#আলো_আধারের_খেলা
#পর্ব_২৭_শেষ_পর্ব
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
জান্নাত মা হতে চলেছে!
রুয়েল কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে চাইছিলো না।কারণ এই দুঃসময়ে এতোবড় সুখবর সে কখনো কল্পনাই করে নি।তার এতো আনন্দ হচ্ছিলো যে খুশিতে সে সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে আবার দেশে আসতে চাইছিলো।রুয়েলের মনে হয়েছে এই সময়ে তার জান্নাতের সাথে সাথে থাকা উচিত।জান্নাতের সেবা যত্ন করা উচিত।জান্নাতের তাকে ভীষণ প্রয়োজন!
রুয়েলের এমন পাগলামো দেখে শুধু জান্নাত নয় ফ্যামিলির সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো।তারা সবাই বলতে লাগলো,মনে হয় জান্নাতই প্রথম মা হচ্ছে আর মনে হয় কেউ মা হয় নি।
রুয়েল তখন একটি কথায় বলে,বাকি সবার কথা আমি জানি না।আমি শুধু জানি জান্নাত আমার কাছে অনেক স্পেশাল একজন মানুষ। আর এই স্পেশাল মানুষ টি আবার অন্য আরেক স্পেশাল মানুষের জন্ম দিবে।সুতরাং তার জন্য তো দুশ্চিন্তা হবেই।আমার দুইটা কলিজা একসাথে আছে।আমি কিছুতেই তাদের কে রেখে এখানে থাকতে পারবো না।
রুয়েলের এমন কথা শুনে রুয়েলের মা বলে,
বাবা,তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি আমি।তুই যে কত টা খুশি হইছিস সেটাও বুঝতে পারছি।কিন্তু যে আসছে তার ভবিষ্যৎ গড়তে হবে না?কি দিয়ে গড়বি?তোর কাছে তো কোনো টাকা নাই বাবা।না আছে দামি কোনো সম্পদ।সেজন্য কয়েকটা বছর একটু ধৈর্য্য ধর বাবা।শুধু কয়েক টা বছর।তারপর আর কেউ তোকে বারন করবে না।দেখবি একদিন তোদের অনেক সুখের সংসার হবে।সারাজীবন সুখে থাকার জন্য এই কয়েকটি বছর একটু কষ্ট করতে পারবি না?
রুয়েল তার মায়ের কথা শুনে আর দেশে আসতে চাইলো না।সে ধৈর্য্য ধরে বিদেশেই থাকলো।রুয়েল আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে লাগলো।কারণ তার মনে হতে লাগলো,সে যত তাড়াতাড়ি টাকা জমাতে পারবে ততো তাড়াতাড়ি জান্নাতের কাছে চলে আসতে পারবে।কারণ জান্নাতের কথা তার ভীষণ মনে পড়ে।সে কিছুতেই এই দূরত্ব সহ্য করতে পারছিলো না।একেক টা দিন একেক টা বছরের মতো কাটতে লাগলো তার।তবুও হাজার কষ্ট বুকে ধারণ করে রুয়েল পরিশ্রম করতে লাগলো।যখনি তার জান্নাতের কথা মনে পড়ে সে ভিডিও কল দিয়ে তাকে দেখতে থাকে।তার সাথে কথা বলতে থাকে।এমনও দিন যায় যে রুয়েল এক সেকেন্ড এর জন্য কল কেটে দেয় না।ভিডিও কল অন করাই থাকে।জান্নাত কখন কি করছে সব সে প্রবাস থেকেই দেখতে থাকে।এতেই সে শান্তি খুঁজে পায়।এখন মনেই হয় না জান্নাত তার থেকে অনেক দূরে আছে।রুয়েল ভাবে জান্নাত তার সাথে সাথেই থাকে সবসময়।
দেখতে দেখতে রুয়েলের একমাত্র বংশধর পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো।রুয়েলের প্রথমেই কন্যা সন্তান হয়।কন্যা সন্তানের কথা শুনে রুয়েলের আনন্দ আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়।সে খুশিতে একদম কেঁদে ফেলে।ভিডিওর মাধ্যমেই মেয়েকে চুমু খেতে থাকে অনবরত।তার বুক টা কষ্টে একদম ফেটে যাচ্ছিলো।নিজের একমাত্র মেয়েকে সে কোলে নিতে পারছে না,আদর করতে পারছে না,এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে?
