এক আকাশ ভালোবাসি পর্ব ৯+১০

#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

পরের দিন,,,,,

সকাল সাতটা। আজ আমি মুহিত ভাইয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। আমাকে ঝাপটে ধরে ঘুমুচ্ছে মুহিত ভাইয়া। ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে আমি মুচকি হেসে তাকিয়ে আছি। ভাল্লাগছে বেশ। গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো এক প্রকার টানতে ইচ্ছে করছে আমার। দাঁড়ি গুলোতে হাত রাখলেই কেমন এক্টা শুরশুরি লাগে। গাঁ টা শিহরে উঠে। অনেক খানি আরাম ও লাগে। ইচ্ছে টা এক্টু এক্টু করে প্রবল হয়ে উঠছে। না নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারছি না। বাঁকা হেসে মুহিত ভাইয়ার দাঁড়ি গুলোতে হাত বুলাচ্ছি। আরাম লাগছে খুব। হাসি ও পাচ্ছে। মুখ চেঁপে হাসছি আমি। অট্ট হাসি দিলে মুহিত ভাইয়া ফটাফট ঘুম থেকে উঠে যাবে। হয়ে যাবে আরেক কেলেঙ্কারি।

মুহিত ভাইয়া হালকা নড়চড়ে উঠছে। হয়তো বিরক্ত বোধ করছে। নয়তো ঘুম ফুরিয়ে এসেছে। ধরা খাওয়ার ভয়ে আমি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে মুহিত ভাইয়ার দাঁড়ি থেকে হাত সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে যেই না পালাতে যাবো অমনি মুহিত ভাইয়া পিছন থেকে আমার বাঁ হাত টেনে ধরল। আমি মুহিত খাইয়ার বিপরীত পাশে মুখ ঘুড়িয়ে বুকে হাত রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে এক নাগাড়ে হাফাচ্ছি। মন বলছে মুহিত ভাইয়া খুব রেগে গেছে। হয়তো আমার জন্য কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে। মুহিত ভাইয়া আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ঢুলুঢুলু কন্ঠে বলল,,,,,,

—–“আমার শান্তির ঘুমটা ভেঙ্গে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,,,,,,,

—-“স্যস্যস্যরি মুহিত ভাইয়া। আমি বুঝতে পারি নি তোমার ঘুমটা এভাবে ভেঙ্গে যাবে। আর কক্ষনো এমন করব না। প্লিজ এবারের মতো আমায় ছেড়ে দাও।”

মুহিত ভাইয়া আমাকে হেচকা টান দিয়ে বেডের উপর শুইয়ে দিয়ে সোজা আমার গাঁয়ের উপর উঠে পড়ল। আমি পিটপিট চোখে মুহিত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। মুহিত ভাইয়া আমার সামনের চুল গুলো কানের পিছনে গুজে দিচ্ছে আর ঘোর লাগা কন্ঠে বলছে,,,,,,,,

—-“আজ সকালটা আসলেই খুব মিষ্টি। এমনটা যদি প্রতিদিন হতো তবে খুব ভালো হতো। প্রতিটা সকালেই আমি তোমার সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে পারতাম। তোমার চুলের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে আমার প্রতিটা আঙ্গুলের বিচরন হতো। তোমার ভয়ার্ত মুখ, মিষ্টি হাসি, আলুথালু কয়েকটা কথার সমাহারে আমার প্রতিটা সকাল স্বার্থক হতো। কিন্তু আপসোস….. এমনটা প্রতিদিন হবে না। জীবিকার টানে প্রতিটা সকাল ফিকে হয়ে যাবে।”

আমি মলিন হেসে মুহিত ভাইয়ার গালে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বললাম,,,,,,

—-“আমি যদি বলি এরপর থেকে প্রতিটা সকাল খুব মিষ্টি হবে তাহলে কি তুমি খুব অবাক হবে?”

—-“কিছুটা অবাক হবো। তবে অপেক্ষা করব। কিছু মাস পরেই আমাদের প্রতিটা সকাল মিষ্টি হবে।”

আমি মুচকি হেসে মুহিত ভাইয়ার গাল টেনে বললাম,,,,,

—-“হুম হয়েছে এবার ছাড়ো। ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে।”

মুহূর্তেই মুহিত ভাইয়া চোখ জোড়া লাল করে বলল,,,,,

—-“মার খাবে তুমি বুঝলে? কাল রাতে বলেছিলাম না রান্না ঘরের ধাঁরে কাছে না ঘেঁষতে।”

—-“আরে আমি সবার জন্য থোরাই না নাস্তা বানাতে যাবো। আমি জাস্ট তোমার জন্য নাস্তা বানাতে যাবো। তুমি নাস্তা করে এরপর অফিস যাবে। আমি থাকতে তোমাকে খালি মুখে বাড়ি থেকে বের হতে দিবো না। বুঝেছ?”

—-“নো ম্যাম বুঝি নি। আর বুঝতে ও চাই না। তুমি রান্না ঘরে যাবে না মানে যাবে না ব্যাস শেষ।”

—-“তুমি না খেয়ে গেলে আমার ভীষন খারাপ লাগবে মুহিত ভাইয়া। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো।”

—-“আমি অফিসে গিয়ে ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিবো রূপসা। তোমাকে খামোখা কষ্ট করতে হবে না।”

—-“তুমি আমাকে ছাড়বে কিনা বলো?”

