একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব -০৯+১০

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-৯

মাথার চু্ল কামিয়ে নিজের মধ্যে একটা বৈরাগ্য ভাব আসল। একটা গেরুয়া কাপড় হলে ধ্যান করতে বসে যেতে পারতাম কোনো নির্জন গাছের তলায়! কিন্তু ঢাকা শহরে নির্জন জায়গা নেই বলে আমার আর সাধু হওয়া হলো না। গেলাম বাসায়। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে ছোট ছোট টবে লতানো গাছ লাগিয়েছে তিন্নি। দেখে ভারি ভালো লাগল। একটু আদর করে দিলাম গাছগুলোকে। আগে তো এমন হয়নি!

দরজা খুলল তিন্নি। খুলেই এমন একটা চিৎকার দিল যে মনে হলো ডাকাত সর্দার সদলবলে তাকে হামলা করতে এসেছে। একছুটে মাকে নিয়ে হাজির হলো সে। মা আরও জোরে চিৎকার দিলেন। আমার মধ্যকার বৈরাগ্য ভাব আরেকটু বাড়ল। অতি নির্বিকার হয়ে আমি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। গা চুলকাচ্ছে, গোসল করলে ভালো লাগবে।

সন্ধ্যার পর চা দিতে এলো মা। দেখি তার চোখদুটো ফোলা ফোলা। পাশে বসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “তোর কী হইছে বাবা বল তো?”

“কিছু হয় নাই মা।”

“আমি অনেকদিন ধরে খেয়াল করছি তুই আগের মতো স্বাভাবিক না। কিছু হইলে বলে দে না মাকে।”

আমি কিছুই বলতে পারলাম না।

মা প্রথমটায় আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করে শেষে কান্নাকাটি শুরু করলেন৷ সবার শেষে বকতে বকতে চলে গেলেন। তার ভাষ্যমতে, বাড়ির কেউ তাকে দাম দেয় না৷ তার দাম একটা পাপোশের চেয়েও কম।”

এরকম কথা শুনেও আমি চুপচাপ বসে রইলাম৷ উদাস হয়ে ভেতর থেকে গান চলে এলো, “জলে ভাসা পদ্ম আমি…শুধুই পেলাম ছলনা…”

দু’দিন পর দ্বিতীয় পরীক্ষা। ওইযে আমি বৈরাগী হয়েছি, তাই তো ন্যাড়া মাথা নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছি নির্বিকারভাবে। তিন্নি কয়েকবার বলেছিল একটা ক্যাপ পরে নিতে, আমার রুচি হয়নি। কয়েকজন খুব হাসাহাসি করল, পাত্তা দিলাম না। পরীক্ষা দিলাম ভালোই। এক স্যার এসে মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বললেন, “কী মাসুদ! গরম লাগে বেশি?”

বললাম, “জি স্যার।”

স্যার বললেন, “আমার প্রতিদিন ইচ্ছে করে চুল কামিয়ে ফেলতে। শুধু বউ এর ভয়ে করি না।”

আমি ফিসফিস করে বললাম, “স্যার একবার চুল কামিয়ে ফেললে দেখবেন বউ এর কথা এত খারাপ লাগবে না।”

বলেই মনে হলো, যা! স্যারকে উপদেশ দিয়ে দিলাম! উন্নতি তো ভালোই হয়েছে।

স্যারও কিছু মনে করেনি। পরদিন দেখি স্যারের মাথা পরিষ্কার করে কামানো। আমাকে দূর থেকে দেখে হাত ইশারায় ডাকলেন। কাছে যেতেই একগাল হেসে বললেন, “তোমার কথা সত্যি। আমার বউ যেসব কথা শুনিয়েছে একটাও গায়ে লাগে নাই। গায়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে।”

আমি হেসে ফেললাম৷ আয়না দেখলে বোঝা যেত হাসিটা ক্যাবলাকান্তের মতো হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে সেই হাসির সাথে সাথে আমার বৈরাগ্য ভাব চলে গেল। বোধহয় স্যারের কাছেই গেল। আমি দুঃখী মন নিয়ে ক্যান্টিনে খেতে গেলাম। বসেছি এক কাপ চা আর দুটো পুরি নিয়ে, দেখি আফ্রিতা ঢুকল। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম৷ তারপর মনে হলো ওকে তো মন থেকে বাদই দিয়েছি, এখন আর লুকিয়ে থাকার মানে নেই। সামনাসামনি থাকি। খেয়াল করলাম আফ্রিতা জ্বলন্ত চোখে কাকে যেন খুঁজছে। আমার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরে গেল একবার, পরক্ষণেই ফিরে তাকাল। তাকিয়েই রইল। এগিয়ে এসে মুখোমুখি বসল। ওর জ্বলন্ত চোখদুটো নিভে গেল, আর আমার দিয়ে চেয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। আমি নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু বৈরাগ্য ভাব মনে হচ্ছে পুরোটা স্যার শুষে নিয়েছেন।

