একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব -১৩ ও শেষ

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-১৩

ভীষণ বাতাস বইছে আজ। আকাশের দিকে চেয়ে মনে হলো আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বোধহয় নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। এখনো আসছে না কেন আফ্রিতা?

রুফটপ রেস্টুরেন্ট পুরোটা ছোট ছোট বাতি দিয়ে সাজানো। বিকেলের মরে যাওয়া আলোয় গোল গোল নীল সবুজ সোনালী বলগুলোর দিকে চাইলে মন ফুরফুরে হয়ে যায়। হালকা একটা মিউজিক বাজছে, কানের জন্য আরামদায়ক। শীত শীত লাগছে। নভেম্বর মাস এখন। বোধহয় আজ কালের মধ্যে বৃষ্টি হয়ে ভালোভাবেই শীত পড়ে যাবে।

আফ্রিতা কখন নিঃশব্দে এসে বসেছে বুঝতে পারিনি। দেখলাম তার চোখদুটো ফোলা। গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে এসেছে। সাজগোজ নেই, তবু সুন্দর লাগছে তাকে। বললাম, “কেমন আছ?”

আফ্রিতা সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, “মেসেজ পড়েছিলে পুরোটা?”

আমি ঢোক গিললাম। বাড়ি ফিরেছি গতকাল। আফ্রিতাকে তিন্নি ফোন করে বললেও সে আসেনি। আমাকে আজ সকালে অজগরের মতো লম্বা একখানা মেসেজ পাঠিয়েছি। পড়তে গিয়ে দেখি গালাগালির বিশাল লিস্ট। সাথে লিখে দিয়েছে, “আমি মুখে গালি দিতে পারি না, তাই নেট থেকে ডাউনলোড করে দিলাম। সবগুলো একটা একটা করে পড়বি। আর আজ বিকাল সাড়ে চারটায় সন্ধ্যামণি রেস্টুরেন্টে চলে আসবি।”

গালাগালি পড়িনি, তবে রেস্টুরেন্টে এসেছি। ওর কথার জবাবে বললাম, “পড়েছি।”

“মিথ্যা বলবি না।”

“আচ্ছা। এখন বলো কেন আসতে বলেছ?”

“কোথায় গুম হয়ে ছিলি?”

“সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।”

কথাটা বেশ কড়া সুরেই বললাম। আমার সাথে যে গেম খেলতে পারে তার সাথে মধুর সুরে কথা বলার কোনো মানে হয় না। খেয়াল করলাম আফ্রিতার চোখে পানি চলে এসেছে। অবাকই হলাম একটু। সে অবশ্য দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, “আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলি, ইটস ওকে, কিন্তু বাবা মাকে কেন শাস্তি দিলি? তুই কি সারাজীবন স্টুপিড থেকে যাবি? বুদ্ধি হবে না?”

“সেটা তোমার দেখার বিষয় না আফ্রিতা।”

আফ্রিতা কড়া গলায় বলল, “বেশি বড় বড় কথা না?”

“হ্যাঁ। তোমাকে তো বলেছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ না রাখতে। তাহলে শুধু শুধু আমার জন্য বাসায় এসে কান্নাকাটি করার মানে কী? আর এখন এসব নাটক করছ কেন?”

আফ্রিতা আমার হাতে জোরে একটা চিমটি দিল। লাফিয়ে উঠলাম প্রায়। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোর জন্য আমার পুরো লাইফ এলোমেলো হয়ে গেছে, এখন তুই বলবি যোগাযোগ না রাখতে, আর আমি মেনে নেব? ফাও মনে হয় আমাকে?”

“আমার জন্য তোমার লাইফ এলোমেলো হয়েছে?” অবাক হয়ে বললাম।

আফ্রিতা টেবিলে একটা কিল দিয়ে বলল, “আলবাত হয়েছে!”

“কীভাবে?”

আফ্রিতা প্রথমে উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল। হঠাৎ থেমে গেল। অন্যদিকে ফিরে কয়েক সেকেন্ড ঝিম মেরে চুপ করে রইল। নিজেকে সামলে নিল, কথা গুছিয়ে নিল হয়তো। তারপর আগের তুলনায় খুব শান্ত আর নরম গলায় প্রশ্ন করল, “আচ্ছা মাসুদ একটা কথা বলোতো, আমার সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো?”

