একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব -১১+১২

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-১১

সমূদ্র নিজে অশান্ত হলেও বোধহয় অনেক অশান্ত মনই শান্ত করে দিতে পারে। আর নতুন সূর্যোদয় সেই মনের শান্তির সাথে জুড়ে দেয় নতুন আশার আলো। ভাগ্যে বোধহয় লেখা ছিল, নয়তো কে জানত এক কার্তিক মাসের হালকা হিমেল মিষ্টি সকালটা আমি আর আফ্রিতা একসাথে দেখব? তাও কোনো ঝগড়া-বিবাদ ছাড়াই?

এখানে আসার পর দুটো দিন পেরিয়ে গেছে কেমন করে জানি না৷ চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়া দিন দুটো ধরে রাখতে চেষ্টা করতে করতেই কেটে গেল। রয়ে গেল অল্প ক’টা স্মৃতি৷ আফ্রিতার সাথে এই দু’দিন একেবারেই কথাবার্তা হয়নি। চোখাচোখি হয়েছে শুধু। শেষ কথা হয়েছিল বাস থেকে নামার সময়। ওর ব্যাগটা নামিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলাম৷ বিরিয়ানি কাহিনীর পর আমার ইচ্ছে হয়নি ওর সাথে কথা বলার৷ সত্যি অভিমান হয়েছিল। আমার মতো পেটুককে না দিয়ে খেয়ে নিল! কী স্বার্থপর মেয়ে! আফ্রিতাও কাজটা করে ফেলে বোধহয় খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভুগছিল। বাস থেকে নামার সময় নিজে যেচে কথা বলেছে৷ আমি পাত্তা দেইনি বলে চুপসে গেছে কিছুটা। এরপর থেকে কেউ কারো সাথে কথা বলছি না।

আজ ঘটনা কী করে যেন এলোমেলো হয়ে গেল। রাতে ঘুম হয়নি। নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না। প্রথম দু’রাত জার্নির ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলেও গতরাতে আর এলো না। শেষে ভাবলাম শুধু শুধু শুয়ে না থেকে সূর্যোদয় দেখে আসি। ভেবেই জামাকাপড় পরে বের হয়ে এলাম। সৈকতে এসে দেখি আফ্রিতা। কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে দূর থেকে দেখার পর থেকে ওর কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় ও আবছা আলোতে আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। এমনকি আমিও। আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালাম। বিষে বিষক্ষয় হয়ে গেছে বোধহয়। দু’জনার বাজে ব্যবহার কাটাকাটি হয়ে গেছে। এখন আর কারো ইচ্ছে নেই অন্যকে খোঁচা মেরে কথা বলার।

আমরা পাশাপাশি দাঁড়াতেই সূর্যটা একটু একটু করে আঁধারের বুকে জেগে উঠতে শুরু করল। একটা কমলা আভা আকাশময় ছড়িয়ে দিল ভোরের বার্তা। সময়টা ভারি মন কেমনের। আফ্রিতা নিজের অজান্তেই আমার একটা হাত চেপে ধরল। আমার কী যে ভালো লাগল! মনে মনে সমূদ্রকে বললাম, “তুমি এত জাদুকরী কেন!”

অবশ্য আফ্রিতা একটু পরেই আমার হাত ছেড়ে দিল। সূর্যোদয় শেষে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকল দূরে। আমিই এগিয়ে গেলাম।

“কেমন কাটছে?”

“ভালো। তোমার?”

