এক আকাশ ভালোবাসি পর্ব ১১+১২

#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_১১
#নিশাত_জাহান_নিশি

—-“কোথায় তুমি রূপ? দুই দিন যাবত তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না। আদনান পর্যন্ত ভার্সিটির হোস্টেলে তোমাকে খুঁজে এসেছে। কিন্তু পায় নি। ছেলেটা তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাই তো আমার এক কথাতেই তোমাকে খুঁজতে চলে গেছে রাজশাহী।”

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,,,,,

—-“মিঃ আদনান কি জার্মান থেকে ফিরেছে মামু?”

—-“দুই দিন হলো আদনান জার্মান থেকে ফিরেছে। তোমাকে পাগলের মতো খুঁজছে সে। তোমার ফুফুর বাড়ির এড্রেস আমি আদনানকে দিয়েছি। আদনান হয়তো মাঝ রাস্তায় আছে। আমি জানি তুমি মুহিতদের বাড়িতেই আছো। হোস্টেল ম্যানেজারের বিবরণ অনুযায়ী ঐ ছেলেটি মুহিত ই ছিলো। যে তোমাকে হোস্টেল থেকে তুলে এনেছে। রূপ আমি তোমাকে ভালোয় ভালোয় বলছি। তুমি আদনানের সাথে হোস্টেলে ফিরে এসো। আমি দেশে ফিরেই আদনানের সাথে তোমার বিয়ের ডেইট ফিক্সড করব।”

মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। শরীরটা কেমন ঢুলছে। এক সাথে এতো চাপ নিতে পারছি না। একসাথে কাকে কাকে সামলাবো আমি? সানায়া আপুকে নাকি মিঃ আদনানকে? নিজেকে কিছুটা শান্ত করে গলাটা ঝাঁকিয়ে মামুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,,,,

—–“মামু…..মিঃ আদনানকে ফিরে যেতে বলো। উনার এ বাড়ি আসা লাগবে না।”

—-“হোয়াট? এসব তুমি কি বলছ রূপ?”

—-“ঠিকি বলছি মামু। আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

—-“রূপ প্লিজ তুমি আমাকে ঘাটি ও না। ঐ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে আমার চেনা আছে। ওরা তোমার সাথে অমানবিক নির্যাতন করবে। একবার তো করেছ ও। এরপরে ও কেনো তুমি ঐ বাড়িতে ফিরে গেলে? কিসের টানে ফিরে গেছো বলো?”

আমি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,,,,,,

—-“মামু….. আমি মিঃ আদনানকে বিয়ে করতে পারব না। কারণ আমি অলরেডি বিবাহিত।”

মামু তেজী কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—-“তুমি কি পাগল হয়েছ রূপ? কখন থেকে পাগলের মতো বকেই যাচ্ছ।”

—-“মামু আমি সত্যি বলছি। আমি বিবাহিত। মুহিত ভাইয়া আমার হাজবেন্ড। সদ্য বিয়ে হয়েছে আমাদের।”

মামু কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলল,,,,,,

—-“তাহলে মুহিত তোমার সর্বনাশটা করেই ছাড়ল? ঐ বাড়িতেই মুহিত তোমাকে বন্দিনী করল?”

—-“মুহিত ভাইয়াকে আমি ভালোবাসি মামু। আমি খুশি মুহিত ভাইয়াকে পেয়ে। তাছাড়া মুহিত ভাইয়া যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমি খুব লাকী মুহিত ভাইয়ার মতো একজন ভালো মানুষকে জীবন সঙ্গি হিসেবে পেয়ে।”

মামু চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—-“মুহিত ভালো হলে কি হবে রূপ? মুহিতের ফ্যামিলির আদার’স মেম্বার রা একদল নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক। ওদের সাথে তুমি শান্তি মতো বাঁচতে পারবে না রূপ। ওরা যখন তখন তোমার নিশ্বাস বন্ধ করে দিবে।”

—-“আমরা এই বাড়িতে থাকব না মামু। কিছু মাস পরেই আমরা আলাদা হয়ে যাবো। মুহিত ভাইয়া এক্টা ঠিকঠাক জব পেলে এই বাড়ি ছেড়ে আমরা অনেক দূরে চলে যাবো।”

—-“হাসালে রূপ। মুহিত যে তোমাকে সম্পূর্ণটা সত্যি বলছে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। তুমি কোন ভরসায় মুহিতকে বিশ্বাস করলে?”

আমি মলিন হেসে বললাম,,,,,,

—-“মুহিত ভাইয়াকে বিশ্বাস করার জন্য আমার গ্যারান্টি লাগবে না মামু। আমি ওর চোখ দেখেই মনের কথা বুঝে নিতে পারি। লোকটার চোখে স্পষ্ট মনের কথা লিখা আছে। তুমি নিশ্চয়ই অবাক হবে বা হাসি ঠাট্টার ছলে উড়িয়ে দিবে। কিন্তু না মামু এটাই সত্যি। আমি মুহিত ভাইয়ার চোখে আমার জন্য এক আকাশ ভালোবাসা দেখি সাথে বিশ্বাসের ফুল প্যাকেজ। আমি ঠকি নি ওকে বিশ্বাস করে। বরং জিতেছি। বাকিটা আমাদের উপর ছেড়ে দাও মামু। আমি সুখে থাকব মুহিত ভাইয়াকে নিয়ে। জীবনের এই এক্টা ডিসিশান আমি খুব ভালো নিয়েছি। যার ফল আশানুরূপ হবে।”

—-“তাহলে আদনানের ড্যাডকে আমি কি জবাব দেবো?”

