আলো আধারের খেলা পর্ব -০২+৩

#আলো_আধারের_খেলা
#পর্ব_০২
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

জান্নাতকে এভাবে বোরকা পড়া দেখে পাত্রের ভাই আর ভাবী ভীষণ অবাক হলো।তার উপর আবার পুরো চেহারা ঢেকে রেখেছে জান্নাত।চোখ দুটিও ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না।এমন নিচ হয়ে বসে আছে মনে হয় এক্ষুনি মাটিতে পড়ে যাবে।তাহলে তারা কিভাবে চুজ করবে এই মেয়েকে?

এদিকে পাত্রের বন্ধুরা হা হা করে হেসে উঠলো।কারণ তারা ভাবতেই পারে নি এই মেয়েকেই তারা দেখতে আসবে।পাত্র নিজেও ভীষণ অবাক।অন্ধকারে বাড়িটা চিনতে না পারলেও জাহানকে দেখামাত্র চিনতে পেরে গেছে সবাই।জাহান নিজেও ভীষণ অবাক।এরা তো সেই ছেলেগুলোই, যারা তাদের আমচোর বলে ভেবেছে।

পাত্রের ভাবী এক দেখাতেই মুখ ফিরে নিলো।তিনি কিছুতেই এমন মেয়েকে তার দেবরের সাথে বিয়ে দেবেন না বলে ঠিক করে নিলেন। এর আগে তারা ৫০ টার মতো মেয়ে দেখেছে।সবগুলো মেয়েই যথেষ্ট সুন্দরী এবং উচ্চ বংশের ছিলো।তবুও রুয়েল একজন মেয়েকেও পছন্দ করে নি।সে যে কেমন মেয়ে খুঁজছে তা নিজেও জানে না।আর এ বোরকা ওয়ালি কে তো জীবনেও চয়েজ করবে না।এইজন্য পাত্রের ভাবী তার স্বামীর কানে ফিসফিস করে বললো, এই পাত্রীর খবর কে দিয়েছে?সে কি আমাদের ফ্যামিলির স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানে না?এই মেয়ে কি করে আমাদের বাড়ির বউ হবে?আমার পছন্দ হয় নি এই মেয়ে।উঠে আসতে বলো সবাইকে।

এদিকে জান্নাতের বাবা জান্নাতকে এরকম সাজে দেখে মনে মনে ভীষণ রাগ হলেন।এতো করে বলার পরও জান্নাত বোরকা পড়েই পাত্রপক্ষের সামনে এসেছে।সবার সামনে বকাঝকাও করতে পারছেন না তিনি।তবুও বললেন,
মা জান্নাত,একটু তাকাও সবার দিকে।মুখের নিকাব টা খোলো একটু।এনারা তোমাকে দেখতে এসেছেন।
জান্নাত তার বাবার কথা শুনে সবার দিকে তাকালো।কিন্তু এক নজর তাকাতেই সে তার চোখ ফিরে নিলো।কারণ সে ভাবতেই পারছে না এতোগুলো ছেলের সামনে সে বসে আছে!আর তার বাবা কি করে তাকে এভাবে সবার সামনে নিকাব খুলতে বলে!জান্নাত এই কাজ জীবনেও করতে পারবে না।সে জন্য জান্নাত তার নিকাব খুললো না।

হঠাৎ পাত্রের ভাই বললো, আমরা তাহলে আজ আসি।মেয়ে দেখা হয়ে গেছে আমাদের।পাত্রের ভাবীও উঠে পড়লেন।আর রুয়েলকে বললেন,উঠে আয়।
জান্নাতের বাবা সেই কথা শুনে বললো, আপনারা বসেন একটু।কিছু মুখে দিন।
–না খাবো না কিছু।এই বলে সবাই চলে গেলো।

