উমা পর্ব -২০

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২০তম_পর্ব

শাশ্বত ফিরলো সন্ধ্যে নামার পর। ক্লান্ত শরীরে প্রবেশ করলো সে চেয়ারম্যান বাড়িতে। শান্ত চেয়ারম্যান বাড়ি যেনো হজম হলো না তার। কারন বিগত দিন বেশ কষাকষি লেগে আছে এই বাড়িতে। এর মাঝেই সে মুখোমুখি হয় মালিনীর। ছেলেকে দেখেই হাত টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায় সে। মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে,
“সত্যি করে বল, দাদা আর রুদ্রকে পুলিশে দেবার পেছনে তোর হাত নেই তো?”

মালিনীর প্রশ্নে আকাশ ভেঙ্গে পরে শাশ্বতের মাথায়। কানকে যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার রুদ্র এবং মামামশাই কে পুলিশ ধরে নিয়েছে? কেনো? এই খবরটা যেনো তার স্নায়ুকোষগুলোকে ক্রমশ চঞ্চল করে তুললো। হাজারো প্রশ্ন ভিড় জমালো। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগলো শাশ্বতের। বিছানায় ধপ করে বসে পরে সে। ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। শাশ্বতকে নীরব থাকতে দেখে মালিনী আরো জোর দেয়,
“কি হলো, কথা বলছিস না কেনো?”
“সত্যি বলছি মা, আমি জানি না এসবের কিছুই। আমি তো আমার কাজে গিয়েছিলাম শহরে। আমি কিছুই জানি না। তোমার দিব্যি। তোমার কেনো মনে হলো আমি মামামশাইকে বিপদে ফেলতে চাইবো। এ কি সম্ভব?”
“দেখ খোকা, আমি তো মা। তোকে আমি ই পেটে ধরেছি। তোর নাড়ীর খবর ও আমি পাই। হতে পারি মুখ্য মেয়েমানুষ, কিন্তু সন্তানের গতি বুঝতে মায়ের বিদ্যের শিক্ষা লাগে না। সে সন্তানের চোখ দেখলেই বুঝতে পারে সব। তুই কদিন ধরে দাদার ঘরের কাছে ঘুরঘুর করছিস। আমি কি সেটা দেখি নি? দেখেছি রে, সবকিছুই দেখেছি। বাবা আগুন নিয়ে খেলিস না। তোর বাবাকেও হাজার বারণ করেছি। সে শুনে নি আমার কথা। অকালেই আমাদের ছেড়ে গত হলেন। এই দাদা না থাকলে তোকে নিয়ে কই যেতাম রে? তাই বলছি, পত্রকার হতে চাও, হও। কিন্তু সিংহের মুখে ঝাপিয়ে নয়।“

মালিনীর চিন্তা অনর্থক নয়। সম্বল বলতে তো একটা ছেলেই। শাশ্বতের পিতা উত্তম বাবু ছিলেন একজন দারোগা, বেশ শিক্ষিত, মার্জিত পুরুষ। অন্যায়কে দমন করার ভুতটা শাশ্বত তার পিতার থেকেই পেয়েছে। কখনো অন্যায় এবং ক্ষমতার কাছে মাথানত করে নি উত্তম। তাই তো সেই মাথাটাই কেটে ফেলা হয়েছে। কে? কিভাবে তা জানা নেই। শুধু রেলওয়ের পটরিতে তার বিচ্ছিন্ন ধর এবং মাথাটা পাওয়া যায়। তাও তিনদিন বাদে, গলা পঁচা লাশটি ঘরে আনা হয়। কোনো ক্রিয়াকর্ম ছাড়াই তাকে পোড়ানো হয়। তখন মালিনী পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা, শাশ্বত একজন অবুঝ শিশু। স্বামীর এমন পরিনতি ছোট মালিনী মানতে পারলো না। বাচ্চাটি খোয়ালো মানসিক ধাক্কার জন্য। অভিনব সিংহ তখন তাকে এই বাড়ি নিয়ে আসে। মালিনী চায় না তার শেষ সম্বলটুকু হারাতে। তাই তো এতো সাবধানতা। শাশ্বত মালিনীর ঝাপসা কাতর নয়ন দেখে খানিকটা আহত হলো। মা কে জড়িয়ে আশ্বত করলো ধীর কন্ঠে,
“মা, আমি কিছুই করি নি। আমি তো জানিও না মামামশাই এবং রুদ্রকে ধরে নিয়ে গেছে। সত্যি বলছি। তুমি শান্ত হও।“

মালিনী শান্ত হলো না। সে উলটো দিব্যি দিয়ে বললো,
“খোকা আমার মাথা খেয়ে বল, তুই এসবে নাক গলাবি না।“

মালিনীর আকুল নিবেদনকে উপেক্ষা করতে বাধ্য হল শাশ্বত। দৃঢ় স্বরে বললো,
“সাংবাদিক সমাজের দর্পন। সেই দর্পন যদি ভেদাভেদ করে হবে তার সাংবাদিক হবার যোগ্যতা নেই। আমি এটা করতে পারবো না মা। আমি সত্যান্বেষে বেড়িয়েছি, এত সহজে কাপুরুষ বনতে পারব না।“

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো শাশ্বত। মালিনী আঁচলে মুখ চেপে নোনাজল ছেড়ে দিলো। ভয় হচ্ছে ছেলের অকল্যান যদি হয়, মায়ের মন তো সত্য অসত্য বুঝে না। বুঝে শুধু সন্তানের মঙ্গল________

