এক চিলতে সিঁদুর পর্ব -১৭

#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_১৭
#অধির_রায়

নিয়তি লজ্জা পেয়ে রুম থেকে চলে আসে৷ নির্বণ মুচকি অফিসের কাজ করতে থাকে৷ এখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে৷ ছোঁয়া এখন স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত৷ নিয়তি দৌড়ে নির্বণের মায়ের রুমে আসে৷ দেখতে আসে তিনি কি করছেন? নিয়তি দেখে তিনি নিজের কাছে ডেকে বসান৷ নিয়তির হাতে হাত রেখে,
“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই৷”
.
নিয়তি অবাক দৃষ্টি মেলে,
“কোন সংকোচ না নিয়ে বলে ফেলেন৷ আমি আপনার কথা মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করবো।”
.
নির্বণের মা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিয়তির হাতে একটা চাবির গোছা তুলে দেন৷ শোভন কন্ঠে বলেন,
“আজ থেকে সংসারের দায়িত্ব তোমার হাতে৷ তুমি নিজ হাতে এই সংসার আগলে রাখবে৷”
.
নিয়তিকে হুট করেই এতো বড় দায়িত্ব দেওয়াতে নিয়তি ভয়ে কাচুমাচু করতে থাকে৷ শুকনো ঢুক গিলে বলে উঠে,
“আসলে মা.. আমি এসব দায়িত্ব বহন করতে পারবো তো৷”
.
নিয়তির হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে ,
“তুমি সব পারবে৷ তোমার দ্বারা সব সম্ভব। কোন কিছু থেকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসবে না৷”
.
“কিন্তু… ”
.
“কোন কিন্তু নয়৷ আমি যা বলছি তাই হবে৷ আজ থেকে এই বাড়ি সামলানোর দায়িত্ব তোমার৷”
.
নিয়তি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দেয়৷ নিয়তি চলে যেতে নিলেই নির্বণের মা পিছন থেকে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,
“আমি তোমাকে এখান থেকে যেতে বলেছি৷ তুমি যাচ্ছো কোথায়?”
.
নিয়তি হতভম্ব হয়ে ভয়ে ভয়ে বলে,
“আসলে মা অনেক কাজ আছে৷ সবার জন্য রান্না করতে হবে৷ এখনো রান্না বসানো হয়নি।”
.
গম্ভীর কণ্ঠে রাগী ভাব নিয়ে,
” যখন তোমাকে যেতে বলবো তখন তুমি যাবে৷ রান্না করার জন্য অনেক লোক আছে৷”
.
নিয়তি ভয়ে ভয়ে হতভম্ব হয়ে,
“ওকে মা৷ নিশ্চয় আপনার কিছু লাগবে? আপনার কি লাগবে? আমাকে বলেন, আমি সব করে দিচ্ছি৷”
.
“আমার কিছু লাগবে না৷ তবে তোমার কাছ থেকে আমি একটা জিনিস চেয়ে নিব৷ তুমি কি আমায় সেই জিনিস দিবে?”
.
“আপনি কি চান? একবার মুখ ফুটিয়ে বলেন৷ আপনার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি৷”
.
“আমি আমার ঘরে নতুন সদস্য দেখতে চাই৷ যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে নাতি বা নাতনির মুখ দেখাও৷”
.
নিয়তি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে৷ নিয়তি এমন বিপাকে পড়বে কোনদিন ভাবতে পারেনি। নির্বণের মা নিয়তির মুখ উপরে তুলে,
“এভাবে আমার কাছে লজ্জা পেতে হবে না৷ আমি নতুন সদস্য দেখতে চাই৷”
.
নিয়তি মুচকি হেঁসে কিছু না বলে দৌড়ে চলে আসে৷ নিয়তি মাথায় শুধু তার শ্বাশুড়ির কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে৷
______