রুয়েল নিজেই নাম রাখে মেয়ের।মেয়ের নাম রাখে সিদরাতুল মুনতাহা।রুয়েল সবসময় তাকে মুন বলেই ডাকে।রুয়েল মনে করে এই অন্ধকার সংসারে চাঁদের আলো হয়ে এসেছে তার এই রাজকন্যা।
জান্নাতও বেশ খুশি মেয়েকে পেয়ে।মুনই এখন তার অবসর সময়ের একমাত্র সংঙ্গী।মেয়েকে পেয়ে সে এখন রুয়েলকেই ঠিকভাবে সময় দিতে পারে না।এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জান্নাত।সারাক্ষণ মেয়ের খেয়াল রাখতে রাখতেই তার দিন শেষ হয়ে যায়।এজন্য আবার রুয়েল রাগ করে বসে থাকে।জান্নাত তখন আবার রুয়েলের রাগ ভাংগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।অন্যদিকে আবার রুয়েল ফোন করেই সবার আগে তার মেয়ে মুনের খবর নেয়।সেজন্য আবার জান্নাত রাগ করে থাকে।সে বলে মেয়েকে পেয়ে আমাকে একদম ভুলে গেছেন।তখন আবার রুয়েল ব্যস্ত হয়ে পড়ে জান্নাতের রাগ ভাংগানোর জন্য।এই ভাবে রাগ, অভিমান আর ভালোবাসার মধ্যে কখন যে এক বছর পার হয়ে যায় তারা টেরও পায় না।
মুনের জন্মদিনে রুয়েল খুব আফসোস করতে থাকে।তার ইচ্ছা ছিলো মেয়ের জন্মদিনে সে দেশে থাকবে।কিন্তু তা আর হয় না।অবশেষে দুই বছরের মাথায় রুয়েল আর কারো কথা শোনে না।সে একবারে দেশে চলে আসে।
রুয়েল দেশে এসে যখন তার মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সে যেনো তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে গেলো।সে মনে করে তার মতো সুখী আর কেউ নয়।জান্নাতের মতো ধার্মিক সহধর্মিণী আর চাঁদের মতো দেখতে তার রাজকন্যা,আর কি লাগে তার জীবনে।রুয়েল বুকের এক পাশে তার মেয়েকে আর অন্য এক পাশে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। তার মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেনো এখানেই লুকিয়ে আছে।এই সুখ রেখে সে কি করে আবার বিদেশ চলে যাবে?না!এটা আর তার দ্বারায় সম্ভব না।সেজন্য রুয়েল সিদ্ধান্ত নিলো, সে আর যাবে না বিদেশ।এইভাবে সবাইকে রেখে সে কিছুতেই আর একা একা থাকতে পারবে না।
রুয়েল এই দুই বছরে যে কয় টাকা জমিয়েছে তা দিয়েই ব্যবসা শুরু করে দিলো।রাজার হালে না চললেও দু মুঠো খেতে পারবে তো,এই আশায় রুয়েল ব্যবসা শুরু করে দেয়।
এদিকে জান্নাত এতো ব্যস্ততার মাঝেও পড়াশোনা টা চালিয়ে যায়।রেগুলার কলেজ যেতে না পারলেও শুধু পরীক্ষার সময় এটেন্ড হয় সে।জান্নাত এইচ,এস,সি পরীক্ষাতেও অনেক ভালো রেজাল্ট করে।তবে এবার সে এ প্লাস পায় না।৪.৭৫ পেয়ে পাশ করে। তারপর জান্নাত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স এ ভর্তি হয়।
এর মধ্যে জান্নাত আবার কৌতুহলবশত প্রাইমারি জবের জন্য এপ্লাই করেছিলো।তখন এইচ,এস,সি পাশ থাকলেই প্রাইমারিতে এপ্লাই করা যেতো।ভাগ্যক্রমে জান্নাত টিকে যায় পরিক্ষায়।কিন্তু রুয়েল চাইছিলো না জান্নাত জব টা করুক।রুয়েলের কথা জান্নাত কে সে কোনো জব করতে দিবে না।জান্নাত যতদূর মন চায় পড়ুক,কিন্তু জব তাকে করতে দিবো না।তখন পরিবারের সবাই রুয়েলকে বোঝাতে থাকে।মানুষ টাকা দিয়েই জব পায় না,আর জান্নাত সেখানে মেধা দিয়ে টিকে গেছে।তাছাড়া প্রাইমারির জব তো খারাপ জব না।আর তেমন কোনো কষ্টও নেই।বাসা থেকেই চাকরি করা যায়।সেজন্য রুয়েল আর কিছু বলে না।জান্নাত পর্দার সহিত প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে থাকে।
