এক জীবনের অনেক জীবন পর্ব ১৯

#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(১৯)
**********************************

নাফিজের কাছ থেকে নাম্বারটা পেয়ে সাদাতে’র শরীরটা উত্তেজনায় কাঁপছিল । এতক্ষণের ব্যর্থ চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত রফিকের কাছে পৌঁছানোর একটা কিছু তো অন্তত পাওয়া গেল । সাদাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় একটা বাজে । এতো রাতে ফোন করা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না সে । দ্বিধা ঝেড়ে সে নাম্বাটায় ডায়াল করলো । বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে । রিং হচ্ছে, পুরো রিং হয়ে থেমে গেলো । কেউ ফোন ধরলো না । আবারো ফোন করলো সাদাত । আবারো একই অবস্থা । সাদাত একটু হতাশ হলো । জারা যদি সত্যি সত্যিই রফিকের সাথে থেকে থাকে তাহলে এই মুহূর্তে ওরা কোথায় আছে , কী করছে ? রফিক কী করছে জারা’র সাথে ? একটা বিষয়ে সাদাত নিশ্চিত, রফিকের যা স্বভাব-চরিত্র ছিল তাতে সে জারা’র সাথে ভালো কিছু তো করবে না । কোন অভিসন্ধিতে সে জারাকে নিজের জালে ফাঁসিয়েছে কে জানে । জারা যে রকম মেয়ে, তার যে রকম চলাফেরা, সামাজিক অবস্থান তাতে খুব সহজে রফিকের মতো ছেলের জারা’র নাগাল পাওয়ার তো কথা না । সে যখন তার নাম পাল্টেছে তখন নিশ্চয়ই আরো অনেক কিছু গোপন করেছে জারা’র কাছ থেকে ।

সাদাত ওপর তলার ফ্যামিলি লিভিং এ বসে ছিল এতক্ষণ । কারো কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না । শুধু নিচ তলা থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে । শিল্পী হয়তো এখনো কোনো কাজ করছে । সাদাত গিয়ে ছোটো খালার রুমের সামনে দাঁড়ালো । রুমের দরজা বন্ধ কিন্তু ভেতর থেকে নিচু লয়ে কথা বলার আওয়াজ আসছে । নক করবে না চিন্তা করেও দরজায় নক করলো সে । রোজা এসে দরজা খুলে তাকে ইশারায় দাঁড়াতে বলে ফোনে কথা শেষ করলো । তারপর বললো –

তুমি ঘুমাওনি এখনো ?

না ।

আমি সিয়ামের সাথে কথা বলছিলাম ।

আচ্ছা । খালা ঘুমিয়েছে ?

হুম ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগে । টেনশনে মা’র প্রেসারটা বেড়ে গিয়েছিল । ডাক্তারের সাথে কথা বলে ঘুমের ওষুধ দিলাম । আচ্ছা বলো তো সাদাত কী হলো এটা ? আমি কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছি না । আমি চিন্তাই করতে পারছি না জারা এমন কিছু করতে পারে ।

তুমি কী জানতে না কিছু ?

আমরা যখন প্রথমে জানলাম বিষয়টা তারপর জারা বললো যে সে রিলেশনটা শেষ করে দিয়েছে । ও প্রমিস করেছিল মা’র কাছে । ও যে এটা কন্টিনিউ করছে সেটা আমরা কেউই ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি । আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করতো অথচ দেখো…. সাদাত বলো তো জারা’র কোনো ক্ষতি হবে না তো ? ভয়ে আমরা হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে আসছে । কথাগুলো বলতে বলতে রোজা’র দু’চোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে পানি ঝরলো ।

কেঁদো না রোজা । আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো , সব ঠিক হয়ে যাবে । তুমি এমন করলে ছোটো খালা তো আরো ভেঙে পড়বে । আর রফিককে আমি যতদূর চিনি , ও হয়তো জারা’র বড় কোনো ক্ষতি করার সাহস পাবে না । ও শুধু মুখে মুখে হম্বিতম্বি করে , নিজের অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি শো অফ করার চেষ্টা করে । ওর ফোন নাম্বার পেয়েছি । এবার একটা ব্যবস্থা হবেই ।

নাম্বার পেয়েছো ? কই দেখি নাম্বারটা ।

আমি ফোন করেছি কিন্তু কেউ ধরছে না । অনেক রাত হয়েছে তো । দেখি খালুর বন্ধু যদি কিছু করতে পারেন । তুমি যাও একটু ঘুমিয়ে নাও । তোমার কাল অফিস আছে ?