আজও নিয়তি নির্বণের ঘরে যায়নি৷ নিয়তি নিজের রুমে বসে বসে গান গেয়ে যাচ্ছে৷ নির্বণ ক্ষেপে নিয়তির রুমে পা বাড়াই৷ কিন্তু নিয়তি কন্ঠে কাকের গান শুনে হেঁসে ফেলে৷
“আমার আতা গাছে
গরু ছাগল বাসা বেঁধেছে
হুসস গরু, হুসস ছাগল।”

নিয়তি পিছনে ঘুরে নির্বণকে দেখতে পেয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। নিয়তি তেড়ে নির্বণের কাছে আসে৷ চোখ পাকিয়ে বলে উঠে,
“আপনি হাসেন কেন? আমি ভালো গান গাইতে পারিনা৷”
.
নির্বণ নিজের হাসি বন্ধ করে অবাক চোখে,
“তুমি গান গাইছিলে! তোমার কন্ঠের প্রেমে পড়ে গেলাম৷”
.
নিয়তি নিজেকে সুপারস্টার দাবী করে,
“আমার গান যে শুনেছে সেই আমার গানের প্রেমে পড়ে যায়৷ শ্রেয়া ঘোষাল আমার কাছ থেকে গান শিখে।”
.
নির্বণ আর নিজের হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না৷ নির্বণ অট্টহাসিতে মেতে উঠে। নির্বণ কোন রকম হাসি থামিয়ে,
“তোমার কাছ থেকে শ্রেয়া ঘোষাল গান শিখে। শ্রেয়া ঘোষালের কপাল এতো খারাপ হলো কবে৷ তোমার মতো শ্রেয়া ঘোষাল কাকের মতো কা কা করে গান বললে; মানুষ তার গানকে রানু মন্ডলের সাথে তুলনা করবে৷”
.
নিয়তি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন৷ আমি আপনাকে ছাড়বো না৷”
.
“আমি তোমার প্রশংসা করছি৷ তোমার সাথে আমার নয়, হিরো আলমের বিয়ে হলে ভালো হতো৷ দুই জনে মিলে মনের সুখে গান গাইতে পারতে৷”
.
নিয়তি তেড়ে নির্বণের কাছে আসে৷ নির্বণের পায়ে লাথি দিয়ে চলে যেতে নিলেই নির্বণ নিয়তির কোমর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়৷ আচমকা এমন ঘটনা গড়তে পারে নিয়তি বুঝতে পারেনি৷ নিয়তি ঠোঁট জোড়া না চাইতেও নির্বণের ঠোঁটের সাথে লেগে যায়৷ নিয়তি তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সংযত করে নেয়৷ নির্বণ নিয়তিকে আরও কাছে টেনে নিয়ে আসে৷ নেশা ভরা কন্ঠে,
“তোমার গান আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে৷ তোমার কন্ঠ রানু মন্ডলের থেকে কোন অংশে খারাপ নয়৷”
.
নিয়তি কর্কশ কন্ঠে,
“আমি কিন্তু এখন…”
.
নিয়তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই নির্বণ নিয়তি ঘাড়ে একটা ডিপ কিস করে৷ নিয়তি কোন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে৷ নিয়তির সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে৷ নিয়তিও নির্বণকে জড়িয়ে ধরে৷
.
নির্বণ দুষ্টু হাসি দিয়ে নিয়তিকে কোলে তুলে নেয়৷ নিয়তি ভয়ে পেয়ে বলে উঠে,
“এই কি করছেন? আপনি অসুস্থ। প্লিজ আমাকে নামিয়ে দেন৷”
.
নির্বণ ভেংচি কেটে,
“আমি এতোটাও দুর্বল নয়৷ তোমাকে বহন করার মতো যথেষ্ট শক্তি আছে৷”
.
“আপনার ভালো চাইলে আমাকে নিতে নামিয়ে দেন৷ আমার ভয় লাগছে৷”
.
“ভয়ের কিছু নেই৷ আমার গলা জড়িয়ে ধরো৷ তাহলে সব ভয় কেটে যাবে৷”
.
“আপনি কিন্তু.. ”
.
নিয়তি কিছু বলার আগেই নির্বণ নিয়তিকে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখায়৷ নিয়তি ভয় পেয়ে নির্বণের গলা জড়িয়ে ধরে৷ নির্বণ মুচকি হেঁসে নিয়তিকে নিয়ে হাঁটা শুরু করে৷ নিয়তি চোখ বন্ধ করে নির্বণের বুকে মাথা রেখেছে৷ নির্বণ নিয়তিকে ছাঁদে নিয়ে আসে৷ দোলনায় নিয়তিকে নামিয়ে দেয়৷
.
নিয়তি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে উঠে,
“এতো রাতে ছাঁদে কি করবেন? আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷ আমি চলে গেলাম৷ আপনি ছাঁদে বসে ভুতদের সাথে কথা বলেন৷”
.
নিয়তির কোলে মাথা রেখে,
“তোমার কোলে মাথা রেখে দূর আকাশের চাঁদ দেখতে চাই৷ চাঁদটা যদি পূর্নিমার চাঁদ হতো তাহলে একটা রোমান্টিক মুহুর্ত থাকতো৷ কিন্তু আফসোস পূর্নিমার চাঁদ নয়৷”
.
“আপনি বসে বসে পূর্নিমা রাতের জন্য অপেক্ষা করেন৷”
.
“আমি শুধু তোমার ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করবো৷ অন্য কারোর জন্য অপেক্ষা করবো না৷”
.
তামাশা শহিত বলে উঠে,
“কবি কবি ভাব৷ কিন্তু কোন ছন্দ মেলাতে পারে না৷”
.
নিয়তিকে কোমর আলতো করে জড়িয়ে ধরে,
“আমি শুধু তোমার জন্য কবি হবো৷ তোমার ভালোবাসার কবি হবো৷ সেখানে ছন্দ নয়, ভালোবাসা বুঝাতে পারলেই হলো৷”
.
“আমি জেগে থাকতে পারবো না৷ আমার কোল থেকে উঠে দোলনায় শুয়ে শুয়ে ঘুম আসেন৷ আর অর্ধেক পূর্নিমার চাঁদ দেখে যান৷”
.
অভিমানী স্বরে,
“না পারবো না৷ আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে এভাবে ঘুম আসবো৷”
.
নিয়তি নির্বণকে শুরশুরি দিতে থাকে৷ নির্বণ হেঁসে নিয়তির কোল থেকে মাথা উঠিয়ে নেয়৷ নিয়তি ছাড়া পেয়ে চলে আসতে নিলেই নির্বণ নিয়তির হাত ধরে ফেল৷ নিয়তি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে,
“আমার কিন্তু ভালো লাগছে না৷ সকালে আমার অনেক কাজ আছে৷”
.
নির্বণ কিছু না বলে নিয়তিকে পাঁজা কোলায় তুলে নেয়৷ নিয়তির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আর হেঁটে নিজের রুমের দিকে যাত্রা শুরু করেছে৷ নিয়তি লজ্জা পেয়ে নির্বণের বুকে মুখ লুকায়৷ নিয়তিকে বিছানায় শুয়ে দেয়৷ তাদের মাঝে সকল ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নেয়৷ তারা ভালোবাসার অসীম সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
_________