আমি কিছুটা কাতর কন্ঠে বললাম,,,,,,,

—-“তুমি যেভাবেই পারো ম্যানেজ করে নাও মামু। আমি জানি আমার জন্য তোমার অনেকটাই সম্মান হানি হবে। এর জন্য আ’ম সো স্যরি মামু। অন্তত তোমার এই ভাগনীর মনের দিকটা ভেবে ওদের দেওয়া কথা ফিরিয়ে নাও। আমি তোমার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব মামু। প্লিজ আর একবার আমাকে দয়া করো। তিন বছর ধরে তো করেই আসলে। আর একবার না হয় করো প্লিজ।”

—-“আমি তোমাকে কখনো দয়া করি নি রূপ। যা করেছি ভালোবেসে করেছি। মন থেকে করেছি। তোমার মাঝে আমি আমার মৃত বোনকে দেখেছি। বোনের সব ভালোবাসাটা তোমাকে দিয়েছি। আমার বোন বেঁচে থাকলে হয়তো এই সুযোগটা ও পেতাম না। আমার বোনই তোমাকে আগলে রাখত।”

মামু এক্টা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবার বলল,,,,,,,

—-“যাই হোক….. দোয়া করি রূপ। তুমি সুখে থাকো। মুহিত যেনো শেষ পর্যন্ত তোমার বিশ্বাস রাখে। তোমাকে নিরাশ না করে। আমি তোমার পাশে অলওয়েজ ছিলাম, আছি, থাকব। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে এনি টাইম পাশে পাবে। তুমি আমার মেয়ের মতো। নিজের মেয়ে থাকলে হয়তো এতোদিনে তোমার মতো অনেকটাই বড় হয়ে যেতো।”

এর মাঝেই বাড়ির ড্রইং রুমে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেলো। ফোনটা কানে রেখেই আমি ছুটলাম ড্রইং রুমের উদ্দেশ্যে। মামু এখনো লাইনেই আছে। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছি আর সদর দরজায় তাকাচ্ছি। একজন ইয়াং ছেলে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। দোলা আপু ছেলেটার সাথে কড়া কন্ঠে কথা বলছে। কেনো জানি না মন বলছে এই ছেলেটাই মিঃ আদনান। দোলা আপু চেঁচিয়ে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,,

—-“আপনি এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। সেই কখন থেকে বলছি আমরা আপনাকে চিনি না। এরপরে ও আপনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন! আজব।”

ছেলেটি নম্র স্বরে বলছে,,,,,,,,

—-“দেখুন, আমি যার সাথে দেখা করতে এসেছি তার সাথে দেখা করেই এ বাড়ি থেকে বের হবো। এর আগে না।”

—-“তা আপনি কার সাথে দেখা করতে এসেছেন শুনি?”

—-“আমি রূপসার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

আমার সন্দেহ ই ঠিক হলো। উনিই মিঃ আদনান। মামুর ঠিক করা পাএ। আমি ফোনটা কান থেকে ছাড়িয়ে হাতে নিয়ে দৌঁড়ে গেলাম সদর দরজার কাছে। দোলা আপু মিঃ আদনানকে কিছু বলতে নিলেই আমি দোলা আপুকে ক্রস করে মিঃ আদনানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,,,,,,,

—-“আমিই রূপসা। আপনি নিশ্চয়ই মিঃ আদনান।”

মিঃ আদনান আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উনার চোখ আমাতেই সীমাবদ্ধ। উনি এক প্রকার হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার এই অদ্ভুত চাহনী আমার অস্বস্তিবোধের কারণ। আমি গলাটা ঝাঁকিয়ে মিঃ আদনানকে উদ্দেশ্য করে আবারো বললাম,,,,,

—-“এই যে শুনছেন? আপনিই কি মিঃ আদনান?”

মিঃ আদনান কিছুটা নড়েচড়ে একগাল হেসে বলল,,,,,,,

—-“ইয়েস মিস রূপ। আমিই মিঃ আদনান।”

কথাটা বলেই উনি প্যান্টের পকেট থেকে এক্টা ফুটন্ত গোলাপ এনে আমার সামনে ধরে বলল,,,,,,,

—-“এটা তোমার জন্য রূপ। জানো এই ফুলটা নিতে আমার কি পরিমান ধকল সহ্য করতে হয়েছে? এটাই গোলাপের লাস্ট পিস ছিলো। এক্টা মাঝ বয়সী মেয়ের সাথে ঝগড়া করে এক প্রকার ছিনিয়ে এনেছি ফুলটা। আমাদের প্রথম দেখা। এক্টু অন্য রকম না হলে ব্যাপারটা সত্যিই জমত না। তাই হাতে করে এক্টা ফুটন্ত গোলাপ নিয়ে এলাম। শুধু তোমার জন্য।”

দোলা আপু তেড়ে এসে পেছন থেকে আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল,,,,,

—-“রূপসা এই ছেলেটা কে? এই ছেলে আমাদের বাড়িতে কি করছে?”

আমি মাথাটা নিচু করে বললাম,,,,,

—-“আপু উনি হলেন মিঃ আদনান। আমার মামুর রিলেটিভ। আমার সাথে কিছু কথা বলেই উনি চলে যাবে।”

দোলা আপু দাঁত কিড়মিড় করে আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,,

—-“নিশ্চয়ই নষ্টামি করার জন্য ছেলেটাকে এনেছিস তাই না? হাতে করে আবার গোলাপ নিয়ে এসেছে। ছেলেটার দৃষ্টি ভঙ্গি ও সুবিধার না। মুহিতের কাছে ভালো সাজা আজ বের করব। দাঁড়া।”

কথাগুলো বলেই দোলা আপু আমার হাতটা ছুড়ে মেরে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠে গেলো। আমি চোখের জল গুলো মুছে মিঃ আদনানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে বললাম,,,,,,,

—-“আ’ম স্যরি মিঃ আদনান। আমার জন্য আপনাকে এতো দূর ছুটে আসতে হলো।”