আফ্রিতা বলল, “কী ভেবেছিলি? মাথা ন্যাড়া করলে তোকে আমি চিনব না?”

আমার রাগ তখনও পুরোপুরি বজায় আছে৷ বিরক্ত মুখ করে খেতে থাকলাম। জবাব দিলাম না। আফ্রিতা বলল, “আজকে দেখা করতে পারবি বিকালে? টিএসসিতে?”

প্রথমে জবাব না দিয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। পরে আবার বসলাম৷ সোজা জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? আজকে কী করতে হবে? তোমার আকিব ভাইয়ের প্রেমিকাকে ধরে চুমু খেতে হবে?”

আফ্রিতা থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল। আমি উঠে চলে গেলাম৷ ভেতরে ভেতরে কেমন যেন খুশি লাগছে। গ্রীলের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে একটা ফুটন্ত জবা ছিঁড়ে নিলাম। সামনেই ক্লাসের একটা মেয়ে ছিল। ওর হাতে দিয়ে বললাম, “নাও ধরো।”

মেয়েটা কিছু না ভেবে নিয়ে নিল। এমনকি মাথায় গুঁজেও ফেলল৷ আমি পেছনে চেয়ে দেখি আফ্রিতা দাঁড়িয়ে আছে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আগুন ঝরিয়ে দিচ্ছে৷ এই মেয়ের আগুনে আমি আর পুড়ছি না। ওর আগুনে ও নিজেই পুড়ে যাক!
#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-১০

কয়েকদিন ব্যস্ততায় আর আফ্রিতার সাথে দেখা হয়নি। পরীক্ষা সবগুলো দিয়ে ফেললাম ভালোভাবে। যেদিন পরীক্ষা শেষ হলো সেদিন বাড়ি ফিরে টানা ঘুম। উঠলাম পরদিন সকালে। উঠেই মনে হলো পৃথিবীটা অদ্ভূত রকমের শূন্য। বাসায় সবাই আছে, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে, তবু সব ফাঁকা কেন লাগছে? আমি ফেসবুকে আফ্রিতার আইডি সার্চ করে দেখলাম। হাসিমুখের ছবি৷ কিছুক্ষন ঘাটাঘাটি করে অনেকগুলো ছবি দেখার পর নিজের ওপরেই মহাবিরক্ত হলাম। এই মেয়ের পেছনে সময় নষ্ট করছি কেন?

কয়েকদিন ছুটি পেয়েছি ভাবলাম কোথাও ট্যুর দিয়ে আসি। ইউনিভার্সিটি থেকে একটা ট্যুর গ্রুপ দেখলাম কক্সবাজার যাচ্ছে। আমি রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। কক্সবাজার আগে বহুবার যাওয়া হলেও কেন যেন জায়গাটার ওপর টান কমে না। মনে আরেকটা ক্ষীণ আশা আছে, যদি সেখানে কোনো সুন্দরীর দেখা পাই তো তবে আফ্রিতা নামক আপদকে পুরোপুরি ঘাড় থেকে নামানো সহজ হবে।

দিনক্ষণ ঠিক হলো। আমি গোছগাছ করে বের হবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। প্রতিবারের মতো মা এবারও হাতে একটা খাবারের বক্স ধরিয়ে দিলেন রাস্তায় যেতে যেতে খেতে। তিন্নি কিছুদিন গাঁইগুঁই করেছে তাকেও নিতে, নেইনি বলে রাগ করে ছিল, আজ নিজেই এসে গলা ধরে বলল তার জন্য আচার আনতে। আর তৌহিদ বলেছে সুন্দর করে কিছু ছবি তুলে নিতে। তার আবার ঘুরতে ভালো লাগে না৷ ভ্রমণ নিয়ে একটা এসাইনমেন্ট বানাতে হবে, ছবিও নাকি লাগবে। আমি সবার থেকে বিদায় নিয়ে খুশি মনে বের হলাম।