আঁধার কেটে নতুন দিনের সূচনা হয়৷ ভোরের আলো ফুটে উঠতেই নিয়তির ঘুম ভেঙে যায়৷ নিয়তি নিজেকে আবিষ্কার করে নির্বণের লোমযুক্ত বুকের মাঝে৷ নির্বণ তাকে একদম বুকের সাথে মিশিশে রেখেছে৷ নিয়তি নির্বণের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে যায়৷ মনে পড়ে রাতের সেই মিলনের কথা৷ নিয়তি আজ সার্থক, নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়েছে৷ নিয়তি অবুঝ মন আজ নির্বণকে ছাড়তে চাইছে না৷
.
নিয়তিকে বারং বার আকর্ষণ করছে নির্বণের ঠোঁট জোড়া। নিয়তি নিজের লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছে না৷ নিয়তি ধীরে ধীরে নির্বণের ঠোঁটের কাছে চলে আসলেই নির্বণ আঁখি মেলে তাকায়। নিয়তি নির্বণের চাহনি দেখে লজ্জা পেয়ে যায়৷ নিজেকে সংযত করে দূরে সরে আসতেই নির্বণ নিয়তিকে ধরে ফেলে৷ নির্বণ ব্রু নাচিয়ে বলে উঠে,
“চুপি চুপি কি চলছে? তুমি আমাকে…”
.
নিয়তি লজ্জা মাখা মুখে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“কই কিছুনা তো৷ আপনি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছেন কেন? আমার শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে৷”
.
নিয়তির নাকে নাক ঘেঁষে,
“সারা রাত যখন জড়িয়ে ধরে ছিলে তখন শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়নি৷ আমি জড়িয়ে ধরলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়৷”
.
নিয়তি চোখ বড় করে,
“আমি মোটেও এমন করিনি৷ ছাড়েন আমাকে, আমার অনেক কাজ রয়েছে৷”
.
“তোমাকে আমি ধরে রেখেছি৷ তুমি যেতে পারো৷”
.
নিয়তি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কর্কশ কন্ঠে উঁচু স্বরে বলে উঠে,
“এভাবে দুই বাহুর মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কে?”
.
নির্বণ চোখ টিপল দিয়ে,
“আমি তোমাকে একদম জড়িয়ে ধরিনি৷ আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরেছি৷ তোমাকে আমি চিনি না৷ কে তুমি?”
.
নিয়তি নির্বণের পেটে চিমটি কাটে৷ নির্বণ “আউচ” বলে নিয়তিকে ছেড়ে দেয়৷ নিয়তি সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভেংচি কেটে চলে যায়৷
_______

