এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ৯

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-৯♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

—- ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা কি লজ্জা! এইভাবে ইজ্জত ধুয়ে মুছে কুয়োয় পড়ে গেলো আমার! ইয়া আল্লাহ উঠালো মুঝে!

নিজের পুরো ঘরে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে পায়চারী করে এই ধরণের আরো কতক বাক্যালাপ আওড়ে চলেছে একনাগাড়ে অন্বিতা।
পাশেই ঠোঁট উল্টে বসে রয়েছে আনন্দ। বোনের এরকম উল্টাপাল্টা প্রলাপ বকায় চরম বিরক্ত সে। না খোলাসা করে সবটা বলছে আর না চুপ থেকে অন্যের মাথাটাকে রেস্টে রাখছে। আনন্দর মনে সংশয় হচ্ছে এই ভেবে “যা শেষমেশ আপু আমার পাগল টাগল হলো না তো?”
প্রশ্নটা বার কয়েক নিজ মনেই আওড়ে নিয়ে নড়েচড়ে বসলো আনন্দ। বোনের পায়চারী সুক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে ভ্রু কুঁচকে সে বললো,

—- “আপু, তুমি ঠিক আছো? মাথায় কি কোথাও চোট লেগেছে তোমার?”

আনন্দর প্রশ্নে চমকে উঠে হাটা থামিয়ে থমকে দাঁড়ালো অন্বিতা। তার ছোট্ট ভাইটা যে কখন ঘরে এসে বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে পড়েছে তা একটিবারের জন্যও খেয়ালে আসে নি তার। নিজের বেখেয়ালিপনায় নিজেই বিরক্ত হলো অন্বিতা। প্রসঙ্গ এড়াবার তাগিদে আমতাআমতা করে বললো,

—- তু….তুই…কখন এলি? ঘুমোস কি কেনো এখন?

বোনের প্রশ্নে বিছানা থেকে চট করে নেমে পড়লো আনন্দ। মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো,

—- ঘুম আসছিলো না আপু, ভাবলাম তোমার কাছে এসে একটু গল্প করি। কিন্তু তুমি তো আছো অন্য ধান্দায়। কিসব উল্টোপাল্টা বকবক করছো! কি হয়েছে আমায় বলো।

অন্বিতা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। “যাক বাবা আগের কথাগুলো শুনে নি!” ভেবেই আস্বস্ত হলো সে। আনন্দকে আবারও বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সে বললো,

—- শুয়ে শুয়ে শুধু গার্লফ্রেন্ডের কথা ভাবলে ঘুম কেনো ঘুমের বাচ্চাকাচ্চাও এসে ধরা দেবে না।

অন্বিতার কথায় ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট উল্টালো আনন্দ।” তার যে গার্লফ্রেন্ড নেই শুধু মেয়ে বন্ধু রয়েছে” এই সিম্পেল কথাটা কেনো যে তার বোন বোঝে না তা নিজেই বুঝতে পারে না সে।

—- উফফ আপু, আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, শুধু মেয়ে বন্ধু আছে।

আনন্দের বোকাসোকা এডাল্ট টাইপ কথাবার্তায় ফিক করে হেসে ফেললো অন্বিতা। ভাইয়ের কালচে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

—- হাদারাম! গার্লফ্রেন্ড আর মেয়ে বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য কোথায় বলতো? গার্ল মানে মেয়ে, আর ফ্রেন্ড মানে বন্ধু। তো হলো না “গার্লফ্রেন্ড” ইজ ইকুয়াল টু “মেয়েবন্ধু”?

অন্বিতার যুক্তি বুঝেও না বুঝার ভান করে ঠোঁট বাঁকালো আনন্দ। সে জানে মুখে যতোই যুক্তি দেখিয়ে মেয়েবন্ধু আর গার্লফ্রেন্ড কে অন্বিতা একই বলুক না কেনো, মনে মনে মিন করে অন্যটাই। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা দুটো ছুঁই ছুঁই হতেই চোখে নেমে এলো তার রাজ্যের ঘুম। ঘুমের সাথে যুদ্ধে নির্মম ভাবে পরাজিত হয়ে বোনের ঘরেই কাথা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে ” গুড নাইট আপুই” বলে শুয়ে পড়লো আনন্দ। আনন্দ চোখ বুজে শুতেই মুচকি হাসলো অন্বিতা। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে আবারও অগত্যাই তাকে বসতে হলো বই-পুস্তকে ডুবে থাকা কাঠের টেবিল টায়। আজ যতো পড়া নিশান্ত তাকে দিয়েছে তাতে সারারাতেও সব কমপ্লিট করতে পারবে কি না এই নিয়ে ব্যাপক সন্দিহান সে।