অফিসে যাবো না । মা’র কাছে থাকবো কালকে ।

বড় খালা আর জাফরিন কোথায় ?

ওরা আমার রুমে শুয়েছে ।

শাফিন জানে কিছু?

ও ফোন করেছিল একটু আগে । মা’র সাথে কথা বলতে চেয়েছিল । ওকে কোনো কিছু জানাইনি । খামোখা টেনশন করবে বেচারা ।

হুম , ঠিক আছে দরজা বন্ধ করে দাও ।

রোজা দরজা বন্ধ করে দিলে সাদাত জারা’র রুমের সামনে এসে দেখলো দরজা খোলা, আলো জ্বলছে কিন্তু রুমের ভেতর কেউ নেই । সাদাত রুমে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো । পুরো রুম জুড়ে জারা’র প্রবল উপস্থিতি । দেয়ালে টাঙানো ছবিটায় কী সুন্দর করে হাসছে জারা । এই রুমটায় সাদাত এসেছে অথচ জারা নেই, এমন কোনোদিনও হয়নি । মনটা কেমন বিষাদে ভরে উঠলো তার । সে শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছে, জারা যেখানেই থাকুক না কেন ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয় ।

জারা’র বারান্দায় এসে থমকে গেল সাদাত । কায়সার মোড়ায় বসে রেলিঙে হেলান দিয়ে আছেন । এভাবে চোখ বোঁজা অবস্থায় বসে থাকতে দেখে সাদাত বুঝতে পারছে না খালু জেগে আছেন না-কি ঘুমিয়ে । খালুকে ফোন নাম্বারটা দেয়া খুব দরকার অথচ তাঁকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না । কী ঝড়টা ই না বয়ে যাচ্ছে খালা, খালু দু’জনের মনের ভেতর ! একটু বিশ্রাম তো তাঁদের দরকার । সাদাত খালুকে না ডেকে জারা’র রুমে এসে গা এলিয়ে সোফায় বসলো । তারও ভীষণ ক্লান্তি লাগছে । দু’দিন ধরে হালকা জ্বর আছে শরীরে সাথে মাথা ব্যাথা । সেই সকাল আটটা থেকে এই পর্যন্ত এতটুকু রেস্ট পায়নি শরীরটা । একবার ভেবেছিল রোজা’র কাছ থেকে ওষুধ চেয়ে খাবে কিন্তু এতো টেনশনের মধ্যে পরে আর মনে ছিল না ওষুধের কথা ।

সাদাতে’র ঘুম ভাঙলো কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে । সে চোখ মেলে দেখলো খালু দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে । তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সাদাত ।

কায়সার বললেন –

আমাদের জন্য তোমাদেরও কষ্ট হয়ে গেল ।
এভাবে শুয়ে থাকলে ঘাড়ে ব্যাথা হবে , বিছানায় যেয়ে শোও ।

“বিছানায় যেয়ে শোও” কথাটা বলার সময় খালুর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো । সাদাত অনুভবে বুঝতে পারলো বিষয়টা । খালুর মলিন আর টেনশন ভরা চেহারাটা দেখে সাদাতের মনে হলো, সে যদি কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় জারাকে এঁদের কাছে এনে দিতে পারতো, কী ভীষণ ভালোই না হতো । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত আড়াইটা বাজে । সে কায়সারকে বললো –

খালু রফিকের নাম্বারটা পেয়েছি ।

পেয়েছো ! হঠাৎ খুশিতে কায়সারের মুখটা ঝলমল করে উঠলো ।

জ্বি আমার এক বন্ধু দিলো ।

কখন পেয়েছো ?