দুই বছর পর তাদের একটা ছেলে বাচ্চা হয়।ছেলেটা হুবহু রুয়েলের মতো দেখতে হয়।যে কেউ এক নজর দেখাতেই বলে দিতে পারে এটা রুয়েলের ছেলে।রুয়েল ছেলের নাম রাখে মুবিন।
বর্তমানে রুয়েল আর জান্নাতের মতো সুখী দম্পতি ঐ এলাকায় একজনও নাই।এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে খুবই সুখে আছে জান্নাত রুয়েল।রুয়েল তার ব্যবসা টা চালিয়ে যায়।এখন ভালোই চলছে রুয়েলের ব্যবসা।পাশাপাশি সে স্টক বিজনেস ও শুরু করে দিয়েছে।
প্রকৃতি সবসময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।সেজন্যই তো যে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে,পরিণামে তাকেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
রুবেল আর ঊর্মি রুয়েলের সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়ে ভেবেছিলো তারা খুব ভালো থাকবে।কিন্তু প্রকৃতি যে কাউকে ছাড় দেয় না এটা মনে হয় তাদের জানা ছিলো না।শুধুমাত্র ঊর্মির কুটনামির কারণে তাদের সাজানো গোছানো সংসার টা একেবারে ভেংগে চুরমার হয়ে গেলো।ঊর্মি নিজেও ভালো থাকতে পারলো না,আর তার ছেলেমেয়েদের জীবন টাও একদম তছনছ করে ফেললো।
ঊর্মি রুবেলের সংসারে ছিলো রাজরানীর মতোন,যখন যেটা মনে করতো সেটাই তার সামনে হাজির হয়ে যেতো।কিন্তু আজ সেই ঊর্মি ভাই এর বাড়িতে কাজ করে খায়।ভাই বউ দিন রাত গালিগালাজ করে।তবুও দু মুঠো ভাতের আশায় সে ওই বাড়িতেই পড়ে আছে।
এক পর্যায়ে সে মানসিক ভাবে ভীষণ ভেংগে পড়ে।এবং শেষ পর্যন্ত সে আত্নহত্যার আশ্রয় নেয়।কথায় আছে লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু। কথাটা যেনো একদম সত্যি হলো।
অন্যদিকে ঊর্মির ছেলে হৃদয় পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।কোনদিন যে সেও দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।কারণ অসর্তকভাবে চলাফেরা করার জন্য কিছুদিন আগেই এক গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে যায়।
ঊর্মির মেয়ে হিয়া অভাবের তাড়নায় স্বামী তুহিনের সাথে গার্মেন্টস এ চাকরি করছে।কথায় আছে যে মেয়ের নফস ভালো নয়, সে কোনোদিনই ভালো হতে পারে না?হিয়া তুহিনের সাথে চাকরি করতে করতে রাজু নামের এক ছেলের সাথে আবার ভাগিয়ে যায়।সে যখন দেখলো তুহিনের সাথে থাকলে তাকে এভাবে চাকরি করে খেতে হবে তারচেয়ে বরং রাজুই ভালো।শোনা যাচ্ছে রাজু গার্মেন্টস এর সুপারভাইজার।রাজু হলো হিয়ার তিন নম্বর স্বামী।আল্লাহই জানে এই সংসার তার কয় দিন টেকে।
আর রুবেল তো তার কৃতকর্মের ফল আগেই ভোগ করেছে।কি নির্মম ভাবে তাকে মারা হয়েছে!রুবেলের শাস্তি টা ভালোভাবেই হয়েছে।কারণ সেই সবচেয়ে বড় অপরাধী ছিলো।
