আলো_আঁধার পর্ব ১৫

#আলো_আঁধার_১৫
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আলো শুধু অপেক্ষায় আছে কবে তার বাচ্চাটা দুনিয়ায় আসবে। তাকে নিয়ে ভেবেই তো এখন আলোর দিন কাটে। বাবুটা দুনিয়ায় চলে এলে আলো ওকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। এই মানুষগুলোর উপর আর বোঝা হয়ে থাকবে না। নিজের পরিচয়ে তার সন্তানকে আলো বড় করে তুলবে। সাথে এমন কিছু করবে যাতে তার পায়ের নিচের মাটিও শক্ত হয়। নিজের পায়ে দাঁড়াবে সে৷ আর কারো উপর নির্ভর হয়ে থাকবে না। জীবনটা তার। এবার থেকে নিজের মত করে বাঁচবে সে। মাথা তুলে। এই পৃথিবীতে নাসির, দীপ্ত ওদের মত অনেক মানুষ আছে। আলো এই মানুষরূপী অমানুষ গুলোর থেকে দূরে থেকে তার সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করবে।
আলো সস্নেহে তার পেটের উপর হাত বোলাতে বোলাতে আলতো স্বরে বলছে,

-“কবে আসবি রে বাবা তুই? মা’কে অত অপেক্ষা করাচ্ছিস যে! তাড়াতাড়ি আয় না মানিক। তোকে কোলে নিয়ে, তোকে দেখে আমার বুক জোড়াই।’

বাইরে থেকে শুভ্রর গলা শোনা যাচ্ছে। সে তার মা’কে ডাকছে। আলো কান খাড়া করে শুনল। মুচকি হাসল। আর কয়দিন পর সে-ও মা হবে। তাকেও একটা ফুটফুটে ছেলে বা মেয়ে মা বলে ডাকবে। মা! আহা, ভাবতেই সুখ সুখ লাগে।

-“মা। মা আমি যাচ্ছি।’

মিসেস আমিনার ছেলের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

-“শুভ্র আজ তুমি কখন ফিরবে?’

-“একটু রাত হবে। একটা ফ্রেন্ডের বাসায় দাওয়াত আছে। না গেলে রাগ করবে।’

মিসেস আমিনা চিন্তায় পড়ে গেলেন। শুভ্ররও আজ ফিরতে দেরি হবে। তিনি নিজেও বাড়ি থাকবেন না। তাহলে আলো একা থাকবে? ওর যে সময় যাচ্ছে। যেকোনো সময় একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। ওর যদি পেইন উঠে আর বাড়িতে কেউ না থাকে, তখন?
মা’কে কিছু ভাবতে দেখে শুভ্র বলল,

-” কোন প্রবলেম মা?’

-“হ্যাঁ। সমস্যা তো একটা আছে। আমিও আজ বাসায় থাকব না। তোমারও ফিরতে রাত হলে আলো একা বাসায় থাকবে? ওকে এই সময় একা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে?’

-“ঠিক আছে। তুমি এই নিয়ে টেনশন করো না। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।’

-“বাঁচালে আমাকে। মেয়েটার জন্য বড্ড চিন্তা হয়। এই কয়দিনে কেমন আপন হয়ে গেছে।’

শুভ্র কিছু বলল না। আলো মেয়েটা এই বাড়িতে আসার পর থেকে তার সাথে হাতে গুনে দু-এক দিন কথা হয়েছে। সে মেয়েটার ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাই ওকে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে পারল না।

দুপুরের পর থেকেই আলোর পেটে হালকা ব্যথা হচ্ছিল। এমন ব্যথা কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। প্রথমে সে ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজকের ব্যথা কমছে না। বরং বাড়ছে। আলো দেয়াল ধরে ধরে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল। বাড়িতে আজ কেউ নেই। সে একা। এখন কাকে ডাকবে সে? আগেভাগেই ডাকাটা কি ঠিক হবে? হয়তো দেখা গেল একটু পরেই ব্যথা কমে যাবে। শুধু শুধু সবাইকে দৌঁড়ানোর মানে হয় না। এমনিতেই মানুষ গুলো তার জন্য কত করছে!
আলো বিছানায় গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে রইল। কিড়মিড় করে ব্যথা খাওয়ার চেষ্টা করছে।
শুভ্র রাতে ফ্রেন্ডের বাড়িতে ডিনার করতে গেলেও পুরোটা সময় তার মন আলোর চিন্তায় পড়ে রইল। মেয়েটা একা বাসায় আছে। এই চিন্তায় শুভ্র ঠিকভাবে খেতে পারল না। তরকারির বাটি উলটে গায়ে ফেলে দিল। আসার সময়ও ভালো করে ওদের সাথে কথা বলে আসতে পারল না। বিদায় না নিয়েই ছুটে এসেছে সে। মা ওকে মেয়েটার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। এর হেলাফেলা হলে মা কখনো তাকে ক্ষমা করবে না। আর যদি তার জন্য মেয়েটার বা বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় তাহলে সে নিজেই কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
বাড়িতে ঢুকেই শুভ্র আলোর ঘরের দিকে পা বাড়াল। আলোর ঘরের সামনে যেতেই ভেতর থেকে আলোর কাতর গলা শুনতে পেল। কিছু বলছে মেয়েটা। কিন্তু সেটা অস্পষ্ট।
আলো এই ব্যথা আর সহ্য করতে পারছে না। সে একনাগাড়ে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে। এত কষ্টের থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেলেও হয়তো শান্তি পেত।

-“মা! ম-মা। আল্লাহ…

শুভ্র আলোর গলা পেয়ে দৌড়ে আসে৷ দরজার সামনে থেকে আলোকে থেকেই সে বুঝে যায়, আজই আলোর ডেলিভারির টাইম। ছুটে আলোর কাছে চলে আসে সে৷ সে নিজে একজন ডাক্তার হলেও এই মুহূর্তে আলোকে কষ্ট পেতে দেখে কিছু সময়ের জন্য কী করবে ঠিক করতে পারছিল না। আলোর হাত ধরল সে,

-“শুনছেন? আলো, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আপনার?’

