আরশি পর্ব ২+৩

#আরশি
#Part_02
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আরশি তুই?

ভাইয়া আমায় জড়িয়ে ধরতেই বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠে। কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে।গলার মধ্যে কান্নাগুলো জোটপাকিয়ে আসতে শুরু করে। নয়ন দুটিও কেমন জ্বালা পোড়া করতে শুরু করে। অনুভূতিগুলো আঁচড়ে পড়ে মনের ভিতরে। দূর্বল হয়ে পড়ছি আমি। হুট করে আমার সাথে এমন কেন হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। এতক্ষণ আমি এমন কিছু আমি অনুভব করি নি। বেশ শক্ত আর কঠোরই ছিলাম আমি। তাহলে এখন এমন কেন হচ্ছে? নিজেই নিজেকে প্রশ্নটি করলাম। অতঃপর ভাইয়ার কথা মনে হতেই মনে হলো অনুভূতিগুলো হয়েতো আপন কোন মানুষটির সামনেই নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে। সেও হয়তো বুঝে তুচ্ছ মানুষের সামনে অনুভূতি গুলো প্রকাশ করা মানেই তাকে গুরুত্ব দেওয়া আর নিজেকে দূর্বল প্রমাণিত করা। তাই তো সে কখনই কোন তুচ্ছ মানুষের সামনে বেড়িয়ে আসে না। কিন্তু আফসোস আমরা সেটা বুঝি না। বার বার আমরা সেই তুচ্ছ ব্যক্তিকেই জোর করে আমাদের অনুভূতিগুলো বুঝানোর বৃথা চেষ্টা করতে থাকি। অথচ আমরা বুঝি এই না অনুভূতিগুলো তার সামনে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছুক না।

ভাইয়ার আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পেতেই আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসি৷ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখি সে ঠোঁটের কোনে প্রশস্ত এক হাসি ঝুলিয়ে অহনার দিকে এগিয়ে যায়। অহনাকে নিজের কোলে নিয়ে ওর গালে ছোট একটা চুমু খেয়ে বলে,

— আমার মামনীটা কেমন আছে শুনি?

অহনা ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

— সবসময়ের মত অনেক ভালো মামু। তুমি কেমন আচো?

ভাইয়া মিষ্টি হেসে বলে,

— এতক্ষণ ভালো ছিলাম না কিন্তু এখন তো তুমি এসে গিয়েছ তাই না। আমি কি এখন ভালো না থেকে থাকতি পারি?

ভাইয়ার কথায় অহনা খিলখিল করে হেসে উঠে। অহনা হেসে উঠতেই আমি এক ধ্যানে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কতটা না উচ্ছ্বাস ভরা হাসিটা। ও হাসলে গালে টোল পড়ে যা ওর হাসিকে কয়েকগুণ মিষ্টি করে তুলে। এই হাসি যে কেউ দেখলে তার মন অনায়েসে ভালো হয়ে যাবে। ওকে কোলে নিয়ে আদর করতে চাইবে। ওর তুলতুলে গালে চুমু খেতে চাইবে। কিন্তু ফাহাদ হয়তো ওর এই হাসিটা কখনো দেখেই নি। দেখলে হয়তো কখনো ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না। ওই বাসায় থাকতে ও কখনো ফাহাদের সামনে হাসেই নি। ও তো সবসময় ফাহাদের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতো। এই বুঝি ও কোন শব্দ করলো আর ফাহাদ এসে ওকে বকে দিল। ফাহাদ চেঁচামেচি একদম পছন্দ করে না। যার ফলে অহনা ফাহাদের সামনে যখনই শব্দ করে খেলতো বা দুষ্টুমি করতো তখনই ফাহাদ ওকে বকে দিত। মাঝে মত হাত তুলতে গিয়েও তুলে না। আবার দুই একসময় হাত তুলেও ফেলতো। ফাহাদের ভয়ে অহনা ওর সামনে সবসময় চুপসে থাকতো। দরকার না পড়লে ওর সামনেও যেত না। ফাহাদও কখনো ওকে নিচ থেকে কাছে টেনে নেই নি। আদরমাখা কন্ঠে দুটো কথা বলে নি। আদৌ কি সে বাবা হওয়ার যোগ্য?

আমার ভাবনার মাঝেই ভাইয়া আনন্দমাখা কন্ঠে বলে উঠে,

— কিরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভিতরে আয়।

কথা বলে নিচে তাকাতেই তার নজরে পড়ে আমার হাতে থাকা সুটকেসটা। সাথে সাথে সে ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকায়। চেহেরায় তার চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। কিছু হয়তো আন্দাজও করতে পারছে। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— আয় ভিতরে আয়। জিনিয়া! এই জিনিয়া দেখ কে এসেছে।

ভাবীকে ডাকতে ডাকতে ভাইয়া ভিতরের দিকে যায়। আমি ধীর সুস্থে বাসায় ঢুকে দরজাটা দিয়ে দেই। অতঃপর ভাইয়ার পিছন পিছন সোফার রুমে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পারি ভাবী রান্নাঘর থেকে ওড়নার কোনে হাত মুচতে মুচতে এইদিকে আসছে। ভাইয়া অহনাকে নিয়ে সোফায় বসে পড়েছে। ভাবী দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই সে হাসি মুখে বলে উঠে,

— আরেহ আরশি তুমি?

আমি কিছু না বলে স্মিত হাসি। ভাবী আমার সামনে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,

— কেমন আছো তুমি?

প্রশ্নটি শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, “আসলেই আমি কেমন আছি? ভালো নাকি খারাপ?” শত চেষ্টা করেও উত্তরটা জানতে পারলাম না। অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— এইতো তুমি?