আমি কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। আবার আফ্রিতা আমাকে তুমি বলা শুরু করেছে। এবার আর ইমোশনাল হব না। মস্তিষ্ক আমাকে লাল সংকেত দিচ্ছে। বিপদ! সামনে আবার বিপদ! মাসুদ রানা, বাঁচতো চাইলে পালাও!

আমাকে বেকুবের মতো বসে থাকতে দেখে আফ্রিতা বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি কোনোদিন দেখেছ আমাকে কারো সাথে ঝগড়া করতে বা খারাপ ব্যবহার করতে?”

“দেখেছি। আমার সাথেই করো।”

“তুমি বাদে।”

একটু ভেবে বললাম, “না।” আফ্রিতা আসলেও খুবই ভালো একটা মেয়ে। মিষ্টভাষী, বুদ্ধিমতী আর পরোপকারী।

“তাহলে তোমার এটা কেন মনে হয়নি যে আমি তোমার সাথে কেন এত ঝগড়া করছি?”

“কারণ আমি তোমার পিছু পিছু ঘুরছিলাম।”

আফ্রিতা কথা না বলে দু’জনের জন্য কফি অর্ডার দিল। নিজের চাদরের কোণে একটা আলগা সুতো টানতে টানতে বলল, “আমার পেছনে এ পর্যন্ত অনেক ছেলেই ঘুরেছে। আমি তাদের সাথেও কোনোদিন ঝগড়া করিনি। শুধু আকিব ভাইকে বলেছি, সে সাইজ করে দিয়েছে। অথচ তোমার নামে আমি আকিব ভাইয়ের কাছে কোনো কথা বলিনি৷ উল্টে তুমি নিজে তার কাছে গেছো। কেন বলিনি বলতে পারো? বা কখনো ভেবেছ?”

আমার এসব ভাবতে ইচ্ছে হলো না। মেয়েটা কথা প্যাঁচানো শুরু করেছে। বললাম, “এত আগের কাহিনী শুনে কী হবে?”

“তুমি প্রশ্ন করেছ আমার জীবন কেন এলোমেলো হয়েছে তোমার জন্য, সেটার জবাব দিতে পুরানো কথা অবশ্যই তুলতে হবে। তাছাড়া তোমাকে বোঝানোর কোনো উপায় তো দেখি না। তুমি হলো চোখ থাকতেও অন্ধ- প্রজাতির যোগ্য উত্তরসূরী।”

“অপমান করতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না?”

আফ্রিতা আমার হাতে আগের চেয়েও জোরে একটা চিমটি দিয়ে বলল, “গাধা কোথাকার! সাধে আমি অন্ধ বলি? ভালো করে খেয়াল করলেই বুঝতে আমি মোটেও তোমাকে অপমান করি না। যা মনে আসে বলে দেই, রাগ থেকে বলি, অভিমান থেকে বলি। কিন্তু অপমান করতে বলি না।”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

কফি চলে এলো। আফ্রিতা গরম কফিতে ছোট ছোট কয়েকটা চুমুক দিল। বিকেল শেষে সূর্য অস্ত যাওয়ার পায়তারা করছে। বললাম, “সন্ধ্যা হয়ে আসছে আফ্রিতা। বাসায় ফিরবে না?”

আফ্রিতা আমার কথা শুনল বলে মনে হলো না। তার দৃষ্টি সন্ধ্যার শহরে একটা দুটো করে জেগে ওঠা বাতিগুলোর দিকে নিবদ্ধ।

অবশেষে আবার মুখ খুলল সে।

“শুরু থেকেই খেয়াল করেছি, আমার পেছনে যারা ঘোরাফেরা করে, তুমি তাদের মতো নও। একটু বোকা টাইপ, তবে ভালো ছেলে। কয়েকটা মেয়েকে ট্রাই করে দেখে যার সাথে লেগে যাবে তার সাথে প্রেম করব এমন প্রবণতা নিয়ে তুমি ঘোরো না। অনেক ছেলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করত, হেল্প করত, ফোন নাম্বার চাইত বা কোথাও থেকে কালেক্ট করে রাতবিরেতে ফোন করত, তুমি কোনোটা করোনি। তুমি সোজা এসে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছ। আমি যা বলেছি সেটা করার জন্য পাগল হয়ে গেছ।

