এক চিলতে সিঁদুর পর্ব -১৮

#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_১৮
#অধির_রায়

নিয়তি নির্বণের ভালোবাসার দিনগুলো কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ভালোভাবে। ধীরে ধীরে চলে যায় চার চারটি মাস৷ এর মাঝে নিয়তি নিজেকে সংসারের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে৷ প্রতিদিনের মতো নিয়তি সকলের জন্য খাবার রান্না করে৷ আজও কোন ব্যতিক্রম হয়নি৷ সকলে টেবিলে বসে ব্রেক ফাস্ট করছে৷ হঠাৎ করেই নিয়তি মাথা ঘুরে পড়ে যায়৷ নিয়তি ফ্লোরে পড়ে যাওয়ার আগেই অন্য সার্ভেন্ট নিয়তিকে ধরে ফেলে৷ নির্বণ যত দ্রুত পারে নিয়তিকে হসপিটালের নিয়ে আসে৷
.
নির্বণ কেবিনের বাহিরে পায়েচারী করছে৷ ডক্টর নির্বণকে রুমে যেতে মানা করেছেন৷ দুশ্চিন্তায় বারং বার কপালের ঘাম মুছে যাচ্ছে। ডক্টর পিছন থেকে বলে উঠেন,
“কংগ্রেস মি. নির্বণ রায়৷ আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন৷”
.
নির্বণ আলতো করে ডক্টরকে জড়িয়ে ধরে,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আজ অনেক খুশি।”
.
ডক্টর চোখ বড় বড় করে,
“আপনি পাগল হলেন নাকি৷ আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছেন কেন? আপনি একজন মহিলা! ভুলে গেছেন আপনি?”
.
নির্বণ ডক্টরকে ছেড়ে দেয়৷ মাথা নিচু করে,
“আমি এতটাই এক্সাইটেড ছিলাম যে, উপস্থিত বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম৷’ দুঃখিত৷”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে,
“ইট’স ওকে। এমন ভুল যেন দ্বিতীয় বার না হয়।”
.
নির্বণ আনন্দের সাথে বলে উঠে,
“ডক্টর আমি নিয়তির সাথে দেখা করতে পারবো কি! আমি নিয়তির সাথে দেখা করতে চাই৷”
.
“হুম আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারবেন৷ কিন্তু উনাকে কোন বিরক্ত করা যাবে না৷ দুই ঘন্টা পর উনার জ্ঞান ফিরে আসবে৷”
.
“আমি নিয়তিকে কোন প্রকার বিরক্ত করবো না৷ ”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে চলে যায়৷ নির্বণ ধীর পায়ে নিয়তির দিকে অগ্রসর হতে থাকে৷ নিয়তির যত কাছে আসছে বুকের হার্ট এতো সাড়া ফেলছে৷ দেহের রক্ত সঞ্চালন দ্রুত গতিতে হচ্ছে৷ কাঁপা কাঁপা হাত রাতে নিয়তির হাতের উপর৷ চোখ থেকে টুপ করে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে৷ এটা কোন কষ্টের কান্না নয়৷ আনন্দ মোহিত হয়ে চোখ থেকে জল এসে পড়েছে৷ নিয়তির হাত ধরে তাদের রোমান্টিক মুহুর্তগুলো অনুভব করে যাচ্ছে৷
.
মাঝে মাঝে নার্স এসে নিয়তিকে দেখে যাচ্ছেন৷ নিয়তির হাতে ভালোভাবে স্যালাইন পুষ্ট হচ্ছে কিনা৷ অনেক সময় পর নিয়তি চোখ মেলে তাকায়। এক হাতে ক্যানোলা লাগানো৷ অন্য হাত ধরে রেখেছে নির্বণ। নিয়তি নির্বণের দিকে তাকিয়ে,
“আমার কি হয়েছে? আমি হসপিটালে কেন?”
.
নিয়তি কন্ঠ শুনে নির্বণ নিয়তির দিকে তাকায়৷ নিয়তির মুখে হাত রেখে,
“কোন কথা নয়৷ তুমি আগে সুস্থ হও৷ তারপর তোমাকে সবকিছু বলবো৷”
.
নিয়তি অসহায় দৃষ্টিতে নির্বণের দিকে তাকিয়ে,
“আপনাকে এমন উসকো খুসকো লাগছে কেন? আমার হাতে ক্যানোলা লাগানো কেন? আমার কি হয়েছে?”
.
নির্বণ মুচকি হেঁসে,
“তুমি মা হতে চলছো৷ তোমার গর্ভে বেড়ে উঠছে আমাদের ভালোবাসা।”
.
নিয়তি মুচকি হেঁসে লজ্জা পেয়ে যায়৷ তখনই ডক্টর এসে হাজির৷ নির্বণ ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“নিয়তিকে আজই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো৷”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে,
“আমাদের মিষ্টি খাওয়ান৷ আমাদের মিষ্টি খাওয়ালে আজই নিয়ে যেতে পারেন৷ আর আমাদের মিষ্টি না খাওয়ালে আমি বলতে পারবো না৷”
.