ভাবী আমায় ছেড়ে দিয়ে খুশি খুশি কন্ঠে বলে,

— আলহামদুলিল্লাহ! তা তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি চা করে আনছি।

আমি কিছু না বলে স্মিত হাসি। ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তা তুমি এইবার সময় নিয়ে এসেছ তো? এইবার কিন্তু তোমায় জলদি ছাড়ছি না। আজ কত বছর পর যে তুমি বাসায় এলে। এত জলদি যেতে দিব না তোমায়।

কথাটা তিনি সরল মনে বললেও কথাটি আমাকে তীরের মত আঘাত করে। হৃদয়টা যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। জোটপাকানো কান্নাগুলো আবার জীবন্ত হয়ে যায়। কন্ঠস্বর পুনরায় ভারী হয়ে আসে। আমি নিজেকে কোন মতে সামলে ভারী কন্ঠে বলি,

— এইবার অফুরন্ত সময় নিয়ে এসেছি ভাবী। এই সময়ের শেষ নেই। বলতে পারো একবারের জন্যই চলে এসেছি।

আমার কথা শুনে ভাবী চমকে উঠে। কপালে ভাঁজ পড়ে যায়। চিন্তার ভাঁজ নাকি বিষ্ময়ের ভাঁজ তা বুঝে উঠতে পারি নি। ভাইয়াও আমার কথা শুনে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার দৃষ্টিতে রয়েছে এক রাশ কৌতূহল। ভাবী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই ভাইয়া বলে উঠে,

— আরশি যা তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। অহনাকেও ফ্রেশ করিয়ে আন। বাকি কথা না হয় পড়েই হবে।

আমি কিছু না বলে সুটকেসের হ্যান্ডেলটা চেঁপে ধরি। অহনার দিকে তাকাতেই ও এক লাফে ভাইয়ার কোল থেকে নেমে পড়ে আর আমার দিকে ছুটে আসে। আমি ওর হাত ধরে আমার রুমের দিকে যেতে থাকি। এর মধ্যেই ভাবীর চাপা কন্ঠ কানে আসে। সে বলছে,

— আরিফ আমার না খুব ভয় করছে। আরশির সাথে খারাপ কিছু হয় নি তো? ওই ফাহ…

বাকিটা শ্রবণ করার আগেই আমি অহনাকে রুমে ঢুকে পড়ি। রুমে ঢুকেই একবার চোখ বুলিয়ে নেই। রুমটা সেই আগের মত নেই। বেশ খানিকটা বদলেছে। আগের পর্দার জায়গায় নতুন পর্দা এসেছে। ফার্নিচারের জায়গায় বদল হয়েছে। গুছানোর ধরনও বদলেছে। শুধু মাত্র একটা জিনিস বদলায় নি। আমার বুকশেলফের বইয়ের বিন্যাসটা। সেই আগের মতই আছে। যা দেখে মনের এক কোনে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। যাক কিছু তো একটা আছে যা দেখে নিজের বলে মনে হচ্ছে।

___________________________________________

বিছানার এক প্রান্তে বসে আছি। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে স্থির চোখে সামনে তাকিয়ে আছি। অপর প্রান্তেই ভাইয়া ভাবী বসে আছে। নিজেদের মধ্যেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। হয়তো কোন কথা থেকে শুরু করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। অহনা পাশের রুমে আদ্র এর সাথে খেলছে। আদ্র ভাইয়ার ছেলে। এইবার ৭ এ পা দিল। আমরা যখন এসেছি তখন ওয়াশরুমে ছিল যার জন্য জানতে পারে নি আমরা এসেছি। যখন জানলো অহনার সাথে খেলার আসর জমিয়ে দিল।

বেশকিছুক্ষণ পর নিরবতা পেরিয়ে ভাইয়া বলে উঠে,

— কি হয়েছে আরশি? ফাহাদ কি কোন ঝামেলা করেছে?

আমি একবার ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নেই। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কথাগুলো গলার মাঝে আটকে আসছে। স্বল্প পরিমাণে কষ্ট অনুভব করছি। কিন্তু কিসের কষ্ট জানি না। শুধু বলতে পারি এইটা বিচ্ছিন্নের কষ্ট নয়। অন্যকিছুর! তা এইটা সংসারের মায়া নাকি অন্যকিছু সেটা জানি না। আমি লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— ফাহাদ আর আমার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।

কথাটা শুনার সাথে সাথে ভাইয়া আর ভাবী আঁতকে উঠে। কথা বলার বাক্য হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু চোখ দুইটিতে পুরো কাহিনী জানার কৌতূহল রয়ে যায়। তা দেখে আমি তাদের পুরো ঘটনাটা খুলে বলি। হঠাৎ দুই চোখ বেয়ে পানি ঝড়তে শুরু করে। এই কান্না কিসের জানি না৷ শুধু বুঝছি চোখ দুটো বেশ জ্বালা করছে। একে শান্ত করতে হলেও এই পানিগুলো আমায় ঝড়াতে হবে। আমি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলি,

— অহনার কথা ভেবেই চুপ ছিলাম এতটা বছর। নিজের কথা ভাবলে হয়তো ফাহাদকে তখনই ছেড়ে দিতাম যখন নাকি ও আমার গায়ে প্রথম হাত উঠিয়েছিল। অহনা ছিল বলেই আমি প্রতিবাদটা করতে পারি নি। সেপারেশন হওয়ার পর দুইটা মানুষ ঠিকই পৃথক হয়ে যায় কিন্তু মাঝ দিয়ে সন্তানেরা দোটানায় পড়ে যায়। সাফার করতে ওদেরকেই। বিব্রতকর প্রশ্ন ও পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাদের। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে তারা। সমাজও এই সেপারেশনের উপর বাচ্চার চরিত্র জার্জ করে। কিন্তু ফাহাদ ওকে এইভাবেই ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। মেয়ে আমার বাবার ভালবাসা কি কখনো বুঝেই নেই। আদর মাখা কন্ঠে ওর সাথে কথাও বলেছিল কি না জানি না। ও সর্বদা ফাহাদকে ভয়ই পেয়ে এসেছে।
যখন ফাহাদ ডিভোর্স পেপারটা দিয়েছিল সত্যি বলতে আমার একটুর জন্যও মন খারাপ হয় নি। বরং খুশিই লাগছিল। শুধু মনের কোনে চিন্তা ছিল অহনাকে নিয়ে। কিন্তু ও যখন বললো, ওর অহনাকে চাই না। অহনা ওর জন্য প্রবলেম। তখন আর আমার মনে এই ডিভোর্স নিয়ে কোন দ্বিধাই ছিল না। এমন বাবা থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। সমাজের চিন্তা করে এতবছর চুপ থাকলেও এইবার আর থাকলাম না। যেখানে ও নিজ থেকেই আমাকে মুক্ত করতে চাইছে সেখানে দ্বিতীয় কোন কথা আসে না।