বই ধরে বসতেই আবারও সেই বিশ্রী এক্সিডেন্টের স্মৃতি ফুটে উঠলো অন্বিতার উত্তেজিত মস্তিষ্কে। নিজের অজান্তেই গালে ফুটে উঠলো গোলাপি আভা। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। একে তো এই ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত এক্সিডেন্ট তার ওপর নূহার লজ্জা ছুড়ে মারা পাকা পাকা কথা। সবটা কানের ভেতর বাদ্যযন্ত্রের ন্যায় আলোড়ন সৃষ্টি করছে অন্বিতার। তখন কোনোরকমে বই-খাতা উঠে দৌড়ে চলে এলেও বুকের ধুকপুকানি কমে নি তার। দৌড়ে চলে আসায় নূপুর টাও নিয়ে আসা হয় নি।
অন্বিতা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। আনমনেই হাত দিলো নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের ওপর। সাথেসাথেই কেঁপে উঠলো পুরো শরীর, লজ্জায় রাঙা হলো সে। নিশান্তের ভ্রু কুঁচকে চোখ বড়বড় করে রাখা মুখশ্রী জ্বালাতন শুরু করলো তার অসহায় হৃদপিন্ডটায়।

____________________________

সকাল ৭ টা বেজে ১২ কি ১৩ মিনিটের মাঝিমাঝি সময়। দরজা বন্ধ করে কাথা মুড়ি দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে নিশান্ত। কাল সারারাত ঠিক মতো ঘুম হয় নি তার। যার দরুন সকালে এসে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে তার দু-চোখের পাতায়।

বেঘোরে ঘুমিয়ে নিজের ভার্সিটিরই প্রফেসর হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলো, এমন সময় হঠাৎ করে কানের কাছে এক তীব্র চিনচিনে শব্দের আগমনে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে কাথা ফেলে উঠে বসলো নিশান্ত।
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে আওয়াজটার অর্থ খুঁজলো সে। অবশেষে ঘুমু ঘুমু চোখদুটো পিটপিট করে খুলে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো নিশান্ত। এই সাত সকালে কোন আহাম্মকের দল “সা রে গা রে সা রে গা.. রে গা মা গা রে গা মা…!” করে চলেছে তা মাথায় খেলছে না তার। নিশান্ত বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছালো। বিছানা থেকে নেমে সেই ধ্বনির উৎসের পানে ছুটতে নিলেই দরজটা ঠেলে দাঁতকপাটি বের করে ভেতরে প্রবেশ করলো সানি-রিভান। সাথে গুটিগুটি পায়ে মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে হেলেদুলে নিজের চুলের ছোট্ট ছোট্ট ঝুটিদুটো নাচাতে নাচাতে ভেতরে এলো নূহা। এতো সকালে সানি-রিভান কে দেখে অবাক হলো নিশান্ত। চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে সে প্রশ্ন ছুড়লো,

—- এতো সকালে তোরা?

বিনিময়ে কেলিয়ে রাখা দাঁত গুলো আরো খানিকটা কেলালো সানি। বোকাবোকা গলার স্বরে সে বললো,

—- ভাবীরে দেখবার আইছি মামা!

সানির কথার বিপরীতে ভ্রু কুঁচকালো নিশান্ত। কোনো অর্থ না বুঝতে পেরে আনমনেই “মানে?” বলে আবারও প্রশ্ন করে উঠলো সে। পাশ থেকে রিভানের জান বের করা গুঁতো খেয়ে সানি বুঝলো ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে । নিজের বোকামির দরুন নিজেকেই মনে মনে খানিক বকে নিলো সানি। প্রসঙ্গ এড়াতে রিভান বললো,

—- আরে ওর কথা ছাড় তো, মজা করছে স্রেফ। তোর খবর বল, কাল রাতে এতোবার ফোন দিলাম ধরোস নাই কেন?

কাল রাতের কথা উঠতেই নিশান্তের মনে পড়লো সেই ভয়ংকর অনাকাঙ্ক্ষিত এক্সিডেন্টের কথা। কিছু একটা ভেবে নিয়ে সে উত্তর দেবে তার আগেই মুখ খুললো নূহা,

—- আরে ভাইয়ু তো মিষ্টিপুর সাথে প্রে…..