গভীর রাতে পুলিশের গাড়ি এসে থামলো চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে। গাড়ির শব্দ শুনেই বারান্দায় ছুটে এলো উমা। তৃষ্ণার্ত আখিজোড়া কাতর চোখে তাকালো মূল ফটকের দিকে। অভিনব সিংহ এবং রুদ্র নামলো গাড়ি থেকে। রুদ্রকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সকালে নাস্তা না করেই বেড়িয়েছিলো সে। পুলিশ অফিসার বিনয়ী স্বরে অভিনব সিংহ এর সাথে কথা বলে গাড়ি ঘোরালো। রুদ্র বাবার জন্য অপেক্ষা করলো না। হনহন করে ভেতরে চলে আসলো। লক্ষী দেবী ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা স্বরে বলল,
“বাপ ফিরেছিস?”
“তুমি কাঁদছিলে?”
“চিন্তা হয় না?”
“খেয়েছো?“
“এই পরিস্থিতিতে কি গলা দিয়ে অন্ন নামে?”
“চল, একসাথে খাই।“

লক্ষী দেবী হু হু করে কেঁদে উঠলেন। রুদ্র মাকে শান্তনা দিলো। কিন্তু চোখজোড়া উমাকে খুঁজে যাচ্ছে। মেয়েটি নামলো না। তবে কি সে আবারো রুদ্রকে ভুল বুঝবে? ভেবেই মনটা আনচান করতে লাগলো। তাদের সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর বটে কিন্ত বেশ জটিল। উমার রুঢ়তা, উপেক্ষা সহ্য হয় না রুদ্রের। এই নারী তার জীবনে না আসলে সে কখনই বুঝতে পারতো না সন্তোষ কেবল দৈহিক হয় না। সন্তোষ হয় মনের। উমা রুদ্রের কেবল দেহের খোড়াক নয়, সে তার অন্তরের খোড়াক। উমার শীতল মনে নিজের রাজত্ব জমানোই তার উদ্দেশ্য। ভালোবাসা নামক বিষাক্ত নেশায় লিপ্ত যে সে। রুদ্রের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উমা ব্যাতীত ই খেতে বসলো সকলে, উমা নামলো না। রুদ্রের চোখ বারবার সিড়ির দিকেই গেলো। কিন্তু হতাশ হলো। উমা আসলো না। ছোট্ট মেয়েটা অভিমান করেছে। এই অভিমান ভাঙ্গানো যে খুব কঠিন___________

খাওয়া শেষে ঘরে আসলো রুদ্র। উমা তখন কাপড় গুছাতে ব্যাস্ত। মন ভালো ছিলো না বিধায় বেঘোরে ঘুমিয়েছে সন্ধ্যায়। অগোছালো শাড়ীগুলো খাটের উপর অবহেলায় পড়ে আছে। তাই এখন সেগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে উমা। রুদ্রকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে আড়চোখে তাকে দেখে নিলো উমা। তারপর আবারো নিজের কাজে মন দিলো। রুদ্র নানা ভঙ্গিমায় তার সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু উমা একটু টু শব্দ করলো না। উমার কাছ থেকে গুরুত্ব পাবার আশায় হাতখানা টেনে ধরলো। উমা দেরী না করেই হাত ছাড়িয়ে নিলো। উমার এরুপ আচারণ রুদ্রের সহ্য হলো না। তাই বাহু টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো তাকে। ঝাঝিয়ে উঠে বলল,
“কি সমস্যা? এমন আচারণ করছো কেনো?”

অন্য সময় হলে উমা চুপ করে থাকতো। কিন্তু আজ যেনো ইচ্ছে হল না। আজ দমবে না সে। অভিমান, ক্রোধে আজ মন বিষিয়ে উঠেছে। একজন সন্ত্রাশের সাথে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। সে মাতাল, নিষ্ঠুর সব কিছু তো মেনেছিলো উমা। কিন্তু মানুষকে ঠকিয়ে তাদের প্রান নিয়ে নেবার মতো পাষানকে নিজের স্বামী মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে চাইলো রুদ্রের দিকে। চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে রয়েছে। ধীর কিন্তু শক্ত কন্ঠে বললো,
“ছাড়ুন, আমার কাজ আছে। ভালো লাগছে না এই আদিক্ষেতা?”
“ভালো লাগছে না মানে?”
“বাংলা বুঝতে কি কষ্ট হচ্ছে?”
“হ্যা, হচ্ছে। আমি একটা মানুষ উমা। তোমার এই পায়ে ঠেলা আচারন আমি নিতে পারছি না”
“তাহলে কি করতে হবে আমাকে? একজন খুনীকে ভালোবাসতে হবে?”

রুদ্র থমকে গেল। উমার কন্ঠে আজ কোন আড়ষ্টতা নেই, নেই কোনো জড়তা। অভিমানের প্রবল ঝড় তার ভেতরটাকে চূর্নবিচূর্ন করে দিচ্ছে। এতোকাল রুদ্রের কোনো কিছুই তাকে বেদনা দিত না, তবে আজ দিচ্ছে। হয়তো লোকটাকে কোথাও না কোথাও মনে ঠায় দিয়েছে সে। তাই তো এই অসহনীয় যন্ত্রণা সইতে পারছে না সে। রুদ্রের চোখে চোখ রেখে রুঢ় কন্ঠে বললো,
“আজ বলেই দিন কি চান আপনি? আর কতো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমাকে? সেদিন তো খুব বলেছেন ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার নমুনা? আর কতো লুকানো সত্য আছে? আর কতো গোপনীয়তা? আজ আমার উত্তর চাই।“

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“বেশ্, আজ তোমাকে সব খুলে বলবো………

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here