পাত্রপক্ষের এভাবে চলে যাওয়া দেখে জান্নাতের বাবা বুঝে গেলো তাদের মেয়ে পছন্দ হয় নি।আর হবেই বা কি করে জান্নাত তো নিকাবটাই টাই খুললো না।আর মুখ না দেখলে কিভাবে চুজ করবে তারা জান্নাতকে।এজন্য জান্নাতের বাবা ভীষণ রাগারাগি করলেন জান্নাতের সাথে।তিনি এমন এমন কথা বললেন যা শুনে জান্নাত কাঁদতে কাঁদতে তার রুমে চলে গেলো।
এবার জান্নাতের মাও বকতে লাগলেন তাকে।তিনি এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলেন এরকম ঘোমটা দিয়ে বসে থাকলে কে তোকে চয়েজ করবে আর কে বা তোকে বিয়ে করবে?এভাবে সারাজীবন কে তোকে পালবে?কত ভালো একটা ঘর।আর ছেলেটাও কত ভদ্র আর সুন্দর!এমন ছেলে যে তোকে দেখতে এসেছে সেটা তোর কপাল।নিজের কপাল নিজের হাতেই শেষ করে দিলি।এই বলে জান্নাতের আম্মু তার কাজে চলে গেলেন।

এবার জাহান বোঝাতে লাগলো জান্নাতকে।মানসম্মান আর রাখলি না তুই।নিকাব টা খুললে কি হতো?বাহিরের মানুষ শুনলে কি হবে?আমাদের মানসম্মান একদম ডোবালি তুই।এখন আশেপাশের সবাই বলবে জহিরের মেয়েকে দেখতে এসেছে কিন্তু পছন্দ করে নি।আচ্ছা তুই কি অসুন্দর!তাই মুখ দেখাতে চাস না?নিকাবটা খুললে কি হতো?
জান্নাত এবার জাহানের কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললো, তুই বুঝবি না এসব।তুই যদি হাদিস পড়তিস তাহলে বুঝতে পারতিছ।একজন মেয়ে মানুষের সৌন্দর্য কখনোই বাহিরের ছেলের সামনে প্রদর্শন করা ঠিক না।মরার পর কি জবাব দেবো আমার আল্লাহকে।সেজন্য আমি কখনোই পরপুরুষের সামনে নিজের চেহারা বের করবো না করবো না।এতে যা হবার তাই হবে।

জান্নাতের কথা শুনে তার দাদী তার কাছে আসলো।আর জান্নাতের মাথা বুলিয়ে দিয়ে বললো, হ্যাঁ ঠিক আছে।দেখাতে হবে না চেহারা।আমিও চাই তুই সারাজীবন এভাবেই পর্দার সহিত থাক।এবার একটু চুপ কর।আর কাঁদিস না।
জান্নাত সেই কথা শুনে বললো, তাহলে সবাই কেনো বার বার মুখ খুলতে বললো।তখন কতগুলো ছেলে এসেছিলো!তারপরও বাবা কেনো বললো একথা?তিনি তো জানেন আমি এমন।
জান্নাতের দাদী তখন বললো, আজ তোকে দেখতে এসেছে।আর দেখতে এসে যদি মুখ টাই না দেখে তাহলে কিভাবে পছন্দ করবে?আর পছন্দ না হলে বিয়ে হবে কেমনে?এজন্য তোর বাবা নিকাব টা খুলতে বলেছিলো।
জান্নাত সেই কথা শুনে বললো না হলে না হবে।তবুও আমি পরপুরুষের সামনে মুখ খুলবো না।

জাহান তখন বললো, আমার মনে হয় আপু যেভাবে চলাফেরা করে ওর জন্য একজন হুজুর জামাই দরকার।অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিলে কখনোই সে সুখী হতে পারবে না।আর যে ছেলে আজ দেখতে এসেছে তাকে দেখে তো বেশ মডার্ন আর স্টাইলিশ মনে হলো।এ ছেলে আপুর কদর বুঝবে না।
জাহানের কথা শুনে দাদী বললো,হ্যাঁ ঠিক বলেছিস তুই।তোর বাপ যে কেনো বোঝে না।তার মেয়ে যেরকম সেইরকমই তো পাত্র খুঁজতে হবে।

