আরশি পর্ব ৪+৫

#আরশি
#Part_04
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

“Finally got married to Fahad Hasan. Please pray for our happy married life.”

ক্যাপশনটা পড়ার সাথে সাথে থমকে গেলাম। শক্ত মনটা কেমন চুপসে গেল। শুরু হলো অস্বস্তি। চোখ দুটি জ্বালা করে উঠলো। মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো যেন অবশ হয়ে আসলো। কেন এমন হচ্ছিল তার উত্তর আমার জানা নেই। কষ্ট পাচ্ছিলাম নাকি তাও বুঝতে পারলাম না। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। কথা আসলে আমার জন্য তিক্ত হলেও সত্য যে, ” স্বল্প হলেও খারাপ লাগছে আমার। লাগাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? তার সাথে আমার সংসার তো আর স্বল্প দিনের না। বছরের পর বছরের। ভালবাসার টান না থাকলেও দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্য দিয়ে একটা টান ঠিকই আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছিল। যার রেশ হয়তো আমার মধ্য থেকে এখনো কাটেনি। কিন্তু কাটতে আর কতক্ষণ?”

এইসব ভেবে কতক্ষণ এইভাবেই বসে ছিলাম তা জানা নেই। অহনার ঝাঁকুনিতেই সজ্ঞানে ফিরে আসি। নিজেকে সামলে নিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি অহনা মুখ ফুলিয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মোবাইলটা পাশে উল্টো করে রেখে ঠোঁটের কোনে মিথ্যে হাসি টেনে বলি,

— কি হয়েছে আমার মামনীটার? এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

অহনা গাল ফুলিয়ে বলে,

— আমি তোমার সাথে রাগ করেছি৷

— ওমা তাই? তা আমার মামনীটা আমার সাথে কেন রাগ করেছে তা জানতে পারি?

— তুমি না বলেছিলে আজ বিকেলে আমায় পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে?

অহনার কথায় মনে পড়লো আজ আমি ওকে বলেছিলাম যে বাইরে নিয়ে যাব। আমি ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলি,

— ইশশ! একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি না থাকলে যে আমার কি হতো?

— কি আর হতো? চকলেট খাওয়া হতো।

এই বলতে অহনা দাঁত বের করে একটা মিষ্টি হাসি দেয়। আমি ওর কথা ফিক করে হেসে দেই। ওর নাক টেনে বলি,

— হাইরে আমার চকলেট পাগলি মেয়েরে। তা আমার মামনীটার চকলেট লাগবে বুঝি?

অহনা দ্রুত গতিতে মাথা দুলিয়ে বলে,

— হাম! হাম!

— আচ্ছা আসার সময় নিয়ে আসবো নে। এখন চল তোমায় রেডি করে দেই। পার্কে না যাবে তুমি।

সাথে সাথে অহনা পা উঁচু করে আমার গলা জরিয়ে বলে,

— থেংক ইউ আম্মু।

আমি মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। অতঃপর ওকে রেডি করিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াই হিজাব পড়ার জন্য। তখন আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রই। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে। চোখ দুটি রাত জাগার কারণে ডেবে গিয়েছে। কালি পড়ে গর্ত হয়ে গিয়েছে। হাল্কা গোলাপি ঠোঁটগুলো শুকিয়ে কালচে হয়ে এসেছে। ফুলা গালগুলো চেপে এসেছে। মুখের গড়ন পরিবর্তন হয়েছে। লাবণ্যহীন লাগছে চেহেরাটি। এখনকার আমি আর ১০ বছর আগের আমি এর মধ্যে যেন কোন মিল নেই। সংসারের টানাপোড়েনে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই পাই। এই কাজ ওই কাজ করতে করতেই তো সময় চলে যেত। রূপচর্চা করার মত সময় কি আর আমার ছিল?হুট করে ফাহাদের সেই কথাটা টনক নাড়লো, “না আছে রুপ, না আছে ক্লাস।”