এইদিকে সব শুনে ভাইয়া রেগে যায়। রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

— আগে কেন বলিস নি এইসব? এত কষ্ট কেন সহ্য করেছিস এতদিন? তিলে তিলে মরে গিয়েছিস অথচ আমাদের একবারের জন্য জানাসও নি।

আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলি,

— বললে কি হতো? আগেই নিয়ে আসতি আমায়? তা নিয়ে আসলেও কি হতো? বোঝাপড়া করে ঠিকই ফাহাদের বাবা-মা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত। মাঝ দিয়ে নিচু হতে হতো তোকে। দোষ হতো বাবা-মায়ের। প্রশ্ন উঠতো তাদের শিক্ষা নিয়ে। না আছে মা, না আছে বাবা। জোর দিয়ে কথা বলার কেউ নেই। তার উপর এই সমাজে ছেলে পক্ষরাই হয় শক্তিশালী। মেয়ে পক্ষ নয়। তারা যা বলবে তাই মানতে হবে,করতে হবে। যদি বলে মেয়ের দোষ তাহলে মেয়েরই দোষ। এইখানে আর দ্বিতীয় কোন কথা উঠে না। অশান্তি চাই নি তাই নি বলে নি।

ভাইয়া আমার কথায় চুপসে যায়। কিন্তু দমে যায় না। সে ফুসফুস করতে করতে বলে,

— ফাহাদ যে অমানুষ তা জানতাম কিন্তু ও সে এক নাম্বার এর জা*** তা জানতাম না। নর্দামার কিট একটা। ভালোই হয়েছে ও তোকে ছেড়ে দিয়েছে। তা না হলে তোর বাকি জীবনটা নষ্ট তো হতোই অহনার জীবনও শুরু হওয়ার আগে শেষ হয়ে যেত।

ভাবী ভাইয়াকে শান্ত করতে করতে বলে,

— যা হওয়ার হয়েছে। এইসব নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই। এখন আগে কি হবে তা ভাবো।

ভাইয়া রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

— আগে কি হবে তা নিয়ে ভাবার মত কিছু নেই। ও এখন থেকে এইখানেই থাকবে। আর অহনাও ওর মায়ের পরিচয়ে বড় হবে। এই সমাজ কি করে তা শুধু আমি দেখবো।

ভাবী ভাইয়াকে শান্ত করার জন্য বলে,

— আরিফ শান্ত হও তো। এইসব কথা পরেও হবে। এখন তুমি চল। আরশিকে আরাম করতে দাও। আজ বেশ দখল গিয়েছে ওর উপর দিয়ে।

ভাই একবার আমার ক্লান্তি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে চলে যায়। ভাবী আমার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে সেও চলে যায়। কিন্তু অবাক করার বিষয় তখনও আমার চোখ পানি ঝড়তেই আছে। নিজেই নিজেকে আবার প্রশ্ন করি,

— আমি কাঁদছি কেন? ফাহাদের জন্য? কিন্তু ফাহাদ আর আমার মধ্যে তো কোন টান থাকার কথা না। আমাদের সম্পর্ক তো নাম মাত্র সম্পর্ক ছিল। যেখানে না ছিল কোন ভালবাসা, না ছিল কোন শ্রদ্ধা। যা ছিল দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্ব ও কর্তব্যের বেড়াজালে আটকে পড়েছিলাম এতটা বছর। তাহলে এই কান্না কিসের? এই কষ্ট কিসের? সংসারের মায়ার?

____________________________________________

সকাল হয়েছে আরও ৫ ঘন্টা আগে। এখন প্রায় বেলা হতে চলেছে। আমি এখনো বিছানায় শুয়ে আছি। অহনা আগেই বাইরে চলে গিয়েছে আদ্র এর সাথে খেলতে। মাঝে মধ্যে একটু উঁকি মেরে দেখে গিয়েছে আমি কি করছি। মেয়েটা বড্ড মা ভক্ত। মায়ের কিছু হলে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। মায়ের অসুস্থতা ওকে বড্ড পুড়ায়। আল্লাহ তায়ালা হয়তো সেই মায়ের কষ্ট মোচন করতেই এই ছোট পরীকে তার কোলজুড়ে দিয়ে গিয়েছেন। তাকে কাছে পেয়ে যে কেউ তার কষ্ট ভুলিয়ে দিবে।
বেশ বেলা করেই বিছানা ছাড়লাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ১১ টা বাজে। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে এসে দেখি অহনা আর আদ্র ভাইয়ার রুমে খেলছে। চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারি ভাইয়া অফিসে চলে গিয়েছে। আমি ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখি দুইজন মহিলা বসে আছে। তার মধ্যে একজনকে আমি চিনি। আমেনা আন্টি।
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। অনেক পুরানো প্রতিবেশী আমাদের। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুইজনই বাইরে দেশে সেটেল। ছেলেও বিয়ে করেছে। তার সাথে থাকে কি না বলতে পারি না। আশেপাশে তাকাতেই দেখি ভাবী এদের জন্য ট্রে-তে চা আর বিস্কুট নিয়ে আসছে। আমি ভাবছিলাম এইখান থেকে কেটে পড়বো। জনমানসের সামনে পড়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই। এই মূহুর্তে তো একদমই নেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমেনা আন্টি আমায় দেখে ফেললেন। এবং দেখে বেশ চমকেই উঠলেন। হয়তো আমাকে আশা করে নি। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে আমাকে তার কাছে ডাকে। আমিও বাধ্য হয়ে নিজের গায়ের ওড়না মাথায় দিয়ে তাদের সামনে যাই। আমেনা আন্টির দিকে তাকিয়ে মলিন একটা হাসি দিয়ে সালাম দেই। সেও সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কত বছর পর আসলে আরশি। সেই কবে দেখেছিলাম তোমায়। ঠিক মনেও নেই। বেশ শুকিয়ে গেছ দেখছি। খাওয়া-দাওয়া করো নাকি?