ঊর্মি যতই তাকে অন্যায় কাজ করতে বলুক,সে কেনো সেটা বিচার না করেই করতে যাবে?তার তো একবার ভাবা উচিত ছিলো রুয়েল তার নিজের আপন ভাই হয়।সেই ২০ বছর বয়স থেকে রুয়েল তাদেরকে ইনকাম করে দিচ্ছে।নিজের কাছে একটা টাকাও রাখে নি।একজন ছোট ভাই তার বড় ভাইকে কতটা বিশ্বাস করলে এইভাবে সব টাকা পয়সা তার এর কাছে জমা রাখে!রুয়েল এতোটাই বিশ্বাস করতো রুবেল কে।রুয়েল ভাবতো বাবার পরেই তার ভাই এর স্থান।সে তার ভাইকে যথাযথ সম্মান আর শ্রদ্ধা করতো।সেজন্যই তো নিঃস্বার্থভাবে সবকিছু তাকে উজাড় করে দিয়েছিলো।
রুয়েল নিজের পুরো ইয়ংকাল বিদেশেই পার করে দিয়েছে।তবুও সে একবারের জন্য বলে নি ভাইয়া আমি আর বিদেশ থাকবো না,এবার দেশে গিয়ে বিয়ে করবো,একবারের জন্য বলে নি আর আমি আপনাদের কোনো টাকা দিতে পারবো না,আমার তো নিজের একটা ভবিষ্যৎ আছে।সে তার ভাই এর সংসার টাকেই নিজের পরিবার মনে করতো।হিয়া আর হৃদয় কে নিজের ছেলেমেয়েদের মতো ভাবতো।সেজন্যই তো তারা যখন যেটা আবদার করতো সাথে সাথে রুয়েল সেটা পূরন করতো।
সেই সহজ সরল ভাইকে ঠকাতে রুবেলের একটুও বুক কাঁপলো না।সে তার দুশ্চরিত্রা পরকিয়ায় আসক্ত কাল নাগিনী বউ এর কথা শুনে এক নিমিষেই তার ভাই কে ভুলে গেলো,তার পাঠানো সব টাকা পয়সা অস্বীকার করলো,শেষ পর্যন্ত তার সব সম্পদ পর্যন্ত কেড়ে নিলো।
কি বেঈমান ভাই ছিলো রুবেল!
অন্যদিকে সবকিছু হারিয়ে নিঃশ্ব রুয়েল নতুন করে আবার তার যাত্রা শুরু করে।তাকে ঠকিয়ে কোন লাভ হয় নাই রুবেলের।মাত্র কিছুবছর একটু তাদেরকে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।তবে সেই কষ্ট কে রুয়েল কষ্টই মনে করে নি।কারণ তার সাথে ছিলো জান্নাতের মতো একজন ধার্মিক সহধর্মিণী। যে সবসময় তার মনে সাহস যোগাতো।নামায কালাম পড়ে আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করতো।সেজন্যই তো আল্লাহ তাদের নিরাশ করেন নি।
জান্নাত ছিলো রুয়েলের মনে সাহস জাগানোর একমাত্র কারিগর। জান্নাত ইচ্ছা করলে রুয়েলকে ছেড়ে চলে যেতে পারতো।কারণ রুয়েলের তো কিছুই ছিলো না।সে একদম নিঃশ্ব হয়ে গিয়েছিলো।তবুও জান্নাত রুয়েলকে ছেড়ে যায় নি।বরং ছেড়ে যাওয়ার বিনিময়ে তাকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করে।আর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে,ইনশাআল্লাহ আবার একদিন আমাদের সবকিছু হবে।হ্যাঁ তাদের এখন সবকিছুই হয়েছে।তবে আগের মতো উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর ঘুরে বেড়ানোর জন্য গাড়ি না হলেও যা করেছে সেটুকুর জন্যই তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।তারা আলহামদুলিল্লাহ অনেক অনেক ভালো আছে।
সমাপ্ত
সামনে আমার পরীক্ষা এজন্য তাড়াতাড়ি করে শেষ করে দিলাম গল্পটা।কেমন লেগেছে পুরো গল্পটা অবশ্যই জানাবে সবাই।আর ভুল ত্রুটি হলে অবশ্যই ধরিয়ে দেবে।
আল্লাহ হাফেজ।সবাই ভালো থাকবেন।এর মধ্যে আর কোনো গল্প দিবো না।পরীক্ষা শেষ হলে দিবো ইনশাআল্লাহ।#আলো_আধারের_খেলা
#পর্ব_২৭_শেষ_পর্ব
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
জান্নাত মা হতে চলেছে!
