এক চিলতে সিঁদুর পর্ব -২০ ও শেষ

#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পব_২০ (অন্তিম পর্ব)
#অধির_রায়

দেখতে দেখতে বয়ে যায় সময়৷ এগিয়ে আসতে থাকে হারানোর সুর৷ নিয়তি এখন আগের মতো চলাফেরা করতে দেয় না৷ নির্বণ অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ নিয়তির খেয়াল রাখে আর কিছ অফিসের কাজ অনলাইনে করে৷
.
গভীর রাতে নিয়তির ঘুম ভেঙে যায়৷ নিয়তি কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না৷ গর্ভের ভিতর বাচ্চা নাড়াচাড়া করছে। পেটে লাথী দিচ্ছে৷ নিয়তি সহ্য করতে না পেরে নির্বণকে ডাক দেয়৷ নির্বণ ধর ফরিয়ে উঠে বসে। নিয়তি পেটে হাত রেখে কান্না করে যাচ্ছে৷ নির্বণ নিয়তিকে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে তুলে বসায়৷ বাচ্চা একটু শান্ত হলে নির্বণ বাহিরে যেতে নিলেই নিয়তি তার হাত ধরে ফেলে৷ নির্বণ অবাক চোখে নিয়তির দিকে তাকায়৷
.
নিয়তি কান্না জনিত কন্ঠে বলে উঠে,
“আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই৷ আমার কথা রাখতে হবেই
.
নিয়তির মুখে হাত রেখে,
“এখন কোন কথা নয়৷ আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছি৷”
.
ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো,
“আমার এখন খেতে ইচ্ছা করছে না৷ আমি কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে চাচ্ছি৷ কথা গুলো পরবর্তীতে বলার সুযোগ নাও পেতে পারি৷”
.
নিয়তির এমন কথা নির্বণের বুকে বিষাক্ত তীরের মতো লেগেছে৷ নির্বণ বুকে চিন চিন ব্যথা অনুভব করতে থাকে৷ অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে৷ নির্বণ মুচকি হেঁসে,
“কোন কথা নয়৷ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো!”
.
নিয়তি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“কথা গুলো না বলতে পারলে আমার ঘুম আসবে না৷ কথাগুলো আমাদের ভালোবাসা এবং আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে৷”
.
নির্বণ মলিন হেঁসে বলে উঠে,
“তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি কালই গাড়ি পাড়িয়ে তোমার মামা মামীকে নিয়ে আসবো৷ তাদের জন্য তোমার মন খারাপ করছে।”
.
নিয়তি চোখ বড় করে বলে উঠে,
“আমি মামা মামীর কথা বলতে….”
.
নিয়তিকে থামিয়ে,
“আরে লজ্জা কিসের? আমি জানি তুমি তোমার মামা মামীকে খুব মিস করছো? তোমার মামী এই তো বলেছেন তারা খুব তাড়াতাড়ি আসবেন৷”
.
নিয়তি নির্বণের কথা আর নিতে পারছে না৷ নিয়তি উচ্চ স্বরে কান্না শুরু করে দেয়৷ নির্বণ নিয়তির চোখের জল মুছে দিতে নিলেই নিয়তি নির্বণের হাত ধরে ফেলে৷ নির্বণের হাত পেটে নিয়ে মায়া ভরা কন্ঠে বলে উঠে,
“আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আমার সন্তানকে কোনদিন অবহেলা করবেন না৷ আমাকে কথা দেন৷”
.
নিয়তির কথাগুলো একদম বুকের মাঝে তীরের মতো লাগল৷ নির্বণের চোখ ছলছল করছে৷ নির্বণ এক বুক কষ্ট নিয়ে কোন কথা না বলে মূর্তির ন্যায় বসে আছে৷ নিয়তি নির্বণকে হালকা ধাক্কা দেয়৷ নির্বণের বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসে।
.
“আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আমাকে কথা দেন, আমার সন্তানের কোন অবহেলা করবেন না৷”
.
নিয়তিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে৷ নির্বণ কান্না জনিত কন্ঠে,
“আমি তোমার কিছু হতে দিব না৷ আমাকে যদি তোমার এবং আমার সন্তানের মাঝে একজনকে বেছে নিতে বলে আমি তোমাকে বেছে নিব৷”
.
নিয়তি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে,
“আমি আমার সন্তানের গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দিব না৷”
.
নির্বণ মায়া ভরা কন্ঠে আটকে আটকে বলে উঠে,
“তোমার কিছু হলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না৷”
.
নির্বণের মুখে আঙুল দিয়ে,
“এমন বাজে কথা কখনো মুখে আনবেন না৷ আমি না থাকলেও আমার সন্তান আপনার সাথে থাকবে৷ আমাদের ভালোবাসার জন্য আপনি বেঁচে থাকবেন৷ আপনাকে বেঁচে থাকতেই হবে আমাদের ভালোবাসার জন্য।”
.
নিয়তিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে,
“আমি তোমাকে ছাড়া একদম বেঁচে থাকতে পারবো না৷ তুমি আমার নিঃশ্বাস৷ তুমি আমার শ্বাস প্র-শ্বাসে জড়িয়ে আছো৷”
.
নিয়তি নিজের চোখের জল মুছে,
“এভাবে ভেঙে পড়বেন না৷ আপনি আমার শক্তি। আপনি ভেঙে পড়লে আমিও যে ভেঙে পড়বো৷”
.
“আগে বলো, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ আমি সব সময় আমাদের ভালোবাসা এবং তোমাকে আগলে রাখবো৷”
.
নিয়তি নিজের কষ্ট লুকিয়ে রেখে বলে উঠে,
“আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷ আমি এখন ঘুম আসবো৷”
.
নির্বণ নিয়তি আলতো করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
________