——— ——— ——— ——— ——— ———

রুয়েলের পরিবার আজকে আবার অন্য আরেকটা মেয়ে দেখতে এসেছে।মেয়ে বেশ সুন্দরী।একদম সুন্দর করে সেজেগুজে শাড়ি পড়ে সবার সামনে বসে আছে।রুয়েলের ভাবীর এইরকম মেয়েই পছন্দ।তিনি পাত্রীকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলেন।তারপর রুয়েলকে বললেন তুই কিছু জিজ্ঞেস কর।রুয়েল তখন বললো তোমরাই জিজ্ঞেস করো।আমার কিছু প্রশ্ন করার নাই।রুয়েল অনেক বেশি স্টাইলিশ আর খোলামেলা টাইপের ছেলে হলেও জান্নাতকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে।কারণ সে যতগুলো মেয়ে দেখেছে সবার মধ্যে জান্নাত সম্পূর্ণ আলাদা টাইপের মেয়ে ছিলো।এরকম মেয়ে সে কখনোই দেখে নি।রুয়েলের বার বার শুধু জান্নাতের কথাই মনে হচ্ছে।সেই যে একবার তাকালো মেয়েটা আর সাথে সাথেই চোখ টা সরিয়ে নিলো এই দৃশ্য টাই বার বার ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

এদিকে বাসার সবাই এই মেয়েকেই পছন্দ করে ফেললো।রুয়েলের বন্ধুরাও রাজি।তাদেরও ভীষণ পছন্দ হয়েছে।মেয়েটা কত স্মার্ট আর আধুনিক।কি সুন্দর করে কথা বলছে সবার সাথে।রুয়েলের ভাই এনগেজমেন্ট এর ডেটও ঠিক করলেন।পাত্রীর জন্য আংটিও বানালো হলো।

এদিকে রুয়েল শুধু বার বার জান্নাতের কথাই ভাবছে।কিন্তু কি করে জান্নাতের কথা সবাইকে বলবে?কারণ তাদের বাসার কেউই জান্নাতকে পছন্দ করে নি।কেউ চায় না জান্নাত তাদের বাড়ির বউ হোক।এজন্য রুয়েল ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।সে আর চুপ করে থাকতে পারলো না।ব্যাপার টা তার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলো।
রুয়েলের কথা শুনে তার বন্ধুরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।তারা বিভিন্ন ধরনের ঠাট্টাও করতে লাগলো।রুয়েলের ফ্রেন্ডরা বললো,কি এমন দেখলি ওই মেয়ের মধ্যে যে তোর এতো ভালো লাগলো তাকে?চেহারাই তো দেখিস নি?মেয়েটা কালো না ফর্সা সেটাও তো বোঝা গেলো না।
রুয়েল তার বন্ধুদের কথা শুনে বললো,জানি না।তবে মনে হচ্ছে আমার ওই মেয়েকেই লাগবে।অন্য মেয়েকে আমার লাগছে না।
তখন রুয়েলের অন্য এক ফ্রেন্ড বললো,মেয়েটার কন্ঠ পর্যন্ত শুনলি না।বোবাও তো হতে পারে।
–জানি না।আমার মন শুধু ঐ মেয়েটাকেই দেখতে চাচ্ছে।চল তো আজ একবার দেখে আসি মেয়েটাকে।
রুয়েলের বন্ধুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।কি বলে এসব?রুয়েল পাগল হয়ে গেলো নাকি?এনগেজমেন্ট এর ডেট হয়ে গেছে আর এই ছেলে পড়ে আছে সেই বোরকাওয়ালিকে নিয়ে।যার চেহারা দেখা তো দূরের কথা একটা কথা পর্যন্ত শোনা যায় নি।
#আলো_আধারের_খেলা
#পর্ব_০৩
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

সারাদিন মাথায় কাপড় দিয়ে থাকিস।গোসল করে ভালো করে চুলগুলোও শুকাস না।সেজন্যই তো মাথায় এতো উঁকুন হয়েছে।চুলগুলো একদম নষ্ট করে ফেললি।এতো সুন্দর চুলগুলো সব উঁকুনে খেয়ে ফেলবে একদিন।জাহান জান্নাতের মাথার উঁকুন তুলে দিচ্ছে আর এসব বলছে।
আচ্ছা আপু!বাড়ির মধ্যে কি কোনো পুরুষ মানুষ আছে?যার জন্য তোকে সারাদিন এক হাত ঘোমটা টেনে থাকতে হবে।
জান্নাত জাহানের কথা শুনে শুধু হাসছে।সে কোনো কথা বলছে না।
–এই আপু হাসছিস কেনো?আমি ভুল কি বললাম?বিশ্বাস কর তোকে এভাবে থাকা দেখে আমারই দম বন্ধ হয়ে আসে।এই গরমের মধ্যে কিভাবে থাকিস এভাবে?