রুয়েল কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে চাইছিলো না।কারণ এই দুঃসময়ে এতোবড় সুখবর সে কখনো কল্পনাই করে নি।তার এতো আনন্দ হচ্ছিলো যে খুশিতে সে সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে আবার দেশে আসতে চাইছিলো।রুয়েলের মনে হয়েছে এই সময়ে তার জান্নাতের সাথে সাথে থাকা উচিত।জান্নাতের সেবা যত্ন করা উচিত।জান্নাতের তাকে ভীষণ প্রয়োজন!
রুয়েলের এমন পাগলামো দেখে শুধু জান্নাত নয় ফ্যামিলির সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো।তারা সবাই বলতে লাগলো,মনে হয় জান্নাতই প্রথম মা হচ্ছে আর মনে হয় কেউ মা হয় নি।
রুয়েল তখন একটি কথায় বলে,বাকি সবার কথা আমি জানি না।আমি শুধু জানি জান্নাত আমার কাছে অনেক স্পেশাল একজন মানুষ। আর এই স্পেশাল মানুষ টি আবার অন্য আরেক স্পেশাল মানুষের জন্ম দিবে।সুতরাং তার জন্য তো দুশ্চিন্তা হবেই।আমার দুইটা কলিজা একসাথে আছে।আমি কিছুতেই তাদের কে রেখে এখানে থাকতে পারবো না।
রুয়েলের এমন কথা শুনে রুয়েলের মা বলে,
বাবা,তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি আমি।তুই যে কত টা খুশি হইছিস সেটাও বুঝতে পারছি।কিন্তু যে আসছে তার ভবিষ্যৎ গড়তে হবে না?কি দিয়ে গড়বি?তোর কাছে তো কোনো টাকা নাই বাবা।না আছে দামি কোনো সম্পদ।সেজন্য কয়েকটা বছর একটু ধৈর্য্য ধর বাবা।শুধু কয়েক টা বছর।তারপর আর কেউ তোকে বারন করবে না।দেখবি একদিন তোদের অনেক সুখের সংসার হবে।সারাজীবন সুখে থাকার জন্য এই কয়েকটি বছর একটু কষ্ট করতে পারবি না?
রুয়েল তার মায়ের কথা শুনে আর দেশে আসতে চাইলো না।সে ধৈর্য্য ধরে বিদেশেই থাকলো।রুয়েল আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে লাগলো।কারণ তার মনে হতে লাগলো,সে যত তাড়াতাড়ি টাকা জমাতে পারবে ততো তাড়াতাড়ি জান্নাতের কাছে চলে আসতে পারবে।কারণ জান্নাতের কথা তার ভীষণ মনে পড়ে।সে কিছুতেই এই দূরত্ব সহ্য করতে পারছিলো না।একেক টা দিন একেক টা বছরের মতো কাটতে লাগলো তার।তবুও হাজার কষ্ট বুকে ধারণ করে রুয়েল পরিশ্রম করতে লাগলো।যখনি তার জান্নাতের কথা মনে পড়ে সে ভিডিও কল দিয়ে তাকে দেখতে থাকে।তার সাথে কথা বলতে থাকে।এমনও দিন যায় যে রুয়েল এক সেকেন্ড এর জন্য কল কেটে দেয় না।ভিডিও কল অন করাই থাকে।জান্নাত কখন কি করছে সব সে প্রবাস থেকেই দেখতে থাকে।এতেই সে শান্তি খুঁজে পায়।এখন মনেই হয় না জান্নাত তার থেকে অনেক দূরে আছে।রুয়েল ভাবে জান্নাত তার সাথে সাথেই থাকে সবসময়।
দেখতে দেখতে রুয়েলের একমাত্র বংশধর পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো।রুয়েলের প্রথমেই কন্যা সন্তান হয়।কন্যা সন্তানের কথা শুনে রুয়েলের আনন্দ আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়।সে খুশিতে একদম কেঁদে ফেলে।ভিডিওর মাধ্যমেই মেয়েকে চুমু খেতে থাকে অনবরত।তার বুক টা কষ্টে একদম ফেটে যাচ্ছিলো।নিজের একমাত্র মেয়েকে সে কোলে নিতে পারছে না,আদর করতে পারছে না,এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে?
