে মাথা দুলাই। সাদমান নামক ছেলেটিও মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,

— জ্বী স্যার।

— ওকে দ্যান। মি. সাদমান এনাকে আপনি নিয়ে যান। সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন আর কাজের ধরণটা বুঝিয়ে দিন। এন্ড ইউ মিস. আরশি, আপনি কালকে থেকে জয়েন করতে পারবেন। আজ আপাতত সকলের সাথে পরিচয় হোন আর কাজের ধরণটা বুঝে নিন। ইউ গাইস ক্যান মে লিভ নাও।

আমি পুনরায় মাথা দুলাই। সাদমানও সম্মতি জানিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। তার দেখাদেখি আমিও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসি। বেরিয়ে আসতেই দেখি সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু না বলে তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াই। তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অতঃপর হুট করে সে সন্দিহান সুরে বলে উঠে,

— তুমি মিস মুকুর না?

#চলবে

কালকে গল্প দিতে না পারার জন্য দুঃখিত। কালকে ফ্যামিলিগিত কিছু প্রবলেমের মধ্যে ছিলাম যার জন্য গল্প দিতে পারি নি। জানি অনেকেই গল্পের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন কিন্তু আমার দিকটাও একটু বুঝার চেষ্টা করবেন প্লিজ।
#চলবে

কাল বেশ মাথাব্যথা ছিল যার জন্য গল্প দিতে পারি নি। এর জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here