এজন্যই শুরু থেকে তোমাকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল, তবে ভালোবাসা অনেক দূরের ব্যাপার ছিল তখনো। তোমার সাথে ঝগড়া করতে খুব মজা লাগত, ঝগড়া করতে থাকলে তোমার মুখটা দেখার মতো হতো। আমি তাই আরও বেশি করে ঝগড়া করতাম। তোমাকে রাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। তুমি রেগে যেতে, কিন্তু কিছু বলতে পারতে না।

আমি তারপর তোমার ব্যাপারে খোঁজ নেই। জানতে পারি খামখেয়ালি হলেও তুমি ভালো ছেলে। তাই আমিও খানিকটা স্পেস দিলাম তোমাকে, দেখার জন্য যে কতদূর কী করতে পারো। লাইব্রেরিতে শুধু শুধু বসে যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে, আমার মোটেও খারাপ লাগত না। কিন্তু তুমি বড্ড বেশি আনস্মার্ট ছিলে। এজন্য বলেছিলাম পার্সোনালিটি নাই, কোনো গুণ নাই।

আর তুমি তাই বলে কবিতা আবৃত্তি করতে উঠে পড়ে লেগে গেলে! আচ্ছা কে বলেছিল যেটা পারবে না সেটা করতে? আমি ভাবতাম তুমি সুন্দর করে কথা বলা শিখবে, জোর দিয়ে বলবে, আফ্রিতা, তোমাকে আমার পছন্দ। কিংবা আমার একটা কথার জবাব সমান কোনো কথা বলে দেবে। তা না, উনি হলভর্তি লোকের সামনে সোনার তরী আবৃত্তি করতে লেগে গেলে!

সেদিন মঞ্চে তোমার বিব্রতকর অবস্থা দেখে এত খারাপ লেগেছিল! আমার চোখে পানি চলে এসেছিল জানো, সবাই যখন তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। আমি চোখের পানি লুকিয়ে ফেলতে হাসার চেষ্টা করছিলাম। আর তুমি ভেবে নিলে আমি তোমাকে বিদ্রুপ করছি। এত বোকা হলে চলবে?

এরপর থেকে তুমি আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিলে। খুব মিস করছিলাম তোমাকে। একবার সরি বলার ইচ্ছে হয়েছিল খুব বেশি। তবে বলব কী করে? তুমি তো আমার সাথে কথাই বলো না! খুব মন খারাপ লাগত। একসময় মনে হতে লাগল তোমাকে আমি অনেক বেশি পছন্দ করে ফেলেছি। এখন আর সেটা নষ্ট করা যাবে না।”

আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, “এক অঙ্গে এত রূপ দেখালে তো চলবে না! তুমি নিজের মুখে বলেছ আকিব ভাইকে তুমি ভালোবাসো।”

আফ্রিতা রেগে গিয়ে বলল, “তো আর কী বলব? তুমি চোখ দেখে মানুষের মনের ভাব বোঝো না সেটা আমার দোষ? সেদিন পার্কে আমি তোমার জন্য বসেছিলাম। জানতাম তোমাদের বাসা ওদিকে, তাই গিয়েছিলাম, যদি দেখা হয়ে যায়! সৌভাগ্যক্রমে দেখা হয়েও গেল। আমি কী ভীষণ আকুতি নিয়ে তোমাকে ডেকেছিলাম! তুমি যখন কাছে চলে এলে আমি তোমাকে প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছিলাম, তখনও বুঝলে না তুমি! হিন্টস দিলাম, তাও বুঝলে না!”

“কোথায় হিন্টস? কোন হিন্টস?”