তার মানে কি ফাহাদ আমার সেই লাবণ্যময় চেহেরা দেখে বিয়ে করেছিল? রুপ দেখে আমাকে পছন্দ করেছিল? আমার রুপ হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কি আমার প্রতি ফাহাদের ভালো লাগাটা ফুরিয়ে এসেছিল? অনিহা জন্মেছিল আমার প্রতি? বোরকা হিজাব পড়তাম বলেই কি আমার ক্লাস ছিল না? তার নজরে কি আমি খ্যাত ছিলাম? আমারটা না হয় বুঝলাম কিন্তু অহনা? অহনার সাথে ওমন ব্যবহার কেন করেছিল সে? শুধু মাত্র ও মেয়ে বলে? একবার তো ফাহাদ বলেছিলই ওর ছেলে চাই। মেয়ে তার চাই না। ছেলেরা হচ্ছে বংশের প্রদীপ আর মেয়েরা হচ্ছে বোঝা। এমনই তো ছিল তার চিন্তা ধারা। কিন্তু অহনার সেই মায়াভরা মুখখানিটা দেখে তো যে কেউ ওর মায়া জড়াতে বাধ্য। তাহলে ফাহাদ কেন জড়ালো না? তাহলে কি সে পিতৃত্বের স্বাদ বুঝতেই পারে নি? কখনো পিতা হওয়ার শ্রেষ্ঠ অনুভূতিটি অনুভবই কর‍তে পারে নি? অবশ্য পারবেও কিভাবে? সে তো আমার গর্ভকালীন কখনো পাশে ছিলই না। অহনার বেড়ে উঠার সেই টুকরো টুকরো মূহুর্তগুলোর সময় সে ছিল না। সে তো কখনো আমার মাঝে অহনার অস্তিত্ব অনুভবই করে নি। তাহলে সে বুঝবে কিভাবে পিতৃত্ব স্বাদ ও এর মর্ম? মাঝে মধ্যে উত্তর সামনে থাকার পরও তা না বুঝে বোকার মত প্রশ্ন করে বসি। অতঃপর নিজেই তার উত্তর খুঁজে বের করি। আর তখন নিজের উপরই হাসি পায়।

বোরকায় টান অনুভব করতেই ধ্যান ভেঙ্গে যায় আমার। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি নিচের দিকে তাকাতেই দেখি অহনা ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে থেকে বলে,

— যাবে না?

আমি মিষ্টি হাসি হেসে বলি,

— হ্যাঁ। এইতো পাঁচ মিনিট।

____________________________________________

বিকেলের প্রহর গড়িয়ে চলেছে। সূর্যমামা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। হলদে আকাশে বুকে বেসামাল ভাবে ঘুরে বেরাচ্ছে হলদে রাঙ্গা মেঘ। দূর আকাশে এক ঝাঁক কবুতরের দোল বৃত্তাকারের বৃহত্তম রেখার ধার ধরে ঘূর্ণিপাকের মত গোল গোল ঘুরেই চলেছে। পার্কে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘন সবুজ বৃক্ষের দল। তারই ফাঁক ফুঁকুর দিয়ে দুই জোড়া চড়ুই পাখি মেতে উঠেছে ছোটাছুটির খেলায়। বেশ আনন্দে আছে মনে হয়। তাই তো আজ তাদের কিচিরমিচির শব্দে পরিবেশটাও মেতে উঠেছে। কয়েকটি ডালের মধ্যে খুবই অলস ভঙ্গিতে বসে আছে বেজোড় সংখ্যার কাক গুলো। মাঝে মধ্যে চড়ুই পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে বিরক্ত হয়ে শাসনের সুরে কা কা করে উঠছে। পার্কের পরিবেশটা আজ বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। মন ভালো করার মত একটি পরিবেশ।

পার্কের এক বেঞ্চিতে বসে আমি পরিবেশটা উপভোগ করছি। সামনেই বেশ কিছু বাচ্চাদের সাথে অহনা খেলছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। অহনার হাসি কানে গুঞ্জিত হতেই মনে প্রশান্তি হাওয়া বয়ে যায়। আমিও মুচকি হেসে ওকে দেখছি। এমন সময় দেখলাম অহনা খেলছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। আমিও ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখি একজন পিতা তার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করছে। যত্ন সহকারে কিছু একটা খায়িয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা দেখা মাত্র বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। বার বার মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে, “অহনা সেইদিকে কেন তাকিয়ে আছে? ওর কি সেই দৃশ্য দেখে কষ্ট হচ্ছে?”
না আমাকে জানতে হবে ওর মধ্যে কি চলছে। আমি নিজেকে কোন মতে সামলে অহনাকে ডাক দেই। অহনা আমার ডাক শুনে এক দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি অহনাকে নিজের কোলে নিতেই সে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে আম্মি? ডাকলে কেন?

আমি শুকনো মুখে ওকে জিজ্ঞেস করি,

— তুমি ওইদিকে তাকিয়ে কি দেখছিলে?

অহনা বুঝতে না পেরে বলে,

— কোন দিকে?

— ওই যে ওই আঙ্কেল আর বাচ্চাটির দিকে? বাবার কথা মনে পড়ছে? তার কাছে যেতে চাও?