আমি মলিন হাসি হেসে বলি,

— খাই তো।

— মনে তো হয় না। নিজের প্রতি যত্ন নিতে শিখ। এই বয়সে দূর্বল হয়ে পড়লে হবে না বুঝলে। তা না হলে অল্প বয়সেই বিছানায় পড়তে হবে।

আমি কিছু না বলে মাথা দুলালাম। সে সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বলে,

— তা একাই এসেছ নাকি? তোমার জামাই আসে নি?
#আরশি
#Part_03
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— তা একাই এসেছ নাকি? তোমার জামাই আসে নি?

কথাটা শুনার সাথে সাথে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। কষ্টগুলো কামড়ে ধরে আমায়। কন্ঠস্বর ভারী হতে আসে। খুব কঠিন গলায় তাকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে,” আচ্ছা বিয়ের পর কেন সবকিছুতে স্বামী নামক সত্ত্বাকে বার বার জড়িয়ে দেওয়া হয়? কেন তার পরিচয়ের আগে স্বামীর পরিচয় দিতে হয়? কেন?” কিন্তু আফসোস প্রশ্নটা করা আমার সাধ্যের বাইরে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে আমি। তাই প্রশ্নটি হয়তো করার সাথে সাথে আমার গায়ে ‘বেয়াদব’ শব্দটির তোকমা লেগে যাবে। এইটাই তো হয় সাধারণত। বড়দের মুখের উপর প্রশ্ন করা মানেই তো সে বেয়াদব। সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস এইটা। কিন্তু তাই বলে সত্যটাও তাদের বলবো না তা তো নয়। মিথ্যা বলা আমার কার্য নয়। আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আন্টির দিকে তাকিয়ে বলি,

— না আন্টি আসে নি। আর আসবেও না।

আমেনা আন্টি একটু চমকে উঠলেন। বাঁকা চোখে তাকালেন। সাথেই তার পাশে বসা মহিলাটাও। ভাবী আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলছে। হয়তো তিনি চাচ্ছে আমি ভিতরের রুমে চলে যাই। এখন এইসব বলার সময় না। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসছে না। কেন আসবে? অন্যায় কিছু তো করি নি। আর তার উপর এই কথা একদিন না একদিন জানাজানি হবেই, তা এখন হলে দোষ কোথায়? আমি স্থির হয়েই দাঁড়িয়ে থাকি। অনুভূতিগুলো চাপা দেওয়ার কষ্ট করছি। আমেনা আন্টি তা দেখে স্মিত হেসে বলে,

— জামাই এর সাথে বুঝি ঝগড়া বাঁধিয়ে এসেছ? তা এমন সকল স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই একটু আধটু হয়। ব্যাপার না! পরে ঠিক হয়ে যায়।

আমি আড়চোখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে আমেনা আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলি,

— আপনার ধারণা ভুল। আমাদের মধ্যে কোন ঝামেলা হয় নি।

— তাহলে?

— আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। আলাদা হয়ে গিয়েছি আমরা।

এই বলে আর এক মূহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে রুমে চলে আসি। পিছে না তাকিয়ে বুঝতে পারছি আমেনা আন্টি আর তার পাশে বসা মহিলাটি আমার দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে। মুখের উপর কেউ তার ডিভোর্সের কথা এইভাবে বলতে পারে তা হয়তো তাদের জানা ছিল না। হয়তো সেখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই আমার উপর দিয়ে প্রশ্নের ঝড় বয়ে যেত। এক প্রকার জেরা করতো আমায়। তখন বাধ্য হয়ে শুনাতে ও বুঝাতে হতো তাদের আমার কাহিনী। সব শুনে হয়তো প্রথমে তারা আমার প্রতি করুণা দেখাতো। অতঃপর বলতো এমন করা ঠিক হয় নি। সংসারে কত কিছু হয়। তাই বলে ডিভোর্স নেয় নি কেউ? বাচ্চার কি হবে? এরপর হয়তো দুনিয়ার জ্ঞান দিত। আর সর্বশেষ আমার উপরই দোষটা চাপিয়ে চলে যেত। দোষটা কি হতো? আমি আমার স্বামীকে আগলে রাখতে পারি নি। তাকে নিজের আঁচলে বাঁধতে পারি নি। ত্রুটি হয়তো আমার মধ্যেই ছিল। এইটাই তো পারবে তারা। এর চেয়ে বেশি এদের কার্য নয়। উহুঁ! ভুল বললাম। এর চেয়েও বেশি তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কার্য আছে। আর তা হলো সকলকে জানানো, “ফ্ল্যাট বি-এর আরিফের বোনের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। সে ডিভোর্সি। বাচ্চা নিয়ে উঠেছে ভাইয়ের বাসায়।” ব্যাস! শুরু হয়ে যাবে কানাঘুষা। সভ্য ভাষায় গোসেপিং। আর এই গোসেপিং এর কেন্দ্রবিন্দু হবো আমি। পুরো ঘটনা না যেনে একাধিক তথ্য তারা বানিয়ে মশলা-পাতি মিশিয়ে প্রচার করবে। দোষটা অবশ্য আমারই দেখাবে। অতঃপর সব শেষে বলবে,” থাক ভাবী বাদ দেন,আমাদের কি? যার ব্যাপার সে বুঝবে।” অথচ আমাকে নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা রয়েই যাবে। এই হচ্ছে আমাদের সভ্য সমাজের আসল নমুনা।