রুয়েল নিজেই নাম রাখে মেয়ের।মেয়ের নাম রাখে সিদরাতুল মুনতাহা।রুয়েল সবসময় তাকে মুন বলেই ডাকে।রুয়েল মনে করে এই অন্ধকার সংসারে চাঁদের আলো হয়ে এসেছে তার এই রাজকন্যা।
জান্নাতও বেশ খুশি মেয়েকে পেয়ে।মুনই এখন তার অবসর সময়ের একমাত্র সংঙ্গী।মেয়েকে পেয়ে সে এখন রুয়েলকেই ঠিকভাবে সময় দিতে পারে না।এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জান্নাত।সারাক্ষণ মেয়ের খেয়াল রাখতে রাখতেই তার দিন শেষ হয়ে যায়।এজন্য আবার রুয়েল রাগ করে বসে থাকে।জান্নাত তখন আবার রুয়েলের রাগ ভাংগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।অন্যদিকে আবার রুয়েল ফোন করেই সবার আগে তার মেয়ে মুনের খবর নেয়।সেজন্য আবার জান্নাত রাগ করে থাকে।সে বলে মেয়েকে পেয়ে আমাকে একদম ভুলে গেছেন।তখন আবার রুয়েল ব্যস্ত হয়ে পড়ে জান্নাতের রাগ ভাংগানোর জন্য।এই ভাবে রাগ, অভিমান আর ভালোবাসার মধ্যে কখন যে এক বছর পার হয়ে যায় তারা টেরও পায় না।
মুনের জন্মদিনে রুয়েল খুব আফসোস করতে থাকে।তার ইচ্ছা ছিলো মেয়ের জন্মদিনে সে দেশে থাকবে।কিন্তু তা আর হয় না।অবশেষে দুই বছরের মাথায় রুয়েল আর কারো কথা শোনে না।সে একবারে দেশে চলে আসে।
রুয়েল দেশে এসে যখন তার মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সে যেনো তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে গেলো।সে মনে করে তার মতো সুখী আর কেউ নয়।জান্নাতের মতো ধার্মিক সহধর্মিণী আর চাঁদের মতো দেখতে তার রাজকন্যা,আর কি লাগে তার জীবনে।রুয়েল বুকের এক পাশে তার মেয়েকে আর অন্য এক পাশে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। তার মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেনো এখানেই লুকিয়ে আছে।এই সুখ রেখে সে কি করে আবার বিদেশ চলে যাবে?না!এটা আর তার দ্বারায় সম্ভব না।সেজন্য রুয়েল সিদ্ধান্ত নিলো, সে আর যাবে না বিদেশ।এইভাবে সবাইকে রেখে সে কিছুতেই আর একা একা থাকতে পারবে না।
রুয়েল এই দুই বছরে যে কয় টাকা জমিয়েছে তা দিয়েই ব্যবসা শুরু করে দিলো।রাজার হালে না চললেও দু মুঠো খেতে পারবে তো,এই আশায় রুয়েল ব্যবসা শুরু করে দেয়।
এদিকে জান্নাত এতো ব্যস্ততার মাঝেও পড়াশোনা টা চালিয়ে যায়।রেগুলার কলেজ যেতে না পারলেও শুধু পরীক্ষার সময় এটেন্ড হয় সে।জান্নাত এইচ,এস,সি পরীক্ষাতেও অনেক ভালো রেজাল্ট করে।তবে এবার সে এ প্লাস পায় না।৪.৭৫ পেয়ে পাশ করে। তারপর জান্নাত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স এ ভর্তি হয়।