—-“এই না রূপ। তুমি আমাকে একদম স্যরি বলবে না। তোমার মুখে আমি স্যরি শুনতে চাই না। অন্য কিছু শুনতে চাই। যা শোনার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি।”

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে উঠলাম,,,,,

—-“আপনি যা শুনতে চাইছেন তা কখনো সম্ভব না মিঃ আদনান। আমি এখন অন্য কারো ওয়াইফ। আমি এই বাড়ির বউ। আমার হাজবেন্ড আছে সংসার আছে।”

মিঃ আদনান হু হা করে হেসে বলল,,,,,,

—-“নাইস জোকস রূপ। তুমি খুব ভালো মজা করতে পারো।”

আমি উনার সাথে কথা না বলে ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখলাম মামু এখনো লাইনে আছে। আমি ফোনটা কানে দিয়ে মামুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,,,,,,

—-“মামু…তুমি প্লিজ মিঃ আদনানকে সবটা বুঝিয়ে বলো। আমি উনাকে ফোনটা দিচ্ছি।”

মামু গম্ভীর কন্ঠে বলল,,,,,,

—-“দাও।”

মিঃ আদনান আমার দিকে কিছুক্ষন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ফোনটা কানে ধরল। উনি চুপ হয়ে শুধু শুনছে কিছু বলছে না। আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে উনার। কিছু ক্ষন পর পর উনি কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুঝতে পারছি বিপরীত অনুভূতি জাগান দিচ্ছে উনার। যাকে বলে তীব্র কষ্টের অনুভূতি। প্রায় দশ মিনিট পর উনি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে মলিন হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“রূপ…… যদি কোনো দিন ও মনে হয় তুমি একা, নিসঙ্গ। তবে চলে এসো আমার দ্বারে। আমার দ্বার তোমার জন্য আজীবন খোলা থাকবে। কিছু কিছু সম্পর্কের নাম হয় না, তবে এর বিশালতা হয় পৃথিবী সমান। আমাদের সম্পর্কের কোনো নাম নেই, তবে এর মান থাকবে আমার জীবন সমান।”

কথা গুলো বলার সময় মিঃ আদনানের গলাটা ধরে আসছিলো। আমার মনটা ও কেমন খারাপ হয়ে গেলো। উনি আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে মলিন হেসে আবারো বলল,,,,,,,

—-“ভালো থেকো রূপ। জীবনের ফেড়ে যদি কোথাও দেখা হয়ে যায়, তবে খানিক মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিও। আমি এতেই তুষ্ট হবো। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর সম্মান আজীবন একই রকম থাকবে। এখন যতোটা আছে।”

মিঃ আদনান আর দাঁড়ালো না। আমার থেকে মুখ ঘুড়িয়ে চোখের জল গুলো মুছে সদর দরজা পাড় হয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো। আমি উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। এক তরফা ভালোবাসা গুলো এরকমই হয়। বেশির ভাগ ক্ষেএেই সেক্রিফাইজ করতে হয়। যা সবাই পারে না। কেউ হয়তো এক বুক কষ্ট নিয়ে ও দিব্যি হেসে খেলে বেড়াতে পারে। আর কেউ ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। উনি এখন কোন পর্যায়ে আছে জানি না। তবে উনার জন্য অনেক দোয়া রইল। কারণ, উনি পরিস্থিতি বুঝে দুজন ভালোবাসার মানুষকে এক করে গেলো। কয়জন ই বা পারে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে? উনার প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো।

রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছি। এক পা, দু পা করে হাঁটছি। মুহিত ভাইয়ার সাথে কথা বলার প্রবল ইচ্ছে জেগেছে। এখনই মুহিত ভাইয়ার কন্ঠ টা আমার শুনতে হবে। রুমে ঢুকে দরজা আটকে মুহিত ভাইয়াকে কল করলাম। সাথে সাথেই উনি কলটা তুলে ফেলল। বেশ মিষ্টি কন্ঠে মুহিত ভাইয়া বলল,,,,,,,

—-“ভালোবাসি রূপ।”

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,,,,,,

—-“কল পিক করে ফার্স্টে হ্যালো বলতে হয়। ভালোবাসি না।”

—-“হুম….. এটা অবশ্যই নির্ভর করে ব্যাক্তি বিশেষের উপর। তুমি আমার ওয়াইফ। সো ফার্স্টে আমি ভালোবাসি বলেই শুরু করতে পারি।”

—-“হুম বুঝলাম। কি করছ তুমি? এখনো কি বাস স্টপে?”

—-“এই মাএ অফিসে ফিরলাম। বাস হয়তো অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে।”

—-“টেনশান হচ্ছে মারুর জন্য। মেয়েটা ঠিকঠাকভাবে বাড়ি পৌঁছালেই হয়।”

—-“চিন্তা করো না রূপ। আল্লাহ্ ভরসা।”

আমি কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম,,,,,,

—-“মুহিত ভাইয়া…… তোমার সাথে আমার কিছু ইম্পরটেন্ট কথা ছিলো।”

মুহিত ভাইয়া বেশ ব্যস্ত স্বরে বলল,,,,,

—-“হুম রূপ বলো।”

—-“মামু কল করেছিলো।”

—-“কি বলল?”

