আলো_আঁধার পর্ব ১৩

#আলো_আঁধার [১৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

-“এই মেয়ে! এই, তুমি ঠিক আছো তো? এই মেয়ে?”

মিসেস আমিনার কোলে আলোর মাথা। রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল সে। মিসেস আমিনা তাকে ওই অবস্থায় পেয়ে গাড়িতে তুলে আনেন। অনেকক্ষণ ধরে আলোর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন তিনি।

-“নাম ঠিকানা না জানলে কীভাবে পৌঁছে দেব ওকে। এই মেয়ে তাকাও। চোখ খুলো। তোমার বাসা কোথায়?”

ড্রাইভার পেছন ফিরে বলল,

-“ম্যাডাম এখন কী করবেন?”

চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি৷

-“কী করব। কী করা যায় বলো তো? মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। ওভাবে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। একটা মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটক দেখেছে। মেয়েটাকে কীভাবে ফেলে রেখে চলে যাই।”

-” উনার তো জ্ঞানও ফিরছে না। নাম ঠিকানা না জানলে তো মুশকিল হয়ে যাবে।”

-“হুম। সেটাই তো। কীভাবে ওর জ্ঞান ফেরানো যায় বলো তো?”

মিসেস আমিনা আলোর মুখের দিকে দেখলেন। মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? পেট দেখে তো মনে হচ্ছে আট নয় মাস চলছে। এই অবস্থায় একা বাইরে বেরুলো! সাথে কেউ আসেনি। ওর পরিবারের কারো কী কাণ্ডজ্ঞান নেই। মেয়েটাকে এই অবস্থায় একা ছাড়ল কীভাবে? এইযে আজ যদি কোন অঘটন ঘটে যেত তাহলে? মেয়েটার, বাচ্চাটারও তো কিছু হয়ে যেতে পারত।
মিসেস আমিনা আলোর মুখে স্নেহভরে হাত বুলিয়ে দিলেন। মুখে চলে আসা এলোমেলো চুলগুলো ভাঁজ করে কানের পেছনে গুঁজে দিল।

-“এই শুনো। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ তুমি?”

আলোর জ্ঞান ফিরছে না। মিসেস আমিনা বাধ্য হয়ে ড্রাইভারকে বললেন,

-“কিছু করার নেই। এই অবস্থায় ওকে ফেলে যেতে পারব না। শুভ্রকে কল করছি আমি। তুমি হাসপাতালে নিয়ে যাও। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারব না।”

মিসেস আমিনা ছেলেকে কল করলেন। মেয়েটা কে তার হদিস না পেলে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করবেন।

-“হ্যাঁ মা বলো।”

-“তুমি এখন কোথায়?”

-“হাসপাতালে।”

-” আচ্ছা ওখানেই থাকো তুমি। কোথাও যেও না। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।”

শুভ্র মা’কে নিয়ে চিন্তিত হলো। মা আজ ঢাকা গিয়েছিল। মা’র তো হাই প্রেশার।

-“তুমি ঠিক আছো মা? তোমার কিছু হয়নি তো?”

-“না। আমি ঠিক আছি। তুমি টেনশন নিও না।”

-“কী হয়েছে বলবে?”

-“আসছি। এসেই বলি।”
__________________________________

-“ও কে মা? কী হয়েছে উনার? ”

-“রাস্তায় জ্ঞান হারিয়েছে। কেউ ধরছিল না। আমি গাড়িতে তুলে আনলাম। মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না। নাম ঠিকানা কিছুই জানা নেই। তাই নিজের সাথেই নিয়ে এলাম।”

শুভ্র আলোকে পরীক্ষা করল। মায়ের দিকে ফিরে বলল,

-“পার্লস রেট অনেক লো। প্রেগন্যান্সি অবস্থায় যথেষ্ট মানসিক চাপ নিচ্ছে। প্রেসার একেবারেই কম। স্যালাইন দিতে হবে শরীর দুর্বল। দেখে তো মনে হচ্ছে ডেলিভারি ডেট নিকটেই।”

-“এই অবস্থায় মেয়েটা একা একা বাড়ি থেকে বের হলো কোন আক্কেলে? বাচ্চাটা ঠিক আছে তো?”