অহনা মাথা নেড়ে বলে,

— না! আমি বাবার কাছে যেতে চাই না। বাবার কাছে গেলে সে বকবে,মারবে। কিন্তু এই কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? আমরা কি বাবার কাছে চলে যাচ্ছি?

— না যাচ্ছি না। আর যাবও না। আমরা মামাবাড়িতেই থাকবো।

অহনা খুশি হয়ে বলে,

— ইয়েএএ!! কি মজা।

— আর শুনো ওই লোককে আর বাবা বলতে হবে না। সে আর তোমার বাবা নেই।

— তাহলে সে আমার কে?

— কেউ না। আর কেউ যদি তোমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে, “তোমার বাবা নেই।”

— ঠিক আচে।

— “আচে” না “আছে” বলতে হয়। তুমি তো “ছ” উচ্চারণ করতে পারো। তাহলে বার বার আচে বলো কেন?

অহনা দাঁত বের করে বলে,

— মজা লাগে।

আমি মুচকি হেসে অহনার গালে ছোট চুমু খাই। হঠাৎ টনক নাড়ে সে ওইদিকে তাহলে কেন তাকিয়ে ছিল? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই আমি সাথে সাথে অহনাকে জিজ্ঞেস করি,

— আচ্ছা তুমি সেইদিকে তাকিয়ে কি দেখছিলে?

— সত্যি বলবো?

— সবসময় সত্যিই বলতে হয় মামনী। মিথ্যা বললে আল্লাহ পাপ দেয়। এইবার বলো কি দেখছিলে?

— আমি না ওই আঙ্কেলের হাতে থাকা চকলেট গুলো দেখছিলাম।

কথাটা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। যাক আমি যা ভাবছিলাম তা না। আমি মুচকি হেসে বলি,

— চকলেট খাবে।

অহনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলি,

— তাহলে চল।

— আম্মি আরেকটু খেলি প্লিজ।

এই বলে অহনা কিউট ফেস করে আমার দিকে তাকায়। আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি বেশ মানুষই আছে চারদিকে। মাঝেই বেশ কয়েকটা বাচ্চা খেলছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ ব্যস্ত। চকলেট কিনতে হলে রাস্তা পার হতে হবে। অহনাকে সাথে নিয়ে এত ব্যস্ত রাস্তা পার হয়ে যাওয়াটা সুবিধার না। সকল কিছু বিবেচনা করে আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। অতঃপর বলি,

— আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তাহলে ওদের সাথেই খেল আমি চকলেট কিনে নিয়ে আসছি। আর শুনো এইখান থেকে কোথাও যাবে না কিন্তু। কাউরো দেওয়া কিছু খাবে না। আম্মি এই যাব আর এই আসবো।

— আচ্ছা।

আমি অহনার কপালে এক চুমু দিয়ে ওকে কোল থেকে নামিয়ে দেই। সে দৌঁড়ে ওই বাচ্চাগুলোর কাছে চলে যায়। আমিও চলে যাই চকলেট কিনতে।

______________________________________

চকলেট কিনে ফিরে এসে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। উন্মাদ প্রায় হয়ে উঠি। হুট করেই মন কু ডাকতে শুরু করে। চোখ দুটি নরম হয়ে আসে। কেন না যেই বাচ্চাদের মাঝে আমি ওকে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে ও নেই। চারদিকে চোখ বুলিয়েও ওর দেখা মিলছে না।
#আরশি
#Part_05
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে অহনা। সামনে থাকা ব্যক্তিটির বিনয়ী সুরে ওর কান্না থামানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে,

— কাঁদে না মামণি। কিছু হয় নি।

অহনা কাঁদো কাঁদো সুরে বলে,

— আম্মি যাব।

লোকটা এইবার আশে-পাশে একবার তাকিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকায়। অতঃপর দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি এক হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— ব্যথা যা মামার বাড়ি, কষ্ট ফেলে যা চাচার বাড়ি।

কথা শুনে অহনা কান্না থামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটি একটু প্রশান্তির হাসি হেসে আলতো হাতে অহনার কান্না মুছে দিয়ে বলে,

— কান্নায় দেখায় পেত্নী, হাসিতে দেখায় নাতনি।

কথা শুনে অহনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। লোকটি তার পকেট থেকে খয়েরী রঙের একটা রুমাল বের করে অহনার বা পায়ের হাটুতে বেঁধে দেয়। তারপর সেই জায়াগায়টার উপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে,

— বেশি ব্যথা করছে?