এর মধ্যে জান্নাত আবার কৌতুহলবশত প্রাইমারি জবের জন্য এপ্লাই করেছিলো।তখন এইচ,এস,সি পাশ থাকলেই প্রাইমারিতে এপ্লাই করা যেতো।ভাগ্যক্রমে জান্নাত টিকে যায় পরিক্ষায়।কিন্তু রুয়েল চাইছিলো না জান্নাত জব টা করুক।রুয়েলের কথা জান্নাত কে সে কোনো জব করতে দিবে না।জান্নাত যতদূর মন চায় পড়ুক,কিন্তু জব তাকে করতে দিবো না।তখন পরিবারের সবাই রুয়েলকে বোঝাতে থাকে।মানুষ টাকা দিয়েই জব পায় না,আর জান্নাত সেখানে মেধা দিয়ে টিকে গেছে।তাছাড়া প্রাইমারির জব তো খারাপ জব না।আর তেমন কোনো কষ্টও নেই।বাসা থেকেই চাকরি করা যায়।সেজন্য রুয়েল আর কিছু বলে না।জান্নাত পর্দার সহিত প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে থাকে।
দুই বছর পর তাদের একটা ছেলে বাচ্চা হয়।ছেলেটা হুবহু রুয়েলের মতো দেখতে হয়।যে কেউ এক নজর দেখাতেই বলে দিতে পারে এটা রুয়েলের ছেলে।রুয়েল ছেলের নাম রাখে মুবিন।
বর্তমানে রুয়েল আর জান্নাতের মতো সুখী দম্পতি ঐ এলাকায় একজনও নাই।এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে খুবই সুখে আছে জান্নাত রুয়েল।রুয়েল তার ব্যবসা টা চালিয়ে যায়।এখন ভালোই চলছে রুয়েলের ব্যবসা।পাশাপাশি সে স্টক বিজনেস ও শুরু করে দিয়েছে।
প্রকৃতি সবসময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।সেজন্যই তো যে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে,পরিণামে তাকেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
রুবেল আর ঊর্মি রুয়েলের সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়ে ভেবেছিলো তারা খুব ভালো থাকবে।কিন্তু প্রকৃতি যে কাউকে ছাড় দেয় না এটা মনে হয় তাদের জানা ছিলো না।শুধুমাত্র ঊর্মির কুটনামির কারণে তাদের সাজানো গোছানো সংসার টা একেবারে ভেংগে চুরমার হয়ে গেলো।ঊর্মি নিজেও ভালো থাকতে পারলো না,আর তার ছেলেমেয়েদের জীবন টাও একদম তছনছ করে ফেললো।
ঊর্মি রুবেলের সংসারে ছিলো রাজরানীর মতোন,যখন যেটা মনে করতো সেটাই তার সামনে হাজির হয়ে যেতো।কিন্তু আজ সেই ঊর্মি ভাই এর বাড়িতে কাজ করে খায়।ভাই বউ দিন রাত গালিগালাজ করে।তবুও দু মুঠো ভাতের আশায় সে ওই বাড়িতেই পড়ে আছে।
এক পর্যায়ে সে মানসিক ভাবে ভীষণ ভেংগে পড়ে।এবং শেষ পর্যন্ত সে আত্নহত্যার আশ্রয় নেয়।কথায় আছে লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু। কথাটা যেনো একদম সত্যি হলো।
অন্যদিকে ঊর্মির ছেলে হৃদয় পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।কোনদিন যে সেও দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।কারণ অসর্তকভাবে চলাফেরা করার জন্য কিছুদিন আগেই এক গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে যায়।
ঊর্মির মেয়ে হিয়া অভাবের তাড়নায় স্বামী তুহিনের সাথে গার্মেন্টস এ চাকরি করছে।কথায় আছে যে মেয়ের নফস ভালো নয়, সে কোনোদিনই ভালো হতে পারে না?হিয়া তুহিনের সাথে চাকরি করতে করতে রাজু নামের এক ছেলের সাথে আবার ভাগিয়ে যায়।সে যখন দেখলো তুহিনের সাথে থাকলে তাকে এভাবে চাকরি করে খেতে হবে তারচেয়ে বরং রাজুই ভালো।শোনা যাচ্ছে রাজু গার্মেন্টস এর সুপারভাইজার।রাজু হলো হিয়ার তিন নম্বর স্বামী।আল্লাহই জানে এই সংসার তার কয় দিন টেকে।