মামুর বলা প্রত্যেকটা কথা মুহিত ভাইয়াকে খুলে বললাম। মুহিত ভাইয়া কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,,,,,,

—-“আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্য করে রূপ। মামুর জন্য মন থেকে অনেক অনেক অনেক দোয়া রইল। কিছুটা সময়ের জন্য আমার শ্বাসটা থমকে যাচ্ছিলো, ভেবেছিলাম মামু হয়তো মানবে না। বাট এখন পুরোটা শুনে শান্তি লাগছে। মামুর কাছে আমি সত্যিই ঋণী থাকব।”

আই থিংক দোলা আপু এখনো মুহিত ভাইয়াকে কিছু জানায় নি। জানালে হয়তো মুহিত ভাইয়া এতোটা শান্ত থাকত না। আমার সাথে জেদ দেখাত। আমি বরং দোলা আপুর আগেই মুহিত ভাইয়াকে মিঃ আদনানের আসার ব্যাপারটা জানিয়ে দেই। এটাই ভালো হবে। এতে অশান্তি ও কমবে। গলাটা ঝাঁকিয়ে আমি কিছুটা কাতর কন্ঠে বললাম,,,,,,,

—-“মুহিত ভাইয়া…..মিঃ আদনান কিছুক্ষন আগে এই বাড়িতে এসেছিলো।”

মুহিত ভাইয়া অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,,,,,

—-“জানি রূপ”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,,,,,,,

—-“কিভাবে জানো?”

—-“দোলা আপু কল করেছিলো।”

—-“কি কি বলল?”

—-“রুচিতে বাঁধছে বলতে।”

—-“তোমার এক্টু ও সন্দেহ হয় নি?”

—-“আমার রূপ কখনো এমন কিছু করতে পারে না। যার জন্য আমি তাকে সন্দেহ করব। দোলা আপুর বলা প্রত্যেকটা কথা আমি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি।”

—-“তোমার মনে হচ্ছে না তুমি আমাকে অন্ধ বিশ্বাস করছ?”

—-“মোটে ও না। অন্ধ বিশ্বাস তো একদল বোকা শ্রেণীর লোকরা কবিরাজ বা তান্ত্রীকদের করে। আমি কোনো বোকা শ্রেণীর লোক নই আর তুমি ও কোনো কবিরাজ বা তান্ত্রীক নও। তবে অন্ধ বিশ্বাসের কথা কোত্থেকে আসছে রূপ? আমি তোমাকে মন থেকে বিশ্বাস করি। যার ক্ষমতা অন্ধ বিশ্বাসের চেয়ে ও বেশি।”

চুপ করে আছি। দিন দিন মুহিত ভাইয়ার প্রতি দারুনভাবে আকৃষ্ট হচ্ছি। লোকটা বারং বারই আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দেয়। উনার কথা গুলো শুনলেই মনটা শিথীল হয়ে যায়। উনার কথার প্রতিটা লাইনে লাইনে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই। লোকটা আমাকে দারুন ভাবে বুঝে। মৌনতা কাটিয়ে মলিন হেসে বললাম,,,,,,

—-“ভালোবাসি মুহিত ভাইয়া!”

—-“আমি ও ভালোবাসি রূপ। তবে তোমার থেকে অনেক বেশি।”

—-“বেশি হলে হবে। তবে কম যেনো না নয়।”

—-“কখনো কমবে না। উল্টে বৃদ্ধি পাবে। যতো দিন যাবে আমার ভালোবাসা ততোই বাড়বে।”

—-“কখন আসবে তুমি?”

—-“সন্ধ্যা হবে রূপ।”

—-“বিকেলে চলে এসো না মুহিত ভাইয়া। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

মুহিত ভাইয়া এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,,

—-“চেষ্টা করব রূপ।”

আমি মলিন হেসে এক নিশ্বাসে বলে উঠলাম,,,,,

—-“মজা করেছি মুহিত ভাইয়া। কাজ শেষ করেই এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।”

—-“মন থেকে বলছ তো রূপ?”

—-“হুম। রাখছি তাহলে। সন্ধ্যায় দেখা হবে।”

মুহিত ভাইয়াকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। কলটা কেটে দিলাম। মনটা বেশ বেসামাল হয়ে আছে। মুহিত ভাইয়াকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে। মনটা ও দিন দিন বেহায়া হয়ে উঠছে। কোনো বারন ই শুনছে না। হুট হাট করে মুহিত ভাইয়াকে পাশে চাইছে। লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে যাদু করেছে। সে যাদু টোনা জানে আগে জানতাম না। শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে। মাথা থেকে এক্টা চাপ সরে গেলে ও বড় এক্টা মহা চাপ রয়ে গেছে। তা হলো সানায়া আপু। উনি হলো সব চাপের মহা চাপ। কখন এসে হানা দেয় বলা যায় না।

কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। এক্টু ঘুমানোর চেষ্টা করছি। দশ মিনিট চোখ বন্ধ রাখার পর আপনা আপনি চোখে ঘুম চলে এলো। এভাবে কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুমের মধ্যেই মনে হলো কেউ আমার পুরো শরীরে পানি ঢেলে দিয়েছে। ভেজা ভেজা লাগছে নিজেকে। সাথে অসম্ভব শীত ও লাগছে। ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। জামা, কাপড় ভিজে চুপচুপ হয়ে গেছে। তার মানে সত্যি সত্যি কেউ আমার গাঁয়ে পানি ঢেলে দিয়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সানায়া আপু হাতে বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ লাল করে উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো আমার। চোয়াল শক্ত করে আমি সানায়া আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,

—-“এসবের মানে কি সানায়া আপু? তুমি আমাকে ভিজালে কেনো?”
#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_১২
#নিশাত_জাহান_নিশি

—-“এসবের মানে কি সানায়া আপু? তুমি আমাকে ভিজালে কেনো?”

সানায়া আপু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,,,,,

—-“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি রূপসা। তুই আমার সাথে গলা উঠিয়ে কথা বলছিস?