মুহিত ভাইয়া আমাকে আরো জোরে ঝাপটে ধরে বলল,,,,,,

—-“না ছাড়ব না। শত জনমের জন্য ধরেছি তোমায়। এতো সহজে থোরাই না ছাড়ব।”

—-“ইসসস বিরক্ত লাগছে খুব। ছাড়ো আমায়। অন্তত এক কাপ হট কফি তো করে দেই। এই হাঁটু কাঁপানো শীতে হট কফি টা খেলে তোমার শরীর টা খানিক হলে ও গরম হবে।”

—-“রূপ….আজ অফিস থেকে ফেরার সময় তোমার জন্য এক্টা ব্ল্যাক রং এর লেডিস জ্যাকেট আনব। যা শীত। জ্যাকেট ছাড়া পোষাবেই না।”

—-“তুমি কথা ঘুড়ানোর চেষ্টা করছ তাই না মুহিত ভাইয়া? আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি।”

মুহিত ভাইয়া হু হা করে হেসে বলল,,,,,,

—-“রূপ….. তুমি বরাবরই আমাকে বেশি বুঝো। আমি জানতাম তুমি আমার চালাকী ধরে ফেলবে।”

—-“জেনেই যেহেতু গেছো তো ছাড়ো এবার। কফিটা করে আনি। তোমার তো আবার অফিসের লেইট হয়ে যাবে।”

—-“এক্টা শর্তেই ছাড়ব।”

আমি এক ভ্রু উঁচু করে বললাম,,,,,

—–“কি শর্ত?”

মুহিত ভাইয়া আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,,,,,,

—-“অনেক গুলা মিষ্টি চাই আমার। যখন আমার তৃপ্তি মিটবে তখনই ছাড়ব।”

আমি চোখ, মুখ লাল করে বললাম,,,,,,

—–“না হবে না। খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছ তুমি। আমাকে বেশি চটাবে না। না হয় কাল থেকে ঠোঁটে চিরতার রস ঘঁষে রাখব। মিষ্টির বদলে তেতো খাবে। বুঝলে?”

মুহিত ভাইয়া হু হা করে হেসে আমাকে ছেড়ে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—-“রূপ…. তোমার তুলনা হয় না। তুমি জাস্ট অতুলনীয়। যতো সব শয়তানী বুদ্ধি কেবল তোমার মাথাই ঘুড়ে।”

আমি ছাড়া পেয়ে বেড ছেড়ে উঠে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ওয়াশ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে চেঁচিয়ে বললাম,,,,,,

—-“শুধু যে আমার মাথাই শয়তানী বুদ্ধি খেলে এমন না মুহিত ভাইয়া। তোমার মাথায় ও কিন্তু শয়তানী বুদ্ধি ঘুরে।”

দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমের খিল লাগিয়ে দিলাম। মুহিত ভাইয়ার হাসির আওয়াজ ওয়াশরুম থেকে পাচ্ছি। গিজার অন করে ফ্রেশ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে রুমে ঢুকলাম। সামনে মুহিত ভাইয়া এক্টা লাল রং এর শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শালটা দেখেই চিনে ফেললাম। একবার শীতে মুহিত ভাইয়া আমাকে এই শালটা গিফট করেছিলো। আমি শালটা মুহিত ভাইয়ার কাছেই রেখে গিয়েছিলাম। আজকের দিনে শালটা খুব কাজে লাগল।

মুহিত ভাইয়া আমার গাঁয়ে শালটা সুন্দর করে পেঁচিয়ে দিলো। মুহিত ভাইয়া খালি গাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি আজব ওর শরীরের এক্টা লোম ও খাঁড়া হচ্ছে না। তাহলে কি ওর শীত লাগছে না? মানে এটা কিভাবে সম্ভব? যেখানে আমি ফ্রিজ হয়ে যাচ্ছি সেখানে সে টোটালী স্ট্রং হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ তুলে মুহিত ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,

—-‘তোমার শীত করছে না মুহিত ভাইয়া? কিভাবে পারছ এই শীতের মধ্যে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে? অন্তত এক্টা শার্ট হলে ও পড়ো।”

—-“আমি আসলেই বুঝি না, তুমি পাশে থাকলে আমার শীত লাগে না কেনো? আমি নিজেই নিজের প্রতি আশ্চর্যিত। বিলিভ মি রূপ আমার এক্টু ও ঠান্ডা লাগছে না। আমার মোটেও মনে হচ্ছে না এই মুহূর্তে আমার গাঁয়ে কিছু জড়ানো উচিত। রূপ…. তুমি কি জানো আমার এমন ফিল হওয়ার কারণটা কি?”

আমি বেকুব হয়ে তাকিয়ে আছি মুহিত ভাইয়ার দিকে। সে প্রহসন করছেন নাকি সত্যি সত্যি এমনটা ফিল করছেন আই ডোন্ট নো। কথা বাড়াতে চাইছি না। ঘড়িতে অলরেডি আটটা বেজে গেছে। আর এক্টু দেরি করলেই মুহিত ভাইয়াকে খালি মুখে বের হতে হবে। আমি কখনোই চাইব না আমার এক্টু খামখেয়ালীর জন্য মুহিত ভাইয়া খালি মুখে বাড়ি থেকে বের হোক। মুহিত ভাইয়ার পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে সোজা কিচেন রুমে চলে গেলাম। পুরো বাড়ি নীরব। সবাই ঘুমুচ্ছে। শীতের প্রকোপ ভয়াবহ বলে কেউ কম্বলের নিচ থেকে উঠার সাহস পাচ্ছে না। সবাই আরামচে ঘুমাচ্ছে। চোখ জোড়া আচমকাই ছলছল হয়ে উঠল। মুহিত ভাইয়ার জন্য মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। এই হাঁটু কাপানো শীতে ও উনাকে এতো সকালে উঠে অফিস যেতে হচ্ছে। যেখানে বাড়ির অন্যরা এখনো রুম থেকেই বের হচ্ছে না। একই বাড়িতে থেকে ও ওদের পথ ভিন্ন। এই বাড়ির ছেলে হয়ে ও উনাকে এতোটা সাফার করতে হচ্ছে। এর কারনটা আমি জানতে চাই। মুহিত ভাইয়া কেনো মৃন্ময় ভাইয়ার মতো লাইফ লিড করতে পারছে না? আসল বাঁধাটা কি? সবটাই আমার জানতে হবে।