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম আফ্রিতার মুখে তুমি শুনে। কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ। আফ্রিতা আমার চোখের দিকে চেয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। আমি হেসে ফেললাম৷ আফ্রিতাও।

তারপর অনেক গল্প হলো। খুব স্বাভাবিক দুটো মানুষের প্রথম দেখায় যেমন গল্প হয় তেমন গল্প। আফ্রিতাকে আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ নতুন একটা রূপে, খুব মিষ্টি মেয়ে হিসেবে, যে গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলে, সামনের মানুষটার পছন্দ অপছন্দ বুঝে চলতে জানে। আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চাইল না। বার বার মনে হতে লাগল এসব আফ্রিতার চাল নয় তো? আবার ইচ্ছে করে আমাকে নিয়ে খেলছে না তো? কথা শুনে যদিও তা মনে হচ্ছে না। তবু বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।

আমার চুলগুলো এখনো অত বড় হয়নি। ছোট ছেট চুলেই হাত চালাচ্ছি। মন একটু অশান্ত থাকলে এরকমই করতে থাকি বার বার।

আফ্রিতা হঠাৎ প্রশ্ন করল, “তুমি চুল কেটে ফেলেছিলে কেন?”

আমি কী যেন একটা ভাবছিলাম। ওর প্রশ্নে খানিক চমকে গিয়ে বললাম, “তুমি আমাকে তুমি বলছ ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে!”

আফ্রিতা একটু হেসে বলল, “সরি। তোমাকে অনেক কথাই বলার আছে। তার আগে যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো!”

“কেন চুল ফেলে দিয়ে খারাপ লাগছে?”

“হ্যাঁ, খুব।” আফ্রিতা স্পষ্ট জবাব দিল, “তোমার চুলগুলো সুন্দর ছিল।” বলেই খানিক লাল হয়ে গেল। তবে এত দ্রুত সামলে নিল যে চোখের ভুল নাকি বুঝতে পারলাম না।

আমি একটু হেসে বললাম, “তোমার সাথে রাগ করেই চুল ফেলে দিয়েছি।”

আফ্রিতা জোরে হেসে ফেলল, “আমিও তাই ভেবেছিলাম।”

আমার খুব ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি সেদিন আকিব ভাইয়ের প্রেমিকার সাথে সেই কাজটা কেন করতে চেয়েছিল, কিন্তু করতে পারলাম না। আকিব ভাইকে ও এখনো পছন্দ করে কি না সেটাও জানা হলো না। আমরা অনেকক্ষণ সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে ক্ষুধা লাগার পর চলে গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে। বাইরে থেলে কুঁড়েঘরের মতো দেখতে হলেও রেস্টুরেন্টের ভেতর বেশ আধুনিক। খাবারও ভালো। খেতে খেতে আফ্রিতা বলল, “শুনেছি তুমি নাকি এখন বইটই পড়ো?”

“একটু আধটু।”

“তোমার সেদিনের কবিতা আবৃত্তি বাজে হয়েছিল, তবে তোমার চেষ্টাটা ভালো লেগেছে।”

আমি ওর অসংলগ্ন কথাবার্তার খেই ধরতে পারলাম না। আরও গুলিয়ে যেতে থাকল সবকিছু। আফ্রিতাও খোলাখুলি কিছু বলছে না। খাওয়ার পর আবার একটু হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে ফিরব, তখন দেখি দলের বাকিরা মাত্র উঠে আসছে। হোটেলের সামনে গিয়ে আফ্রিতা বলল, “শোন, আমি এতক্ষণ তোর সাথে একটু নাটক করলাম৷ খুব মন চাইছিল বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে। কিন্তু কেউ তো নাই, তাই তোকে দিয়ে শখ পূরণের একটু চেষ্টা করেছিলাম৷ যদিও চেষ্টাটা ব্যর্থ ছিল। তুই বয়ফ্রেন্ড হিসেবে একেবারেই বাজে। যাই, একটু ঘুমাব। গতরাতে ঘুম হয়নি।”

আমি বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে এই আশঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু এভাবে বলবে ভাবিনি। সত্যিকারের ক্ষতবিক্ষত করা বুঝি একেই বলে। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল নিজেকে সামলে নিতে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের রুমে চলে গেলাম। লম্বা শাওয়ার নেবার পর আমার নিজেরও ঘুম পেল। একেবারে শরীর ভেঙে আসা ক্লান্তি আর হতাশার ঘুম। আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল বিকেলে।


