জাহান একদম গাছের মগডালে উঠে আম পারছে।আর
কালো নিকাব,কালো হিজাব আর পুরো শরীরে কালো বোরকায় আবৃত জান্নাত বসে থেকে আম কুড়াচ্ছে।
হঠাৎ একদল ছেলে আম গাছটার নিচ দিয়ে যাচ্ছিলো।
তারা জান্নাত আর জাহানকে দেখামাত্র চিৎকার করে বলে উঠলো,
এই মেয়েরা আম চুরি করছো কেনো?
এদের মধ্যে থেকে একটি ছেলে এবার জান্নাতের দিকে এগিয়ে এসে বললো,বোরকা পড়ে আম চুরি করা হচ্ছে?তোমাদের মতো কিছু মুখোশধারি বোরকাওয়ালির জন্য সব বোরকা পড়া মেয়েদের বদনাম হয়।
অচেনা কোনো ছেলের কন্ঠ শোনামাত্র জান্নাত আম রেখেই দৌঁড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো।সে একটিবারের জন্যও ছেলেগুলোর দিকে তাকালো না।
কিন্তু জাহান কিছুতেই পালালো না।সে গাছ থেকে তড়তড় করে নেমে সোজা ছেলেগুলোর কাছে এগিয়ে এলো,সে ভালোভাবে তাকালো ছেলেগুলোর দিকে।একজন ছেলেও তাদের গ্রামের ছিলো না।সেজন্য সে স্পষ্ট করে বললো,
ভাইয়া এটা আমাদের বাড়ি।আর গাছগুলোও আমাদের।সেই হিসেবে আমগুলোও আমাদের।নিজের গাছ থেকে আম পারলে সেটাকে চুরি করা বলে না।না জেনে এভাবে কাউকে চোর বলা ঠিক না।নেক্সট টাইম কাউকে কিছু বলার আগে ভালোভাবে জেনে বলবেন।ওকে।
এই বলে জাহান আমগুলো কুড়াতে লাগলো।ছেলেগুলো এখনো হা করে তাকিয়ে আছে।জাহান তখন গুনেগুনে পাঁচটি আম একটা ছেলের হাতে দিয়ে বললো,সবাই মিলে খান।আমাদের গাছের আম অনেক বেশি মিষ্টি।এই বলে বাকি আমগুলো নিয়ে জাহান বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।
ছেলেগুলো জাহানের কথা শুনে একদম বেকুব হয়ে গেলো।এটা মেয়ে না অন্যকিছু।তারা যে এই বাড়ির মেয়ে,এই কথাটা ভালোভাবে বললে কি হতো?তারা তো আর জেনেবুঝে বলে নি কথাটা।আবার তাদের আমও খেতে দিলো।বড়ই আজব মেয়ে তো!
এদের মধ্যে আবার একজন ছেলে জান্নাতকে নিয়ে ভাবছে।কারণ তার মাথাতে এটা কিছুতেই ঢুকলো না, যদি এটা এদের ই বাড়ি হয়,আর গাছগুলোও তাদের ই হয় তাহলে ওই মেয়েটা ওভাবে বোরকা পড়া অবস্থায় আম কুড়াচ্ছে কেনো?
জান্নাত আর জাহান আপন দুই বোন।তবে দুইজনের আচার আচরণ দুই ধরনের।জান্নাত নম্র,ভদ্র,আর পর্দাশীল একটা মেয়ে।সে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে,কোরান শরিফ পাঠ করে।বলতে গেলে খুবই আল্লাহভীরু মেয়ে জান্নাত।জান্নাতের আরেকটা বিশেষ গুন হলো, তার চেহারা এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষ মানুষ ই দেখে নি।শুধুমাত্র তার বাবা ছাড়া।সে বাড়ির বাহিরে গেলেই পুরো শরীর কালো বোরকা হিজাব আর নিকাবে ঢেকে রাখে।
আর অন্যদিকে জাহান চঞ্চল টাইপের একটা মেয়ে।খুব বেশি কথা বলে,কেউ কিছু বললে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে।জাহান জান্নাতের মতো এমন পর্দাশীল নয়।তবুও এক প্রকার বাধ্য হয়ে শুধু মাথায় হিজাব টা দেয়।সেটাও শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়ার সময়।কোনো আত্নীয়র বাড়িতে গেলে আবার সাজগোছ করে যায়।হাজার চেষ্টা করেও জান্নাত তাকে বোরকা পড়াতে পারে না।এ নিয়ে দুই বোনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হয়।জাহান সাফ জানিয়ে দিয়েছে এভাবে তাকে জোর করে সে হিজাব নিকাব পড়াতে পারবে না।সে খোলামেলা পছন্দ করে।নিকাব পড়লে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