কফি বসিয়ে দিয়েছি গ্যাসে। পাশাপাশি পাউরুটিতে জেলি মাখছি ছুরি দিয়ে। কফিটা হয়ে গেলেই মুহিত ভাইয়াকে গরম গরম কফিটা আর জেলি মাখানো পাউরুটি গুলো দিয়ে আসব। প্রায় দশ মিনিট পর কফি করা হয়ে গেলো। এক্টা ডিশে কফির কাপটা আর জেলি মাখানো পাউরুটি গুলো নিলাম। সোজা হাঁটা ধরলাম মুহিত ভাইয়ার রুমে। রুমের দরজাটা খুলে ডেস্কের উপর ডিশটা রেখে যেই না পিছু ঘুরলাম অমনি আমার মুখটা আপনা আপনি হা হয়ে গেলো। মুহিত ভাইয়া এই শীতে শাওয়ার নিয়েছে। তা ও আবার এই সাত সকালে। শরীর থেকে উনার টপটপ করে পানি পড়ছে। চুল থেকে ও পানি ঝড়ছে। চান্দুর এতক্ষনে শীত লেগেছে। থরথরিয়ে কাঁপছে। আমি তাড়াহুড়ো করে বারান্দার দঁড়ি থেকে টাওয়াল এনে মুহিত ভাইয়ার চুল মুছে দিচ্ছি আর বকবক করে বলছি,,,,,,

—-“কি দরকার ছিলো এতো সাত সকালে শাওয়ার নেওয়ার হুম? তাছাড়া আজ তো প্রচন্ড শীত পড়ছে।”

মুহিত ভাইয়া কাঁপাকাঁপির জন্য কথা বলতে পারছে না। দাঁতে দাঁতে ধর্ষণ হচ্ছে। আমি ওর শরীরটা মুছে দিয়ে আমার গাঁয়ের শালটা দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার শরীরের তাপটা ওর গাঁয়ে লাগছে। আর ওর শরীরে ঠান্ডাটা আমার শরীরে লাগছে। মুহিত ভাইয়া আমাকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। আমি শালটা আরো বেশি করে মুহিত ভাইয়ার শরীরে প্রশস্ত করে দিলাম। প্রায় পাঁচ মিনিট পর মুহিত ভাইয়া শান্ত হলো। কাঁপাকাঁপিটা অনেকাংশে কমে যায়। মুহিত ভাইয়া আমাকে বুকের মাঝে চেঁপে ধরে বলল,,,,,,

—-“থ্যাংকস রূপ। সত্যিই শীতে জমে যাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে ঝাপটে না ধরলে ডিরেক্ট ফ্রিজ হয়ে যেতাম।”

—-“থ্যাংকস দিতে হবে না মুহিত ভাইয়া। তোমার সাথে কি আমার থ্যাংকস এর সম্পর্ক?”

—-“ওকে মিসেস রূপ। আমার ভুল হয়ে গেছে। নেক্সট টাইম আর এই ভুল গুলো হবে না।”

মুহিত ভাইয়া আমাকে ছেড়ে কাবার্ড থেকে ব্ল্যাক কালার শার্ট, প্যান্ট বের করে চেইন্জ্ঞ করে নিচ্ছে। আমি বেড গুছাচ্ছি। মুহিত ভাইয়া সম্পূর্ণ রেডি হয়ে আমার হাত ধরে বেডের উপর বসল। আমি কফিটা এক্টা পেয়ালা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। তাই অনেকক্ষন হওয়ার পরে ও কফিটা গরম আছে। মুহিত ভাইয়ার সামনে কফির কাপটা ধরলাম। মুহিত ভাইয়া ঘড়ির ফিতে বাঁধছে আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,

—-“রূপ….তুমি আগে এক চুমুক খাও। এরপর আমি খাবো।”

—-“আমি এখন কিছুই খাবো না মুহিত ভাইয়া। সবাই উঠলে একেবারে ব্রেকফাস্ট করব।”

—-“খেতে বলছি খাও। এতো এক্সকিউজ দেখি ও না।”

মুখটা বাঁকা করে কিছুটা বাধ্য হয়ে এক চুমুক কফি খেয়ে নিলাম। মুহিত ভাইয়া মুচকি হেসে আমার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে আমি যেই জায়গাটায় চুমুক দিয়েছি ঠিক সেই জায়গাটায় চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—-“আহা কি টেস্ট। তোমার ঠোঁট গুলো যেমন টেস্টি তেমন কফিটা ও দারুন টেস্টি।”

এতক্ষনে বুঝলাম সে কেনো আমাকে কফির কাপে চুমুক দিতে বলেছিলো। সেয়ানা এক্টা। পর পর কয়েকটা চুমুক দিয়ে মুহিত ভাইয়া কফিটা শেষ করে বসা থেকে উঠতে নিলেই আমি মুহিত ভাইয়ার হাত টেনে মুহিত ভাইয়াকে বেডের উপর বসিয়ে দিলাম। পাউরুটির এক্টা পিস হাতে নিয়ে মুহিত ভাইয়ার মুখের কাছে ধরে বললাম,,,,,,

—-“অন্তত এক্টা পিস হলে ও খেয়ে যাও মুহিত ভাইয়া। না হয় আমি শান্তি পাবো না। প্লিজ না করো না।”

মুহিত ভাইয়া আমার আকুতি ফেরাতে পারে নি। পাউরুটিতে বাইট দিয়ে এক্টু এক্টু করে সম্পূূণ পাউরুটি টা খেয়ে নিলো। সামন্য এক্টু জেলি লেগে আছে মুহিত ভাইয়ার থুতনীর কাছে। আমি মুচকি হেসে হাত দিয়ে জেলিটা মুছে দিলাম। মুহিত ভাইয়া আমার কপালে চুমো খেয়ে আলমারি থেকে ল্যাপটপটা বের করে বেশ হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—-“রূপ আমি আসছি। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরব। যেভাবে বলে গেছি ঠিক সেভাব চলবে। রান্না ঘরের ধারে কাছে ও ঘেঁষবে না। ঠিক টাইমে ব্রেকফাস্ট এন্ড লাঞ্চ করে নিবে। ওকে?”

