আলো_আঁধার পর্ব ৬

#আলো_আঁধার [৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

সাদা একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে লিজার মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গাড়িতে উঠেও চিৎকার করছিল সে। দীপ্তর লোকেরা লিজাকে দীপ্তর গোপন আস্তানায় নিয়ে আসে। দীপ্ত আগেই এখানে চলে এসেছে। পুরনো মত একটা স্টোর রুমে চেয়ার পেতে পায়ের উপর পা রেখে বসে আছে সে। ঘরটায় আলো একেবারেই নেই বললে চলে। তবে ভাঙা টিনের চালের ফাঁকফোকড় দিয়ে যেটুকু আলো আসছে তাতে আবছা ভাবে সামনের মানুষটাকে দেখা যায়। নিজের উপস্থিতি ছাড়াও অন্য কারো উপস্থিতি টের পেতে এই আলো টুকুই যথেষ্ট। দুই পাশ থেকে দু’জন লোক লিজার দুই হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে আসছে। ও আসতে চাইছে না। পা মাটির সাথে গড়াচ্ছে। হাত দু’টো ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

-” বস, নিয়ে এসেছি।’

দীপ্ত হাতে লাইটার নিয়ে খেলা করছে। বসার ভঙ্গিতে একটুও পরিবর্তন এলো না তার। কিন্তু ওদের ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

-‘ আহ করছিস কী হ্যাঁ? ও আমার মেহমান। মেহমানকে এভাবে ধরে নিয়ে আসে কেউ! উমহু, কাজটা তোরা ঠিক করলি না। আমি শুধু বলেছিলাম, মালটাকে তুলে নিয়ে আয়। তোরা তো দেখি আমার কথার উল্টো মানে করে ওকে হাত পা বেঁধে, টেনেহিঁচড়ে ছিড়ে ফেলার উপক্রম করছিস। ছাড় ওকে। ছাড় বলছি। আরে হাত দু’টো তো ভেঙে ফেলবি দেখছি।’

দীপ্ত ওদের উপর রাগ দেখালেও ওর কন্ঠে প্রশ্রয় স্পষ্ট। ছেলেগুলোর কাজে ও যে খুশিই হয়েছে তা বলতে বাকি নেই।

-“তুলে আনার সময় চিৎকার করছিল বস। গাড়িতে তুলেই দুই থাপ্পড় দিয়েছি, পুরো রাস্তা আর একটা কথা বলেনি। এখন গাড়ি থেকে নেমে ত্যাড়িবেড়ি করছে। লাগাব নাকি আরও দুইটা।’

-“না, না। মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তোলা আমি পছন্দ করি না। আমার আড়ালে মেরেছিস তাই কিছু বললাম না। আমার সামনে মারলে তোদের খবর আছে। মুখ খুলে দে।’

লিজা সবই শুনছে। নিজের কানকে ও বিশ্বাস করতে পারছে না। ও লোকটার যে উপকার করেছে তারপরও লোকটা তাকে গুণ্ডা দিয়ে তুলে এনেছে! ওর টাকা দেবার নিয়ত না থাকলে সোজা বলে দিত। তাকে মিথ্যা বলে বাড়ি থেকে বের করে এ কোথায় ধরে নিয়ে এসেছে! ওকে কি মেরে ফেলবে। অনেকক্ষণ চোখ বেঁধে রাখার পর চোখ খুলে দিলে প্রথম কয়েক মুহূর্ত তাকাতেই পারল না সে। আস্তে আস্তে চোখে দেখতে শুরু করলে লিজার চোখ ছানাবড়া। এ কোথায় আছে সে! এখান থেকে বেরুনোর পথ কোথায়? কীভাবে এদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে?
ঝাপসা অন্ধকারেও সামনের একটা চেয়ারে বসে থাকা দীপ্তকে দেখতে পাচ্ছে সে। আতঙ্কগ্রস্ত গলায় লিজা চিৎকার করে বলল,

-“আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন মিস্টার দীপ্ত? এসব কী হচ্ছে? আমাকে কিডন্যাপ করার কারণ কী?’

দীপ্ত আঁতকে ওঠা গলায় বলল,

-“কিডন্যাপ! মিসেস লিজা আপনি এসব কী বলছেন? আপনি আমার মেহমান। আমি আপনাকে কিডন্যাপ করতে যাব কোন দুঃখে?’