আজ কক্সবাজারে আমাদের শেষ রজনী। তাই বেশিরভাগই কেনাকাটায় ব্যস্ত। আমিও বাড়ির সবার জন্য কিছু কিছু কিনলাম। সবচেয়ে বেশি নিলাম তিন্নির জন্য আচার।

কেনাকাটা শেষে একটা খুব সুন্দর দেখে মুক্তোর সেট ভারি পছন্দ হয়ে গেল। দাম বেশি, কিন্তু কেনার প্রচন্ড ইচ্ছে হলো বলে কিনে নিলাম। সামনে ক’দিন চলতে কষ্ট হবে, তা হোক! প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম আফ্রিতাকে। পেলাম না। সবাই আছে, সে নেই। আফ্রিতার সাথে যে মেয়ে দুটো রুম শেয়ার করছে, তাদের জিজ্ঞেস করতে বলল ওর নাকি শরীর খারাপ, সকালের পর আর বের হয়নি। অগত্যা হোটেলে রওনা হলাম।

আফ্রিতার রুমে নক করতে দরজা খুলে দিল। আলুথালু চুল, গায়ে ওড়নাটা চাদরের মতো জড়ানো, চোখদুটো ফোলা। কেঁদেছে নাকি ঘুমিয়েছে বোঝা গেল না। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, “কী দরকার?”

“তোমার জন্য এনেছি।” বলে প্যাকেটটা ওর হাতে দিলাম।”

“কী এটা?”

“দেখে নাও।” বলে উল্টো ঘুরে চলে এলাম। ও নিশ্চয়ই দরজা ধরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটা এলো।

“তুই আমাকে এটা কেন দিলি? নিয়ে যা এক্ষুনি। আমার লাগবে না।”

আমি শান্ত স্বরে জবাব দিলাম, “তুমি আমাকে কয়েক ঘন্টার বয়ফ্রেন্ড বানিয়েছিলে, সেজন্য আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। মনে করো সেই সময়টুকুর প্রেমিক ভালোবেসে তোমাকে দিল। এটা আর ফেরত নেব না। ভালো থেকো। আর আমার সাথে যোগাযোগ করো না, খুব খুশি হব তাহলে।”

আফ্রিতা ফোন রেখে দিল। আমিও মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এক টুকরো তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটা ভীষণ অর্থহীন মনে হতে থাকল। কী প্রয়োজন ছিল কাউকে ভালোবেসে অকারণে কষ্ট ডেকে আনার? আমি তখনও জানতাম না কষ্টের কেবল শুরু। আমার জটিল প্রেমের ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল কেবল। আসল জার্নি এখনো বাকি।
#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-১২