কথাগুলো বলেই মুহিত ভাইয়া রুম থেকে বের হয়ে সোজা নিচে নেমে গেলো। আমি রুমের দরজা থেকে দাঁড়িয়ে মুহিত ভাইয়ার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। সদর দরজায় পা রেখে মুহিত ভাইয়া পিছু ফিরে আমার দিকে তাকালো। খানিক মলিন হেসে মুহিত ভাইয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আমি এক্টা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে গেস্ট রুমে চলে গেলাম। রুমের দরজাটা ভেজানো ছিলো। মারু বেশ আরামসে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি রুমের জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা খুলতে গিয়ে ও থেমে গেলাম। বাইরে বরফ পড়ার মতো শীত পড়ছে। কুয়াশায় ঢেকে আছে পুরোটা বাড়ি। এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হওয়া মানে জমে বরফ হয়ে যাওয়া। শরীর খারাপ হওয়ার ও পার্সেন্টেজ খুব বেশি। চোখ থেকে দু এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মুহিত ভাইয়ার কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। কেবলমাএ আমার সুখের কথা ভেবেই মুহিত ভাইয়াকে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। লোকটা আমার চোখে মহান। ভালোবাসার চেয়ে ও বেশি সম্মান বেশি লোকটাকে।

চোখের জল গুলো মুছে মারুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে সোজা চলে গেলাম কিচেন রুমে। ব্রেকফাস্ট বানাতে। একা একা ভালো লাগছে না। এখন হাজার চেষ্টা করলে ঘুম ও আসবে না। তাই ভাবলাম এক্টু কাজ করি। শরীর, মন দুটোই ভালো লাগবে। ব্যাস আর কী! পরোটা বানাতে লেগে পড়লাম। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমার পরোটা বেলা শেষ হলো। এবার সেকার পালা। এর মাঝেই বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। মারু জাগার আগেই আমি তাড়াতাড়ি করে পরোটা গুলো সেকে ডাইনিং টেবিলে সার্ভ করে দিলাম। ফুফুমনি, দোলা আপু, সোহেলী আন্টি, সাকিব ভাইয়া, রেজাউল আংকেল সবাই বেশ খুশি। ওরা সবাই অলরেডি খেতে বসে গেছে। মৃন্ময় ভাইয়া হয়তো ফ্রেশ হচ্ছে তাই এখনো আসে নি। আর মারুর বাচ্চা নিশচয়ই ঘুমুচ্ছে। যাই ওকে ডেকে আনি। মারুকে ডাকার জন্য যেই না সামনের দিকে কদম বাড়ালাম অমনি ফুফুমনি হেসে হেসে বেশ আহ্লাদি কন্ঠে বলল,,,,,,,

—-“আমাদের রূপসার কোনো তুলনাই হয় না। মুহিত বারণ করার পরে ও সে আমাদের কথা ভেবেছে। আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে। খুব ভাল্লাগছে রে রূপসা। আসলেই তোর মতো মেয়ে ই হয় না।”

বাকিরা ও মৃদ্যু হাসছে। আমাকে খাঁটাতে পারলে ওদের খুব শান্তি লাগে। এক অদ্ভুত মানুষ ওরা। আই হোপ ওরা মানুষদের সিলেবাসে আদৌ পড়ে না। যাই হোক আমি উনাদের দিকে তাকিয়ে এক্টা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলাম। মারুর কম্বল ধরে টানছি। মেয়েটা বেশ বিরক্ত হচ্ছে এরপরে ও ঘুম থেকে উঠছে না। মাথায় এক্টা শয়তানী বুদ্ধি ঘুরপাক খাচ্ছে। দেরি না করে মারুর কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,,,,,,

—-“এই মারু তাড়াতাড়ি উঠ। মৃন্ময় ভাইয়া অফিসে চলে যাচ্ছে। শেষ দেখা ও কি দেখবি না?”

মারু এবার ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-“সত্যি বলছিস? মৃন্ময় অফিসে চলে যাচ্ছে?”

—-“হুম। তাড়াতাড়ি উঠ। আর এক্টু দেরি করলেই চলে যাবে।”

মারু কিসের উপরে বেড ছেড়ে উঠে ল্যাকেজ থেকে ডার্ক ব্লু কালারের চুড়িদার বের করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। আমি এ মেয়ের কান্ড দেখে খিল খিল করে হাসছি। প্রায় পনেরো মিনিট পর মারু ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রীম মেখে, চোখে হালকা করে কাজল দিয়ে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক পড়ে আমার দিকে ঘুড়ে বলল,,,,,,

—-“কেমন লাগছে আমায় তাড়াতাড়ি বল। এক্ষনি মৃন্ময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আজ আমাকে দেখে ওর মনে ঘন্টা বাজতেই হবে।”

আমি নখ কামড়ে মারুর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললাম,,,,,,

—-“কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না আপাতত। বাট দারুন সুন্দর লাগছে তোকে। মৃন্ময় ভাইয়াকে কাত করার জন্য যথেষ্ট।”

মারু বাঁকা হেসে আমার গাল টেনে বলল,,,,,

—-“এজন্যই তোকে এতো ভালোবাসি। সবসময় সত্যি বলিস তো তাই।”

মারু আর দেরি করল না। নাচতে নাচতে রুমে থেকে বের হয়ে সোজা মৃন্ময়ের রুমে চলে গেলো। রূপসা হি হি করে হেসে ওদের বেড গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মৃন্ময়ের রুমে ঢুকে মারু পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে মৃন্ময়কে ড্রেসিং,টেবিলের সামনে দেখল। মৃন্ময়কে দেখার সাথে সাথেই মারু চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলল। কজ আজ মৃন্ময় ও ডার্ক ব্লু রং এর শার্ট পড়েছে। মারু দৌঁড়ে গিয়ে মৃন্ময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক নিশ্বাসে বলে উঠল,,,,,,

—–“দেখি দেখি দেখি আপনাকে একটু ভালো করে দেখি। আমার সাথে ম্যাচ করে শার্ট পড়েছেন দেখছি। আচ্ছা আপনি কি আগে থেকেই জানতেন আজ আমি ডার্ক ব্লু রং এর চুড়িদার পড়ব?”