জান্নাত সেই কথা শুনে বললো,জাহান্নামের আগুনের তুলনায় এই দুনিয়ার আগুন কিছুই না।আর এই গরমই সহ্য করতে পারছিস না।তাহলে মাটির তলে গেলে কি করবি?
জাহান তখন বললো, এ আপু ভয় দেখাস না প্লিজ।আমার ভীষণ ভয় লাগে এসব শুনলে।
–এতই যখন ভয় লাগে তাহলে কেনো এভাবে খোলামেলা চলিস?এই যে চুল খুলে ইচ্ছামতো বেড়াচ্ছিস।কোনো পরপুরুষ একটা চুল দেখলে মাটির তলে গিয়ে সেই চুলটাই সাপ হয়ে তোকে ছোবল মারবে।তাহলে ভাব এখন মাথায় কতগুলো চুল আছে?
–আপু প্লিজ চুপ কর।আর বলিস না।এই বলে জাহান ওড়না টা দিয়ে তার মাথা ঢেকে রাখলো।আর আবার জান্নাতের মাথার উঁকুন দেখতে লাগলো।

জান্নাত তখন বললো মেয়ে মানুষের সৌন্দর্যই হলো চুল।আর এই চুল সবসময় পরপুরুষের থেকে আড়াল রাখাই উত্তম। তুই কি জানিস আমাদের দুই কাঁধে দুইজন ফেরেশতা আছে।যারা সবসময় আমাদের পাপ আর ভালো কাজের হিসাব নিকাশ করছে।

জান্নাত জাহান কে যতই বোঝাক না কেনো পরে আবার ঠিক মাথার চুল খুলে বেড়াবে।সে যখন জান্নাতের মুখে এসব হাদিস শোনে তখনি একটু সেগুলো মেনে চলে।পরে আবার সবকিছু ভুলে যায়।

হঠাৎ কে যেনো গেটে ঠকঠক করতে লাগলো।জান্নাত সেই শব্দ শোনামাত্র তাড়াতাড়ি করে উঠলো।আর চুলগুলো বেঁধে মাথায় কাপড় দিয়ে তাড়াতাড়ি করে রুমে চলে যেতে ধরলো ।জাহান তা দেখে বললো,এই আপু!আব্বু মনে হয় এসেছে।বস তো।আরেকটু উঁকুন তুলে দেই।
–হ্যাঁ দেখিস পরে।আগে দেখে আয় কে এসেছে।তারপর আমাকে খবর দিস।এই বলে জান্নাত তার রুমে চলে গেলো।

এদিকে জাহান নাচতে নাচতে গেট খুলতে গেলো।সে ভেবেছে তার বাবা এসেছে।এদিকে তার যে মাথায় কাপড় নাই সেদিকে তার খেয়ালই নাই।

জাহান গেট খুলতেই একদম চমকে উঠলো। এ তো সেই ছেলে গুলো।এরা আবার এসেছে কেনো?
জাহানকে দেখামাত্র রুয়েলের বন্ধু শিহাব বললো,কেমন আছো পিচ্চি?
–ভালো আছি।আপনারা আবার কেনো এসেছেন?
–কেনো আসতে বারণ নাকি?
–হ্যাঁ বারণ আছে।অপরিচিত ছেলেরা আমাদের বাসায় প্রবেশ করতে পারে না। আব্বু যখন বাড়িতে থাকবে তখন আসিয়েন।

এদিকে রুয়েলের আরেক বন্ধু তারেক জাহানকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।আর রুয়েলের কানে কানে বললো,দোস্ত এই মেয়েটাকে দেখ না?দেখতেও সুন্দর!আর কত স্মার্ট?কথাবার্তা গুলোতে কি ঝাঁঝ!তোর জন্য এইরকম একটা স্টাইলিশ মেয়ে দরকার।ওই বোবা আর বোকা মেয়েকে বিয়ে করে কি করবি?
রুয়েল সেই কথা শুনে বললো, কি বলছিস এসব?চুপ থাক।এই বলে রুয়েল জাহানকে খুব নম্র আর শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো তোমার দাদী আছে বাড়িতে?
–হ্যাঁ আছে তো।
–তাহলে তাকে গিয়ে বলো রুয়েল এসেছে।
–দাদির সাথে কি দরকার আপনার?
–সেটা দাদীকেই বলবো।তুমি গিয়ে খবর দাও দাদীকে।