এই তো বেশ কিছুক্ষণ আগে ।

আহা এতক্ষণ বলোনি কেন আমাকে ? জহির কখন থেকে অপেক্ষা করে আছে ।

আপনি বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন । এতো টায়ার্ড হয়ে ছিলেন যে ডাকতে ইচ্ছে করলো না ।

কায়সার একটু বিরক্ত হয়ে বললেন –

আমার ঘুমটা তো এখন ইম্পরট্যান্ট না । কেন যে তোমরা কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারো না আমি বুঝি না । কেথায় নাম্বারটা? তাড়াতাড়ি দাও । ইশ কতো দেরি হয়ে গেল ।

খালু রাগ করলেও সাদাত মন খারাপ করলো না । সে তাঁদের সবার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছে । তারই আসলে ভুল হয়েছে । খালুকে ডেকে নাম্বারটা তখনই দেয়া উচিত ছিল । সাদাত নাম্বারটা বের করতে করতে বললো –

আমি দু’বার ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু কেউ ধরেনি ।

কোথায় নাম্বারটা দেখি । সাদাতের মোবাইলটা হাতে নিয়ে কায়সার বন্ধু জহিরকে ফোন করলেন । বন্ধুকে নাম্বারটা দিয়ে মোবাইলটা সাদাতকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন –

এখন ফোন করে দেখো তো ধরে কি-না ।

সাদাত আবারও ফোন করলো । রিং হয়ে থেমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে কেউ একজন ঘুম জড়ানো কন্ঠে কথা বললেন –

হ্যালো……

হ্যালো রফিক আছে ?

আপনি কে?

আমি ওর বন্ধু সাদাত ।

ঘড়িতে সময় দেখে ফোন করেছেন ? নূনতম কাণ্ডজ্ঞান বলে কী কিছু আছে আপনার ?

জ্বি আমি খুবই সরি এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য কিন্তু রফিকের সাথে আমার ভীষণ দরকার । ওকে ফোনটা দেয়া যাবে প্লিজ ।

যা দরকার সেটা সকালে ফোন করে কথা বলবেন ।

সাদাতকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইনটা কেটে গেল ।

কায়সার ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে ছিলেন সাদাতের দিকে । কথা শেষ হতেই বললেন –

কী হলো কে ফোন ধরলো ?

একজন মহিলা ফোন ধরেছেন ।

আদিত্য নেই ?

সে-সব কিছুই বললেন না শুধু বললেন, সকালে যেন ফোন দেই ।

তুমি আবার ফোন করো । দাও মোবাইলটা আমার কাছে দাও, আমি কথা বলবো ।

সাদাত এবার ফোন দিতেই নাম্বারটা বন্ধ পাওয়া গেল । সে বললো –

খালু নাম্বারটা বন্ধ বলছে ।

আচ্ছা ঠিক আছে । জহিরকে পাঠিয়ে দিয়েছি , ও ব্যবস্থা করে ফেলবে । তুমি যেয়ে একটু ঘুমাও । তেমাকে দেখতে খুব টায়ার্ড লাগছে ।

খালু আপনিও একটু ঘুমিয়ে নেন । সারাদিনে কোনো রেস্ট হয়নি আপনার ।

আমি ঠিক আছি সাদাত । জারা’র খোঁজটা পাওয়া যাক, জারা ফিরলে আমি ঘুমাবো ।

খালুর কন্ঠে এমন দরদ ছিল , সাদাতে’র বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো একদম । সে আর কোনো কথা বললো না । এমন মুহূর্তে কী বলতে হয় তার জানা নেই । নিখোঁজ সন্তানের জন্য টেনশন করতে থাকা বাবা-মা’র কষ্ট বুঝতে পারার ক্ষমতা আল্লাহ অন্যদের দেননি । সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো । কায়সার ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন ।

.
.