নির্বণ কোন কিছু না বলে দ্রুত গতিতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়৷ নির্বণের এমন কান্ড দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায়৷ কিছু বললো না কেন? নিয়তির হাত পা নিমিষেই ঠান্ডা হতে শুরু করলো৷ নিয়তি ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“প্লিজ ডক্টর কিছু মনে করবেন না৷ মেবি উনার জরুরি কোন কাজ পড়ে গেছে৷ নির্বণ এখনই ফিরে আসবে৷”
.
“ইট’স ওকে। নার্স ক্যানোলা খুলে দেন৷ উনার রিপোর্টগুলো কাল পেয়ে যাবেন৷ আজ কিছু বলতে পারবো না৷”
.
ডক্টর কেবিন থেকে বের হতে নিবে ঠিক তখনই নির্বণ দৌড়ে কেবিনে প্রবেশ করে৷ দৌড়ে আসাতে নির্বণ হাঁফাতে থাকে৷ হাতে মিষ্টির বক্স৷ দেখে বুঝা যাচ্ছে নির্বণ হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে কিনে এনেছে। ডক্টরের হাতে মিষ্টির বক্স ধরিয়ে দিয়ে,
” ইচ্ছামতো মিষ্টি খান৷ আমাদের ভালোবাসার জন্য আশীর্বাদ করবেন৷”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে মিষ্টির বক্স হাতে নিয়ে চলে যান৷ নির্বণ নিয়তিকে অতি সাবধানে বাড়িতে নিয়ে আসেন৷ বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে৷ সকলের মুখে হাসি৷ নির্বণ সার্ভেন্টদের বলে দেয় তাদের রুম নিজে গুছিয়ে দিতে৷ সিঁড়ি বাইতে যেন নিয়তির কোন কষ্ট না হয়৷
_________

নির্বণ নিয়তিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে৷ নিয়তির চোখে ঘুম নেই৷ অজানা আশঙ্কা কাজ করতেছে। কাল সব রিপোর্ট ঠিক ঠাক আসবে তো৷ নিয়তির কিছুই ভালো লাগছে না৷ নিয়তি নির্বণের হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে৷ সারা রুমে পায়েচারী করছে৷ ঘেঁমে একাকার হয়ে যাচ্ছে৷ ব্যালকনিতে এসে র‍্যাকিং চেয়ারে শুয়ে আছে৷ বাহিরের ঠান্ডা হাওয়া নিয়তির গায়ে লাগছে না৷ ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেও নিয়তির একঘেয়েমিতা লেগে আছে৷
.
নির্বণ হাত সারাতেই শূন্যতা অনুভব করে৷ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নিয়তি বিছানায় নেই৷ নির্বণ তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে উঠে পড়ে৷ ঘরের লাইট অন করে দেখে নিয়তি ঘরে নেই৷ ব্যালকনির দরজা খোলা দেখে নির্বণ ব্যালকনিতে আসে৷ নিয়তি র‍্যাকিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে৷ নিয়তির কাঁধে হাত রাখতেই নিয়তি চমকে উঠে।
.
“নির্বণ আভয় বানী দিয়ে,
“এভাবে চমকে উঠলে কেন? কি হয়েছে?”
.
নিয়তি চকিত হয়ে,
“আপনি কি করছেন এখানে!”
.
“আমারও একি প্রশ্ন! এতো রাতে তুমি ব্যালকনিতে কি করছো?”
.
“আমার ঘুম আসছিল না৷ তাই ব্যালকনিতে র‍্যাকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম৷”
.
“হুম সব বুঝলাম৷ কিন্তু এতো রাতে ঠান্ডার মাঝে শুয়ে থাকতে কে বলেছে?”
.
নিয়তি মনে মনে বলে উঠে,
“নির্বণকে কিছুই বুঝতে দেওয়া যাবে না৷ বেচারা এমনি আমার জন্য খুব চিন্তা করে৷”
.
নিয়তির সামনে চুটকি বাজিয়ে,
“কি হলো নিয়তি? কোথায় হারিয়ে গেলে?”
.
“আসলে আমি ভাবছিলাম একটা শাল গায়ে দিতে৷ কিন্তু যাওয়ার আলসেমির জন্য শাল গায়ে জড়াতে পারিনি৷”
.
নিয়তির পেটে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে,
“তোমার গর্ভে আমাদের ভালোবাসা বেড়ে উঠছে৷ এখন কোন অবহেলা করলে চলবে না৷ ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে বসে আছো, যদি তোমার ঠান্ডা লেগে যায়।”
.
নিয়তি মুচকি হেঁসে,
“আমি আমাদের ভালোবাসার চিহ্নের কিছু হতে দিব না৷ এসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না৷”
.
“আমি আর কোন চিন্তা করবো না৷ কাল তোমার রিপোর্ট আসবে৷ চল ঘুম আসবে৷ কাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে৷”
.