আর কিছু বলা হয়ে উঠলো না নূহার। এটুকু বলতেই নিশান্ত হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো তার। মুখে জোড় পূর্বক হাসি ফুটিয়ে আমতাআমতা করে সে বললো,

—- আ…আ..আরে নূহা তুই কার্টুন দেখার বদলে বড়দের মাঝে কি করছিস? যা, আম্মুর কাছে যা।

ভাইয়ের আজ্ঞায় ঠোঁট উল্টালো নূহা। তার মিষ্টিপুর ঘর থেকে গানের আওয়াজ কানে আসতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো তার। ভাইয়কে ভেংচি কেটে মুখ ফুলিয়ে সে বললো,

—- থাকবো না তোমার কাছে যাও। আমি আমার মিষ্টিপুর কাছে যাবো।

বলেই আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না নূহা। নিজের ছোট্ট ছোট্ট ঝুটি দুটো লাফাতে লাফাতে এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো সে ঘর থেকে। আবারও নূহার মুখে অন্বিতার গুণগান শুনে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেললো নিশান্ত। সানি-রিভান নূহার অসম্পূর্ণ বাক্য শুনে খানিকটা আঁচ করে একসাথেই বলে উঠলো,

—- কি বলতে নিছিলো নূহা?

বিনিময়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিশান্ত। রিভান কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে আবারও বললো,

—- ওই বল, অন্বিতার লগে কি করসোস তুই?

রিভানের অন্বিতাকে নিয়ে এতোটা কিউরিসিটি দেখে রেগে গেলেও প্রকাশ করলো না নিশান্ত। দাঁতে দাঁত চেপে কড়া গলায় সে বললো,

—- ওর সামনে এক্সাম তাই একটু পড়া দেখিয়ে দিয়েছি। এতো উত্তেজনার তো কিছু নেই।

রিভান বুঝলো নিশান্ত ক্ষেপে গিয়েছে তাই আর কথা বাড়ালো না। এমন সময় তার কানে ভেসে আসতে লাগলো এক শ্রুতিমধুর গলার সংগীত, যাতে আনমনেই ডুব দিলো সে। এতোক্ষণ গান ধরার আগে বাচ্চাদের রেওয়াজ করাচ্ছিলো অন্বিতা। এভাবে বেশকিছুক্ষণ রেওয়াজ করানোর পর ছাড়া গলায় গান ধরলো সে,

—- তুমি তাই, তুমি তাই গো…
আমার পরাণ যাহা চায়…!!

তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো…
আমার পরাণ যাহা চায়……!

হারমোনিয়ামের ছন্দে অন্বিতার সুমধুর গলায় গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতে স্তব্ধ হয়ে রইলো রিভান সহ সানি-নিশান্তও। মেয়েটা এতো ভালো গায় আগে তো জানতো না সে। আর জানাবার সুযোগটাই বা হলো কখন? এই তো মাত্র দু-তিন দিনের পরিচয়। রিভান অন্বিতার গানে মুগ্ধ হয়ে বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরলো। চোখ দুটো বুজে নিয়ে আনমনেই বললো,

—- কি অসাধারণ গায় মেয়েটা। উফফ…এই গলা শুনতে তো একদিন কেনো, সারাজীবনই অপেক্ষা করতে রাজি আছি আমি।

রিভানের কথায় সঙ্গ দিয়ে সানিও অন্বিতার গান হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে লাগলো। কখনোও রবীন্দ্রসংগীত না শুনায় ঠোঁট উল্টে বললো,

—- হিন্দি গান গাইলে কি এমন ক্ষতি হতো ভাবীর? আহা কি গলা! কন্ঠেই কেমন যেনো প্রেম প্রেম ভাব!

যদিও অন্বিতার গানে মুগ্ধ হয়েছিলো নিশান্ত তবে সেই মুগ্ধতা বেশিক্ষণ রইলো না মোটেই। সানি-রিভানের করা উক্তিতে মুগ্ধতা বদলে হিংস্রতার রূপ ধারণ করলো নিশান্ত। “যে করেই হোক এই গান তাকে বন্ধ করতে হবে, হবেই হবে!” বাক্যটা নিজ মনেই প্রতিধ্বনির ন্যায় দ্যোতনা সৃষ্টি করলো তার। এক মুহূর্তও আর দাঁড়ালো না সে। রেগেমেগে দুহাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরে রওনা হলো সে এই গানের উৎসের পানে। নিশান্তকে এভাবে রেগেমেগে বাইরে যেতে দেখে সন্দেহ হলো রিভানের। সানিকে হেঁচকা টান মেরে নিশান্তের পেছন পেছন যেতে ইশারা করেই নিজেও ছুট লাগালো সে। কোনোভাবেই কোনো সিনক্রিয়েট হোক তা বিন্দুমাত্রও চায় না রিভান।