মৃন্ময় মারুর দিকে তাকিয়ে মারুর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চেইক করে বলল,,,,,,

—–“এই তুমি আমার ফেভারিট কালারের জামা পড়েছ কেনো? নিশ্চয়ই তুমি ইচ্ছে করে এমনটা করেছ। আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য।”

মারু কোমড়ে দু হাত গুজে বাঁকা হেসে মৃন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-“কিভাবে বুঝলেন? তার মানে আপনি ইমপ্রেস হয়েছেন। বলুন বলুন বলুন।”

#চলবে,,,,,,,,,,
এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_১০
#নিশাত_জাহান_নিশি

—-“কিভাবে বুঝলেন? তার মানে আপনি ইমপ্রেস হয়েছেন। বলুন বলুন বলুন।”

মৃন্ময় কিছুটা থতমত খেয়ে বলল,,,,,,

—-“ইমপ্রেস না ছাই। বয়ে গেছে আমার। তোমার মতো এক্টা সাইকো মেয়ের উপর ইমপ্রেসড হতে।”

মারু চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,,,,,

—-“কি বললেন আপনি? আমি সাইকো?”

মৃন্ময় মারুর কাছাকাছি এসে নাকের ডগায় তুড়ি মেরে বলল,,,,,

—-“আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুমি সাইকো।”

মারু তেড়ে এসে মৃন্ময়ের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,,,,,,

—-“এক্ষনি প্রমাণ দেখাবেন। না হয় খবর আছে।”

মৃন্ময় কিছুক্ষন মারুর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকাই হু হা করে হেসে বলল,,,,,

—-“প্লিজ তুমি আমার রুম থেকে বের হও। তোমার বাচ্চা বাচ্চা স্বভাব আমার এমন উদ্ভট হাসির কারন। আমি আর হাসতে চাইছি না। প্লিজ বের হও।”

মারু মুখটা ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

—–“আপনি খুবই বাজে এক্টা লোক মৃন্ময়। সবসময় আমাকে এভয়েড করেন। এতোটা এভয়েডনেস আমার একদম সহ্য হয় না।”

মৃন্ময় কিছুটা সিরিয়াস হয়ে কপাল কুঁচকে মারুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-“বুঝলাম না। আমার এভয়েডনসে তোমার কি আসে যায়? আমার থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়ার আশা কেনো করো তুমি?”

মারু মাথাটা নিঁচু করে কাঠ কাঠ গলায় বলল,,,,,

—-“কজ………….. আমি আপনাকে ভালোবাসি মৃন্ময়!”

মৃন্ময় কিছুক্ষন মারুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-“হোয়াট? তোমার সাথে আমার পরিচয় জাস্ট দুই দিনের। দুই দিনের পরিচয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে পারে বলে তো আমার মনে হয় না। এজন্যই এক্টু আগে বলেছিলাম তুমি সাইকো।”

মারু মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,,,,,

—-“আপনার সাথে পরিচয়টা আমার জাস্ট দুই দিনের না। তিন বছর তো হবেই। রূপসার ফোনে আমি আপনার ফটো দেখেছি। সেখান থেকেই আপনাকে ভালো লাগা। এরপর ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকে এই অব্দি আপানার কাছে ছুটে আসা।”

মৃন্ময় মারুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বেডের উপর থেকে ল্যাপটপ টা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে সোজা ড্রইং রুমে চলে গেলো। মারু মৃন্ময়ের যাওয়ার পথে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মুখটা কালো করে রুম থেকে বের হয়ে সোজা গেস্ট রুমে চলে গেলো। মৃন্ময় ডাইনিং টেবিলে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর মারুর কথা গুলো ভাবছে। আচমকাই মৃন্ময় চাঁপা হাসি দিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,,,,,

—–“মেয়েটা সত্যিই খুব সাহসী। আমার রাগী রূপ দেখে ও গড়গড় করে মনের কথাটা বলে দিলো। ভালোবাসে বলেই হয়তো এতোটা সাহস রাখে বুকে। যাই হোক, প্রপোজালটা কিন্তু মন্দ না। তবে এক্টা প্রবলেম আছে। মেয়েটা এক্টু সাইকো টাইপ। কেবল বকর বকর করে। এতোটা বকর বকর আমার পছন্দ না। আমার তো বিশ্বাস ই হচ্ছে না এই মেয়ে আমাকে তিন বছর আগে থেকে চিনে। অবশ্য মেয়েটা মিথ্যে বলে নি। ওর চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। আমার ফেভারিট কালারটাতে ওকে জাস্ট দারুন লাগছিলো। আমি তো চোখ ফেরাতেই পারছিলাম না।”

মৃন্ময় এসব ভাবছে আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মৃন্ময় গেস্ট রুমের দিকে উঁকি চুকি মারছে। মারুকে একটি নজর দেখার জন্য। অথচ মারুর কোনো পাওাই নেই। মারু রূপসার সাথে বেডের উপর মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। মৃন্ময় কিছুক্ষন উঁকি চুকি মেরে কিছুটা হতাশ হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গার্ডেনে পার্ক করা গাড়িতে বসে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।

আমি মারুর পাশে বসে আছি। মারু কোনো কথাই বলছে না। কেবল গালে হাত দিয়ে মুখটা ভার করে রেখেছে। বেশ বুঝতে পারছি হয়তো মৃন্ময় ভাইয়া ওকে চটিয়েছে। তাই তো বেচারা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আমি গলাটা খানিক ঝাঁকিয়ে মারুর দিকে ঝুঁকে বললাম,,,,,,

—-“এই কি হয়েছে তোর? মুখটা এভাবে ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো?”