আলো শুভ্রর হাত খামচে ধরল। প্রসববেদনায় সবকিছু ভুলে গেছে সে। এই মুহূর্তে শুভ্রকে কাছে পেয়ে ওকেই সবথেকে আপন মনে হচ্ছে।

-“আমি আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাব৷ আর একটু ধৈর্য ধরুন। কোন ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি। কোন ভয় নেই।’

আলো অসহনীয় ব্যথায় চিৎকার করছে। ব্যথা সহ্য করতে ঠোঁট কামড়ে কেটে ফেলছে। শুভ্র কিছু না ভেবে আলোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। পাশের সিটে আলোকে বসিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে হসপিটালে চলে এলো। এখানে আনার একটু পরেই ওরা শুভ্রকে জানাল, নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না। বাচ্চার কন্ডিশন খারাপ। দেরি হলে মায়ের জীবনও সংশয় দেখা দিতে পারে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। শুভ্র কিছু ভেবে পেল না। তার জন্যই কি আলোর আজ এই অবস্থা? সে বাড়ি থাকলে আলোকে আরও আগে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারত। মেয়েটা একা বাড়িতে কষ্ট সহ্য করেছে। তার দায়িত্বহীনতার কারণে যদি বাচ্চাটার কিছু হয় তাহলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না শুভ্র। সে নিজেও তো একজন ডাক্তার। রোগীর জীবন বাঁচানো তার প্রথম দায়িত্ব। আজ বাসায় থেকে গেলেই পারত। আলোকে একা ছাড়া ঠিক হয়নি।
শুভ্র অসহায় মুখে হাসপাতালের করিডরে বসে আছে। নিজের ডাক্তারি বিদ্যা কোন কাজেই লাগছে না তার। দুই হাত সমানে কাঁপছে। তার পক্ষে ভেতরে থাকাও সম্ভব হয়নি। তাই বাইরে বসে আছে। অনেকক্ষণ হয়েছে। ভেতর থেকে কেউ বেরুচ্ছে না। আলো তার বাচ্চাটা সুস্থ আছে তো?
মিসেস আমিনা ছেলেকে দেখে ওর কাছে চলে এলেন।

-“আলো এখন কোথায়?’

-“ভেতরে।’

-“তুমি ওর পাশে ছিলে না?”

-“আমি বাসায় ফিরে দেখি পেইন শুরু হয়ে গেছে। কখন থেকে হচ্ছিল জানি না। তারপর এখানে নিয়ে এলাম।’

মিসেস আমিনা ছেলেকে আর কিছু বললেন না। শুভ্র এরকম পরিস্থিতিতে কমই পড়েছে। আর পড়লে সে ঘাবড়ে যায়। ছোট বেলার কিছু স্মৃতি তাকে বিপদের মোকাবেলা করতে দেয়না। বাধা দেয়। ছেলেটার এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তার বাবা নামের ওই ছোটলোক মানুষটা।

আলো ছেলে জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি। জন্মের দুমিনিটের মাথায়ই সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। আলোর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। সে জানে না তার বাচ্চা মারা গেছে। জানলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে কে জানে। সামলাতে পারবে সে নিজেকে? যে বাচ্চার জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছে। এত লড়াই লড়েছে তাকে হারিয়ে আলো কীভাবে স্বাভাবিক থাকবে? এই বাচ্চার কথা ভেবেই তো সে বেঁচে ছিল। নইলে কবেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলত।
শুভ্র যখন খবরটা শুনলো তখন সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। বাচ্চা ছেলেদের মত মা’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। ছেলের কান্না থামাতে পারছিল না মিসেস আমিনা। তার হাতে যে কিছুই করার নেই। সৃষ্টিকর্তা যা ভালো মনে করেন সেটাই ঘটবে। মানুষ মেনে নিতে না পারলেও এর মধ্যেই তার মঙ্গল লুকিয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্তা আলো মেয়েটাকেও হয়তো এত দুঃখ দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছে। শেষে ওর জন্যও ভালো কিছুই ভেবে রেখেছে।
আলো সন্তান হারিয়ে প্রথম কয়দিন পাগলের মত কাটাল। যখন তখন চিৎকার করে কান্না করে। ঘরে দরজা দিয়ে দুই তিন দিন আটকে থাকে। খায় না। কারো সাথে কথা বলে না। আলোকে নিয়ে মিসেস আমিনা, শুভ্রের চিন্তার শেষ নেই। মেয়েটা কেন বুঝে না। এতে তার নিজেরই ক্ষতি হবে। বাচ্চাটাকে ফিরে পাবে না। তবুও মায়ের মন। যার জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা তাকে হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কি জীবন থেমে থাকবে? নিজেকে ওর সামলাতে হবে না?
শুভ্র সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করে। তার বারবার মনে হয় তার জন্যই এসব হয়েছে। সে বাড়িতে থাকলে যথাসময়ে আলোকে হসপিটালে নিয়ে গেলে বাচ্চাটা হয়তো বেঁচে থাকবে। সে আলোর অপরাধী। আলো তাকে কখনো ক্ষমা করবে কি?

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here