অনেক দিন পর নির্বণ আজ নতুন করে অফিসে যাচ্ছে৷ অফিসের কোন কিছুই তার নখর দর্পনে থাকলেও কেন জানি আজ নিজেকে অসহায় মনে করছে৷ এতোদিন অফিস সামলিয়েছে ছোঁয়া, আবির৷ এখন ছোঁয়া আবিরের নিজস্ব একটা সংসার হয়ে গেছে৷ আবির নিজের বাবার অফিস সামলাতে ব্যস্ত।
.
নির্বণ নিয়তির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে৷ নিয়তি নির্বণের মুখ বন্ধ করে দিয়ে,
“এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে মুখে মশা ঢুকবে৷”
.
নিয়তি সোনালী পাড়ের লাল রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছে৷ নিয়তির সিঁথিতে সিঁদুর হাতে সোনার কাকন৷ নিয়তিকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নির্বণ অপলক দৃষ্টিতে নিয়তির দিকে তাকিয়ে আছে৷ নিয়তি নির্বণের ট্রাই বাঁধতে বাঁধতে,
“আমার দিকে না তাকিয়ে থেকে কাজে মন দেন৷ আমাকে দেখার কোন মানেই নেই৷”
.
নিয়তির কানে ফিসফিস করে নেশা ভরা কন্ঠে,
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে৷ লাল শাড়িতে তোমাকে লাল পরী লাগছে৷”
.
“এখন কথা না বাড়িয়ে অফিসে যান। আপনার জন্য মঙ্গল হবে৷ নাহলে আপনাকে মিঠুন দাদার শ্মশানে পাঠাবো।”
.
নির্বণ নিয়তির কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দেয়৷ মায়ের পায়ে হাত রেখে প্রণাম করে অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে৷

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here