আফ্রিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বলেছিলাম তোমার সাথে যা হয়েছে, আমার সাথেও তাই হয়েছে। তার মানে তুমি রিজেক্ট হয়েছ, আমিও। বোঝাতে চেয়েছিলাম শুরুতে আমি তোমাকে রিজেক্ট করেছি, পরে তুমি আমাকে করেছ। কিন্তু তুমি তাও বোঝোনি, গাধার মতো জিজ্ঞেস করে বসেছিলে কার থেকে? তখন আমি বলতাম তোমার থেকে? এত রাগ হয়েছিল! কিছু না পেয়ে আকিব ভাইয়ের নাম বলে দিয়েছিলাম। তারপর একটা বানানো কাহিনীও বলেছিলাম।”

“হায় হায়!” আমার মুখটা বিরাট হা হয়ে গেল। নারীচরিত্র এত ভয়ানক রকমের রহস্যময়, এদের মনের ভেতর এত এত সুড়ঙ্গ, আমার মতো মাথামোটার তো দূরে থাক, সত্যিকার গল্পের মাসুদ রানার পক্ষেও সেই সুড়ঙ্গ পাড়ি দিয়ে মনের আসল খবর জানা সম্ভব নয়। আরে আমি কি জ্যোতিষি নাকি যে মুখ দেখে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলে দেব?

আফ্রিতা এবার আমার হাতে তৃতীয় রামচিমটি দিয়ে বলল, “আমি কী বলছি কানে যাচ্ছে?”

“উফ! হু শুনছি! বলতে থাকো!”

“কী বলব আর? তোমার তারপরের ব্লান্ডারের কথা? আকিব ভাইয়ের কাছে আমাকে কী পরিমাণে ছোট করেছ তোমার কোনো ধারণা আছে? তবুও যে আমি তোমার সাথে কথা বলি সেটা তোমার ভাগ্য! তুমি আমার সব ফিলিংস নিয়ে জাস্ট ছেলেখেলা করেছ!”

“আমি কী করলাম? তুমিই তো তার প্রেমিকার কাছে প্যাঁচ লাগানোর জন্য আমাকে দিয়ে প্রেমপত্র পাঠালে!”

“সেটা আমার আরেকটা প্ল্যান ছিল!”

“কী প্ল্যান?”

“তা আর কী করে বলব? চিঠি তো পাচার করে দিয়েছ আকিব ভাইয়ের হাতে!”

আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল চিঠিটার একটা ফটোকপি করে আমার মানিব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম। সেটা হয়তো এখনো আছে। মানিব্যাগ বের করে পেয়েও গেলাম চিঠি। ভাজ খুলে আফ্রিতার হাতে দিলাম। সে চোখ কপালে তুলে বলল, “ব্যাঙের সর্দি!”

আমার এই প্রথমবার মনে হলো, আফ্রিতা আমাকে অপমান করছে না, যা বলছে মজা করে বলছে। কথাটা মনে হতেই অদ্ভূত ভালোলাগায় ছেয়ে গেল মন। আফ্রিতার এতক্ষণের কথাগুলো কেমন অনিশ্চিত লাগছিল। ওকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। হুট করেই বিশ্বাস হয়ে গেল। অনেকদিনের জমাট মনের কোণের বরফ হলে যেতে লাগল হু হু করে। তুমুল স্রোত বইতে থাকল মনের নদীতে। এত ভালো বোধহয় অনেকদিন লাগেনি!

আফ্রিতা ভুরু কুঁচকে বলল, “কী ভাবো?”

“কিছু না।”

“চিঠিটা পড়ো।”

আগে একবার পড়েছিলাম৷ এখন আবার পড়লাম।
_____________

প্রিয় মাকসুদা,

তুমি এত বোকা কেন? আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেটা বুঝতে কি খুব কষ্ট হয়? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করো? তোমার সাথে প্রথম দেখার দিন থেকে তোমার প্রতি ভালোলাগা জন্মেছে। প্রতিদিন সেই ভালোলাগার গাছ বড় হয়েছে। আমিই পানি দিয়েছি, সার দিয়েছি তাতে। মাঝখানে এতদিনের দূরত্ব সেই গাছটাকে হুট করে অনেকখানি বড় করে দিয়েছে। ভালোলাগার গাছটা পরিণত হয়েছে ভালোবাসায়। তুমি আমাকে হয়তো প্রেম নিবেদন করবে না, আমার প্রতি কত রাগ তোমার! কী আর করার! আমিই করলাম। ভালোবাসি তোমাকে। সরাসরি বলতে পারব না বলেই এই আজব পদ্ধতিতে বললাম। জবাব দিও, অপেক্ষায় থাকব।