অহনা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। লোকটি মিষ্টি হেসে বলে,

— তারাতারি চলে যাবে। তোমার মত ছোট পরীর কাছে কি ব্যথা বেশিক্ষণ থাকতে পারে?

অহনা জোরে মাথা দুলাই। যার অর্থ না। লোকটি এইবার হেসে বলে,

— আমাকে ভয় পেতে হবে না। আমি খারাপ আঙ্কেল নই।

অহনা তার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,

— তাহলে আপনি কেমন আঙ্কেল?

— আমি চকলেট আঙ্কেল। ছোট ছোট পরীদের ম্যাজিক ক্যান্ডি দেই আমি।

— ম্যাজিক ক্যান্ডি কি?

— ওয়েট!

এই বলে লোকটি মুষ্টিবদ্ধ হাতটি একটু ঘুরিয়ে অহনার সামনে ধরে। অতঃপর মুষ্টিবদ্ধ হাতটি খুলতেই সেখান থেকে দুইটা ‘পালস ক্যান্ডি’ বেরিয়ে আসে। অহনা বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটি এক হাসি দিয়ে বলে,

— এই যে এসে পড়লো ছোট পরীর জন্য ম্যাজিক ক্যান্ডি।

অহনা বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে উঠে,

— এইটা কিভাবে হলো?

লোকটি মিষ্টি হেসে বলে,

— ম্যাজিক!

বলে অহনার হাতে ক্যান্ডিটা ধরিয়ে দেয়। সাথে সাথে অহনা তা ফিরিয়ে দিয়ে বলে,

— আম্মি বলেছে কাউরো কাজ থেকে কিছু নিতে না।

লোকটি মুচকি হেসে অহনার নাক টেনে দিয়ে আবার ওর হাতে ক্যান্ডি দিয়ে বলে,

— আম্মি জিজ্ঞেস করলে বলবে এইগুলা চকলেট আঙ্কেল দিয়েছে। তখন দেখবে আম্মি কিছুই বলবে না।

অহনা অবিশ্বাস্য চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে রয়। অতঃপর জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— আপনি আমার আম্মিকে চিনেন?

— উঁহু! কিন্তু তুমি বললে চিনে যাব নে। তা এই ছোট পরীটির নাম কি জানতে পারি?

অহনা আদো আদো কন্ঠে বলে,

— আমার নাম অহনা।

— বাহ! বেশ মিষ্টি নাম তো। তাহলে আমি তোমায় অহুপরী ডাকব কেমন।

অহনা মাথা দুলায়। লোকটি মিষ্টি হেসে বলে,

— তা তোমার আম্মি কোথায়? অনেকক্ষণ তো হলো। সে নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজছে। চল তার খুঁজার আগে আমরাই তাকে খুঁজে ফেলি।

অহনা খুশি হয়ে বলে,

— আচ্ছা।

লোকটি অহনাকে কোলে নিয়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বেশ সামনে যেতেই অহনা এইবার চেঁচিয়ে উঠে, “আম্মি!” লোকটি সামনে তাকাতেই দেখে একজন বোরকা ও নেকাব পরিহিত মহিলা এইদিক ওইদিক বার বার তাকাচ্ছে আর কার নাম যেন ধরে ডাকছে। সম্ভবত কাউকে খুঁজছে। লোকটি অহনার দিকে তাকাতেই দেখে সে নামতে চাইছে। লোকটি অহনাকে নিজ কোল থেকে নামাতেই অহনা দৌঁড়ে সেই মহিলার দিকে ছুটে চলে যায়।

_________________________________________________

চারদিকে পাগলের মত অহনাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজেই পাচ্ছি না। বার বার অহনার নাম ধরে ডাকছি কিন্তু সারা পাচ্ছি না। আশেপাশের প্রায় সকল মানুষই আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু কেউ আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে না কি হয়েছে। ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি আমি। দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি। মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে অহনাকে চাইচ্ছি। ঠিক এমন কেউ আমার পা জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। নিচে তাকাতেই অহনা। অহনাকে দেখা মাত্র আমার প্রাণে প্রাণ ফিরে আসে। আমি দ্রুত অহনার সামনে হাটু গেড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে দেই। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে থেকে ওকে ছেড়ে ওর গালে হাত রেখে উত্তেজিত কন্ঠে বলি,

— কোথায় ছিলে মামণি? তোমাকে না পেয়ে আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

— আমি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম আম্মি। তখন চকলেট আঙ্কেল এসে আমাকে উঠায় এবং ওই কিনারের বেঞ্চে নিয়ে যায় আর আমার পায়ে কাপড় বেঁধে দেন।

অহনার কথা শুনার সাথে সাথে আমি ওর হাতে পায়ের দিকে তাকাই। বা পায়ের হাটুতে খয়েরী রঙের রুমাল বাঁধা। সাথে সাথে আমি বিচলিত হয়ে যায়৷ অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— বেশি ব্যথা পেয়েছ? জ্বলছে?