আর রুবেল তো তার কৃতকর্মের ফল আগেই ভোগ করেছে।কি নির্মম ভাবে তাকে মারা হয়েছে!রুবেলের শাস্তি টা ভালোভাবেই হয়েছে।কারণ সেই সবচেয়ে বড় অপরাধী ছিলো।
ঊর্মি যতই তাকে অন্যায় কাজ করতে বলুক,সে কেনো সেটা বিচার না করেই করতে যাবে?তার তো একবার ভাবা উচিত ছিলো রুয়েল তার নিজের আপন ভাই হয়।সেই ২০ বছর বয়স থেকে রুয়েল তাদেরকে ইনকাম করে দিচ্ছে।নিজের কাছে একটা টাকাও রাখে নি।একজন ছোট ভাই তার বড় ভাইকে কতটা বিশ্বাস করলে এইভাবে সব টাকা পয়সা তার এর কাছে জমা রাখে!রুয়েল এতোটাই বিশ্বাস করতো রুবেল কে।রুয়েল ভাবতো বাবার পরেই তার ভাই এর স্থান।সে তার ভাইকে যথাযথ সম্মান আর শ্রদ্ধা করতো।সেজন্যই তো নিঃস্বার্থভাবে সবকিছু তাকে উজাড় করে দিয়েছিলো।
রুয়েল নিজের পুরো ইয়ংকাল বিদেশেই পার করে দিয়েছে।তবুও সে একবারের জন্য বলে নি ভাইয়া আমি আর বিদেশ থাকবো না,এবার দেশে গিয়ে বিয়ে করবো,একবারের জন্য বলে নি আর আমি আপনাদের কোনো টাকা দিতে পারবো না,আমার তো নিজের একটা ভবিষ্যৎ আছে।সে তার ভাই এর সংসার টাকেই নিজের পরিবার মনে করতো।হিয়া আর হৃদয় কে নিজের ছেলেমেয়েদের মতো ভাবতো।সেজন্যই তো তারা যখন যেটা আবদার করতো সাথে সাথে রুয়েল সেটা পূরন করতো।
সেই সহজ সরল ভাইকে ঠকাতে রুবেলের একটুও বুক কাঁপলো না।সে তার দুশ্চরিত্রা পরকিয়ায় আসক্ত কাল নাগিনী বউ এর কথা শুনে এক নিমিষেই তার ভাই কে ভুলে গেলো,তার পাঠানো সব টাকা পয়সা অস্বীকার করলো,শেষ পর্যন্ত তার সব সম্পদ পর্যন্ত কেড়ে নিলো।
কি বেঈমান ভাই ছিলো রুবেল!
অন্যদিকে সবকিছু হারিয়ে নিঃশ্ব রুয়েল নতুন করে আবার তার যাত্রা শুরু করে।তাকে ঠকিয়ে কোন লাভ হয় নাই রুবেলের।মাত্র কিছুবছর একটু তাদেরকে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।তবে সেই কষ্ট কে রুয়েল কষ্টই মনে করে নি।কারণ তার সাথে ছিলো জান্নাতের মতো একজন ধার্মিক সহধর্মিণী। যে সবসময় তার মনে সাহস যোগাতো।নামায কালাম পড়ে আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করতো।সেজন্যই তো আল্লাহ তাদের নিরাশ করেন নি।
জান্নাত ছিলো রুয়েলের মনে সাহস জাগানোর একমাত্র কারিগর। জান্নাত ইচ্ছা করলে রুয়েলকে ছেড়ে চলে যেতে পারতো।কারণ রুয়েলের তো কিছুই ছিলো না।সে একদম নিঃশ্ব হয়ে গিয়েছিলো।তবুও জান্নাত রুয়েলকে ছেড়ে যায় নি।বরং ছেড়ে যাওয়ার বিনিময়ে তাকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করে।আর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে,ইনশাআল্লাহ আবার একদিন আমাদের সবকিছু হবে।হ্যাঁ তাদের এখন সবকিছুই হয়েছে।তবে আগের মতো উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর ঘুরে বেড়ানোর জন্য গাড়ি না হলেও যা করেছে সেটুকুর জন্যই তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।তারা আলহামদুলিল্লাহ অনেক অনেক ভালো আছে।
সমাপ্ত