পরের দিন রাতের বেলা নিয়তির মামা মামী এসে হাজির৷ নিয়তি খুব খুশি আজ৷ মামীর সাথে মন খোলে কথা বলছে৷ মামীর কোলে মাথা রেখে নিয়তি শুয়ে আছে৷ মামী নিয়তিকে রুপকথার বিভিন্ন গল্প শুনাচ্ছেন৷ গল্প শুনতে শুনতে কখন যে নিয়তি ঘুমিয়ে পড়ে জানা নেই!
.


দেখতে চলে আসে সেই দিন৷ হসপিটালের করিডরে সবাই বসে আছে৷ নিয়তিকে রক্ত দিবে তার মামী৷ মামীর রক্তের গ্রুপের সাথে নিয়তির রক্তের গ্রুপের মিল আছে৷ নিয়তিকে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়ার আগে সেখানে উপস্থিত হয় আগুন চৌধুরী৷ নিয়তি চোখ আকাশ প্রাণে আগুন চৌধুরীকে দেখে৷ আগুন চৌধুরী সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আমিও নিয়তিকে রক্ত দিব৷ আমার ব্লাড গ্রুপের সাথে নিয়তির ব্লাড গ্রুপের মিল আছে৷”
.
আগুন চৌধুরীর কথা শুনে নির্বণ নিয়তি দুই জনই চকিত হয়ে যায়৷ আগুন এসব কিছু কিভাবে জানতে পারলো? সকলের এমন অবস্থা দেখে আগুন চৌধুরী বলে উঠে,
“নিয়তিকে বিকেল চারটার দিকে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাবে তো৷ নিয়তি তুমি কোন চিন্তা করবে না৷ তোমার কিছু হবে না৷”
.
নিয়তির মনে ভয় কাজ করছে৷ নিয়তির একমাত্র উক্তি,সে তার বাচ্চাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাবে৷ কান্না করেই যাচ্ছে নিয়তি৷
.
নির্বণকে দেখে হবে হচ্ছে কোন মানসিক হসপিটাল থেকে পালিয়ে এসেছে৷ ঠিলেঠালা পোশাক পড়ে আছে৷ চুলগুলো উসকো খুসকো। আগুন চৌধুরী তাদের সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে৷
.
আগুন চৌধুরী নিয়তিকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলে৷ যেদিন নিয়তিকে তার মনের কথা বলতে যাবে সেদিন জানতে পারে নিয়তি বিবাহিত। নিয়তির হাসব্যান্ড হলো নির্বণ৷ আগুনের ভুলের জন্য যে মৃত্যুর পথে ধাপিত হয়েছিল৷ ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে কোন কথা নেই৷ দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। ত্যাগের মাঝে ভালোবাসা নিহিত। আগুন মন থেকে সারাজীবন নিয়তিকে ভালোবেসে যাবে৷ কিন্তু আগুনের ভালোবাসা হলো এক প্রেক্ষিক ভালোবাসা৷ আগুন ভেবে নিয়েছে, নিয়তির সুখে না থাকতে পারলেও নিয়তির বিপদে সব সময় পাশে থাকবে৷ সেজন্য আগুন চৌধুরী সব সময় নিয়তির উপর নজর রাখতো৷
______