________________________

হুট করে বাসায় কোনো আগুন্তকঃ এর প্রবেশে গান ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অন্বিতা। বাচ্চারা তাদের অন্বিপুকে লক্ষ্য করে নিজেরাও দাঁড়িয়ে পড়লো যে যার স্থান থেকে। নিশান্তের হিংস্র চাহনি দেখে ভ্রু কুঁচকাতেই রিভান ও সানি হাঁপাতে এসে দাঁড়ালো তার পেছনে। ভাইকে হঠাৎ এখানে আসতে দেখে বিস্ময় ভরা চাহনি নিক্ষেপ করলো সে। জিজ্ঞাসু কন্ঠে সে তার ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—- ভাইয়ু, তুমি এখানে? তুমিও কি গান শুনতে এসেছো?

নূহার কথাটা আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার কাজ করে ফেললো অজান্তেই। নিশান্ত রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলো, কড়া গলায় উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,

—– এখানে এতো বাচ্চাকাচ্চা কেনো? এটা কি কোনো বাসা নাকি গানের স্কুল যে এভাবে সাত সকালে এতোগুলো বাচ্চাকে ডেকে এনে গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে মানুষের ঘুম হারাম করছেন?

সবার সামনে এভাবে বিশ্রী ভাবে কথা শুনানোয় রাগেশ্বরী রূপ ধারণ করলো অন্বিতা। ঘাড়ের সামনে থাকা চুলগুলো পেছনে ফেলে কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো গলায় সে বললো,

—- এসব কোন ধরণের অসভ্যতা মি. নিশান্ত! গলা ফাটিয়ে গান গাইছি মানে? দেখুন আমরা আপনাদের বাসা ভাড়া নিয়েছি তার মানে এই নয় যে আপনার কথায় উঠবস করতে হবে আমাদের।

—- ওয়েট ওয়েট! আমার জানা মতে আপনাদের শুধুই বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছে, গানের স্কুল তো ভাড়া দেওয়া হয়নি মিস অন্বিতা। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এভাবে মানুষকে নিজের বেসুরে গলায় গাওয়া গান শুনিয়ে বিরক্ত করছেন আপনি?

এভাবে বাড়ি এসে এতোগুলো মানুষের সামনে অপমান করায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো অন্বিতার। রিভান নিশান্তের লাগামহীন কথা বার্তা বন্ধ করবার জন্য তার হাত চেপে ধরে থামতে বলায় এক ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো নিশান্ত। অন্বিতা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো। আঙুল তুলে দাঁত কটমট করে বললো,

—- বেশ করেছি নিজের বেসুরে কন্ঠে গলা ফাটিয়ে ফাটিয়ে গেয়েছি। আপানার তাতে কি? আপনি তো মানুষ নন। আপনি তো রোবট! আপনার তো কোনো প্রবলেম হবার কথা নয়। কই অন্য কোনো মানুষের তো আমার গানে প্রবলেম হচ্ছে না তাহলে আপনাত এতো লাগছে কেনো? কি ভাইয়ারা আপনারা কি ডিস্টার্ব ফিল করেছেন?

অন্বিতার প্রশ্নে শুকনো ঢোক গিললো সানি-রিভান৷ অসম্মতি স্বরূপ মাথা ঝাঁকাতেই আস্বস্ত হলো অন্বিতা। আবারও সে বলতে শুরু করলো,

—- দেখুন, আপনার বন্ধুদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না তবে আপনার এতো ফাটছে কেনো? একমাত্র আপনার জন্যই তো সারারাত ঠিক মতো ঘুমোতে পারিনি আমি। এতোগুলো হোমটাস্ক কোনো মানুষ দেয়? আচ্ছা ঠিক আছে আমি তাও না ঘুমিয়ে টাস্ক গুলো কমপ্লিট করেছি। আপনার জন্য জন্ম নিয়েছে আমার সময় স্বল্পতা, যার জন্য সমিতিতে না গিয়ে বাচ্চাদেরই বাসায় ডেকেছি আমি। মানলাম গানের স্কুল ভাড়া দেন নি আপনি বাসা ভাড়া তো দিয়েছেন। যার বিনিময়ে প্রাপ্য মূল্যও তো দিবো আমরা। ফ্রি ফ্রি তো থাকতে আসি নি। যতোদিন বাসার ভাড়া দেবো ততোদিনই বাড়ির এই ফ্লাটটা আমাদের। আমাদের বাসায় কে আসবে না আসবে তার পারমিশনও কি আপনার থেকে নিতে হবে আমায়? নিজে তো দিব্যি মাঝরাতে গলা ফাটিয়ে ফাটিয়ে বই পড়ে মানুষের ঘুমের বারোটা ছেড়ে তেরোটা বাজান। কই আমরা তো কেউ কিছু বলি নি। তবে আপনার এতো গায়ে লাগছে কেনো? এতোই যখন আপনার প্রবলেম তো কানে তুলো গুঁজে দিন। ব্যাস, সিম্পল!