রুমের ভিতর পায়চারী করছে। বেশ বিরক্তবোধ করছি। কেন না আন্টি আর সেই মহিলা এখনো যান নি। হয়তো ভাবীর কাছ থেকে সকল তথ্য সংগ্রহ করছে। অন্যের জীবন নিয়ে ঘাটতে এদের বেশ ভালো লাগে। যেন এর চেয়ে মজার কাজ আর দুটো নেই। অস্বস্তি লাগছে এখন। মন কেমন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। কেন জানি না। কয়েকদিন যাবৎ নিজেকে একদমই বুঝতে পারছি না। না পারছি অনুভূতিগুলো বুঝতে, না পারছি নিজের অবস্থান বুঝতে। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি জীবনের আসল সংগ্রাম যে এখন থেকেই শুরু। ভাবনার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে অহনা দৌঁড়ে আসে আমার কাছে। তার ছোট ছোট হাত দিয়ে আমায় পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে আমি খানিকটা চমকে উঠে নিচে তাকাই। অহনাকে দেখতে পেয়ে মনটা শান্ত হয়। আমি অহনাকে নিজের কাছ থেকে ছাঁড়িয়ে নিয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসি। ওর দুই হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলি,

— কি হয়েছে আমার মামনীটার? এইভাবে দৌঁড়ে এলে যে?

অহনা ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,

— ঘুম ধরেছে। ঘুমাবো।

কথাটা শ্রবণ করার সাথে সাথে ভ্রু আমার কুঞ্চিত হয়ে আসে। মনটা বিচলিত হয়ে যায়। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২ টা বাজে। এই অবেলায় তো ওর ঘুমানোর কথা না। শরীর খারাপ করছে নাকি কে জানে। আমি সাথে সাথে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখি ওর কপাল সামন্য গরম। হুট কালকে জার্নি করা হয়েছে বলে হয়তো শরীর খারাপ করছে। আবার আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব ও পড়তে পারে। আমি কিছু না বলে অহনাকে কোলে নিয়ে নেই। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ওকে বুকে নিয়ে ঘুম পারাতে থাকি। অহনাও খুব আয়েশ করে আমার বুকের উপর ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়ে। ছোট দুইটি হাত দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি অহনার কপালে একটা চুমু খেয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। তাকিয়ে রই ওর মুখপানে। এমন কি নিষ্পাপই না তার মুখখানি। মায়াভরা চোখ চোখ, সুরু গোলাপি ঠোঁট, বোঁচা নাক। চোখের পাপড়ি বেশ ঘন ও উঁচু উঁচু। গাল দুইটি ফুলা। গায়ের রঙ হাল্কা ফর্সা হলেও গোলাপি গোলাপি৷ গোলাপি ফর্সা যাকে বলে। এমন একটা বাচ্চার দিকে যে কেউ তাকালে আপনা-আপনি মায়া এসে পড়বে। কঠোর মানুষও গলে মোম হয়ে যাবে। আচ্ছা ফাহাদ কি একবারও ওর মুখপানে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল? দেখেছিল কি ওর চোখ দুটি অবিকল তার মত? খেয়াল করেছিল কি তার মতই ওর গালেও টোল পড়ে? হয়তো দেখেনি। দেখলে হয়তো নিজের অংশকে অবজ্ঞা করতে পারতো না। দূরে সরিয়ে দিত না। এক দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনা হয়ে যাই। পুরোনো স্মৃতির মাঝে ডুবে যাই। মনে পড়তে থাকে আমার ফাহাদের বিয়ের কথাটা। চোখের সামনে ভেসে উঠে একের পর এক ঘটনা।