অপারেশন থিয়েটারের সামনে কান্না রুল পড়ে গেছে৷ নিয়তির মামী কান্না করেই যাচ্ছেন৷ নির্বণের চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নিয়তি নির্বণের হাত ধরে আছে৷ ডক্টর তাড়া দিচ্ছে৷ তবুও কোন কথা শুনছে না নিয়তি৷ নিয়তি নির্বণের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে৷
.
নিয়তি কান্না করতে করতে বলে উঠে,
“আমার সন্তানকে কখনো অবহেলা করবেন না৷ সব সময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবেন।”
.
নির্বণ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“কোন কথা বলবে না৷ তোমার মাথায় বাজে চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু আসে না৷ ভালো কিছু ভাবতেও তো পারো।”
.
নিয়তি মলিন হাসি দিয়ে,
“ভালো ভাবলেই কি হবে? আমি আমার মায়ের কাছে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারবো৷ কোনদিন মায়ের ভালোবাসা পায়নি৷ মৃত্যুর পর মায়ের ভালোবাসা পাবো৷”
.
মামীর হাত ধরে মামীকে উদ্দেশ্য করে,
“মামী তুমি আমাকে তোমার মেয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসা দিয়েছো৷ তুমি আমার জন্য যা করেছো নিজের মা থাকলেও এমন করতো না৷”
.
মামী নিয়তির কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে,
“তোমার কিছু হবে না৷ আমি তোমাকে নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনি।”
.
“মামী আজ তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো তুমি আমায় দিবে৷”
.
“আমি তোমার জন্য আমার জীবন দিয়ে দিতেও প্রস্তুত৷ তোমার জন্য আমি সব করতে পারবো৷”
.
“তুমি আমাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছো আমার সন্তানকে ততটাই ভালোবাসা দিবে৷ আমি না থাকলে মায়ের অভাব বুঝতে দিবে না৷ আর একটা সুযোগ দিবে৷”
.
“আমি সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করবো৷ তোমার কিছু হবে না৷ সৃষ্টি কর্তা আমার মেয়েকে কেঁড়ে নিতে পারবে না৷”
.
“আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে ‘মা৷’ অসহায় দৃষ্টিতে মামীর দিকে তাকিয়ে আছে।
.
মামী নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়৷ কান্না করতে করতে বলে উঠেন,
” আজ থেকে আমার কোন আফসোস নেই৷ আমি আমার মেয়েকে পেয়ে গেছি৷”
.
ডক্টর তাড়া দিয়ে,
“প্লিজ এখানে ভিড় করবেন না৷ আমাদের কাজ করতে দেন৷”
.
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিয়তিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান৷ আগুন চৌধুরী এক পাউন্ড ব্লাড, মামী এক পাউন্ড ব্লাড দেন৷ নির্বণ মাথা চেপে ধরে করিডরে আসে আছে৷ নির্বণকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে আগুন৷ কিন্তু আগুন চৌধুরীর কোন কথা নির্বণের কান অব্দি যাচ্ছে না৷ নিয়তির কথাগুলো নির্বণের কানে বাজছে৷
________

বাচ্চার কান্নার শব্দে সকলের মুখে হাসি ফুটে৷ কিন্তু নির্বণ একদম ভেঙে পড়ে৷ নির্বণ নিয়তি বলে চিৎকার করে উঠে৷ নির্বণের আর কিছু মনে নেই৷ নিয়তি বলার পরই নির্বণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
.
নির্বণের জ্ঞান ফিরে আসার পর আগুন চৌধুরী কোলে করে নির্বণের বাচ্চাকে নিয়ে আসে৷ নির্বণ বাচ্চার দিকে না তাকিয়ে বলে উঠে,
“আমার নিয়তি কোথায়৷ আমি নিয়তি কাছে যেতে চাই৷”
.
নার্স বলে উঠেন,
“মা ও ছেলে দু’জনই ভালো আছে৷ আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারেন৷”
.
নির্বণ ছেলেকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে নিয়তির কেবিনে প্রবেশ করে৷ ছেলেকে মামীর কাছে দিয়ে নিয়তিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে,
“হ্যাঁ সৃষ্টি কর্তা, আপনি আমাদের কথা রেখেছেন৷ আমার আর কিছু চাওয়া নেই আপনার কাছে৷”

______

নির্মল তার বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে খেলছে৷ নিয়তি বাবা, ছেলের এমন কান্ড দেখে হেঁসে বলে উঠে,
“ছেলেকে পেয়ে আমার কথা ভুলেই ছেলে৷”
.
নির্বণ ছেলের কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে,
“নির্মল তুমি তোমার দাদুর কাছে যাও৷ তোমার দাদু তোমাকে ডাকছে৷”
.
নিয়তি চোখ ছোট করে,
“নির্মল কোথাও যাবে না৷ বাবা আমার কাছে আসো৷ আমরা খেলা করবো৷”
.
নির্বণ ছেলে নির্মলকে কোলে নিয়ে মামীর কাছে দিয়ে আসেন৷ মামা মামীকে আর যেতে দেয়নি৷ মামা মামীকে এখানেই রেখে দিয়েছে৷
.
নিয়তি পিছন ফিরে চলে আসতে নিলেই নির্বণ নিয়তির কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়৷ নিয়তির ঘাড়ে ডিপ কিস দিয়ে,
“তুমি সারা জীবন আমার ভালোবাসার সঙ্গী হয়ে থাকবে৷ তোমাকে কেউ আমার কাছ থেকে আলাদা করতে হবে না৷”
.
নিয়তিও নির্বণকে জড়িয়ে ধরে,
“আমি এক চিলতে সিঁদুর নিয়ে মরতে চাই৷ আমি থাকতে আপনার কিছু হতে দিব না৷ আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি৷”
.
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here