অহনা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— আমি ঠিক আছি আম্মি। এত ব্যথা করছে না।

— ওই লোকটা কোথায় যে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল।

অহনা পিছে ঘুরে আঙুল দেখিয়ে বলে,

— ওই য..

কিন্তু কথাটা বলতে পারলো না। কেন না যেখানে সেই লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে সে দাঁড়িয়ে নেই। অহনা চারদিকে চোখ বুলিয়ে তার চকলেট আঙ্কেলকে খুঁজতে থাকে কিন্তু পায় না। অতঃপর ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

— এইখানেই ছিল কিন্তু এখন খুঁজে পাচ্ছি না।

আমিও চারদিকে চোখ বুলিয়ে তেমন কাউকে দেখতে পারলাম না। অতঃপর এইসব নিয়ে বেশি মাথা না ঘাটিয়ে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে অহনার কপালে চুমু এঁকে দিলাম। শান্ত কন্ঠে বললাম,

— হয়তো সে চলে গিয়েছে।

এই বলে চুপ রইলাম আমি। তারপর অহনার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— দোষ আমারই আমি তোমাকে একা রেখে না গেলে এইসব কিছুই হতো না৷ মাফ করে দিও মামণি। এর পর থেকে যত যাই হোক তোমায় একা ছাড়বো না। আর তুমিও এর পর একা একা কাউরে সাথে যাবে না বুঝেছ?

অহনা শুধু মাথা নাড়ে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ওকে কোলে তুলে নেই। রওনা হই বাসার উদ্দেশ্যে।

__________________________________________

রাত ঘনিয়ে এসেছে। ব্যস্ত শহরটি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে। কম বেশি সকলের চোখেই এসে ভীড় করেছে নিদ্রার সমুদ্র। সেই নিদ্রার সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়েছে অনেকেই। অহনাও তলিয়ে আছে সেই সমুদ্রে। আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। সে আমার সাথে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে। আমি কিছুক্ষণ তার মুখ পানে তাকিয়ে থাকি। একবারের পায়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। আজ যদি ওর কিছু হতো তাহলে আমার কি হতো তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। কেন যে এমন বোকামি করতে গেলাম কে জানে। অবশ্য কথায় আছে, “মানুষ ভুল থেকেই শিখে।” ছোট ছোট ভুল হতেই অনেক সময় আমরা বড় ধরনের ভুল করা থেকে বেঁচে যাই। আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে পড়ি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে চলে যায়। কোমড় অব্ধি চুলগুলো বিনুনি করে নেই। পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল বিধায় বাধ্য হয়ে রুম থেকে বের হই। ডায়নিং যাওয়ার সময় ভাইয়ার রুম মাঝে পরে। তার রুমের সামনে দিয়ে যেতে নিলে কিছু কথা শুনে থমকে যাই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই নিজের জায়গায়। শুনতে পাই ভাবী ভাইয়াকে বলছে,

— দুইজন মানুষের খরচ তো আর কম না। দেখছই তো এইবার খরচ বেশি হয়ে গিয়েছে আরিফ। চলতে এখন হিমসিম খেতে হচ্ছে।

#চলবে

এখন বেশ ব্যস্ত আছি। যার জন্য বড় করে পর্ব দিতে পারছি না। কয়েকদিন হয়তো বড় পর্ব দিতেও পারবো না। সরি! কিন্তু চেষ্টা করবো ছোট করে হলেও প্রতিদিন দেওয়ার।

আর বাস্তব জীবনে কার পরিণতি কি হয়েছিল তা গল্প শেষে জানানো হবে। এখন বললে গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এখন বলতে চাচ্ছি না।
#চলবে

ব্যস্ততার জন্য পর্বটা আজ পর্বটা বড় করতে পারলাম না। এর জন্য দুঃখিত।

আর যারা যারা জানতে চাইছিলেন গল্পটা আদৌ কাল্পনিক নাকি বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। তাদের জন্য বলছি প্রথম ৩ পর্ব পর্যন্ত যতটুকু লিখা হয়েছে পুরোটাই বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। কিন্তু এর পর থেকে বাকি যত পর্ব হবে তা কাল্পনিক আর বাস্তব জীবনের সংমিশ্রণ থাকবে। হ্যাপি রিডিং!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here