জান্নাত বাড়ির মধ্যে ঢুকেই বোরকা টা খুলে ফেলে।আর মাথায় ওড়না দিয়ে আম কাটতে বসে।এদিকে জাহান লবন মরিচ মাখছে।দুইবোন লবণ মরিচ মাখিয়ে খুব মজা করে আম খাচ্ছে।আর তাদের আম্মু বারান্দায় বসে নকশি কাঁথা সেলাই করছে।
হঠাৎ বাড়ির মধ্যে জান্নাতের আব্বু প্রবেশ করলো।তিনি এসেই জান্নাতের আম্মুকে বললেন,
জান্নাতের আম্মু শুনছো,আমাদের জান্নাতের সাথে হাফিজের ছোট ছেলে রুয়েলের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না।
জান্নাতের আম্মু কথাটা শোনামাত্র ভীষণ চমকে গেলেন।সেজন্য তিনি কাঁথা সেলাই বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি করে উঠে এলেন।আর বললেন,
কি বলছেন আপনি?কোন হাফিজ?আমাদের গ্রামে তো একটাই হাফিজ।তাদের ছোট ছেলের সাথে আমাদের মেয়ের বিয়ে! এটা কি করে সম্ভব!তুমি তো তোমার মেয়েকে ভালো করেই চেনো।জান্নাত ঐ ফ্যামিলি তে গিয়ে নিজেকে এডজাস্ট করবে কিভাবে?
–হ,হ।আমি নিজেও টাস্কি খাইয়া গেছি।কিভাবে ওরা এই বিয়ের প্রস্তাব দিলো?ওদের বাড়ির বড় বউ ঊর্মির সাথে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারবে না জান্নাত।কি বেপর্দা ভাবে চলাফেরা করে।আর বাচ্চাগুলো যে মর্ডান ড্রেস পড়ে গ্রামে আসে যা দেখার মতো নয়।
এদিকে জান্নাত তার বিয়ের কথা শোনামাত্র আম খাওয়া বাদ দিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলো।তার ভীষণ মন খারাপ হলো।কারণ সে কিছুতেই এখন বিয়ে করতে চায় না।সে মাত্র এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়েছে।এখনো রেজাল্ট বের হয় নি।তার ইচ্ছা অনেকদূর পর্যন্ত পড়ালেখা করবে সে।গ্রামের আট দশটা মেয়েদের মতো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে না।কিন্তু তার বাবা মা তার কথা শুনলে তো।তাছাড়া জান্নাত তার বাবা মার মুখের উপর দিয়ে একটি কথাও বলে না।
কাউকে কিছু না বলে জান্নাত তার রুমে বসে একা একা কাঁদতে লাগলো।
এদিকে জাহান জান্নাতকে খুঁজতে খুঁজতে তার রুমে চলে আসলো।জান্নাতকে এভাবে কাঁদা দেখে বললো,
এ আপু কাঁদছিস কেনো?শুনলাম ছেলেরা বিশাল বড়লোক।বিল্ডিং বাড়ি,গাড়ি সবকিছু আছে।আর টাকার তো কোনো অভাবই নাই।তোর যতদূর মন চায় ততদূর পড়তেও পারবি।তাছাড়া আজ না হয় কাল তো বাবা তোকে বিয়ে দেবেই।
জাহানের কথা শুনেও কোনো কথা বললো না জান্নাত।সে অঝোর ধারায় কেঁদেই চলছে।
জাহান এবার জান্নাতের ঘাড় ধরে বললো, সবই ঠিক আছে।কিন্তু ছেলের বয়স টা একটু বেশি।তোর থেকে কম হলেও ২০ বছরের বড় হবে।আবার পড়ালেখাও কম।মাত্র এস,এস,সি পর্যন্ত পড়েছে।পরীক্ষা না দিতেই বিদেশ উড়াল দিয়েছে।
জান্নাত তা শুনে চিৎকার করে বললো,
তুই যাবি এখান থেকে।এই বলে সে আরো জোরে জোরে করে কাঁদতে লাগলো।
আজ সারাদিন জান্নাতের কাঁদতে কাঁদতেই চলে গেলো।জান্নাত কে এরকম কাঁদা দেখে এবার তার দাদী শান্ত্বনা দিতে এলো।
–পাগল মেয়ে কোথাকার।বিয়ের কথা বলতেই কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি?
জান্নাত তার দাদীকে দেখে বললো,তোমরা সবাই কি শুরু করেছো বলো তো?মাত্র এস,এস,সি পরীক্ষা দিলাম।আর এক্ষুনি কেনো বিয়ের কথা ভাবছো তোমরা?