-“হুম।”

ঠিক তখনই আলো নড়ে উঠল। পিটপিট করে চোখ খুলছে সে। মিসেস আমিনা খুশি হয়ে ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লেন।

-“এই মেয়ে শুনছো? এখন কেমন লাগছে তোমার? তুমি কেমন মেয়ে বলো তো! এতটা কেয়ারলেস কেন তোমরা?”

মিসেস আমিনা আলোকে এমন ভাবে ধমকাচ্ছেন যেন আলো তার পূর্ব পরিচিত। আলোকে অনেকদিন জানেই জানেন। তাই তার খামখেয়ালির জন্য শাসন করছেন। শুভ্র চাপা গলায় ডাকল,

-“মা! উনার বক্তব্য তো আগে শুনে নাও।”

আলো চোখ মেলে নিজেকে সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে পেল। এ কোথায় এসেছে সে? এই মানুষ গুলো কে।

-“তোমার নাম কী?”

ক্ষীণ গলায় আলো জবাব দিল,

-“আলো। আমি এখন কোথায়?”

-“কোথায় তুমি? হাসপাতালে। তোমার ভাগ্য ভালো আমি তোমাকে পেয়েছিলাম। নইলে এতক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকতে। এখন বলো তো আমার বাসা কোথায়?”

বিড়বিড় করল আলো।
-“আমার বাড়ি!”
উঠে বসতে চাইছে সে। কিন্তু জোর পাচ্ছে না।

-“আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কার বাড়ির মেয়ে? তোমার বাবা, মা, স্বামী হয়তো তোমাকে খুঁজছে। তোমাকে না পেয়ে টেনশনে ওদের অবস্থা কেমন হয়েছে ভাবো তো একবার? তোমার কাছে ফোন থাকলে বাসায় জানিয়ে দাও, তুমি ঠিক আছো। নইলে শুধু শুধু খোঁজাখুজি করবে।”

মা’কে নিয়ে পারে না শুভ্র। মা সবাইকে নিয়ে এমনভাবে ভাবেন যেন পৃথিবীর সবাই উনার কত আপন! মেয়েটাকে চিনে না৷ কিছুক্ষণের পরিচয়ে ওর এমন কেয়ার করছে যেন নিজের মেয়ে।

-“মা আমি আসছি। স্যালাইন শেষ হওয়ার আগে উনাকে উঠতে দিও না। উনাকে কেউ নিতে এলে আমাকে জানিও।”

-“হুম। তুমি তোমার কাজে যাও। আমি ওর পাশে আছি।”

আলো বুঝতে পারছে তাকে এই মহিলা সাহায্য করেছে। মিসেস আমিনা আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললেন,

-“তোমার বাড়িতে কে কে আছে মা? কোথায় তোমার বাড়ি? ”
______________________________
আলোকে কোথাও না পেয়ে দীপ্তর মা দিশেহারা হয়ে দীপ্তকে কল করে। আলো কি একা একাই বাড়ি চলে গেল নাকি? মেয়েটাকে তো চোখ চোখেই রেখেছিল। তবুও হঠাৎ কোথায় চলে গেল। দীপ্ত মা’র চিন্তিত গলা পেয়েই কিছু আন্দাজ করে নিয়েছে হয়তো। সে সময় ব্যয় না করে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের চলে এলো। আলোকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে, আশেপাশে অনেক খুঁজলো সে। কোথায় গেল আলো। বাধ্য হয়ে শেষে হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে হলো। হয়তো লিজার ভাগ্য এবার তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে, তাই দীপ্ত সিসিটিভি ফুটেজে আলোর সঙ্গে ওকে দেখেনি। তবে আলো গেট দিয়ে বাইরে রাস্তায় বেরিয়েছে এটা স্পষ্ট।

-“হঠাৎ আলো আমাকে কিছু না জানিয়ে কোথায় গেল? সবকিছু তো ঠিকই চলছিল। আলো আমার উপর চোখ বুজে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে দিয়েছিল। আহ…’

