আলো_আঁধার পর্ব ১১

#আলো_আঁধার [১১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

রাহা ঠিক এক ঘন্টা শুভ্রর ক্যাবিনে বসে রইল। এই এক ঘন্টায় সে কিছু কাজ সারল। দু’তিন জন রোগীও দেখল। রাহা টুঁশব্দও করেনি। তাকে বিরক্ত করবে তো দূর একবার এটাও বলেনি যে, শুভ্র আর কতক্ষণ? শুভ্র মাঝে মাঝে আড়চোখে ওকে দেখেছে। মেয়েটা নির্বিকার বসে একটা ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা ওলটাচ্ছে। রাহা সত্যিই ভীষণ ভালো মেয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-“চলো রাহা।”

রাহা ওর দিকে চাইল। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে তার। জিজ্ঞেস করল,

-“তোমার কাজ শেষ? ”

-“হুম।”

-“তাহলে চলো।”

ওরা দু’জন শপিংমলে রওনা দিল। শুভ্র গাড়িতে বসে কোনোকিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করছে। রাহা কতক্ষণ খুশি মনে কী কী বকবক করল তার কিছুই শুনেনি সে। রাহা তার হাতে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-“এই শুভ্র! কোথায় হারিয়ে গেলে?”

-“হে, না, না। তুমি বলো।”

-“আমিই তো বলে যাচ্ছি। তুমি তো কিছুই বলছো না। কিছু বলো।”

-“কী বলব?”

-“কী বলবে তাও আমি বলে দেব!”

-“তুমি বলো আমি শুনছি। তোমার কথা খুব গোছানো। শুনতে ভালো লাগে।”

রাহা নিঃশব্দে হাসল। শুভ্রটা এত পাগল কেন? এভাবে বললে তার লজ্জা লাগে, এটা কি শুভ্র বুঝে না। রাহা শুভ্রর খেয়ালে ডুবে থাকলেও শুভ্র অন্য কিছুই ভাবছে।
______________________________
দিয়ার মৃত্যুর খবরে আলো অনেকটা ভেঙে পড়েছে। শরীরটাও সুস্থ নেই তার। মনের শক্তি কমে গেলে শরীরে রোগ বাসা বাঁধতে বেশি সময় নেয় না। আসলে মনের জোর হারিয়ে ফেলেছে সে।
দিয়ার মৃত্যুতে কিছুটা সে নিজেও দায়ী। কিছুটা না, সবটাই। আগের কথাগুলো মনে হয়ে গেলে দীপ্তর বাড়িতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই বাড়ির মেয়েটা তার জন্য মারা গেছে। এই বাড়ির বউ তার কারণেই পাগল হয়েছে। ঘুরেফিরে সে আজ এই মানুষ গুলোর কাছেই আশ্রয় নিয়েছে। আত্মসম্মানে ভীষণ লাগছে তার।
দীপ্ত দরজায় টোকা দিলে আলো উঠে বসে বলে,

-“আসো।”

আলোকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। রোগা দেখাচ্ছে। দীপ্ত ঘরে ঢুকেই বলল,

-“ওঠো, রেডি হয়ে নাও।”

-“কেন?”

-“ডাক্তারের কাছে যাব আমরা। তোমার তো এটা এইট মান্থ। চেক-আপ করিয়ে আনি। কয়দিন ধরে তোমাকে রোগা লাগছে।”

-“আমি ঠিক আছি দীপ্ত। এই সময়টাতে একটু এরকম হয়ই৷ সিরিয়াস কিছু না। তুমি আমাকে নিয়ে টেনশন নিও না।”

-“তোমাকে নিয়ে না আমি তোমার বেবিকে নিয়ে টেনশন করছি। আমি চাই না তোমার অবহেলা বা খামখেয়ালির জন্য ওর কিছু হোক। ওকে সুস্থ ভাবে দুনিয়ার দেখতে চাই আমি।”

আলোর চোখ টলমল করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

-“নিজে জন্মদাতা যাকে অস্বীকার করে, তার মা’কে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সেখানে তুমি তার চিন্তা করছো। অন্যের সন্তানকে নিয়ে ভাবছ। তার খেয়াল রাখছো। আমি যে দিন দিন তোমার কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছি।”

দীপ্ত আলোকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ওর হাত ধরল। আলো এতে কিছু মনে করল না। দীপ্ত মৃদু হেসে বলল,

-“পুরোনো কথা কেন বারবার মনে করো? যা হয়েছে ভুলে যাও। নতুন করে জীবনটা শুরু করো তুমি।”

-“ভুলেই যাব। বাবুটা দুনিয়ায় এলেই ডিভোর্স নিয়ে নেব। ওই লোকের ঘর করা আমার পক্ষে সম্ভব না। জানোয়ার একটা। অমানুষ। ও এসে আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও আমি ওকে ক্ষমা করব না। আমি দুর্বল না দীপ্ত। শুধু এই সময়টাতে আমার কাউকে পাশে লাগবে। কখন কী হয়ে যায়। আমি আমার বাচ্চাটাকে হারাতে চাই না। ও-ই এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।”