জারা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে । রফিক কয়েকবার এসে চেক করে গেছে । শরীরের তাপমাত্রা কম মনে হওয়ায় সে আর জারাকে ডাকেনি । ঘুমাক, ঘুমিয়ে থাকলে খারাপ লাগাটা কমবে আর সে-ও চিন্তা ভাবনা করার একটু সময় পাবে । তানভীরের সাথে নিজের কথাগুলো শেয়ার করে মেজাজটা একদম খিঁচড়ে আছে তার । বন্ধু ভেবে সে কথাগুলো বললো তানভীরকে । কোথায় তাকে সাহায্য করবে , বুদ্ধি দেবে তা না করে বড় বড় লেকচার দিলো । এখন যতো দ্রুত জারাকে বুঝিয়ে ব্যাপারটা সহজ, স্বাভাবিক করে নেয়া যায়, তার জন্য ততই মঙ্গল কিন্তু কীভাবে কথা শুরু করবে সেটাই সে বুঝতে পারছে না । জারা’র সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে আজ প্রথম একটু নার্ভাস লাগছে তার । সব ঐ তানভীরের দোষ । তানভীর ই যখন এমন আচরণ করলো তার সাথে তখন রুদ্র আর কাফিকে আপাতত বিষয়টা জানাবে না সে । দেখা যাক একটা না একটা ব্যবস্থা তো হবেই ।

সকাল থেকে মোবাইলটা সুইচড অফ করে রেখেছিল রফিক । এই তিনদিনে মা কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু আব্বা তাকে একবারও ফোন করেনি । আজ তিন দিন হলো সে বাড়িতে যায় না । আব্বার কথাগুলো খুব বেশি গায়ে লেগেছে তার । আব্বা নিজে তো কিছুই করতে পারেনি তার জন্য অথচ কথা শোনানোর বেলায় এক্কেবারে ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা । সে তো দেখছে তার সব বন্ধুরা তাদের ফ্যামিলি থেকে অনেক সাপোর্ট পাচ্ছে সবসময় । শুধুমাত্র তার আব্বা ই আছেন এমন একজন যিনি কি-না নিজের ছেলের ভালো চান না । থাকগে আব্বার কাছে হাত পেতে সে নিজেকে আর ছোট করবে না । আলাদীনের চেরাগ তো সে হাতে পেয়েই গেছে । এখন শুধু কায়দা মতো ঘষা দিতে পারলেই আর কোনো ভাবনা নেই জীবনে । বাপের নেই তো কী হয়েছে, শ্বশুরের তো আছে । জারা’র কাছে ওর ফ্যামিলির গল্প যা শুনেছে সে তাতে মনে হয়েছে জারা’র বাবা খুবই নিরিহ মানুষ । ওনাকে হাত করা খুব একটা কঠিন হবে না তবে জারা’র মা’কে তার মোটেও সুবিধার মনে হয়নি । যমুনায় যেদিন দেখা হয়েছিল , মহিলা কেমন সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল । রফিকের শুধু ভয় হচ্ছিল যে আর কিছুক্ষণ ওনার সামনে থাকলেই মহিলা তার ভেতরের সবকিছু পড়ে ফেলবেন । এ কারণে সে আগে থেকে প্ল্যান করেই ওখানে গিয়েছিল । যাক সমস্যা নেই , এখন বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন কেউ কোনো কিছু করে সুবিধা করতে পারবে না । আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু ঘুমানো দরকার । সারাদিনে যা ধকল গেছে তাতে এখন না ঘুমালে শরীরে এনার্জি পাওয়া যাবে না । যা ভাবনা চিন্তা করার কাল সকালে করা যাবে । জারা’র পাশে না শুয়ে বালিশটা তুলে নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো সে । শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল রফিক ।

.
.