জান্নাতের দাদী তখন জান্নাত এর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,এটাই তো মেয়েদের উপযুক্ত বিয়ের বয়স।এখন চেহারায় যে লাবণ্য আছে আর দুই বছর পরে সেটা আর থাকবে না।তখন আর কেউ বিয়ে করতে চাইবে।
–না করলে না করবে।আমি এখন বিয়ে করবো না করবো না।এই বলে জান্নাত তার দাদীর কাছ থেকে দূরে সরে গেলো।তখন জান্নাতের দাদী জান্নাতের কাছে গিয়ে বললো,ঘর টা অনেক ভালো।সবচেয়ে বেশি ভালো ছেলেটা।যেমন দেখতে সুন্দর,তেমনি তার সুন্দর ব্যবহার।এখন যে কেমন হয়েছে দেখতে জানি না।সেই ২০ বছর আগে দেখেছি।তবে ২০ বছরের সেই ইয়ং সুঠামদেহী রুয়েলের চেহারা এখনো ভাসছে চোখে আমার।আমাকে দেখলে তো একদম দাদী দাদী করে পাগল হয়ে যেতো।
জান্নাত দাদীর কথা শুনে একদম চমকে উঠলো।দাদী চিনলো কেমনে এই ছেলেকে?জান্নাতকে এভাবে অবাক হওয়া দেখে দাদী বললো,
আমাদের পুরাতন বাড়ির পাশেই ওদের গ্রামের বাড়ি ছিলো।মাঝে মাঝে গ্রামে ঘুরতে এলে আমাদের বাড়ি আসতো।তোকে ছোট বেলায় কত কোলে নিয়েছে।কিন্তু বিদেশ চলে যাওয়ার পর আর একবারও দেখা হয় নি।
দাদী জান্নাতের সাথে কথা বলতেই জাহান হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে প্রবেশ করলো।এই আপু!তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।পাত্রপক্ষ তোকে দেখতে এসেছে।আম্মু বললো,আজ যেনো তুই বোরকা না পড়িস।সুন্দর একটা জামা পড়তে বললো।
জান্নাত জাহানের কথা শুনে বললো, মরে গেলেও আমি জামা পড়ে ওসব ছেলে মানুষের সামনে যাবো না।দেখি কিভাবে আমাকে নিয়ে যাও তোরা।এই বলে জান্নাত কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
জান্নাত কে অসময়ে এভাবে শোয়া দেখে তার দাদী ডাকতে লাগলো।জান্নাত,পাগলামি করিস না।বিয়ের মানুষ মুখ দেখলে কিছু হয় না।তাছাড়া কেউ যদি তোর চেহারা না দেখে কিভাবে পছন্দ করবে?যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।শুধু আজকে একটু মুখ টা খুলে রাখ।
জান্নাত তার দাদীর কথার কোনো গুরুত্বই দিলো না।সে আগের মতো শুয়ে থাকলো।
এদিকে জান্নাতের আম্মু নাস্তা রেডি করা নিয়ে ব্যস্ত।তিনি জান্নাতের কাছে আসতেই পারছেন না।জান্নাতের আব্বু জান্নাত কে না দেখে নিজেই চলে এলেন।জান্নাত তার আব্বুকে দেখামাত্র তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়লো।কারণ জান্নাত তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়।কারণ তার বাবা ভীষণ রাগী আর রগচটা।ওনার মুখের উপর দিয়ে কিছুতেই কথা বলা যায় না।জান্নাত কে দেখামাত্র তার বাবা বললো, কখন বলেছি রেডি হতে?এখনো হস নি কেনো?তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চলে আয়।সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।এই বলে জান্নাতের আব্বু চলে গেলো।আর বিড়বিড় করে বললো,এতো তাড়া যে কেনো এদের কিছুই বুজছি না।কিছুক্ষণ আগেই প্রস্তাব দিলো।আর এক্ষুনি আবার কাউকে কিছু না বলে দেখার জন্য চলে এসেছে।
জান্নাত তার আব্বুর কথা শুনেও রেডি হলো না।যে জামা পড়া ছিলো সেই জামার উপরেই বোরকা টা পড়ে নিলো।তারপর হিজাব নিকাব সব পড়লো।জান্নাতকে এভাবে রেডি হওয়া দেখে দাদী আর জাহান হা করে তাকিয়ে রইলো।এতোকিছু বলার পরও জান্নাত তার মন মতোই রেডি হলো!
#আলো_আধারের_খেলা
#সূচনা_পর্ব
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
#চলবে,