মারু ভার ভার কন্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-“মৃন্ময় আমাকে পাওাই দেয় না দোস্ত। আজ তো ডিরেক্টলি ভালোবাসি বলেই দিলাম। আমাকে পাওা না দিয়ে সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সত্যি আর মানতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে দোস্ত।”

বুঝতে পারলাম মারু খুব কষ্ট পাচ্ছে। আসলেই মৃন্ময় ভাইয়া এক্টু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে উনার কি এমন এসে যায়? যাই হোক আপাতত মারুকে শান্তনা দেওয়া দরকার। আমি মারুকে এক হাত দিয়ে ঝাপটে ধরে মৃদ্যু হেসে বললাম,,,,,,

—-“প্লিজ মারু মন খারাপ করিস না। দেখিস কিছুদিন পর মৃন্ময় ভাইয়া বাধ্য হবে তোকে ভালোবাসতে। আমি কিন্তু অনুমানের বশে কিছু বলছি না। আমার মন যা বলছে তাই বললাম।”

মারু ভার ভার গলায় বলল,,,,,

—-“সেই দিনটা কবে আসবে রূপ? আমি যে আর পারছি না। মৃন্ময়কে আমি একান্তভাবে চাই। খুব কাছে পেতে চাই। যতোটা কাছে পেলে মৃন্ময় আমার থেকে দূরে যেতে ভয় পাবে।”

—-“এক্টা সম্পর্ক তৈরী হতে অনেক সময় লাগে মারু। হুট করেই কোনো সম্পর্কেই যাওয়া যায় না। তুই হয়তো মৃন্ময় ভাইয়াকে অনেকক আগে থেকেই চিনিস। কিন্তু মৃন্ময় ভাইয়া তোকে মাএ দুই দিন ধরে চিনে। তোকে চিনতে, বুঝতে উনার কিছুটা সময় লাগবে। তবে ফুল গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, মৃন্ময় ভাইয়া বাধ্য হবে তোকে ভালোবাসতে। সেই দিনটা শীঘ্রই আসবে দেখে নিস।”

মারু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসল। আমি মারুর নাক টেনে বেশ আহ্লাদি স্বরে বললাম,,,,,,

—-“এবার নিচে চলুন ম্যাম। ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”

মারু মুখটা কাচু মাচু করে আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল,,,,,,,

—-“রূপ…..কেনো জানি না আমার মনটা খুব অশান্ত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে। কি হবে এক্টু বল না!”

—“আরে গর্দভ আমি কি করে বলব? আমি জোতিষ নাকি?”

—-“তাও ঠিক।”

এর মাঝেই মারুর কল বেজে উঠল। বালিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে মারু স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-আব্বু কল করেছে রূপ। দাঁড়া কথা বলে নেই।”

আমি মুচকি হেসে মাথা নাঁড়ালাম। মারু হ্যালো বলে খিলখিল হেসে যেই না আংকেলকে কিছু বলতে যাবে এর আগেই মারু মুখটা কালো করে চোখের জল ছেড়ে দিলো। আমি ভ্রু কুঁচকে মারুর দিকে তাকিয়ে আছি। প্রায় এক মিনিট পর মারু ফোনটা কান থেকে ছেড়ে বেডের উপর রেখে আচমকাই আমাকে ঝাপটে ধরে হেচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,,,,,

—-“রূপ…… দাদু মারা গেছে। আমাকে এক্ষনি নোয়াখালী ব্যাক করতে হবে।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মারু ঢুকড়ে কাঁদছে। ওকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই আমার। আমি ও মারুকে ঝাপটে ধরে কাঁদছি। কিছুক্ষন পর মারু আমাকে ছেড়ে পাগলের মতো ল্যাকেজ গুছাচ্ছে আর কেঁদে কেঁদে বলছে,,,,,,

—-“রূপ….. আমি আসছি। রাজশাহী গেলে দেখা হবে। আর হয়তো এই বাড়িতে আসা হবে না। তোদের বাড়ির বাকিরা আমাকে পছন্দ করে না। তাছাড়া মৃন্ময় ভাইয়া ও আমাকে পছন্দ করে না। তোর যদি কখনো আমাকে দেখতে মন চায় তাহলে রাজশাহী চলে আসিস।”

আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে মারুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,

—-“তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না মারু। পরিস্থিতি ঠিক থাকলে হয়তো আরো দশ, বারো দিন তোকে আমার কাছে রেখে দিতাম। কিন্তু আচমকাই এই দুঃসংবাদ টা এসে সব এলোমেলো করে দিলো।”

মারু ল্যাকেজ গুছিয়ে ল্যাকেজটা হাতে নিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,,,,,,

—-“তোকে খুবব মিস করব রূপ। তিন তিনটে বছর তোর সাথে কাটিয়েছি। শত শত স্মৃতি জমা আছে আমাদের। জানি না আর কবে দেখা হবে। তবে মনটা সারাক্ষন তোকে দেখার জন্য বেকুল হয়ে থাকবে।”

মারু কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,

—-“নিজের খেয়াল রাখিস রূপ। মুহিত ভাইয়াকে নিয়ে খুব সুখে থাক এটাই চাই। বাড়ির মানুষদের সাথে মানিয়ে গুছিয়ে থাকার চেষ্টা করিস। ওদের সাথে বেশি ভালো মানুষী দেখাতে যাস না। এতে তোরই ক্ষতি হবে। মুহিত ভাইয়ার কথা মতো চলার চেষ্টা করবি। মুহিত ভাইয়া অসম্ভব ভালো এক্টা ছেলে। তোকে ভীষন ভালোবাসে। আর শুন…. আমার মৃন্ময়কে ও দেখে রাখিস। এই দুই দিনে যদি মৃন্ময়ের মনে আমার জন্য এক্টু হলে ও জায়গা তৈরী করতে পারি তাহলে উনি অবশ্যই আমার খোঁজ নিবে। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। আর আমি ঐ দিনটার অপেক্ষায় থাকব।”