ভোরের দিকে ঘুম ভাঙার পর মিনা মোবাইলটা অন করলো । রাতের বেলায় কোন বদমাশ যে এতো বিরক্ত করছিল ফোন করে কে জানে । বাধ্য হয়ে ফোনটা অফ করে ঘুমিয়েছে সে । এই নাম্বারটা রফিকের । বেশ কিছুদিন আগে তার মোবাইলের সিমটা হঠাৎ করেই লক হয়ে গিয়েছিল । কোনোভাবেই আর কাজ করছিল না ওটা । নানা ঝামেলার কারণে নতুন সিম তুলতে যেতে পারছিল না মিনা তখন রফিকই ওর একটা সিম ইউজ করতে দিয়েছিল তাকে । তখন থেকেই তার মোবাইলে এই নাম্বারটা রয়ে গেছে ।

মোবাইল অন করার সাথে সাথে আবারো ফোন আসলো অচেনা নাম্বার থেকে । এটা অন্য আরেকটা নাম্বার , কাল রাতেরটা না । পরপর তিনবার কল কেটে দেয়ার পরও যখন আবার ফোন এলো নাম্বারটা থেকে মিনার মেজাজটা এই ভোরবেলাতেও বিগড়ে গেল । সে কলটা রিসিভ করলো আচ্ছা মতো কথা শোনানোর জন্য । কল রিসিভ করতেই উল্টো তাকেই ধমক খেতে হলো । অপর প্রান্তের মানুষটি যখন নিজেকে পুলিশ বলে পরিচয় দিলেন আর রফিকের খোঁজ চাইলেন তখন ভয়ে মিনার দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় । তিনদিন ধরে বাড়ি ফেরেনি রফিক । আব্বার ওপর অভিমান করে ও নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেললো না তো আবার ? পুলিশের কাছে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সে রফিককে ফোন করলো কয়েকবার । ফোনটা বন্ধ দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে আব্বা মা’র দরজায় নক করলো ।

সুফিয়া জেগেই ছিলেন । নামাজ পড়া শেষে কোরআন পড়ছিলেন তিনি । এতো ভোরে মিনাকে দেখে সুফিয়ার মনে দুশ্চিন্তা হলো , লীনার কিছু হলো না তো আবার ?

মিনা ভয় জড়ানো গলায় বললো –

মা থানা থেকে ফোন এসেছিল ।

কোন থানা থেকে আর থানা থেকে আমাদের কাছে ফোন আসব কেন !

আমি জানি না মা । রফিকের খোঁজ করছিল । মা রফিকের কোনো বিপদ হলো না তো আবার ?

সুফিয়া আঁতকে উঠলেন । তাঁর এমনিতেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে আছে ক’দিন ধরে । স্বামী আর ছেলের ঝগড়া তিনি নিরব দর্শকের মতো শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন, কিছুই করতে পারেননি । তিনদিন হলো ছেলেটা বাসায় আসে না, তার ওপর এখন আবার পুলিশের ফোন ! ভয়ে তার নিশ্বাস আটকে আসছে একদম ।

সুফিয়া আওলাদ হোসেনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে কথাটা বলতেই আওলাদ হোসেন বললেন –

দেখো গিয়ে কোথায় কোন খুনখারাপি করে বসে আছে তোমার ছেলে ।

কী বলো তুমি এইসব ? নিজের ছেলের সম্বন্ধে এমন কথা বলতে তোমার এতটুকু খারাপ লাগছে না ?

তোমার ছেলে করতে পারবে আর আমি বলতে গেলেই যতো দোষ । ফোন করো তোমার ছেলেকে, তাকে জিজ্ঞেস করো কোন রাজকর্ম সে উদ্ধার করে বসে আছে ।

মিনা বললো –

রফিকের ফোন বন্ধ আব্বা ।

আওলাদ হোসেন বললেন –

মানুষের জীবনে অশান্তির জন্য এমন একটা সন্তানই যথেষ্ট । আর কিছু লাগে না ।

সুফিয়া বললেন –

তুমি এভাবে কথা বলছো কেন ? ছেলেটাকে তুমি একেবারে সহ্যই করতে পারো না ।

তোমার ছেলের যা খুশি হোক, আমার তাতে কিচ্ছু আসে যায় না । তার একবারে বড়লোক হওয়ার শখ হয়েছে না , দেখো গিয়ে নির্ঘাত ছিনতাই করে বসে আছে ।

তোমার মুখে কী কিছু আটকায় না মিনার আব্বা ? নিজের ছেলেকে এতো খারাপভাবে কেউ বলে ?