তখন অনার্স প্রথম বর্ষে যখন নাকি ফাহাদের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়। সম্বন্ধটা এনেছিল আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা। ছেলে সরকারি চাকরি করে,গাড়ি আছে,দুটো ফ্ল্যাট আছে,গ্রামের বাড়িতে জমি ও বাড়ি আছে। ব্যাস আর কি লাগে? কিন্তু বাবা এত জলদি আমায় বিয়ে দিতে চান নি। সে আমাকে পড়ালেখা করাতে চেয়েছিল। কিন্তু চাচার কথার জ্বালে ফেঁসে যান। তিনি এনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকেন, এমন ছেলে নাকি সহজে পাওয়া যায় না। তার উপর সে আমাকে পড়াবে। আমি ভালো থাকবো। আরও মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাবাকে রাজি করিয়ে নিলেন। অবশেষে বাবাও খোঁজ নিলেন। ভালোই জানলেন। দেখতে আহামরি যে সুন্দরী ছিলাম তা কিন্তু না। মোটামুটি ছিলাম দেখতে। তাও আমাকে দেখে তাদের পছন্দ হয়। তাই কথা পাকাপাকি করা হয়। প্রেম ছিল না বলে আমারও বিয়েতে অমত ছিল না। মা ছিল না আমার। ইন্টারের দ্বিতীয় বর্ষে থাকতেই মা মারা যায়। কিন্তু এর আগেই তিনি আমায় সংসারের যাবতীয় কাজ শিখিয়ে দিয়ে যান। সংসারের মায়ায় জড়িয়ে থাকার উপদেশ দিয়েছেন। স্বামীর প্রতি অনুগ্রহ হতে বলেছেন। কিভাবে আদর্শ স্ত্রী হওয়া যায় তা শিখিয়েছেন। ছোট থাকতেই আমার মধ্যে লোকভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বুঝানো হয় মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে আমি। “প্রতিবাদ” শব্দটি আমাদের জন্য না। আমিও তা দৃঢ় প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করি।
অবশেষে আমার আর ফাহাদের বিয়ে হয়। বিয়েতে ফাহাদরা যৌতুক চায় নি। চেয়েছিল গিফট। সভ্য সমাজ এই যৌতুকেরই আরেক নাম গিফট। কিন্তু সেটা কখনো তারা শিকার করবে না। সেই যাই হোক! বাবা নিজের সাধ্য অনুযায়ী ঘর সাজানোর জন্য সকল আসবাবপত্রই দিলেন। গহনা দিলেন। এই নিয়ে শুরু হয়েছিল জীবনের নতুন যাত্রা।
বিয়ের প্রথম রাতেই ফাহাদ আমার কাছে তার অধিকার চায়। মানা করার মত পরিস্থিতি আমার ছিল না। অপরিচিত হলেও যে সে আমার স্বামী ছিল। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমায় তাকে তার অধিকার দিতে হয়েছিল। সেই রাতে আমি শুধু নিরবে নিজের চোখের জল বিসর্জন দিয়েছিলাম। চোখের জল নিয়ে শুরু আমার সাংসারিক জীবন। ফাহাদ এক সরকারি ব্যাংকে কর্মরত ছিল। ভালো এক পজিশনেই ছিল। ঢাকাতেই তার পোস্টিং ছিল। কিন্তু বিয়ের ৬ মাসের মাথায় ফাহাদের বদলি হয় খুলনায়। আমিও ভার্সিটিতে থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে চলে আসি তার সাথে। সেখানে তিনি একটা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট পান আর অফিস যাওয়া আসার জন্য গাড়ি৷ আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি দেশের বাড়িতে থাকতেন। তো সেই ডুপ্লেক্সে জায়গায় হয় আমার তার। ফাহাদ তার কথা রেখেছিল। আমায় সে পড়ালেখা করতে দিয়েছিল। আমাকে সে খুলনারই একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেয়। ভেবেছিলাম সে হয়তো ভালো মনের মানুষ। বাবা হয়তো সঠিক পাত্রের হাতেই আমাকে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। দিন যাওয়ার সাথে সাথে ফাহাদের আসল রুপ বেড়িয়ে আসছিল। পড়ালেখা তো সে করাছিল কিন্তু এর জন্য প্রতিনিয়ত আমাকে খোটা শুনতে হতো। ভার্সিটিতে ক্লাস করতে গেলে শুনতে হলো কোন এক ছেলের সাথে নাকি দিন কাটিয়ে এসেছি। আমি নাকি নষ্টা মেয়ে। তাকে কখনো তার কাজে বাঁধা দিলে শুনতে হতো অহেতুক গালি। আমাকে সর্বদা নিচু করত। এমনকি খাবার দিতে এক মিনিট দেরি হলেও শুনতে হতো নিম্ন মানের গালি। দিন যত যাচ্ছিল তার তার ব্যবহার আমার প্রতি অতি নিকৃষ্ট হচ্ছিল। বেশি ঝামেলা হতো ভার্সিটি যাওয়া নিয়ে। তাই একসময় ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দেই। বাসায় থেকে নোটস কালেক্ট করে পড়তাম আর এক্সামের সময়ই শুধু এক্সাম দিতে যেতাম। কিন্তু এতেও ফাহাদের সমস্যার শেষ নেই। সে কখনোই নিজ থেকে আমাকে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যেত না। কোন পার্টিতে নিতে যেত না। বাকি ৮-১০ টা কাপলদের মত আমরা কোন কালেই ছিলাম না। শুরু থেকেই ফাহাদের কাছ থেকে আমি শুধু অবহেলা পেয়েছি। আমি খেয়েছি কিনা অসুস্থ কিনা সে কখনো জানতে চায় নি। শুধু রাতে বেলায় আমাকে তার প্রয়োজন ছিল। এর বাদে তার জীবনে আমার কোন প্রয়োজন ছিল না। আমি চেয়েও তখন কিছু বলতে পারতাম না। একমাত্র চোখের জল ফেলা ছাড়া। এইভাবেই চলছিল আমাদের সাংসারিক জীবন।
বিয়ের ২ বছরের মাথায় ভাইয়া বিয়ে করে। কিন্তু সেই বিয়ের কোন আয়োজনে আমি ছিলাম না। একমাত্র বিয়েতে যেতে পেরেছিলাম আমি৷ তাও যেদিন গিয়েছিলাম তার পরেরদিন বিকেলেই চলে এসেছিল। এর কারণও ফাহাদ। আমার বাপের বাড়ি যাওয়া ফাহাদের পছন্দ না। তার ভাষ্যমতে আমি নিশ্চয়ই বাবার বাসায় কাউকে রেখে এসেছিলাম যার জন্য আমি সেই বাসায় যেতে চাই। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হলে সে আমার বাবা-মাকে নিয়ে পর্যন্ত গালি দেয়। আর আমি? নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই।

ভাইয়ার বিয়ের দেড় বছরের ব্যবধানেই বাবা মারা যায়। কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি ভেঙ্গে পড়ি। ছুটে যেতে চাই বাবার কাছে। কিন্তু ফাহাদ সেখানেও বাঁধা সাজে। যেতে দেয় না আমায়। বাবার শেষ দেখাটাও আমায় দেখতে দেয় নি সে। সেইদিন তার পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলাম আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কতটাই না আকুতি মিনতি করেছিলাম বাবার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু না তার মন গলে নি। সে আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। বাসার মেইন দরজা পর্যন্ত তালা দিয়ে যায় যাতে আমি চলে যেতে না পারি। আমাদের মধ্যে শুরু থেকেই কোন ভালবাসা ছিল না। আমার দিক থেকে সামন্য শ্রদ্ধা ছিল তার প্রতি। কিন্তু তাও সেইদিনই মারা যায়। শুধু রয়ে যায় দায়িত্ব-কর্তব্য। আমিও একদম চুপ হয়ে যাই। নিজেকে একদম গুটিয়ে নেই।