—-“আমার সাহস বরাবরই বেশি সানায়া আপু। এতো দিন আমার সব সাহস সুপ্ত অবস্থায় ছিলো। তবে এবার থেকে সাহস দেখিয়েই এই বাড়িতে থাকতে হবে। না হয় তোমাদের মতো জঘন্য মানুষ গুলোর সাথে এই বাড়িতে স্টে করা সম্ভব হবে না। তোমরা হলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্তরের মানুষ বুঝলে? যাদের মধ্যে বিন্দু মাএ দয়া মায়া নেই। তোমাদের হায়ানা বললে ও ভুল হবে।”

আমার কথা গুলো শুনে সানায়া আপু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। উনি চোখ মুখ লাল করে হাতের বালতি টা ফ্লোরে রেখে উনার ডান হাত উঠিয়ে আমার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো। চড়ের আওয়াজে আমার অন্তর আত্না কেঁপে উঠল। আমি গালে হাত দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ থেকে টলটল করে পানি পড়ছে। কানের পর্দা হয়তো অলরেডি ফেটে গেছে। গালটা ও কেমন শিরশির করছে। গালে হয়তো পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে। নাক, কান গরম হাওয়া বের হচ্ছে। কানে কেবল শো শো আওয়াজ হচ্ছে। পাঁচ মিনিট আমি থম মেরে ছিলাম। এরপর কিছুটা স্বাভাবিক হই।

সানায়া আপু বকর বকর করেই যাচ্ছে। উনার ঠোঁট জোড়া অনবরত নড়ছে। উনি কি বলছে না বলছে কিছুই আমার কানে যাচ্ছে না। এক প্রকার শো শো আওয়াজ হচ্ছে কানে। কান দুটোকে হাত দিয়ে ঝাকাচ্ছি। শোনার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। নিজের কান্নার আওয়াজ নিজেই শুনতে পারছি না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। গালটা ও খুব জ্বালা করছে। চিৎকার করে কাঁদছি আমি। ভিতরের সব কষ্ট উগড়ে দিচ্ছি। এতো পেইন এক সাথে সহ্য করতে পারছি না আমি।

বসা থেকে উঠে সানায়া আপুর মুখোমুখি দাঁড়ালাম। প্রচন্ড রাগ উঠে গেছে আমার। আর কতো নির্যাতন সহ্য করব? চুপ থাকতে থাকতে আজ এই অবস্থা। এবার হয়তো আমাকে বধীর ই করে ছাড়ল। খুব আপসোস হচ্ছে। আর হয়তো মুহিত ভাইয়ার তীব্র ভালোবাসা মাখা কথা গুলো আমার কান অব্দি পৌঁছাবে না। ওর ভালোবাসার আকুতি গুলো আমার মনকে আর নাড়াতে পারবে না। ওর মিষ্টি কন্ঠে রূপ ডাকটা ও শুনতে পারব না। তবে আর না। অনেক সহ্য করেছি। এবার থেকে শুধু প্রতিবাদ হবে। ইট ছুড়লে পাটকেল খেতেই হবে।

চোখ, মুখ লাল করে আমি ডান হাতটা উঠিয়ে সানায়া আপুর দুই গালে একের পর এক চড় মারছি আর চিল্লিয়ে বলছি,,,,,,,

—-“এই…..তোরা কি আমাকে রিলিফের মাল পেয়েছিস? যে যেভাবে পারবি সেভাবে আমাকে মারবি, বকবি, অত্যাচার করবি? আমি সব মুখ বুজে সহ্য করে নিবো? তোদের ধারণা সম্পূর্ন ভুল বুঝলি?”

কিছুটা হাঁফিয়ে আবার বললাম,,,,,,

—-“কান খুলে শুনে রাখ…… তোরা আমার উপরে আর রাজ করতে পারবি না বুঝলি? কারণ, আমি আর চুপ থাকব না। তোরা আমার গাঁয়ে যতোবার হাত তুলবি আমি ততোবারই তোদের গাঁয়ে হাত তুলব। উল্টে আমি তোদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকব। তোরা আমাকে একবার মারবি তো আমি তোদের দুইবার মারব।”

এলোপাথারী মারছি সানায়া আপুকে। ঠাস ঠাস করে চড় দিচ্ছি। মাঝে মাঝে চুল ও টানছি। কানটা আস্তে আস্তে নরমাল হচ্ছে। অস্পষ্টভাবে শুনতে পারছি সব। সানায়া আপু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাদঁছে আর চিল্লিয়ে বলছে,,,,,,

—-“রূপ ছাড় বলছি। জেঠি মা শুনতে পেলে তোকে আস্ত রাখবে না। মেরেই ফেলবে তোকে। অল্প বয়সে মরতে না চাইলে ছাড় আমাকে। প্লিজ ছাড় বলছি রূপ। আমার ব্যাথা লাগছে।”

—-“মৃত্যুকে ভয় পাই না আমি বুঝলি? মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বোকামী। আমি মোটে ও বোকা নই। ব্যাথা লাগার জন্যই তোমাকে মারছি। নাটক করার জন্য নয়।”

মোটে ও ধামছি না আমি। উরা ধুরা মেরেই যাচ্ছি। এতো দিনের জমে থাকা সব রাগ, জেদ এই ডাইনীটাকে মেরে উড়াচ্ছি। ডাইনীটার চিৎকারের আওয়াজে ফুফুমনি, সোহেলী আন্টি আর সাকিব ভাইয়া দৌঁড়ে আমার রুমে ছুটে এলো। ফুফুমনি আর সোহেলী রুমে ঢুকেই চিৎকার করে বলে উঠল,,,,,,

—-“রূপ…. কি করছিস তুই? ছাড় সানায়াকে।”

আমি ওদের দিকে একবার তাকিয়ে আবারো সানায়া আপুকে চড় মেরে যাচ্ছি। ফুফুমনি আর সোহেলী আন্টি দৌঁড়ে এসে আমাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে বলল,,,,,

—-“সানায়ার কিছু হলে আমরা তোকে ছাড়ব না রূপ। ভালোয় ভালোয় সানায়াকে ছেড়ে দে। মুহিত যদি জানতে পারে তুই সানায়াকে মেরেছিস তাহলে সে তোকে আস্ত রাখবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।”