ট্রেনে ঢাকায় ফিরলাম আমি। সবার সাথে মজা করে ফেরবার মতো ইচ্ছে কেন যেন মরে গেছে। তারচেয়ে বড় কথা ফেরার সময়েও আফ্রিতার পাশে বসে আসার একটা সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে যেটা চাই না। ট্রেনের কামরাটা গভীর রাতে নীরব হয়ে আছে। প্রায় সবাই ঘুমে ঢলছে। জানালার ফাঁক গলে বাতাস আমার চুল উড়ে দিয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ কেটে যাচ্ছে অল্প অল্প করে। আমি ঠিক করলাম এখন থেকে জীবন নিয়ে অনেক সিরিয়াস হয়ে যাব। পড়াশোনা আর দেড় বছর পরেই শেষ হয়ে যাবে৷ এখন থেকে চাকরির প্রস্তুতি নিতে হবে। ওকালতি করব কি না জানি না, এতদিন ইচ্ছে ছিল না, পড়া দরকার বলে পড়তাম৷ এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা ভালো। মা বাবার বোঝা হয়ে থাকা যাবে না। সংসারটা আমারই তো দেখাশুনা করতে হবে। আর আমি কি না আছি কোথাকার কোন মেয়ের প্রেম নিয়ে! আর সে আমার জীবন নিয়ে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছি! আমিও সানন্দে সেটা হতো দিচ্ছি! ওর চেয়ে বেশি খারাপ আমি নিজেই। ঠিক করে ফেললাম চাকরি পেতেই বিয়ে করে ফেলব। আমার মতোই খুব সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করব। আমাকে সে আমার মতোই ভালোবাসবে, আমিও তাকে খুব ভালোবাসবো। আর যদি কোনোদিম আফ্রিতার সাথে দেখা হয়ে যায়, তাকে দেখিয়ে দেব মাসুদ রানা তার বউকে কত ভালোবাসতে পারে! আফ্রিতার নিশ্চয়ই খুব হিংসে হবে! আফ্রিতার বর কোনোদিন ওকে আমার মতো ভালোবাসতে পারবে না, কথাটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আফ্রিতা তখন খুব জ্বলবে। বেশ হবে! আচ্ছা ইউনিভার্সিটিতে একটা প্রেম করলে কেমন হয়? আফ্রিতাকে দেখিয়ে আমরা হাত ধরাধরি করে ঘুরব..এক কাপে চুমুক দিয়ে চা খাব… বৃষ্টিতে এক ছাতার নিচে গা ঘেঁষে হাঁটব…আর আফ্রিতা….

উফ! আমার চিন্তা যেদিকেই যাক সেদিকেই মেয়েটা চলে আসে কেন? অপমানটা আমার গায়ে বসে গেছে মনে হচ্ছে। কী করলে উঠবে?

ট্রেনটা ভোরের দিকে কোনো এক অজানা স্টেশনে এসে থামল। কিছুটা গ্রামের মতো জায়গাটা। একপাশে বিস্তৃত ক্ষেত। আমি নেমে গেলাম সেখানে। ভোরের হালকা কুয়াশায় ছেয়ে আছে মাঠ প্রান্তর। সেদিকে হাঁটতে থাকলাম ভূতে পাওয়া মানুষের মতো। কোথায় যাচ্ছি জানি না। অসহায় লাগছে বড্ড। আমার পেছনে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কাঁধের ব্যাগটা সাথেই আছে। আরেকটা বড় ব্যাগ চলে যাচ্ছে ট্রেনের সাথে। ওটাতে কী আছে? কয়েকটা জামাকাপড়ই তো! যাক…আমি আবার হাঁটা ধরলাম।

বেশ অনেকক্ষণ যাওয়ার পর একটা পুকুর দেখতে পেলাম। সেটার অপর পাড়ে দুটো গরু, তারপর গাছপালায় ঘেরা দুটো ঘর চোখে পড়ল। আমার মাথাটা কেমন ফাঁকা লাগতে শুরু করেছে। কাল দুপুর থেকে কিছু খাইনি। শরীর অবসন্ন লাগছে। আমি হাঁটছি…চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসছে…

শুধু মনে আছে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। গ্রামের স্নিগ্ধ পরিবেশের ঠান্ডা ঘ্রান নাকে এসে লাগছে। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম…


জ্ঞান ফিরল বিকেলে। দেখি টিনের একটা ঘরের বিরাট খাটে শুয়ে আছি। পাশে চিন্তিত মুখে বসা এক লোক। গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ দেখে বুঝলাম ডাক্তার। আমাকে যত্নের ত্রুটি করা হলো না। বাড়িতে সব বয়সের লোকজন আছে। এক মহিলা খুব সেবা করছেন আমার। কথায় মনে হচ্ছে তিনি বাড়ির কর্ত্রী। মাঝবয়সী আরও কিছু মহিলাকে দেখলাম। কয়েকজন লোক, যারা নিজেদের ক্ষেতে কাজ করেন৷ কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েও আছে। আর আছে ছিপছিপে গড়নের মিষ্টি একটা মেয়ে, বয়স বোধহয় সতেরো-আঠারো হবে। লাজুক মুখে আমার ঘরের দরজার কাছে প্রায়ই এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি তাকালেই ছুটে পালিয়ে যায়৷