এর মধ্যে আমি নিজের পড়ালেখা শেষ করি৷ কিন্তু মাস্টার্স কমপ্লিট করতে পারি নি। ফাহাদ দেয় নি। তার ভাষ্যমতে সে আমায় বহুত পড়িয়েছে আর পড়াতে পারবে না। আর এমনেও আমি এত পড়েলেখে কি করবো? সে তো আমায় জব করতে দিবে না। আমিও তখন বিনাবাক্যে কথাটা মেনে নেই। এর কয়েকমাসের ব্যবধানে জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। কথাটি আমি জানার সাথে সাথে অনেক খুশি হয়েছিলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে হচ্ছিল সেদিন নিজেকে। কিন্তু ফাহাদ আদৌ খুশি ছিল কিনা জানি না। প্রেগ্ন্যাসির জন্য সে আমার কাছে আসতে পারতো না বলে তার ক্ষোভের শেষ ছিল না। ক্ষোভও মিটাতো আমার উপর দিয়েই। গালিগালাজ করে। ধীরে ধীরে আমাদের মাঝে বেশ দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমাকে ভাইয়ার বাসায় যেতে দেওয়া হয় না বলে আমার দেখা শোনার জন্য শ্বাশুড়ি চলে আসে গ্রাম থেকে। প্রেগ্ন্যাসির সময় তিনিই ছিলেন আমার পাশে। সে যে খারাপ মনের মানুষ ছিল তা কিন্তু না। বেশ ভালো মনেরই মানুষ ছিলেন। তাকে দেখে বলা বাহুল্য ফাহাদ তারই ছেলে। দেখতেই দেখতে অহনা আমার কোলজুরে আসে। কিন্তু আমার মনে আছে অহনা যেদিন হয় সেইদিন ফাহাদ আমার পাশে ছিল না। এমনকি অহনার সদ্যজাত ফোটা চেহেরাটাও সে দেখে নি। দেখেছিল অহনার জন্ম হওয়ার ২ দিন পর। তখন শুধু নিজেকে একটা প্রশ্নই করেছিল, ” মেয়েটা আমার আদৌ বাবার আদর পাবে তো?”
অহনা হওয়ার পর ভাইয়া জোর করে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যান। ফাহাদ তখন চেয়েও না করতে পারি নি। কেন না আমার শ্বাশুড়ি মা তাকে বাঁধা দিয়েছিল। তখন সে শুধু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছিল। ভাইয়ার বাসায় আমি প্রায় ২ মাসের মত ছিলাম। আর এই দুই মাসে একবারের জন্যও সে আমার ফোন করে নি। অহনার কোন খোঁজও নেই নি। কিন্তু কথাটা আমি ব্যতীত কেউ জানে নি। ফাহাদ আমাকে নিতে আসে নি বরং ভাইয়াকে যেতে হয়েছিল আমাদের দিয়ে আসতে। তখন শুধু আমি ভাইয়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়েছিলাম। ভাইয়া এর অর্থ বুঝেছিল কিনা জানিনা। সে শুধু আমার মাথায় আদর মাখা হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।

ভাইয়ার বাসা থেকে আসার পর এক নতুন ফাহাদকেই আমি আবিষ্কার করলাম। যে নাকি আগের চেয়ে হয়ে উঠেছিল দ্বিগুণ হিংস্র। ফাহাদ আগে সময়মত বাসায় আসলেও পরবর্তীতে খুব দেরি করে আশা শুরু করে। দুই একসময় সারা রাত বাসার বাইরেই কাটাতো। এইদিকে অহনাকে নিয়ে আমি সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। বাচ্চা পালা যে সহজ না তা তখন হারে হারে টের পাচ্ছিলাম। সারাদিন অহনার পিছে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দুই নয়ন জগতের সকল নিদ্রা এসে ভর করতো। তখন চেয়েও সজাগ থাকতে পারতাম না। যার ফলে ফাহাদের দিকে নজরও দিতে পারতাম না। অহনা যত বড় হতে থাকে ততো ফাহাদের অনিহা বাড়তে থাকে আর বিষয়গুলো আমার নজরে পড়তে শুরু করে। তো একদিন আমি না পেরে তাকে জিজ্ঞেস করে বসি সে এত রাত পর্যন্ত কই থাকে? কিন্তু সে তেমন উত্তর দেয় নি। জোরাজোরি করলে সে আমার গালে চড় বসিয়ে দেয়। সেই প্রথম সে আমার গায়ে তুলা শুরু করে। এরপর থেকেই কোন কিছু হলে সে আমার গায়ে হাত তুলে। শুধু মাত্র অহনা ছিল বলে আমি তার কাছে পড়েছিলাম। অহনার ভবিষ্যতের চিন্তা করেই চুপ ছিলাম। কিন্তু তার এই হাত তুলা যে আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না তা না। অহনার উপরও সে বেশ কয়েকবার হাত উঠিয়েছি। ধমক তো প্রায় দিত। আমি প্রতিবাদ করতে গেলে আমার গায়ে হাত উঠাতেন। সামনে যা পেত আমার দিকে ছুঁড়ে মারতো। একবার তো কথার মাঝে ফ্লাওয়ার ভ্যাস আমার উপর ছুঁড়ে মারে। যার ফলে আমার মাথা ফেটে যায়। এই দৃশ্যটা অহনার সামনেই ঘটে। তখন সে শুধু মা মা বলে চিৎকার করেছিল। কিন্তু তাও ফাহাদের মায়া হয় নি। শুধু দায়িত্বের খাতিরে আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
সেইদিনের পর থেকে আমি নিজেকে আরিও গুটিয়ে নেই। অহনাও ফাহাদকে ভয় পেতে শুরু করে। অহনার মনের মধ্যে ফাহাদের প্রতি কোন টান মহব্বত কিছুই ছিল না। প্রথম প্রথম অহনা ফাহাদের কাছে একটু ভালবাসা আর আদরের আশায় ছুটে গেলেও ফাহাদের অবহেলা ছাড়া কিছুই পায় নি। যার জন্য একসময় অহনাও হাল ছেড়ে দেয়। ফাহাদকে অহনাকে নিয়ে প্রশ্ন করলে সে শুধু এতটুকুই বলেছিল, ” তোমাদের দরকার তো পূরণ করছি। এর বেশি আর কি চাই তোমাদের?”
তখনও নির্বাকই ছিলাম। শুধু ভাবছিলাম মানুষ কতটা না পাষাণ হলে এমন কথা বলতে পারে। জীদ উঠছিল তখন। উঁহু! ফাহাদের উপর না নিজের উপর। এত অন্যায় সয়েও আমি কেন চুপ ছিলাম এই ভেবে। প্রতিবাদ করার তীব্র ভাবনা মনের মধ্যে বাসা বাঁধলেও অহনার মুখপানে তাকাতেই তা উবে যেত। ডিভোর্স শব্দ যখনই মাথায় আসতো তখনই টনক নাড়তো, “কোথায় যাব ওকে নিয়ে? ওকে নিয়ে এই সমাজে আমি একা বাঁচতে পারবো তো? আদৌ কি আমি আমার মেয়ের কাছে থাকতে পারবো? ফাহাদ যদি আমার মেয়েকে কেড়ে নেয় তখন আমি কি করবো?”
কিন্তু ভাগ্যের কি খেল। ফাহাদ নিজ থেকেই আমায় ডিভোর্স লেটার দিয়ে দেয়। মুক্ত করে দেয় আমায়।