ইতি
আফরাত
______________

চিঠিটা প্রথমবার পড়ে মনে হয়েছিল আফ্রিতা প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে ঝামেলা বাঁধাতে এটা করেছে! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চিঠি সে আমাকেই লিখেছে। মাকসুদা মানে মাসুদ আর আফরাত মানে আফ্রিতা! এত বড় ক্লু দেখেও যে আসল ঘটনা না বোঝে তার নাম গোয়েন্দার নামে রাখারও যোগ্য না৷ আমি ভয়ে ভয়ে আফ্রিতার দিকে তাকালাম। সে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সম্ভবত এই কেলেঙ্কারির ধকল আগেই পুরো সামলে নিয়েছে। বললাম, “কিন্তু আমি তখন অতকিছু মোটেও ভাবিনি। আর তুমি চিঠি দেবার এত মারাত্মক রকমের অভিনব কৌশল বের করবে আমি কি সেটা ভাবতে পেরেছিলাম?”

আফ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার সহজ সরল কিছু করতে ভালো লাগে না। আমি অবশ্য তোমাকে পথ দেখাতে তোমার পেছন পেছন নিচে নামছিলাম। তুমি যদি চিঠিটা খুলে না পড়তে তাহলে আমিই ডেকে বলতাম নিজে পড়ে তারপর দিতে। যখন নিজে পড়লে তখন কী ভালো লাগছিল! ভাবছিলাম তক্ষুনি আমার কাছে চলে আসবে। লজ্জাও লাগছিল। তাই ছাদে চলে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে তুমি কী করলে? চিঠির বদলে সাদা কাগজ ওই মেয়ের হাতে দিয়ে সোজা চলে গেলে আকিব ভাইয়ের কাছে। সে বেচারা কিছু জানতও না!”

আমি কাচুমাচু মুখে বললাম, “আকিব ভাই পরে কী করেছিল?”

“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। কী পরিমাণে টিজ করেছে আমাকে ভাবতেও পারবে না। শেষ পর্যন্ত তাকে একটা গার্লফ্রেন্ড খুঁজে দিয়ে শান্ত করতে হয়েছে।”

“তার মানে? ওই মেয়েটা ওনার গার্লফ্রেন্ড ছিল না?”

“না।”

“তাহলে কে ছিল?”

“আমি কী জানি?”

আমি মিনিট দুই চোখ বন্ধ করে পুরো বিষয়টা ভাবার চেষ্টা করলাম। মাথা ফাঁকা লাগছে, পেটটাও। ভাবলাম কিছু অর্ডার করি। আফ্রিতাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, “একদম না! শুধু কফি অর্ডার করো। দু’জনের জন্যই। কিছু খাওয়া যাবে না এখন।”

“কেন? ক্ষুধা লেগেছে তো!”

“লাগুক।”

আমি দুটো কফি অর্ডার করলাম। আফ্রিতা বলল, “তারপর তুমি বলবে।”

“কী বলব?”

“চুল ফেলে দিয়েছিলে কেন?”

“অনেক রাগ লাগছিল।

আফ্রিতা মুখ ভোঁতা করে বলল, “তুমি জানো তোমার চুলগুলো আমার কত পছন্দ? সেদিনের পর ভেবেছিলাম তোমার সাথে কথাই বলব না। কিন্তু তোমার চুল নেই দেখে কী যে রাগ লাগল! ভেবেছিলাম সব বলে দেব। তাই বলেছিলাম বিকেলে দেখা করতে। কিন্তু তুমি তা করবে কেন! উল্টে আমাকে আজেবাজে কথা বলে উঠে গেলে। তার ওপর সেদিন মেয়েটাকে ফুলও দিলে৷ ইচ্ছে করছিল তোমার পেটটা ফুটো করে দিতে!”

“হিংসে হচ্ছিল?”