আমার কী হয়েছিল তাদের বলেছি। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমাকে ট্রেন থেকে ভূতে পেয়েছিল। ফজরের পর সাধানত ভূতের আসর কেটে যায় কিন্তু আমার ওপর থেকে কাটেনি। সেটাই এনে ফেলেছে এখানে। আমার ভাগ্য ভালো তাই পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলেনি। আমি তাদের ব্যাখ্যার বিপরীতে কিছুই বলিনি। এত আদরযত্ন অনেকদিন পাই না। তাই ভালোই লাগল। বাড়ি ফেরার কথা বললাম পরদিন, কিন্তু মহিলা বললেন আমাকে কিছুদিন থেকে যেতে। তার ছেলেটা নাকি আমার বয়সী, বিদেশ গিয়ে আর ফেরার নাম নেই। আমাকে কিছুদিন প্রাণভরে খাওয়াদাওয়া করাতে পারলে মনে হবে তিনি নিজের ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন। এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত আতিথ্য গ্রহণ করতে মনটা ইতস্তত করলেও এদের আন্তরিক ব্যবহারে মনে হলো থেকেই যাই।

তবে সবার আগে যে কাজটা করলাম সেটা হলো মোবাইল বন্ধ করে দেয়া৷ আমি কাউকে কিছু বলে আসিনি। যোগাযোগ করতে না পেরে এরা একটু চিন্তা করুক না! আমি তখন বুঝিনি কত ভুল একটা কাজ করলাম! আমার সুপ্ত বাসনা ছিল আফ্রিতাকে চিন্তায় ফেলার। কিন্তু এটা কল্পনা করতে পারিনি যে আফ্রিতা আমার জন্য চিন্তা করবে না, করবে আমার বয়ষ্ক বাবা মা। জটিল প্রেমে পড়লে মানুষের বোধবুদ্ধি হয়তো কমেই যায়। আমি নিজে তার প্রামাণ।


সেখানে আমি রইলাম এক সপ্তাহ। স্বপ্নের মতো দিনগুলো কাটল। বিশুদ্ধ হাওয়া, মনোরম পরিবেশ, তাজা খাবার- পুকুরের মাছ, ক্ষেতের সবজি, গরুর দুধ, পিঠেপুলি। সকাল বিকাল হাঁটতে বের হওয়া, বাচ্চাদের সাথে মিলে মাছ ধরা, ঘুড়ি ওড়ানো। আর ফ্রিতে অষ্টাদশী কন্যার আঁড় চোখের চাহনী তো আছেই।

আমাকে ছেলে বলা মহিলাটিকে ডাকতে হলো মা বলে। মা ছাড়াও খালা, চাচী, মামী, দাদী, দাদা, চাচা কতকিছু হলো! বাচ্চারা আরও বেশি আপন হয়ে গেল। আমি ফেরার দিন তাদের সে কি কান্না! সবচেয়ে অবাক হলাম অনেকে মিলে যখন আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এলো। আমি ট্রেনের কামরায় বসার পর সবাই জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রইল ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত। এই স্টেশনে অল্পক্ষণই ট্রেন দাঁড়ায়। ছেড়ে দিল ট্রেন। আমি বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। আবার ছুটছি ঢাকার দিকে।

হঠাৎ সেই মেয়েটা দৌড়ে এলো। মেয়েটার নাম বলা হয়নি। ওর নাম জোনাকি। নামটা শুনতে বেশ লাগে! জোনাকি দৌড়ে এসে জানালা দিয়ে একটা ভাজ করা কাগজ ফেলল। ট্রেন ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে আরও দ্রুত, তাই জিজ্ঞেস করা হলো না কিছু। কাগজের ভাজ খুলে দেখি নির্জলা প্রেমপত্র। খুব একটা অবাক হলাম না, ভালোই লাগল। আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র এটা।