এদিকে জান্নাতের দাদী আর আম্মু নিজেরাই এসে গেছে।
রুয়েল দাদীকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলো আর বললো,দাদী কেমন আছো তুমি?
–আছি ভাই।এই বয়সে আর কেমন থাকুম।তা কি মনে করে?
রুয়েল কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।সে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। রুয়েলের বন্ধু তারেক তখন বললো, আপনার নাতনি কে দেখতে এসেছে দাদী।সেদিন তো মুখখানা দেখতে পারে নি।তাই আজ একটু আলাদাভাবে দেখতে এসেছে।আপনার নাতনিকে কি দেখাবেন না?কতই এভাবে সিন্দুকে করে লুকিয়ে রাখবেন?

রুয়েল সেই কথা শুনে তারেকের মাথায় একটা চড় দিয়ে বললো,কি সব ভুলভাল বকছিস?দাদী তো ভাববে আমি ঠিকই তার নাতনি কে দেখতে এসেছি।এই বলে রুয়েল দাদীর হাত ধরে বললো, আমাদের জমিগুলো দেখতে যাচ্ছি দাদী।কোথায় কোন জমি আছে কিছুই তো জানি না।ভাবলাম গ্রামে যখন এসেছি তাহলে জমিগুলোর একটু খোঁজ নিয়ে আসি।
দাদী রুয়েলের কথা শুনে বললো,খুব ভালো করেছিস।নিজের জমি একটু খোঁজখবর না নিলে হয়।
–হ্যাঁ দাদী।এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম।তাই আপনার সাথে একটু কথা বলতে এলাম।সেদিন রাতে ভাই আর ভাবি তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো,ঠিক করে কথা বলাও হলো না।
এই বলে রুয়েল বাড়ির ভিতর তাকাতে লাগলো।

দাদী তা দেখে বললো,আয় বাড়ির মধ্যে।এখানে গেটে দাঁড়িয়েই কথা বলবি?
দাদীর কথা শুনে রুয়েলের বন্ধু তারেক,শিহাব আর চঞ্চল তাড়াতাড়ি করে ঢুকে পড়লো বাড়ি তে।তারা সবাই চারপাশ টা দেখে বললো, বাহঃ খুব সুন্দর তো বাড়ির ভিতর টা।চারপাশে গাছগাছালি দিয়ে ভরা।কি সুন্দর আম আর কাঁঠাল ধরেছে।।গ্রামের বাড়ির সৌন্দর্য আসলেই দেখার মতো।আর কি সুন্দর ফুলের বাগান!এই বলে চঞ্চল একটা টকটকে লাল গোলাপ ছিঁড়লো।।রুয়েল আর একা একা দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে?সেও প্রবেশ করলো বাড়ির মধ্যে।
দাদী রুয়েলদের রুমে নিয়ে গেলো।আর জান্নাতের মা ওদের জন্য নাস্তা রেডি করতে গেলো।

রুয়েল বুঝতে পারছে না কিভাবে শুরু করবে?আর দাদীকে কিভাবে বলবে জান্নাতের কথা?সে সেজন্য চুপচাপ থাকলো।রুয়েলকে চুপচাপ থাকা দেখে দাদী নিজেই জিজ্ঞেস করলো,দেশে কত দিনের ছুটিতে এসেছিস?

রুয়েল তখন বললো,ছয়মাসের জন্য।আমি আসতে চাইছিলাম না।আরো কিছু বছর থেকে তারপর একবারে চলে আসতাম।আর দেশেই ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করতাম।কিন্তু আম্মু খুবই তাড়া দিচ্ছিলো বিয়ের জন্য।ওনার নাকি ছেলের বউ দেখার শখ হয়েছে।সেজন্য আসা এবার।

দাদী সেই কথা শুনে বললো তাড়া তো দিবেই।বয়স তো আর কম হলো না।তবে আমার মনে হয় তোদের তো টাকা পয়সার অভাব নাই।বিয়ে করে বিদেশ আর না যাওয়ায় ভালো ।দেশেই কিছু একটা কর না?
রুয়েল দাদীর কথা শুনে চুপ করে থাকলো।

হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলো।গরমে আর থাকতে পারলো না কেউ।দাদী তখন বললো, বাহিরে বারান্দায় খুব সুন্দর ঠান্ডা বাতাস আছে।ওখানে গিয়ে বস তোরা।আমি আসছি।এই বলে দাদী ওদেরকে বারান্দায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

এদিকে জান্নাতের মা নাস্তা রেডি করে জান্নাতকে বোঝাতে গেলো।মা জান্নাত,ওনাদের সামনে একবার যা।আমি নাস্তা রেডি করেছি।তুই একটু দিয়ে আয়।
জান্নাত সেই কথা শুনে বললো, আমি যেতে পারবো না ওনাদের সামনে।প্লিজ আম্মু আর রিকুয়েষ্ট করো না আমাকে।তাছাড়া বাসায় আব্বুও নাই।এতোগুলো ছেলের সামনে আমি একা একা কিভাবে যাবো?
জাহান সেই কথা শুনে বললো, আমি আছি তো।আমিও যাবো তোর সাথে।
–তুই চুপ কর।তোর যাওয়ার হলে তুই একাই চলে যা।

জান্নাতের আম্মু সেই কথা শুনে বললো, তুই কি বিয়ে করবি না?ওনাদের সামনে না গেলে তোকে চয়েজ করবে কেমনে?আর বিয়ের জন্য প্রস্তাবই বা দেবে কেমনে?

জান্নাত তার মায়ের কথা শুনে চুপ করে রইলো।এদিকে জান্নাতের আম্মু বকেই যাচ্ছে।এবার জান্নাতকে দাদী আসলো বোঝাতে।জান্নাত তবুও ছেলেগুলোর সামনে গেলো না।এদিকে রুয়েল তো শুধু ছটফট করছে এক নজর দেখার জন্য।সেদিন তবুও একটু সামনে এসেছিলো।কিন্তু আজ তো সামনেও আসছে না জান্নাত।

দাদী আর জাহান দুইজন মিলে রুয়েলদের জন্য নাস্তা নিয়ে গেলো।জাহান নিজের হাতে নাস্তা সার্ভ করলো ওদের।ওদিকে জান্নাতের আম্মু জান্নাতকে বকেই যাচ্ছে।আর জান্নাত বার বার বলছে আব্বু বাড়িতে থাকলে সে যেতো।আব্বু নাই দেখে সে যাচ্ছে না।

হঠাৎ তারেক বললো, আচ্ছা দাদী তোমার বড় নাতনির কি সব ঠিকঠাক আছে?সে কি আমাদের মতো স্বাভাবিক মানুষ?

দাদী কথা টা শুনে একদম আশ্চর্য হলো।কি বলেরে ছেলেগুলো?তারা কি জান্নাতকে পাগল ভাবছে নাকি?

দাদীকে চুপ থাকা দেখে শিহাব বললো,না মানে ও বলতে চাইছে জাহান যেমন কি সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে।আমাদের সাথে সুন্দর করে কথা বলছে।এই যেমন আমাদের নাস্তা সার্ভ করছে, জান্নাত সেরকম করছে না কেনো?জান্নাত এতো ভয় পায় কেনো?ও কি দূর্বল নাকি?

রুয়েল সেই কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলো।সে রাগান্বিত কন্ঠে বললো,আচ্ছা তোরা বার বার জান্নাত জান্নাত করছিস কেনো?কেউ যদি না আসে সামনে তাকে কি জোর করে আনা যাবে?তাছাড়া আজ তো আমরা জান্নাতকে দেখতে আসি নি।আজ আমি শুধু দাদীর সাথে কথা বলার জন্যই এসেছি।সেজন্য কে সামনে এলো আর কে এলো না এ নিয়ে তোদের এতো মাথাব্যথা কেনো?

দাদী বুঝতে পারলো রুয়েল আজও জান্নাতকে দেখার জন্যই এসেছে।আজ জান্নাত সামনে আসে নি দেখে এভাবে বলছে।সেজন্য দাদি বললো, জান্নাত একটু অন্য টাইপের মেয়ে।ও কোনো পরপুরুষের সামনে কখনোই যায় না।ওকে মেরে ফেললেও সে কখনোই আসবে না এখানে।
রুয়েল তখন বললো,দাদী ওদের কথায় কিছু মনে করো না।ওরা একটু বেশি কথা বলে।আজ তাহলে উঠি দাদি।এই বলে রুয়েল তার বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতে ধরলো।

তখন রুয়েলের বন্ধু চঞ্চল বললো,আচ্ছা বুঝলাম কোনো পরপুরুষের সামনে যায় না।তাহলে স্কুলে যখন গিয়েছে তখন কি করেছে?বা কোনো আত্নীয়র বাড়িতে গেলে?