“তো কি হবে না?” বলেই লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ফিরল। ওর গালদুটো টুকটুকে লাল হয়ে গেছে। খুব ইচ্ছে হলো ওর একটা হাত ধরতে। আলতো করে ধরেও ফেললাম। আর সাথে সাথে চতুর্থ চিমটি খেয়ে হাত সরিয়ে নিলাম।

আফ্রিতা বলল, “তারপর কক্সবাজার ট্যুরের লিস্টে তোমার নাম দেখে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বাসে আমার পাশে বসতে চাইলে না দেখে ভীষণ রাগ হয়েছিল। তাই সবটুকু বিরিয়ানি একা খেয়ে নিয়েছিলাম। পরে অবশ্য খুব খারাপ লেগেছে।”

“তুমি আমার জন্য কক্সবাজার গিয়েছিলে? সত্যি?”

“হুম।”

“তাহলে সেদিন নাটক করেছিলে কেন?”

“কোন নাটক?”

“প্রেমিক প্রেমিকা হওয়ার নাটক?”

আফ্রিতা এবার দারুণ রেগে গেল। নাকের পাটা ফুলে গেল। মুখ লাল হয়ে গেল। বলল, “সেদিন আমি সব বলে দিতাম, সব! তোমাকে প্রপোজও করতাম সত্যি সত্যি। আমি আর থাকতে পারছিলাম না। কিন্তু তুমি কোনো আগ্রহই দেখালে না! একটা বার জিজ্ঞাসাও করলে না আমার মনের কথা। শুধু পাশে পাশে ঘুরলে। এমন নিস্পৃহ একটা মানুষকে কেউ কেমন করে প্রপোজ করতে পারে? সব বলতে গিয়েও বলিনি। রাগ হচ্ছিল বলে তোমাকেও জ্বালাতে বলে এসেছিলাম নাটক করেছি, আসলে সব সত্যি ছিল।”

আমার মাথা এবার আক্ষরিক অর্থেই বনবন করে ঘুরতে শুরু করল। আমি চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। মনে মনে বললাম, “আল্লাহ! এ কোন গোলকধাঁধায় আমায় ফেললে তুমি! উদ্ধার করো এবার!”

আফ্রিতার হাতের স্পর্শ পেয়েই ছিটকে হাত সরিয়ে নিলাম। সে রাগী গলায় বলল, “হাত সরালে কেন?”

“চিমটি দিতে যাচ্ছিলে তো!”

“আমি হাত ধরতে চেয়েছিলাম!”

আমি ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আফ্রিতা ধরল না। মুখ ফিরিয়ে বসে রইল। ওর গল্প শেষ। এরপর যা করার আমি করেছি। ও সেদিন হোটেলে বসে সারাদিন কেঁদেছিল। আমি তার ওপর অপমান করে রেখে এসেছি। তারপর নিরুদ্দেশ হয়ে গেছি। কী আজব আমি! আসলে আমি আজব নাকি আফ্রিতা? ওর গল্প শুনলে লোকে ভাববে ও আমার পেছনে ঘুরছিল। আমি পাত্তা দেইনি। এদিকে আমার দিক থেকে ভাবলে আমি ওর পেছনে ঘুরেছি, ও বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে। এ প্রেম জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আমি মাথা ঘোরা কমানোর জন্য টেবিলটা শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। সামনের মেয়ের মনস্তত্ত্ব বোঝা আমার পক্ষে অসম্ভব। এদিকে মনে হচ্ছে এর সাথেই বাকিটা জীবন কাটাতে হবে। ভাবনাটা যে ভেতরে ভেতরে ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে এটাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

ধীরেসুস্থে কফি শেষ করলাম আমরা। আফ্রিতা এবার গলা থেকে চাদর আর কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে দিল। দেখলাম আমার দেয়া সেই মুক্তোর সেটটা পরে এসেছে। কী সুন্দর লাগছে ওকে! আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও লজ্জা পেলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ও যে একটা মোটাসোটা ব্যাগ নিয়ে এসেছে সেটাও খেয়াল করিনি এতক্ষণ। ব্যাগ থেকে বড় একটা বক্স বের করে মুখ খুলল। দেখি বিরিয়ানি। বলল, “খাও এটা। সেদিন দেইনি বলে এই ক’দিন কিছু মুখে তুলতে পারছিলাম না। পুরোটা খাও তো, তারপর শান্তি পাব।”