দীপ্ত যেন না চাইতেও হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল। সে আলোকে ইনিয়েবিনিয়ে নানা ভাবে ডিভোর্সের কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু আলো যদি আবার তাকে ভুল বুঝে, সেটা ভেবেই বলা হয়নি। এখন তো আলো নিজেই ডিভোর্সের কথা বলছে।

-“আমি তোমার পাশে থাকব আলো। সব সময় তুমি আমাকে তোমার পাশে পাবে। ডিভোর্সের ব্যাপারটাও নাহয় আমি দেখে নেব৷ তুমি টেনশন করো না। তোমার বাবুর কিচ্ছু হবে না।”

-“হু।” আলো উদাসীন গলায় জবাব দিল। দীপ্তর খুশির বাঁধ মানছে না।

-“রেডি হয়ে নাও আলো। ডাক্তারের কাছে যাবে না!”

-“হুম। তোমার উপর…

আলো কথা শেষ করতে পারল না। দীপ্ত রাগ করার মত করে বলল,

-“আবার ওসব কথা! তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো না? হ্যাঁ। তাহলে আর কী? ওসব কথা আর কখনও বলবে না। মনে থাকে যেন।”
_______________________________
নাসির তিনদিন নিরুদ্দেশ ছিল। ওর পরিবার ওকে খুঁজে না পেয়ে থানায় ডায়েরি করে। কিন্তু তবুও ওকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাড়ির ছেলে সকালে অফিসে গেছে রাতে আর বাড়ি ফিরছে না। কোথায় গেছে কেউ জানে না। একটা মানুষও দেখেনি ছেলেকে। মায়ের চিৎকার বাবার হাহুতাসে বাড়ির পরিবেশ পাল্টে গিয়েছে। কেউ বুঝতে না পারলেও লিজা ঠিকই বুঝতে পারছে নাসিরকে কে বা কারা নিয়ে গেছে। বুঝলেও কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না সে৷ বললেই যে তার নিজের কুকর্মের কথাও বেরিয়ে আসবে। সবাই জেনে যাবে আলোর কোন দোষ ছিল না। আলো নির্দোষ। যা করেছে সব লিজাই করেছে। শ্বশুর শাশুড়ির কাছে এই সত্য জানাজানি হলে এই বাড়িতে তারও যায়গা হবে না। তাকেও আলোর মত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।
তিনদিন পর অজ্ঞান অবস্থায় নাসিরকে কয়েকজন লোক ধরাধরি বাড়িতে দিয়ে যায়। উনাদের বক্তব্য, তারা এই অবস্থাই তাকে জঙ্গলে খুঁজে পেয়েছে। কে বা কারা ফেলে গেছে তা তারা জানেন না। নাসিরের অবস্থা ভালো না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তারও তেমন কোন আশা দিতে পারেননি।
আলোকে দীপ্তরই নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে যেন কার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে যায়। যাবার আগে মা’কে বলে যায় আলোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।
______________________________
মিসেস আমিনা ছেলের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছেন না। বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর এখন ছেলে এসব কেমন কথা বলছে! রাহার বাবা মা যেদিন এসেছিল সেদিন তো চুপ করেই ছিল। কোন কথা বলেনি। কোন প্রকার আপত্তিও জানায়নি। আজ গিয়ে রাহাকে বিয়ের শপিং করে দিল। এখন বাসায় এসে বলছে সে বিয়ে করতে পারবে না! এটা কি মজা চলছে? বিয়ে নামে সার্কাস হচ্ছে নাকি?

-“শুভ্র, তুমি কী চাইছো বলো তো? বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় বলোনি কেন তাহলে?”

শান্ত কন্ঠে শুভ্র বলল,

-“তখন বুঝতে পারিনি মা। এখন বুঝতে পারছি।’

-“কী বুঝতে পারছো হ্যাঁ!”

-“বিয়ে করাটা ঠিক হবে না।”

মিসেস আমিনা ছেলের এসব খামখেয়ালি কথা শুনে রাগে কাঁপতে লাগলেন।

-“এখন কেন তোমার মনে হচ্ছে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না?”

শুভ্র চুপ করে রইল। সে বুঝতে পারছে মা রেগে যাচ্ছে।

-“রাহা কি ভালো মেয়ে না? ওকে তোমার পছন্দ না?”

-“রাহা ভালো মেয়ে মা। ওকে অপছন্দ করার কোন কারণ নেই।”

-“তাহলে সমস্যা কী?”