আমি সানায়া আপুকে ছেড়ে পিছু ঘুরে ফুফুমনি আর সোহেলী আন্টিকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বললাম,,,,,,

—-“এতোক্ষনে তোমরা ছুটে এসেছ তাই না? এর আগে কোথায় ছিলে তোমরা? যখন তোমাদের মেয়ে আমার গাঁয়ে পানি ঢালছিলো, আমাকে চড় মারছিলো? কই তখন তো কেউ ছুটে আসো নি। আমাকে বাঁচাতে আসো নি। এমনকি তোমাদের মেয়েকে ও মুহিত ভাইয়ার ভয় দেখাতে আসো নি। এখন যখন দেখেছ, আমি তোমাদের মেয়েকে মারছি তখন তাড়াতাড়ি করে ছুটে এলে? মেয়েকে বাঁচানোর জন্য? আমাকে মুহিত ভাইয়ার ভয় দেখানোর জন্য। এক্টা কথা তোমরা সবাই কান খুলে শুনে রাখো। মুহিত ভাইয়া কখনো এক তরফা বিচার করবে না। উনি উভয় দিক বিবেচনা করে সঠিক ডিসিশান নিবে। আমার কথা শুনবে এমনকি তোমাদের কথা ও শুনবে। এরপর যেটা উনার ঠিক মনে হবে উনি সেটাই করবে। সো তোমরা আমাকে মুহিত ভাইয়ার ভয় দেখাতে এসো না। একদম না।”

কিছুটা হাঁফিয়ে আবার বললাম,,,,,,

—-“তোমাদের মেয়েকে নিয়ে আমার রুম থেকে এক্ষনি দফা হও। সহ্য করতে পারছি না তোমাদের। তোমরা আমার কাছে বিষস্বরূপ। যাদের দেখলেই আমার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হয়।”

ফুফুমনি আর সোহেলী আন্টি আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। উনারা পারছে না আমাকে গলা টিপে মেরে দিতে। দোলা আপুকে কোথাও দেখছি না। হয়তো লিয়েন ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেছে। সাব্বির ভাইয়া কু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভিজা অবস্থায় আমার জামা কাপড় গাঁয়ের সাথে চিপকে আছে। বেশ উপভোগ করছে উনি। মাথাটা ফট করে গরম হয়ে গেলো। এই লুচু লোকটাকে এখন ই এক্টা শাস্তি দিতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি ফুফুমনি দের ক্রস করে তেড়ে গিয়ে সাকিব ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। উনি এখনো কু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাজে ভাবে জিভ নাড়াচ্ছে। কিছুতেই দৃষ্টি সংযত করছে না। আমি চোয়াল শক্ত করে ডান হাত উঠিয়ে সাকিব ভাইয়ার গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দিলাম। উনি বেকুব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উনাকে এক ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে জোরে চিল্লিয়ে বললাম,,,,,,

—–“জানোয়ারের বা** রুম থেকে বের হ তুই। এক্টা মেয়েকে ভেজা অবস্থায় দেখতে খুব ভাল্লাগছে? মজা নিচ্ছিস? চোখ দিয়েই চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছিস? এই….. তোর না আমার মতো ছোট্ট এক্টা বোন আছে। আপন বোনকে ও কি এই একই ভাবেই দেখিস? আর কখনো আমার দিকে কু দৃষ্টিতে তাকাবি তো আমি তোর চোখ খুলে ফেলব। অনেক সহ্য করেছি তোদের। তবে আর না। সবকটাকে ধরে ধরে জুতো দিয়ে পেটাবো। তোরা কেউ সভ্য জগতের মানুষ না বুঝলি? একেকটা অমানুষ। মানুষের কোনো বৈশিষ্ট্যই তোদের মধ্যে নেই।”

ফুফুমনি, সোহেলী আন্টি আর সানায়া আপু আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ওদের চোখে, মুখে হিংস্রতার পাশাপাশি ভয় ও কাজ করছে। আমি রুমের দরজা লাগিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে বসে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না জুড়ে দিলাম। ওদের জন্য আমাকে এতোটা ভাইলেন্ট হতে হলো। অসভ্য আচরণ করতে হলো। গালাগাল ও দিতে হলো। ভদ্রতার বিপরীতে গিয়ে অভদ্র হতে হলো।

নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এমন লাঞ্চ্যনার জীবন আমার মোটে ও ভালো লাগছে না। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। পেটে সাংঘাতিক ক্ষিদে ও পেয়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল। পেটে এখনো কিছু পড়ে নি। আম্মু, আব্বুকে খুব মিস করছি। ওরা থাকলে হয়তো আমার এতো দুর্দিন আসত না। সবসময় ঢাল হয়ে আমার মাথার উপর থাকত। সুন্দর আর হাসি খুশি এক্টা পরিবার থাকত আমার। খানিক ক্ষিদে পেলেই আম্মু বুঝে যেতো। অন্য সব মায়েদের মতো আমার আম্মু ও হয়তো আমাকে লোকমা তুলে খাইয়ে দিতো। আব্বু রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমার জন্য গাঁধা গাঁধা চকলেট নিয়ে ফিরত। খুব আদরে থাকতাম আমি। তখন কেউ সাহস করত না আমার গাঁয়ে হাত তুলার।