—-“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মারু। তোকে আটক দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আটকাতে ও পারব না। উভয় সংকটে পড়েছি আমি। যাই হোক…. তোকে একা একা ছাড়ছি না আমি। এক্টু ওয়েট কর। আমি মুহিত ভাইয়াকে ইনফর্ম করছি। সে তোকে নোয়াখালী ছেড়ে দিয়ে আসবে।”

—-“পাগল হয়েছিস রূপ? উনি আমাকে নোয়াখালী অব্দি পৌঁছে দিবে? কিচ্ছু করা লাগবে না দোস্ত। আমি যেতে পারব।”

—-“না পারবি না। অন্তত বাস স্টপ পর্যন্ত মুহিত ভাইয়া তোকে এগিয়ে দিয়ে আসবে।”

আমি আর দেরি না করে কাবার্ডের উপর থেকে ফোনটা অন করে হতবাক হয়ে গেলাম। এই দুই দিনে মামুর নাম্বার থেকে অজস্র কল এসেছে। অথচ আমি টেরই পাই নি। ফোন ই তো ধরা হয় নি, টের পাবো কি করে? যাই হোক আপাতত ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মুহিত ভাইয়ার নাম্বারে কল লাগলাম। প্রথম কল বাজার সাথে সাথেই মুহিত ভাইয়া কলটা পিক করে ফেলল। মুহিত ভাইয়া কিছু বলার আগেই আমি কান্না জড়িত কন্ঠে এক নিশ্বাসে বলে উঠলাম,,,,,,

—-“মুহিত ভাইয়া…. তুমি প্লিজ কয়েক ঘন্টার জন্য ছুটি নিয়ে নিয়ে বাড়ি এসো। মারুর দাদু মারা গেছে।”

মুহিত ভাইয়া উওেজিত কন্ঠে বলে উঠল,,,,,,

—–“ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাহির রাজিউন। কখন হলো এসব?”

—-“এক্টু আগেই। প্লিজ তুমি মারুকে বাস স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসো। মারু বলছে একা একাই চলে যাবে। কিন্তু আমি ভরসা পাচ্ছি না।”

—-“আমাকে জাস্ট দশ মিনিট সময় দাও রূপ। আমি আসছি। অফিস থেকে দু ঘন্টার ছুটি নিচ্ছি। তুমি প্লিজ কেঁদো না। কাঁদলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। কলটা রাখো তুমি। আমি আসছি।”

মুহিত ভাইয়া কলটা কেটে দিলো। মারু দৌঁড়ে এসে আমাকে ঝাপটে ধরে কান্না জুড়ে দিলো। আমার ও যেনো কান্না থামছে না। উল্টে বেড়ে যাচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না। প্রায় পনেরো মিনিট পর মুহিত ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে আমাদের রুমে ছুটে এলো। আমি দৌঁড়ে গিয়ে মুহিত ভাইয়াকে ঝাপটে ধরে কান্না জুড়ে দিলাম। মারুকে ছাড়তে আমার মোটে ও ইচ্ছে করছে না। সে চলে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাবো। তিন বছরে সে আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। অভ্যেস থেকে মুক্তি পাওয়াটা চাট্টি খানি কথা না। মুহিত ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,,,,,,

—–“শান্ত হও রূপ। তুমি মারুর যাওয়া নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ তাই তো? একদম চিন্তা করো না রূপ। আমরা প্রতি মাসে মাসে গিয়ে মারুকে দেখে আসব। প্রতি মাসে অন্তত একবার হলে ও রাজশাহী যাবো। তুমি এভাবে কান্না কাটি করলে মারুর মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যাবে। এমনিতেই সে তার একজন আপন মানুষকে হারিয়েছে। তার উপর তোমার কান্নাকাটি। তোমার উচিত এই মুহূর্তে মারুকে শান্তনা দেওয়া।”

আমি অশ্রুসিক্ত চোখে মারুর দিকে তাকিয়ে আছি। মারু নিচের দিকে তাকিয়ে হেচকি তুলে কাঁদছে। আমি চোখের জল গুলো মুছে মুহিত ভাইয়ার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মারুর মুখোমুখি দাঁড়িয় মারুর চোখের জল গুলো মুছে দিয়ে মলিন কন্ঠে বললাম,,,,,,,

—-“নিজের যত্ন নিস মারু। প্রতি মাসে আমাদের একবার হলে ও দেখা হবে। মুহিত ভাইয়া তো বলল ই। আর শুন….. দাদুর জন্য এভাবে না কেঁদে দোয়া কর। দোয়াটাই কাজে লাগবে।”

মারু আমাকে শেষ বারের মতো ঝাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে সোজা বাড়ির গার্ডেনে চলে গেলো। মুহিত ভাইয়া আমার হাত ধরে রুম থেকে বের হয়ে বাড়ির গার্ডেনে চলে এলো। মারু অলরেডি গাড়িতে বসে গেছে। মুহিত ভাইয়া আমার কপালে চুমো খেয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,,

—-“একদম কাঁদবে না রূপ। চেষ্টা করব খুব তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরার। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। লাঞ্চের সময় উঠে লাঞ্চ করে নিও। মন খারাপ হলে বা শরীর খারাপ লাগলে আমাকে কল করবে। আমি চেষ্টা করব কাজের ফাঁকে ফাঁকে তোমার সাথে কথা বলার।”

মুহিত ভাইয়া আর দাঁড়াল না। ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। মারু ব্যাক সিটের জানালা দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মারুর কান্না ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারছি না। আমি ও হেচকি তুলে কাঁদছি। মারু এবার জানালার কাঁচটা লাগিয়ে দিলো। মুহিত ভাইয়া ও গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমি কিছুক্ষন বাড়ির গার্ডেনে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে সোজা ড্রইং রুমে চলে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার আগেই ফুফুমনি, দোলা আপু আর সোহেলী আন্টি আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। দোলা আপু চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—-“সকাল থেকেই তোর ন্যাকা কান্না শুনছি। এই কি হয়েছে বল তো?”