নিয়তি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি জানায়৷ নির্বণ নিয়তিকে পাজা কোলা করে রুমে নিয়ে আসে৷ নিয়তির কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।
________

টান টান উত্তেজনা নিয়ে ডক্টরের সামনে বসে আছে নির্বণ নিয়তি। ভয়ে দুই জনের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ নিয়তির মনে যত খারাপ চিন্তা আছে সব মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ডক্টর মুখ গম্ভীর করে বলে উঠেন,
“মিসেস নিয়তি আমি আপনাকে আবার পরীক্ষা করতে চাই৷”
.
নিয়তি চকিত হয়ে চোখ বড় করে,
“ডক্টর আমার কি হয়েছে? আপনি এভাবে ভয় পেয়ে আছেন কেন?”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে বলে উঠে,
“আসলে কাল অনেক জন একসাথে আসছিল৷ আমি সব রিপোর্ট গুলিয়ে ফেলেছি। তাই আবার আপনাকে চেক আপ করাতে চাই৷”
.
নির্বণ নিয়তির হাতে হাত রেখে,
“ভয়ের কিছু নেই৷ আমি তোমার সাথে আছি৷ আমি থাকতে তোমাদের কোন ক্ষতি হতে দিব না৷”
.
নিয়তি চোখ ভয়ে ছলছল করছে৷ না চাইতেও চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিয়তি নিজেকে শক্ত করে,
“ওকে ডক্টর। আমি প্রস্তুত৷ আমি কোন কিছুতেই পিছপা হবো না৷”
.
নির্বণকে কেবিনে বসিয়ে রেখে ডক্টর নিজেই নিয়তিকে চেক আপ করতে নিয়ে যান৷ নির্বণ এতোক্ষণ শক্ত থাকলেও এখন ভেঙে পড়ছে৷ প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেল কেউ আসছে না৷ নির্বণ অনেক বার ডক্টরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু নার্স যেতে মানা করেছে৷
.
সারা রুমে পায়েচারী করে যাচ্ছে নির্বণ। কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে? নিয়তির সাথে কিছু খারাপ হবে না তো! মনে মনে সৃষ্টি কর্তাকে ডেকে যাচ্ছে৷ তিন ঘন্টা পর নিয়তি আর ডক্টর কেবিনে আসে৷ নিয়তি চোখ মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে৷ দেখে একদম পাগল লাগছে৷ ডক্টরের হাতে রিপোর্ট।
.
নির্বণ মিয়তিকে জড়িয়ে ধরে,
“আমি তোমার কিছু হতে দিব না৷ তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে৷”
.
নিয়তি ভয়ে ভয়ে বলে উঠে,
“পাগল হলেন নাকি৷ আমার কিছু হয়নি৷ আমি একদম ঠিক আছি৷”
.
গম্ভীর কণ্ঠে ডক্টর বলে উঠে,
“প্লিজ আপনারা বসেন৷ আপনাদের রিপোর্ট আমার হাতে৷”
.
নির্বণ নিয়তিকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়৷ নির্বণ ভয়ে ভয়ে বলে উঠে,
“ডক্টর রিপোর্ট সব নরমাল তো।”
.
ডক্টর নির্বণ নিয়তির দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলেন৷ ডক্টর কিভাবে কথাটা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না?
.
নির্বণ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“কি হলো ডক্টর? আপনি কিছু বলছেন না কেন?”
.
ডক্টর বারং বার রিপোর্টে চোখ বুলাচ্ছেন৷ আর নিয়তির দিকে তাকাচ্ছেন৷ ডক্টরের চাহনি দেখে নিয়তির যায় যায় অবস্থা। নিয়তি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেছে।
.
নির্বণের চোখ লাল হয়ে গেছে রাগে৷ ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠে,
“আপনি ডক্টর হয়ে তামাশা শুরু করছেন কেন? কি হয়েছে নিয়তির? কিছু বলছেন না কেন?”
.
ডক্টর নির্বণের দিকে রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে,
“নিয়তি দেহে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের পরিমাণ খুব কম৷ নিজ থেকে খুব পরিমাণ হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয়৷”
.
নির্বণ চকিত হয়ে ভয়ে ভয়ে বলে,
“এখন কি করতে হবে? নিয়তিকে হসপিটালের এডমিট করতে হলে আমি নিয়তিকে হসপিটালে এডমিট করবো৷”
.
ডক্টর গম্ভীর কণ্ঠে,
“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি৷ আমার কথা শেষ না হলে কথা বলবেন না৷”
.
নির্বণ মাথা নিচু করে,
“ওকে আর কোন কথা বলবো না৷ আপনি আপনার কথাগুলো শেষ করেন৷”
.
ডক্টরের মুখ থেকে যা শুনতে পাই, তার জন্যে তারা দুই জনের মাঝে একজনও মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷ নিয়তি কান্না করতে করতে কেবিন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here