নিজের চুল টানল সে। হঠাৎ মনে হলো,

-“আলো ওর মা’র কাছে যায়নি তো? হ্যাঁ। অনেকদিন ধরে মা’কে দেখে না বলেই হয়তো মা’কে দেখতে গেছে। এছাড়া আর কোথায় যাবে সে। ওর তো যাওয়ার কোন জায়গা নেই। মা’র জন্য মন খারাপ করছিল। তাই আমাকে না বলেই চলে গেছে। হ্যাঁ।’

দীপ্ত কথাগুলো বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিল। তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। আলোকে না পেয়ে তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আলো হঠাৎ এভাবে কেন কোথায় চলে যাবে? কাল রাতেও তো দীপ্তর সাথে কথা হয়েছে ওর হাজবেন্ডের থেকে ডিভোর্স নিবে সে। বেবি জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত দীপ্তর কাছেই থাকবে।
_______________________________
শুভ্র বাড়ি ফেরার সময় মা’র কথা তার মনে রইল না। অনেকটা সময় চলে গেছে। মা এখনো হাসপাতালে থাকবে না। কখন হয়তো চলে গেছে। এটা ভেবে সে সোজা বাড়ি চলে এলো। রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকল। আজ যা গরম গেছে! ঠান্ডা পানির স্পর্শের জন্য মনটা আকুপাকু করছে।
গোসল সেরে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। মা’র ঘরে যাবার সময় বারান্দা থেকে দেখতে পেল মা ওই মেয়েটাকে নিয়ে মাত্র ভেতরে ঢুকেছে। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। ওই মেয়েটাকে মা হাসপাতাল থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে কেন? ওর পরিবার এখনো ওকে নিতে আসেনি? এতটা সময় ধরে মেয়েটা এখানে আছে তার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ এখনো মেয়েটার পরিবার পায়নি নাকি? পেলে তো অবশ্যই এতক্ষণে নিতে আসার কথা ছিল। শুভ্র নিচে নেমে এলো। মেয়েটার সামনে এখনই মা’কে কিছু জিজ্ঞেস করল না। মিসেস আমিনাই শুভ্রকে দেখে বললেন,

-“ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম। হাসপাতালে রেখে আসতে পারলাম না।’

-“হুম।’

মা তাকে যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে। মা’র এরকম আচরণ আজ প্রথম দেখল সে। মনে মনে হাসিও পেল। যেন সে এই বাড়ির কর্তা। তাকে না জানিয়ে মা একটা বিরাট কাজ করে ফেলেছে। এখন বকা খাওয়ার ভয়ে আগেভাগেই বলে দিচ্ছে।

-” মা তুমি এসো। ঘরে গিয়ে একটু রেস্ট নাও। চলো তোমার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।’

আলোও বাধ্য মেয়ের মত আমিনার কথায় মাথা কাত করল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখন কোন ঘোরের মধ্যে আছে। জীবন নিয়ে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলেছে সে। জীবন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। জীবন এখন তাকে যেখানে নিয়ে থামাতে পারে। মনের সবটুকু জোর হারিয়ে ফেলেছে। ঠকতে ঠকতে নিজের প্রতিই এখন বিরক্ত আলো। বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে আলো। প্রথমে তার স্বামী তাকে ভুল বুঝে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তার নিজের মা-ও তাকে বিশ্বাস করেনি। ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। ফেরেশতার মত এসে দীপ্ত তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আলো তাকে বিশ্বাস করেছিল। ভরসা করতে শুরু করেছিল। যখন জানতে পারল সে যাকে ফেরেশতা ভাবছে সে-ই শয়তান হয়ে তাকে নিয়ে ওইরকম খেলা খেলেছে। তার জীবনে যা যা ঘটেছে সবকিছুর জন্য ওই লোকটা দায়ী, তখন ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে আলো। বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলে বেঁচে থাকা সত্যিই দুরূহ হয়ে পড়ে। তার ক্ষেত্রে তো সেই ভিত ভেঙে পড়েছে।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here