তবে খারাপ লাগল মেয়েটার জন্য। ওর প্রতি আমার সেরকম কোনো অনুভূতি নেই। দু’দিন আগে বিরাট ছ্যাকা খাওয়া বেতাল মানুষ এত দ্রুত প্রেমে পড়তে পারে না। ‘আমাকে ভুলে যেও’- টাইপ একটা উত্তর দেয়া যেতে পারে, ওদের বাড়ির ঠিকানা জানি। বার বার আমাকে যেতে বলে দেয়া হয়েছে সেখানে। কিন্তু উত্তর দিলে ব্যাপারটা আরও গড়াবে, তারচেয়ে এখানেই সমাপ্ত হোক ঘটনা। চিঠিটাকে একটা স্যুভনির হিসেবে রেখে দেয়া যাবে। মাসুদ রানার জীবনে পাওয়া প্রথম প্রেমপত্র। হোক না গ্রামের অবুঝ, সরল কোনো মেয়ের লেখা! প্রেমপত্র তো!


বাড়িতে ঢোকার সময় ভয় ভয় লাগতে লাগল। মা বাবা কি মারবে? খুব বকবে? কলিংবেল চাপলাম আলতো করে। মনে হচ্ছে ঝড় নামবে এক্ষুনি। দরজা খুলল তিন্নি। আমাকে দেখেই বিকট এক চিৎকার দিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ও। ওর চেঁচামেচিতে বাকিরাও চলে এসেছে। মা আমাকে দেখার সাথে সাথে মূর্ছা গেলেন। বাবা কাঁপা হাতে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন। শুধু তৌহিল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাইয়া কোথায় ছিলে?”

আস্তে আস্তে জানতে পারলাম সবকিছু। আমাকে না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। অনেক খোঁজা হয়েছে। তৌহিদ নাকি কক্সবাজারও গিয়েছিল। পুলিশে ডায়েরি করা হয়েছে। ওরা আমার খোঁজ পায়নি, তবে আমার ব্যাগটা উদ্ধার করেছে ট্রেন থেকে। ওদের আশঙ্কা ছিল আমি হয়তো চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাপিয়ে পড়ে জীবন দিয়েছি। তবে আমার যেহেতু আত্মহত্যা করার কোনো কারন ছিল না, তাই সেটা নিয়ে কেউ নিশ্চিত ছিল না। মায়ের চেহারা দেখেই বোঝা যায় ক’দিনে অর্ধেক হয়ে গেছে, বাবা ঝিমিয়ে পড়েছে। নিজের ওপর খুব রাগ হলো আমার। ইচ্ছে করল চুলগুলো একটা করে টেনে ছিঁড়ি৷ আমার মতো খারাপ ছেলে ক’টা হয় পৃথিবীতে?

আমি কোথায় ছিলাম, কেন নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলাম সেটা কেউ জিজ্ঞেস করল না। আমি নিজে ব্যাখ্যা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু মা বলল প্রয়োজন নেই। আমি ফিরে এসেছি তাতেই তারা খুশি। খানিক অবাক লাগল, আবার স্বস্তিও পেলাম। শুনতে চাইলে বানিয়ে বলতে হলো।

কথার মাঝে তিন্নি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আফ্রিতা আপুকে বলতে ভুলেই গেছি। যাই ফোন করে আসি।”

আমি ওর হাত টেনে ধরলাম। “আফ্রিতা আপু মানে? তুই ওকে কীভাবে চিনিস?”

তিন্নি জবাব দিল, “তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে আফ্রিতা আপু প্রতিদিন আসে তোমার খোঁজে। আমাদের অনেক সান্ত্বনা দেয়, অনেকক্ষণ থাকে, তারপর চলে যায়। মাঝে মাঝে নিজেও কান্নাকাটি করে। উনিই তো বলেছে তোমার সাথে উনার ঝগড়া, তাই তুমি হারিয়ে গেছ। ওনার কারণে নাকি হারিয়েছ।”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

(চলবে)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here