কথা কাটাকাটির মাঝখানে কলিংবেলের শব্দে মিনা তাড়াতাড়ি বারান্দায় দেখতে গেল এতো ভোরে কে এসেছে । সাথেসাথেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো –

আব্বা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে । আমি নিচে যাবো ?

না তুই থাক, আমি দেখছি । কথাগুলো বলে আওলাদ হোসেন ফতুয়াটা গায়ে চাপিয়ে নিচে নেমে গেলেন । সুফিয়া মিনা’র হাতটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন দরজার সামনে ।

কিছুক্ষণ পর দু’জন পুলিশ অফিসারসহ আওলাদ হোসেন ওপরে উঠে এলেন । ড্রইংরুমে তাদের বসিয়ে সুফিয়া আর মিনাকে ডাকলেন তিনি ।

সবাই এসে বসলে অফিসারদের মধ্যে থেকে একজন জেরা শুরু করলেন –

আদিত্য আপনাদের কে হয় ?

সবাই সবার দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে অফিসার বললেন –

ঠিক আছে এবার বলুন রফিক কে?

আমার ছেলে, আওলাদ হোসেন বললেন ।

সে কোথায় ?

কয়দিন হলো বাসায় আসে না ।

কেন, বাসায় কেন আসে না ?

সুফিয়া বললেন –

বাপ-বেটার ঝগড়া হয়েছিল তাই ছেলে রাগ করে ঘরে আসেনি কয়দিন ।

সে এখন কোথায় আছে ?

আমরা জানি না । কেন স্যার, কিছু হয়েছে ? আমার ছেলের কোনো বিপদ হয়েছে না-কি ?

আগে বলেন তার বন্ধুর কাছ থেকে যে মোবাইল নাম্বারটা নিয়েছি সেটা তো রফিকের তাহলে ফোন রিসিভ করলো কে ?

ফোন আমি ধরেছিলাম স্যার । ঐ নাম্বারটা কিছুদিন ধরে আমি ইউজ করছি ।

কেন ?

আমার সিমটা লক হয়ে গিয়েছিল তাই রফিক আমাকে ওর সিমটা দিয়েছে ইউজ করতে । স্যার রফিক কী কিছু করেছে ?

সে তাহলে কোন নাম্বার ইউজ করছে ? সেই নাম্বারটা দেন আর রফিকের একটা ছবি দেন। ইট’স আর্জেন্ট ।

মিনা রফিকের ছবি আর মোবাইল নাম্বারটা দেয়ার পর অফিসার ফোন দিয়ে দেখলেন নাম্বারটা বন্ধ । মিনার দিকে তাকিয়ে বললেন –

সে এখন কোথায় আছে বলেন তো দেখি । একটু দ্রুত বলবেন । এমনিতেই আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে ।

আমরা সত্যি জানি না রফিক কোথায় ? একবার ফোন করে কথা বলেছিল কিন্তু কোথায় আছে আমরা বলতে পারবো না ।

সে বাসায় লুকিয়ে নেই তো ?

না স্যার বাসায় নেই ।

আপনারা যতো বেশি সত্য কথা বলবেন, তত কম বিপদে পড়বেন । এখন আমার লোক যদি সার্চ করে এই বাসা থেকে তাকে খুঁজে পায় তাহলে কিন্তু আপনারা সবাই বিপদে পড়বেন । আমি শুরুতেই আপনাদের সাবধান করে দিলাম ।

সত্যি বলছি স্যার, ও তিনদিন ধরে বাসায় আসে না ।

আওলাদ হোসেন বললেন –

স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ?