-“রাহা ভীষণ ভালো মেয়ে এটাই সমস্যা। আমি ওকে মানুষ হিসেবে, একজন বন্ধু হিসেবে পছন্দ করি। কিন্তু এই পছন্দ বিয়ে করার জন্য যথেষ্ট না। রাহাকে বিয়ে করলেও ও আমার সাথে সুখী থাকবে না।”

মিসেস আমিনা কপাল চেপে ধরে সোফায় বসে পড়লেন। এই ছেলে নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। পাগলের মত কথা বলছে। রাহা ভালো মেয়ে, ওকে পছন্দ করে তবুও নাকি বিয়ে করতে পারবে না।

-“আমি জানি, রাহা আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু ওটা সেরকম পছন্দ না। ও আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধতা কয়েকদিন থাকবে। তারপর ঠিকই কেটে যাবে। তখন ও আমার সাথে থেকে বিরক্ত হবে। আমি চেষ্টা করেছি মা। কিন্তু রাহাকে নিয়ে একজন বন্ধু ছাড়া অন্যরকম কোন অনুভূতি ফিল করতে পারিনি। আমরা ভালো বন্ধু।”

-“ভালো বন্ধুই ভালো হাজবেন্ড ওয়াইফ হতে পারে।”

-“হাজবেন্ড ওয়াইফের মাঝে ভালোবাসা থাকাটাও জরুরি।”

-“একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসা তৈরি হয়ে যাবে। মেয়েটাকে সময় দিবে তো নাকি?”

-“সময়ে কী হয় মা? তুমি পেরেছ বাবাকে আটকে রাখতে? ”

শুভ্র না চাইতেও বাবার কথা বলে ফেলেছে। বাবাও একদিন ঠিক এই কথাগুলো বলেই তাকে ও মা’কে ফেলে চলে গিয়েছিল। মা একই ভুল রাহার সাথেও করতে চাইছে। মিসেস আমিনা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সাহেদের সাথে তার বিয়ে পারিবারিক ভাবে হয়েছিল। বিয়ের ষোল বছর পর সে নতুন করে অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে। তখন শুভ্রর বয়স চৌদ্দ বছর। সে নাকি কখনও আমিনাকে ভালোবাসতে পারেনি। শুধু একসাথে থেকে মানিয়ে নিয়েছে। শুভ্র কতক্ষণ মা’কে দেখল। তারপর নীরবতা ভেঙে নিজেই বলল,

-“রাহার মত মেয়ে আমি আর দু’টা দেখিনি। রাহা আমার থেকেও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। যে ওকে ভালোবাসবে তার সাথেই ও সুখী থাকবে। যাকে সে ভালোবাসে তার সাথে কিছুকাল সুখী হলেও, সারাজীবন কাটাতে পারবে না। ভালোবাসা ছাড়া সব সম্পর্কই মূল্যহীন।”

-“এই কথাটা রাহাকে জানিয়েছ তুমি?”

-“না। ওর হাসিখুশি মুখে বিষাদের কালো ছায়া দেখতে পারব না আমি। তাই বলা হয়নি।”

-“তার মানে এই অপ্রীতিকর কাজটাও আমাকেই করতে হবে!”

-“তুমি আমার মত দুর্বল নও মা। তুমি আমার দেখা নারীদের মধ্যে সবথেকে স্ট্রং একজন মানুষ। তোমাকে আমি কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। আর তাইতো তোমার উপর আমি এতটা নির্ভরশীল।”

ছেলেকে ভালো করে দেখলেন তিনি। কথার ছলে কীভাবে মায়ের মন ভালো করতে হয় তা এই ছেলে জানে। শুধু জানে না, খুব ভালো করেই জানে। ছেলের মুখে এই কথা শুনে একটু আগের খারাপ লাগা দূর হয়ে গেল। সেদিন স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর উনি ভেঙে পড়লে আজ ছেলের মুখে এই কথা শুনতে পেত না।

-“রাহাকে তুমি বোলো মা। আঙ্কেল আন্টির কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নেব।”

-“তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ? আজ বিয়ে না করো, কাল করবে। রাহাকে না করো অন্য মেয়েকে তো করবে। বিয়ে না করে তো জীবন কাটাবে না, তাই না? আমাকে বলো। কেমন ধরনের মেয়েকে তুমি তোমার স্ত্রী হিসেবে পেতে চাও। তুমি যেমন বলবে আমি তেমন মেয়ে খোঁজার চেষ্টা করব।”

শুভ্র হেসে বলল,

-“তোমার মত একজন কঠিন প্রকৃতির মেয়ে। যে ভালো থকার জন্য শক্ত হাতে দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে পারবে। আবার যার মনটা তোমার মতই কোমল হবে। এমন মেয়ে পেলে আমার বিয়ে করতে কোন আপত্তি নেই।”

চলবে___

বিঃদ্রঃ একটু ব্যস্ত আছি তাই নিয়মিত গল্প দিতে পারতেছি না। ব্যস্ততা কেটে গেলেই রেগুলার গল্প দেব ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here