-“কিডন্যাপ না করলে আপনার লোক জোর করে আমাকে গাড়িতে তুলে চোখ, মুখ বেঁধে দিল কেন?আমি এতদিন যা যা করেছি সব তো আপনার কথা মতই করেছি। আপনি বলেছেন বলেই আলোকে বাড়ি থেকে বের করার জন্য আমি রাজি হয়ে আপনার সাথে হাত মিলিয়েছি। আপনি বলেছেন আপনার হয়ে কাজ করলে আমাকে আপনি টাকা দিবেন। আপনি সব প্ল্যান করেছেন। সে প্ল্যান অনুযায়ী আলোকে আমি ওর স্বামীর চোখ দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করেছি। নাসির এমনকি আমার শ্বশুর শাশুড়িকে পর্যন্ত বুঝিয়েছি যে, আলোর পেটের ওই বাচ্চা অন্য কারো পাপ। আপনার প্ল্যান মত সবাই আলোকে ভুল বুঝেছে। নাসির আলোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আপনি তো এমনটাই চেয়েছিলেন। এখন আপনার চাওয়া পূরণ হওয়ার পর আমার টাকা দিচ্ছেন না। উল্টো লোক লাগিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করে এনেছেন। এই আপনি জবান! কাজ হাসিল করে এখন পল্টি খাচ্ছেন। আমি কিন্তু সহজ মহিলা না মিস্টার দীপ্ত। আমার টাকা না পেলে আলোকে আমি আপনার সত্য জানিয়ে দেব।’

হঠাৎ দীপ্তর চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বেরুতে লাগল। মুখের চেহারা ভয়ানক হয়ে গেছে তার। এই ঘরে পর্যাপ্ত আলো থাকলে লিজা দীপ্তর ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পেত। দরকার পড়লে যে দীপ্ত কতটা নির্দয় হতে পারে তা লিজার জানা নেই বলেই এতগুলো কথা বলার সাহস পেল। ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে দীপ্ত। লাথি দিয়ে পেছন দিকে চেয়ারটা ফেলে দিয়ে ঘুসি পাকিয়ে লিজার দিকে এগিয়ে এলো সে। লিজার মুখের সামনে হাত তুলে মাঝপথে থেমে গেল। দাঁত কিড়িমিড়ি করে হাত নামিয়ে নিয়ে পাশে পড়ে থাকা ভাঙা টেবিলে ঘুসি মেরে ওটাকে কয়েক টুকরোয় বিভক্ত করে ফেলল। বাঁ হাতে লিজার গাল চেপে ধরেছে দীপ্ত। মাংসে নখ বিঁধে যাচ্ছে। ব্যথায় কাতরাতে লাগল লিজা।

-“কুত্তার বাচ্চা! তোর সাহস হয় কীভাবে আমার মুখে মুখে কথা বলার! হ্যাঁ, আমিই তোকে বলেছিলাম ওসব করতে। সব প্ল্যান আমার ছিল। আমার কথা মতই সব হয়েছে। টাকার লোভ দেখিয়ে তোকে আমি আলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি।’

লিজাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল দীপ্ত। ওর পাশে গিয়ে এক হাঁটু গেড়ে বসল।

-” সবই আমার চাওয়া মত হয়েছে। কিন্তু আমার প্ল্যানে আলোকে মার খাওয়ানোর কোন সিন ছিল না। ওটা তুই করেছিস। আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি। আলোকে তুই সহ্য করতে পারিস না। তাই আমার অজুহাত দিয়ে আলোর উপর নিজের রাগও মিটিয়ে নিলি, তাই না?’

-” আ- আমি কিছু করিনি। নাসির ওকে মেরেছে। আ-আমার কোন দোষ নেই।’

দীপ্ত হুংকার ছাড়ল।

-” ওই কুত্তার বাচ্চা ওই, তুই থাকতে ওই কুলাঙ্গার আলোর গায়ে হাত তুলে কীভাবে? তুই কী করছিলি তখন? কেন আটকালি না হ্যাঁ? মজা দেখছিলি তুই, মজা? আমার আলো মার খেয়ে কষ্ট পাচ্ছিল আর তুই মজা দেখছিলি! ওই স্কাউন্ডেলটা আমার আলোকে মেরেছে, না? আমার আলোকে কষ্ট দিয়েছে! ওকে তো আমি ছাড়ব না। যে হাত দিয়ে আমার আলোকে কষ্ট দিয়েছে ওর ওই হাতই রাখব না আমি। তার আগে তোকে…

-“আমাকে ছেড়ে দিন। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি কিছু করিনি। আলো আমার শত্রু না। আমি আপ…

-“চুপ। চুপ, চুপ। কথা না হুস্ কথা না। তোর জন্য কী শাস্তি রেডি আছে দেখবি? আমি আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছি। দাঁড়া তোকে দেখাই।’

দীপ্ত দাঁড়াল। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বাঁকা হাসল। তার চোখ চিকচিক করছে।

-“ওই কই রে তোরা? নিয়ে আয়। মেহমানের খাতিরদারি কর। কইরে…

-“বস, রেডি।’

-“গুড। ভেরি গুড। এই ঘরের দরজা, জানালা সব পেরেক মেরে বন্ধ করে দিয়েছিস তো?’