রাতের তাঁরা হতে ইচ্ছে করছে আমার ও। ভিন দেশে চলে যেতে মন চাইছে। এতিমরা এই পৃথিবীতে বড্ড অসহায়। ওদের ছায়া দিয়ে বুকে আগলে রাখার মতো কেউ নেই। বাঁচার ইচ্ছে টা হারিয়ে ফেলছি। আর সহ্য হচ্ছে না। এই রঙ্গিন পৃথিবীতে নিজেকে নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে। এভাবে সত্যিই আর পারছি না। আঘাত পেতে পেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এক্টু পরে হয়তো দেয়ালটা ও খসে যাবে। আমার জন্য মুহিত ভাইয়া ও কষ্ট পাচ্ছে। ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে। সারা দিন রাত চাকরের মতো খাঁটতে হচ্ছে। লোকটা আমার জন্য এক্টু ও শান্তি পাচ্ছে না। ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছে। আমার উচিত তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া। পৃথিবী ত্যাগ করার সময় ঘনিয়েছে আমার। আম্মু, আব্বুর সাথে আমি ও তাঁরার দেশে পাড়ি জমাতে চাই। ওরা ও হয়তো ভালো নেই আমাকে ছাড়া। আমি মুহিত ভাইয়াকে মুক্তি দিয়ে তাঁরার শহরে হারিয়ে যেতে চাই। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তাঁরা হয়ে আমি মুহিত ভাইয়ার মনের আকাশে জ্বলব। হয়তো আমি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবো তবে মুহিত ভাইয়ার মন থেকে কখনো হারাব না। আমার এক আকাশ ভালোবাসা এতোটা ও ঠুনকো না। আমি নির্দ্বিধায় পরকালে পা বাড়াতে চাই। মুহিত ভাইয়াকে এক্টা সুস্থ, সুন্দর লাইফ উপহার দিতে চাই। মুহিত ভাইয়া এটাই ডিজার্ভ করে। আমি না হয় স্মৃতি হয়ে মুহিত ভাইয়ার মনের আনাচে কানাচে কোথাও এক্টা থেকে যাবো।

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কাবার্ড থেকে এক্টা সুতির উড়না টেনে বের করলাম। চোখের জল গুলো মুছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে টুলটা নিয়ে বেডের উপর রাখলাম। উড়নাটা হাতে নিয়ে বেডের উপর দাঁড়ালাম। পাখা বরাবর টুলটা সেট করলাম। সাবধানে টুলের উপর দাঁড়িয়ে পাখার সাথে উড়নাটা শক্ত করে বাঁধলাম। হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে আমার। কি করছি না করছি কিছুই জানি না। উড়না বাঁধা হয়ে গেছে। এবার শুধু ফাঁসি দেওয়ার পালা। বুক ভরা সাহস নিয়ে উড়নায় মাথা ঢুকিয়ে দিলাম। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। চোখ দুটো বুজে রেখেছি। মুহিত ভাইয়ার শুভ্র মুখটা বার বার চোখে ভেসে উঠছে। সাথে আম্মু, আব্বুর ও। এই পৃথিবীটা আমার না। তাই হয়তো এতো গুলো বছরে ও এই জমকালো পৃথিবী থেকে কিছুই পাওয়া হয় নি। লাঞ্চনা, গঞ্চনা আর অপমান ছাড়া। মুখের উপর আপন মানুষদের অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা সহ্য করেছি। বিনিময়ে চোখ থেকে অজস্র জল ঝড়িয়েছি। এই পৃথিবীটা যদি আমার ই হতো তাহলে আম্মু, আব্বু আমার পাশেই থাকতো। আর পাঁচটা মেয়েদের মতো আমার জীবনটা ও সুস্থ, সুন্দর আর গোছালো হতো।

আর কিছু ভাবতে পারছি না। ভিতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। যা বিশ্লেষন করার ভাষা আমার নাই। শরীরটা অসম্ভব রকম কাঁপছে। এক্টু ও শক্তি পাচ্ছি না। দাঁড়ানোর শক্তিটা ও হারিয়ে ফেলছি। মাথাটা ঘুড়ছে। এক্টা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে। মুহিত ভাইয়ার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো আমাকে তাড়া করছে। বার বার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,,,,,,,

—-“ভালোবাসি রূপ। খুব খুব খুব ভালোবাসি। তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না রূপ। আমি তোমাকে ছাড়া নিস্ব কাঙ্গাল। তুমি চলে গেলে আমি ভালো থাকতে পারব না রূপ। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবো।”

আর পারলাম না। ফটাফট উড়নার প্যাচ থেকে গলাটা বের করে নিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বুক ফাঁটা চিৎকার দিয়ে বললাম,,,,,,

—-“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না মুহিত ভাইয়া। আমি তোমার সাথেই এই স্বার্থপর পৃথিবীতে থেকে যাবো। হাজার অপমান সহ্য করে ও আমি তোমার হয়ে থেকে যাবো। কেবল মাএ মৃত্যুই আমাদের আলাদা করতে পারবে। নয়তো দ্বিতীয় কারো শক্তি নেই তোমার থেকে আমাকে আলাদা করার। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি মুহিত ভাইয়া। খুব খুব খুব ভালোবাসি। তুমি শুধু আমার। আজীবন আমারই থাকবে। আমি তোমাকে একা করে কোথাও যাবো না মুহিত ভাইয়া। কোথাও না।”

কাঁদতে কাঁদতে মাথা টা ধরে এলো। অসম্ভব পেইন হচ্ছে মাথাটায়। সাথে পুরোটা রুমটা ও ঘুরছে। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। ভেজা শরীর নিয়েই খাটের উপর ধপ করে ছিটকে পড়লাম। এভাবে কতোক্ষন সেন্সলেস ছিলাম জানি না। মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে আমার জ্ঞান ফিরল। অস্পষ্ট গলায় কেউ বলছে,,,,,,

—-“রূপ উঠো। প্লিজ আমাকে আর কষ্ট দিও না। আমি আর পারছি না। চোখ খুলে তাকাও রূপ। আমি তোমার চোখের চোখ রাখতে চাই। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেকে শান্ত করতে চাই।”