অন্বিতার এতোবড় ভাষণে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো সানির। রিভান বুঝলো এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে গোলাবারুদের বর্ষণ শুরু হবে নির্ঘাত। এই ভেবেই নিশান্তকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করলো রিভান। নিশান্ত রেগেমেগে রিভানের হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্য চেঁচিয়ে উঠতেই এক হাতে ঠোঁট চেপে ধরলো সানি। অনুরোধের সুরে সে বললো,

—– মামা, প্লিজ সিনক্রিয়েট করিও না, মাইয়া মানুষ তো পরে দেখা গেলো আন্টির কাছেই বকা খাইতে হইলো তোমার।

এই ফাঁকে দৌড়ে গেলো রিভান। অন্বিতার মুখপানে করুন চোখে তাকিয়ে সে বললো,

—- রাগ করিও না অন্বিতা, আসলে ওর রাতে ঘুম হয়নি তো তাই মাথার ঠিক নেই। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। বাই দ্য ওয়ে তোমার গানের গলা অসাম! সি ইউ লেটার!

বলেই আবারও বেড়িয়ে এলো রিভান। অন্বিতা রিভানকে যেতে দেখে গলা উঁচু করে বললো,

—- হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যান ওই রোবট টাকে। পারলে মানুষ বানাবার চেষ্টা করবেন। যত্তসব আজাইরা মানুষরূপী এলিয়েন!

__________________________

সন্ধ্যে ৬ টা বেজে ৪৫ মিনিট, একটু পরই আযান দিবে বিধায় বাসায় না এসে একেবারে নামায পরে আসবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো নিশান্ত। এমনিতেই আজকের এতো বিশ্রী এক্সপেরিয়েন্স তারওপর নামাযের পরপরই আবারও জল্লাদ মেয়েটার মুখ দর্শন, সব মিলিয়ে একরকম বিপাকের মধ্যে পড়ে রয়েছে নিশান্ত। নিজের এরকম বিহেভিয়ারে নিজেই বিরক্ত সে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব অনুভূতি এসে বাসা বাঁধছে তার মনের আঙিনায়। যার অর্থ বুঝবার মতো ক্ষমতা নেই তার।

নিশান্তের ভাবনার মাঝেই সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো সানি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে সে বললো,

—- কি ভাবোস এতো? তুই তো আগে এমন ছিলি না, এরকম হইছোস কিল্লায়?

নিশান্ত ভ্রু কুঁচকালো। কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বললো,

—- তোরে বলছি না আমার সামনে সিগারেট টানবি না? ভালো লাগে না আমার এসব।

সানি ঠোঁট উল্টালো। সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছাড়তে ছাড়তে সামনে তাকাতেই দেখলো ভুলে মানি ব্যাগটা দোকানের বেঞ্চেই ফেলে এসেছে সে। যা দেখে কপাল চাপড়ালো সে, জলন্ত সিগারেটটা নিশান্তের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনুনয়-বিনয় করে বললো,

—- মামা, এক সেকেন্ড সিগারেটটা একটু ধর। মানিব্যাগ ফেলে এসেছি।

বলেই ছুট লাগালো সানি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে ধরে রাখলো তার জলন্ত সিগারেটটা নিশান্ত।

শিখার কাছ থেকে ভার্সিটির নোটস সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিলো অন্বিতা। হটাৎ রাস্তার ধারে সিগারেট হাতে নিশান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেললো সে। মনে মনে শয়তানি বুদ্ধি উঁকি দিলো তার। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে আনমনেই সে বললো,

—- খুব তো গুণগান গায় আব্বু আপনার ! এখন আমিও দেখিয়ে দেবো আপনার আসল চরিত্র মি. নিশান্ত! জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। অন্বিতার সাথে লাগতে আসার ফল তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে। হবেই হবে।
.
.
.
.
চলবে…………………💕

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here