-“ইয়েস বস।’

-“ফাঁক ফোকর গলে এই মুটি বেরিয়ে যেতে পারবে না তো? ‘

-“না বস। একটা ইঁদুরও বেরুনোর রাস্তা রাখিনি। এটা তো একটা হাতি। আমাদের কেউ দরজা না খুলে দিলে দুনিয়া উল্টে গেলেও এই মুটি এখান থেকে বেরুতে পারবে না।’

দীপ্ত হাসছে। খুশি হয়েছে সে।

-“তোর নামটা যেন কী রে?’

-“বাপ মা’র দেওয়া নাম পাল্টে আমি নাম রেখেছি ডন।”

-“গুড। ভেরি গুড। তোকে আমার ভালো লেগেছে। কাজের আছিস তুই। এখন থেকে আমার সাথে সাথে থাকবি তুই।’

-“সব আপনার কৃপা বস।”

-” বক্সে মাল আছে তো? নে, নে। ওগুলোকে এবার ছেড়ে দে। অনেকক্ষণ ধরে বেচারারা আটকা পড়ে আছে। ওগুলোকে মুক্ত করে দে। তা কয়দিন ধরে না খাইয়ে রেখেছিস ওদের? ”

-“দুই দিন বস।”

-“গুড, ভেরি গুড। দুই দিন ধরে না খাওয়া শিকারী ওরা। মুটিটাকে একটু একটু করে খাবে। আমি যাচ্ছি। কাল আমি এখানে না আসার আগে ওকে কেউ যেতে দিবি না।’

-” জি বস।”

লিজা তার স্বরে চেঁচাচ্ছে। লিজার একটা কথাও এখানের কেউ শুনছে না। তার চিৎকার কানেই নিচ্ছে না। দু’টা বক্সের মুখ খুলে দিয়ে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পঞ্চাশ, পঞ্চাশ করে দুই বক্স থেকে একশোটা ইঁদুর আর চিকা বেরিয়ে এলো। ওদের চিঁচিঁ শব্দ কানে যেতেই লিজার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দুই হাঁটু বুকের কাছে গুটিয়ে নিল সে। চিৎকার করার জন্য হাঁ করেও মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। জীবনে সে এই দু’টা জিনিসকেই সবচে বেশি ভয় পায়। দেখলেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। রক্ত শীতল হয়ে যায়। একটা ইঁদুর লিজার পায়ে ঠোকর দিলে লিজা লাফিয়ে দুই হাত পেছনে সরে এলো।

-” না, না। সর, সর। হুস্, খেয়ে ফেলবে। ওরা আমাকে খেয়ে ফেলবে৷ কেউ আছো? দীপ্ত দরজা খুলুন। আমাকে যেতে দিন। আপনি আমাকে মারুন, তবুও আমাকে এদের মাঝে ছেড়ে চলে যাবেন ন। আমি ওদের ভীষণ ভয় পাই। আমাকে খেয়ে ফেলবে। খেয়ে ফেলবে…

আবার চিঁচিঁ শব্দ কানে আসতে লিজা পাগলের মত করতে লাগল,

-“সর,সর। কাছে আসবি না। হুস্, কাছে আসবি না।’
________________________

দীপ্ত হাসি মুখে মেইন ডোর দিয়ে ঢুকল। আজ সারাটা দিন আলোকে দেখেনি সে। কাজের মেয়েটাকে বলে গিয়েছিল আলোকে খাবার দিতে। ওর খেয়াল রাখতে, সারাক্ষণ আলোর সাথে থাকতে। দীপ্তর আদেশ অমান্য করার সাহস ওই মেয়ের নেই৷ তাই আলোকে নিয়ে সে কোন টেনশন করেনি। লিজাকে শাস্তি দিয়ে এসেছে সে। আলোর কষ্টের জন্য কিছুটা লিজা দায়ী। সারারাতে একশোটা ইঁদুর চিকা মিলে ওকে ছিড়ে খাবে।
দীপ্ত সিঁড়ির মাথায় উঠতেই মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মায়ের মুখ দেখেই দীপ্ত কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে।

-“কী হয়েছে মা?”

-“ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না দীপ্ত। ও যেন কোথায় চলে গেছে। পুরো বাড়িতে ওকে খুঁজেছি। কোথাও নেই।”

দীপ্তর মাথা ফাঁকা লাগছে। বিড়বিড় করে সে উচ্চারণ করল,

-” আলো চলে গেছে! আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আলো? কিন্তু কেন? কেন গেছে ও? কোথায় গেছে? ”

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here