আমি মাথাটা নিচু করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললাম,,,,,,

—-“মারুর দাদু মারা গেছে।”

ফুফুমনি হু হা করে হেসে বলল,,,,,

—-“যাক বাবা আপদ টা বিদেয় হলো। লাজ, লজ্জা বলত কিছু নেই। ফ্রেন্ডের বাড়িতে এসে কেউ এতো দিন থাকে নাকি?”

দোলা আপু অট্ট হাসি দিয়ে ফুফুমনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

—-“হাসালে আম্মু। তুমি হয়তো ভুলে গেছো এই বাড়িটা তোমার ভাইয়ের মেয়ের নয়। এই বাড়িটা আমাদের। তোমার ভাইয়ের মেয়ে নিজেই এই বাড়ির আশ্রিতা।”

আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। এভাবে সত্যিই হাঁফিয়ে উঠছি। এতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের জীবন আমার আর ভাল্লাগছে না। এক্টা পালিত কুকুরের সাথে ও কেউ এতোটা নিকৃষ্ট ব্যবহার করে না। ওরা যতোটা আমার সাথে করে! তাহলে আমি নিজেকে কার সাথে তুলনা করব? কুকুরের সাথে নাকি কুকুরের চেয়ে ও নিচু শ্রেণীর কোনো প্রাণীর সাথে?

এক্টা বিশুদ্ধ শহর চাই আমার। যেখানে কোনো নোংরা মন মানসিকতার মানুষ থাকবে না। এই শহরের হাওয়া ও দূষিত। শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে। আমি এসব কটু কথা করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে যেই না সামনে কদম বাড়ালাম অমনি পিছন থেকে ফুফুমনি চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,

—-“এই যে নবাব নন্দিনী। কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? রান্না ঘরে সব কাজ পড়ে আছে। এক এক করে সব সেরে ফেল। এক্টু পরেই সানায়া বাড়ি ফিরবে। এয়ারপোর্টে অলরেডি পৌঁছে গেছে। রাঁধবে বাড়বে কে শুনি?”

কলিজাটা আচমকাই মোচড় দিয়ে উঠল। সানায়া আপু আসছে। মানে আমার জম আসছে। এবার আমার মুহিতকে এই মেয়ে নিজের করেই ছাড়বে। যে করেই হোক উনি মুহিত ভাইয়াকে হাসিল করে নিবে। আমাকে আবারো এই বাড়ি থেকে বের করে দিবে। তবে এবার আর এমনটা হবে না। বের হতে হলে আমি একা নই মুহিত ভাইয়াকে নিয়ে বের হবো। এই পিশাচ গুলোর হাতে আমি মুহিত ভাইয়াকে একলা ছেড়ে যাবো না। মুহিত শুধু আমার। আর কারো না। আমি মুহিত ভাইয়ার বিয়ে করা বউ। ওর অর্ধাঙ্গীনি। সানায়া আপু বাড়াবাড়ি করতে এলেই আমি সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে দিবো। চোখের জল গুলো মুছে আমি পিছু ফিরে ফুফুমনি আর দোলা আপুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,,,,

—-“বাড়ির কোনো কাজে আমি হাত লাগাতে পারব না। এবার যেই আসুক বাড়িতে। আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। মুহিত ভাইয়া আমাকে যা বলে গেছে আমি তাই শুনব।”

ফুফুমনি তেজী কন্ঠে বলল,,,,,

—–“মুহিতের কথা মতো চলবে নাকি সব? মুহিতের কথা শুনতে আমরা বাধ্য নই।”

সোহেলী আন্টি আচমকাই ফুফুমনির হাত চেঁপে ধরে ফুফুমনিকে থামিয়ে দিলো। ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কথা বলছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি না। ফুফুমনি মলিন হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—-“যা রূপসা যা। তুই তোর রুমে যা। মুহিতকে আবার কিছু বলতে যাস না। আসলে আমি তোর সাথে এতোক্ষন মজা করেছি। প্লিজ সিরিয়াসলি নিস না।”

ফুফুমনির কথায় শত পার্সেন্ট সন্দেহ আছে আমার। তবে এই মুহূর্তে আমার কিছুই ভালো লাগছে না। মারুর জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। তার উপর সানায়া আপু আসবে। সব মিলিয়ে আমি বেশ ডিপ্রেসড। ওদের কথায় পাওা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা রুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলাম। দরজায় ঠ্যাস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। কষ্টে বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই চোখ গেলো বেডের উপর রাখা ফোনটার দিকে। মামুর কথা মনে পড়ল। দৌঁড়ে বেডের উপর বসে মামুর নাম্বারে কল লাগালাম। প্রথম কলটা এমনি বেজে গেলো। দ্বিতীয় কল বাজার সাথে সাথেই মামু কলটা রিসিভ করে ফেলল। তেজী কন্ঠে মামু চিল্লিয়ে বলে উঠল,,,,,

—-“কোথায় তুমি রূপ? দুই দিন যাবত তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না। আদনান পর্যন্ত ভার্সিটির হোস্টেলে তোমাকে খুঁজে এসেছে। কিন্তু পায় নি। ছেলেটা তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাই তো আমার এক কথাতেই তোমাকে খুঁজতে চলে গেছে রাজশাহী।”

#চলবে,,,,,,,,

(গল্পটার রেসপন্স কমে যাচ্ছে কেনো? গল্পটা কি পাঠকদের ভালো লাগছে না?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here