আমি খুশিতে বাক্যহারা হয়ে গেলাম। সুস্বাদু চেহারার বিরিয়ানি সামনে নিয়ে কী বা বলব! প্রথম লোকমাটা নিয়ে আফ্রিতার মুখের সামনে ধরলাম। সে কঠিন গলায় বলল, “ঢং করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমি মোটেও ন্যাকা মেয়ে না। আমার সাথে প্রেম করলে এসব চলবে না।”

আমি কথা না বাড়িয়ে খেতে থাকলাম। খুব মজা হয়েছে। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললাম, “আন্টিকে বলে দিও রান্না ভালো হয়েছে।”

“কোন আন্টি?”

“আরে তোমার মা। এখনই তো আর মা ডাকা যাবে না, তাই আন্টি ডাকলাম।”

আফ্রিতা রুদ্রমূর্তি হয়ে বলল, “ফাজিল কোথাকার! বিরিয়ানি কষ্ট করে রান্না করলাম আমি আর সে প্রশংসা করে আমার মায়ের!”

“তুমি! সত্যি! তুমি এত ভালো বিরিয়ানি রাঁধতে পারো? তুমি তো দেখি সর্বগুণ সম্পন্না! তোমাকে বাঁধাই করে রাখতে হবে আমার।”

আফ্রিতা মুখ ভেঙচি দিল।

ফিরে আসার সময় আফ্রিতা আমার হাত ধরে নিচে নামল। ওকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিলাম। বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে নিচু স্বরে বলল, “তোমার চোখদুটো খুব সুন্দর জানো?”

★★★

চার বছর পর…….

গোসল করে সবে বের হয়েছি, আফ্রিতা কোথা থেকে এসে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল একটা। ভাগ্যিস মেঝেতে পড়লাম না, খাট আর সোফার মাঝামাঝি পড়ে কোমরে খানিক চোট পেলাম। কোমর ডলতে ডলতে বললাম, “কী হলো আবার?”

আফ্রিতা আমার চোখের সামনে কাগজ নাচিয়ে বলল, “এটা কী? কে দিয়েছে শুনি?”

কাগজ হাতে নিয়ে দেখি সেই জোনাকির প্রেমপত্রটা। আফ্রিতার কাছে জোনাকির চ্যাপ্টার পুরোপুরি লুকিয়ে রেখেছিলাম। জানলে কী করে ঠিক নেই। এখন এই চিঠি কোথা থেকে পেয়ে গেল! ঢোক গিলে বললাম, “এটা তো একটা মেয়ে…মানে আমি ওকে পছন্দ করতাম না…ও ই আমার পেছনে…আসলে…”

“তাই বুঝি এত যত্ন করে চিঠি রেখে দেয়া?”

“না সেজন্য না, আসলে…”

“কী?”

“তেমন কিছু না…ওইযে…”

আফ্রিতা আমার জবাবদিহির অপেক্ষা না করে আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। তখনই মনে পড়ল আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র তো এটা না, আফ্রিতা যেটা দিয়েছিল সেটা, যার আসল কপি আমি দিয়ে এসেছি কবি আকিব ভাইকে। ইচ্ছে করল নিজেই নিজেকে আরেকটা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেই।

আমার জটিল প্রেম এখনো জটিলই আছে। আফ্রিতা নামক ধাঁধার বইয়ের এক পার্সেন্টও আমি সমাধান করতে পারিনি। কষ্টও কম না জীবনে। বিয়ের পর থেকে একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে! তবু জীবনটা খুব একটা খারাপ মনে হয় না! কষ্টের মোড়কে ঢাকা জীবনটা আমার ভেতরে ভেতরে সুখে ভরা। বাইরে যাই করি না কেন, আমরা যে একে অপরকে কত গভীরভাবে ভালোবাসি তা আমরাই শুধু উপলব্ধি করতে পারি। মুখে বলাবলির প্রয়োজন হয় না।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here