গিয়ে দেখি অনেকেই চলে এসেছে। সিট নাম্বার জেনে বাসে উঠে একটা ধাক্কা খেলাম। আমার পাশের সিটে আফ্রিতা। আরামসে বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গুনগুন করছে। আমি আসার পর চোখ মেলে তাকাল। একটা লম্বা হাই তুলল যেন আমার চেহারার মতো একঘেয়ে জিনিস পৃথিবীতে নেই যা দেখে তার ঘুমে চোখ ধরে আসছে। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। আফ্রিতা বলল, “সব সিট বুকড। তুই যদি আমার সাথে যেতে না চাস তাহলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।”

আমি বললাম, “তোমার সাথে বসার চেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভালো।”

আফ্রিতা আরও একটা হাই তুলে বলল, “তাহলে তোর সিটটা আমি ইউজ করি হু? শান্তিমতো ঘুমানো যাবে।” বলে সে আমার সিটে পা তুলে দিল। মাথার নিচে একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল।

আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “বসবি না? ডাক ওকে।”

আমি বললাম, “থাক।”

কয়েকজন আমার আর আফ্রিতার জটিল সম্পর্কের কথা মোটামুটি জানে। তারা মুখে কুটিল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। সিট বদলের চেষ্টা করেও লাভ হলো না। কেউ নিজের সিট ছাড়তে রাজি না। ওরা মজা দেখতে চায়। বন্ধুরাও বিপদের সময় শত্রুর চেয়ে খারাপ হয়ে যায়!

বাস ছাড়ল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার হাত, পা ব্যথা হয়ে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আর পারলাম না। আফ্রিতাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, “ওঠো! আমি বসব। টাকা দিয়ে সিট বুক করেছি। তোমার জন্য দাঁড়িয়ে যাব নাকি?”

আফ্রিতা হাই তুলতে তুলতে উঠে বসল। পা নামিয়ে জায়গা করে দিয়ে বলল, “আমি তো তোকে বসতে মানা করিনি।”

আমি আফ্রিতার পাশে বসলাম। সাথে সাথে ওর শরীর থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভেসে এলো। কী সুন্দর ঘ্রাণ! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। এতক্ষণের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কয়েকজন গান ধরেছে গিটার বাজিয়ে। বাকিরাও তাল দিচ্ছে। আফ্রিতার গলা শুনতে পেলাম সবার মাঝেও আলাদা করে।

….তোমার জন্য নীলচে তারার একটু খানি আলো
ভোরের রঙ রাতে মিশকালো
কাঠগোলাপের সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো….

কী যে ভালো লাগল! আমি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল আফ্রিতার ধাক্কাধাক্কিতে। দেখি বাস থেমেছে। সবাই বের হচ্ছে। আফ্রিতা নিচু গলায় বলল, “অ্যাই, আমি ওয়াশরুমে যাব। নিয়ে যাবি তুই।”

আমি শুকনো মুখে বললাম, “কোনো মেয়ের সাথে যাও।”

ও আমার ওপর কঠিন দৃষ্টি ফেলে বলল, “কোনো মেয়েকে চিনি না।”

অগত্যা আমাকেই ওর সাথে যেতে হলো। আমি কিছু খেলাম না। মা কী দিয়েছে কে জানে! না খেলে আবার নষ্ট হয়ে যায় যদি। আমি ফিরে এলাম বাসে। আফ্রিতাও পিছু পিছু ফিরল। বাক্স খুলে দেখি পাটিসাপটা পিঠা৷ আমার প্রিয় জিনিস। গপাগপ তিনটে খাওয়ার পর মনে হলো আফ্রিতাকে কি সাধব? একা একা খাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। বললাম, “খাবা?”

আফ্রিতা ভেঙচি কেটে বলল, “আমি খেলে তোর কম পড়ে যাবে।”

“আরে না, খাও।”

আফ্রিতা খেল না। নিজের ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করল। খোলার পর চমৎকার ঘ্রাণ বের হলো। হটপটে করে ও নিয়ে এসেছে বিরিয়ানি। আমি ঢোক গিললাম। আফ্রিতা আমাকে সাধার চেষ্টাও করল না। দেখিয়ে দেখিয়ে পুরোটা সাবাড় করে দিল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here