বলুন ।

স্যার আমার ছেলে কী কোনো বিপদে পড়েছে না-কি নিজেই কোনো ক্রাইম করেছে ?

আপনার ছেলে বেশ বড় ধরনের ক্রাইম করে বিপদে পড়েছে । তাকে আমরা ধরতে পারলে সে বাঁচতে পারবে না ।

কী করেছে স্যার ?

সে অনেক উঁচু জায়গায় হাত দিয়েছে । তার নাগালের বাইরে এমন কিছুকে টার্গেট করেছে সে । আপাতত কিছু বলছি না । শুধু এটুকু বলে যাচ্ছি, যদি সে এর মধ্যে ফোন করে অবশ্যই আমাদের ইনফর্ম করবেন । কোনো চালাকি করলে কিন্তু.…….

সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন –

স্যার আমার ছেলে কিছু করেনি ।

কিছু না করলে আপনাদের টেনশন করারও কিছু নেই ।

পুলিশ চলে গেলে বাসায় কান্নার রোল পড়লো । সুফিয়া নিজে তো কেঁদে কেটে অস্থির হচ্ছেন ই সাথে স্বামীকেও দোষারোপ করতে ছাড়ছেন না । আজ তাঁর কারণেই রফিক ঘর ছেড়েছে, বিপদে পড়েছে, স্বামীকে এমন কথা বলতেও ছাড়লেন না সুফিয়া ।

.
.

তানভীর বেশ কিছুক্ষণ ধরে নক করে যাচ্ছে দরজায় । রফিকের কোনো খবরই নেই । ব্যাটা ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে । সে বেশি জোরে নক করতেও পারছে না জারা’র অসুস্থতার কারণে । তানভীরের এতো বেশি রাগ হচ্ছে রফিকের ওপরে, মনে হচ্ছে কলার ধরে এনে দু’টো ঘুষি বসিয়ে দেয় নাক বরাবর । তানভীর আবারও নক করলো দরজায়, এবার একটু জোরে ।

সে কী এই বাসা থেকে চলে যাবে না-কি রুদ্র আর কাফিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।

পাঁচ মিনিট পর তানভীর আবারো নক করলো । দরজার খোলার আওয়াজে সে বললো –

ব্যটা তাড়াতাড়ি বাইরে আয়, ঝামেলা হয়ে গেছে ।

বাইরে এসে জারা বললো –

ভাইয়া কী ঝামেলা ?

তানভীর থতমত খেয়ে বললো –

কিছু না, কিছু না । তোমার জ্বর কমেছে ?

বোধহয় একটু কমেছে ।

আচ্ছা ওকে একটু ডেকে দেয়া যাবে ?

কাকে, আদিকে ?

হুম ।

দিচ্ছি । জারা ভেতরে গিয়ে আদিত্যর কাঁধে নাড়া দিয়ে ওকে জাগিয়ে তুললো । আদিত্য জারাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো –

তোমার জ্বর কমেছে ?

মনে হয় । এখন একটু ভালো লাগছে । তানভীর ভাইয়া তোমাকে ডাকছে ।

আদি চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে এসে বললো –

কী রে তুই ঘুমাসনি ? এতো সকালে উঠে গেছিস কেন ?

তানভীর দেখলো রফিকের পেছনে দাঁড়িয়ে জারা তার দিকে তাকিয়ে আছে । সে রফিককে বললো –

একটু এদিকে আয়, শুনে যা ।

তানভীরের পিছন পিছন বারান্দায় এসে রফিক বললো –

কী বলবি বল ।

মিনা আপা ফোন করেছিল ।

আপা, তোকে ! কেন ?

কারণ তোর মোবাইলটা বন্ধ তাই ।

আচ্ছা আমি ফোন করবো আপাকে ।

রফিক তোদের বাসায় পুলিশ এসেছিল ।

রফিকের ঘুম ঘোর চেহারার মধ্যে কেউ যেন কারেন্ট শক দিয়ে দিল ।……………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here