জাহান ছেলেটির কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,আপনারা আমার বোনের ব্যাপারে তাহলে কিছুই জানেন না।সেজন্য এভাবে বলছেন।আগে পুরো গ্রাম ঘুরে আসুন,আর আমার বোনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করুন।সবাই এক কথায় বলবে,জান্নাতের মতো মেয়ে এই পুরো গ্রামে একজনও নাই।ও যখন স্কুলে যেতো তখনও এভাবেই বোরকা নিকাব পড়ে যেতো।আর কখনোই এদিক ওদিক তাকাতো না।ওর পাশ দিয়ে কেউ যদি যেতো সে কখনোই জানতো না সেটা ছেলে ছিলো না মেয়ে।আমার আপু সব মেয়েদের থেকে আলাদা।

চঞ্চল সেই কথা শুনে বললো,তাহলে কি বোনকে সারাজীবন এভাবে সোকেসেই সাজিয়ে রাখবে?তাকে বিয়ে দেবে না?বুঝলাম আলাদা টাইপের মেয়ে।তাই বলে কি পাত্রপক্ষের সামনে বোকার মতো চুপচাপ থাকতে হবে।সেদিন তো রুয়েলের ভাই আর ভাবী জান্নাতকে দেখে পাগল মেয়ে ভেবেছে।

রুয়েলের আর এক সেকেন্ড থাকতে ইচ্ছা করছে না।তার বন্ধুরা কি শুরু করেছে এসব।সেজন্য রুয়েল বললো,এরা আসলে এরকম মেয়ে দেখে নি কখনো এজন্য এতো বেশি অবাক হচ্ছে।তাছাড়া শহরের মেয়েরা অনেক বেশি স্টাইলিশ।তারাও অনেকেই বোরকা নিকাব হিজাব পড়ে।তবে তাদের সবার সাথে বন্ধুত্ব আছে।তারা সবার সাথে কথা বলে।এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়।দাদী এদের কথা শুনে রাগ করেন না প্লিজ।
আচ্ছা দাদি ঠিক আছে।আজ তাহলে আসি।এই বলে রুয়েল সবাইকে নিয়ে চলে আসলো।

রুয়েল তার বন্ধুদের নিয়ে বাহিরে এসেই আগে সিগারেট ধরালো।আর বললো, তোরা এতো বেশি কথা বলছিলি কেনো?কে তোদের জান্নাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে বলেছে?বন্ধুরা তখন বললো, তুই তো জান্নাতকেই দেখতে গিয়েছিলি।তাহলে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো না তো কার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো?আর তুই দাদীকে কিছু বললি না কেনো?যে তুই জান্নাতকেই বিয়ে করতে চাস।
রুয়েল সিগারট টানছে আর ধোঁয়া ছাড়ছে।সে কোনো কথাই বলছে না।তখন চঞ্চল বললো একটিবার তো দাদীকে বলতে পারতিস যে তুই আজও ওকে দেখতে এসেছিস।দেখি দাদী কি বলে?ওনাদের ইন্টারেস্ট আছে কিনা বিয়ে তে?
রুয়েল সেই কথা বললো,দাদী ১০০% রাজি আছে।শুধু দাদী না জান্নাতের মা বাবা সবাই রাজি আছে।এখন মূল সমস্যা ভাই আর ভাবীকে নিয়ে। ওনাদেরকে রাজি করাবো কিভাবে সেটাই ভাবছি।

তারেক তখন বললো, শুধু তোর ভাই ভাবী না।আমি তো ভাবছি জান্নাতের কথা।ওই মেয়ে কি কোনোদিন রাজি হবে?যে মেয়ে ছেলে মানুষের সামনে আসতেই ভয় করে সে কি করে বিয়ে করবে তোকে?

#চলবে,কেমন হচ্ছে গল্পটি অবশ্যই জানাবে।
#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here