অহনা একটু নড়ে উঠতেই আমি চমকে উঠি। অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসি। আমি অহনার দিকে দিকে তাকিয়ে দেখি সে ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি প্রশান্তির নিশ্বাস নিতে গেয়ে থেমে যাই। নিজের এক হাত গালে ছুঁয়াতেই ভেজা অনুভব করি। বুঝতে দেরি নেই অতীত মনে করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। বুকের মধ্যে চাপা এক কষ্ট অনুভব করছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো চোখের পানিটা ফেলছি কার জন্যে? কারণ কি? আদৌ কি এই পানির কোন দাম আছে? আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ মুছে নেই। সকল কষ্টদায়ক অনুভূতিগুলো দূরে ছুঁড়ে মারি। এই বেদনার দেখার কেউ নেই, বুঝার কেউ নেই। তাহলে এইগুলো বুকের মাঝে পুষে কি লাভ? নিজেকে শক্ত করতে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। অনেক সহ্য করেছি অন্যায় আর না। আমি অহনার দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমার সাথে তুই থাকবি তো মামনী?

___________________________________________

দেখতেই দেখতে আমার ফাহাদের ডিভোর্সের এক মাস কেটে যায়। এই এক মাসে আমাদের কোন যোগাযোগ হয়নি। মাঝে আমার শ্বাশুড়ি ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল এইসব কিভাবে হলো। তখন আমি তাকে কিছুই বলি নি। শুধু বলেছিলাম যা জানার তা যেন ফাহাদের কাছেই জেনে নেয়। সে যদি আমার দোষ দেয় তাহলে আমার দোষ আর সে যদি তার দোষ শিকার তাহলে তার দোষ। ব্যাস এতটুকু বলেই ফোন কেটে দিয়েছিলাম আমি। এরপর সেখান থেকে আর কোন ফোন কল আসে নি। ইতিমধ্যে আত্মীয়স্বজন সকলের মধ্যে আমার ডিভোর্সের কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে। পাড়াপ্রতিবেশিতেও কথাটা ছড়িয়েছে। কিন্তু সে নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। এতদিনে নিজেকে বেশ শক্ত করে ফেলেছি। উত্তর দেওয়া শিখেছি। কাউকো নিয়ে মাথা ঘামাই না। সবসময় হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করি। কারণ শুধু অহনাই। আমাকে যে অহনার জন্য ভালো থাকতেই হবে।

আজ অনেকদিন পর ফেসবুকে লগ ইন করলাম। নিজেকে একান্ত সময় দিতে চাচ্ছিলাম বলে এতদিন মোবাইল ঠিক মত ব্যবহার করা হয়ে উঠেনি। এখন নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই জীবনটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। এই ভাবনা নিয়ে ফেসবুক স্ক্রোল করছি। এমন সময় একটা পোস্ট দেখে থমকে গেলাম। ফাহাদ আর একটির মেয়ের ছবি। মেয়েটি বেশ রূপবতী। মেয়েটি ফাহাদের এক হাত জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রেখে আছে। বেশ হাসি খুশি মনে হচ্ছে দুইজনকে। পোস্টটা হয়তো মেয়েটি করেছে আর ফাহাদকে ট্যাগ করা হয়েছে। উপরে গোটা গোটা অক্ষরে ক্যাপশন দেওয়া,

“Finally got married to Fahad Hasan. Please pray for our happy married life.”

#চলবে
#চলবে

আরশির সম্পর্কে কালকে বিস্তারিত জানানো হবে। আমি আস্তে ধীরে এগুতে চাচ্ছি তাই একটু সময় নিচ্ছি।
গল্পটি কেমন লাগছে প্লিজ জানাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলে খুশি হবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here