বুঝতে পারলাম মুহিত ভাইয়া এসেছে। মাথাটা এখনো ব্যাথা করছে। চোখ, মুখ খিঁচে রেখেছি। এক্টু এক্টু করে চোখ খোলার চেষ্টা করছি। পিটপিট চোখে সামনের দিকে তাকালাম। মুহিত ভাইয়ার মুখটা অস্পষ্ট ভাবে দেখছি। চোখ থেকে দু, এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে মুহিত ভাইয়ার। মুখটা কেমন নেতিয়ে গেছে। ফর্সা মুখটা কালচে হয়ে গেছে। মুহিত ভাইয়ার এই রূপটা আমার একদম ভালো লাগছে না। বুকের চিনচিনে ব্যাথাটে বেড়ে যাচ্ছে।

আমাকে চোখ খুলতে দেখে মুহিত ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। আমার ঠোঁটে ও হাসির রেখা ফুটে উঠছে। মুহিত ভাইয়া আমাকে ঝাপটে ধরে আমার বুকে মাথা রেখে বলল,,,,,,

—-“রূপ তুমি ঠিক আছো তো? কোথাও সমস্যা হচ্ছে না তো?”

আমি মুহিত ভাইয়ার মাথার হাত বুলিয়ে যেই না কিছু বলতে যাবো অমনি সানায়া আপুর ন্যাকা কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসল। পাশে তাকিয়ে দেখি সানায়া আপু, ফুফুমনি আর সোহেলী আন্টি দাঁড়িয়ে আছে। সানায়া আপু নাকের জল চোখের জল এক করে কাঁদছে আর বলছে,,,,,,,

—–“মুহিত….. তোমাকে এর উপযুক্ত বিচার করতেই হবে। এই মেয়েটা আমাকে ইচ্ছে মতো মেরেছে এমনকি আমার সাকিব ভাইয়াকে ও মেরেছে। শুধু তা না আমাকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেলেছে। আমি তোমার কাজিন হই মুহিত। তুমি চাইলে কিছুদিন পরে আমাদের বিয়ে ও হবে। তোমার উড বি ওয়াইফের গাঁয়ে হাত তুলেছে এই মেয়ে। এরপরে ও তুমি চুপ থাকবে মুহিত? এখনো কি এই মেয়েটার পক্ষই নিবে?”

মুহিত ভাইয়া আমার বুক থেকে মাথা তুলে সানায়া আপুর মুখোমুখি দাঁড়িযে বলল,,,,,,,

—-“হুম। আমি আজ ও রূপের পক্ষই নিবো সানায়া। কেনো জানো? কারণ রূপকে আমি খুব ভালো করে চিনি। এমনকি তোমাকে ও ভালো করে চিনি। রূপ আপনা আপনি তোমাদের মারতে যায় নি। নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো কারণ আছে। সাকিব ভাইয়ার চরিএ সম্পর্কে আমার বেশ ভালো জানা আছে। আর তোমার স্বভাব সম্পর্কে ও জানা আছে। সব মিলিয়ে রূপ যা করেছে একদম ঠিক করেছে। আমি খুশি রূপের কাজে।”

সানায়া আপু দাঁত কিড়মিড় করে মুহিত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—-“এই মেয়টার উপর তোমার এতো বিশ্বাস কোত্থেকে আসে মুহিত? কি হয় এই মেয়েটা তোমার?”

—-“এই মেয়েটা আমার ওয়াইফ সানায়া। আইনি নিয়ম অনুযায়ী আমি রূপকে বিয়ে করেছি। তাই ওর প্রতি আমার বিশ্বাসটা অনেক। তার চেয়ে বড় কথা হলো….আমি রূপকে ভালোবাসি।”

সানায়া আপুর চোখ থেকে টলটল করে পানি পড়ছে। ফুফুমনি আর সোহেলী আন্টি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা সবাই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সানায়া আপু কিছুক্ষন চুপ থেকে আচমকাই আমার কাছে তেঁড়ে এসে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,

—–“হাতিয়ে নিয়েছিস আমার মুহিতকে না? ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের করে নিলি? বল কি দেখিয়ে আমার মুহিতকে তুই হাতিয়েছিস বল?”

কথা গুলো বলেই সানায়া আপু ডান হাতটা তুলে যেই না আমার গালে ঠাস করে চড় বসাতে যাবে অমনি মুহিত ভাইয়া সানায়া আপুর হাতটা ধরে জোরে মোচড় দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,,,,,

—-“হাতটা সংযত রাখো সানায়া। নয়তো হাতটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আমার রূপের গাঁয়ে হাত তোলার আগে একশ বার ভাববে। ওর গাঁয়ে যদি একটা ও আঁচ লাগে তো আমি তোমাদের নেক্সট টাইম ছেড়ে কথা বলব না। হাতটা গুড়িয়ে দিতে বাধ্য হবো। ওয়ার্ন করলাম তোমাদের।”

সানায়া আপু ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠছে আর মৃদ্যু চিৎকার করছে। হাতে হয়তো ব্যাথা পাচ্ছে। ফুফুমনি আমার দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সোহেলী আন্টি কাতর কন্ঠে মুহিত ভাইয়ার হাত ধরে বলছে,,,,,,

—-“মুহিত ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে। আমরা আর কখনো রূপের পিছনে লাগব না। আমার মেয়েটা ব্যাথা পাচ্ছে। প্লিজ মুহিত ছাড়ো।”

মুহিত ভাইয়া সানায়া আপুর হাতটা ছেড়ে ফুফুমনির দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে উঠল,,,,,,

—-“আম্মু…..আমি আর রূপ আগামী মাসেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। মাস তো প্রায় শেষের দিকে। আমার বউ তোমাদের বাড়িতে সেইফ না। তাই বাধ্য হচ্ছি।”

#চলবে,,,,,,,,,,
#চলবে,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here